দুপুর দেড়টা নাগাদ শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়ি হাটের দিকে যাত্রা। ক্যানেল পাড় সংলগ্ন রাস্তা ধরে এগোনোর সময় নজরে এলো, মেয়েরা বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে পণ্যসামগ্রী নিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছে।
আক্ষরিক অর্থেই এটি হাট। কোথাও কোনো স্থায়ী ঘর নেই। নেই অস্থায়ী ঘর কিংবা সামিয়ানাও। কেউ ত্রিপল, কেউ চট, কেউবা মাটিতে কাপড় বিছিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। গ্রাম-গঞ্জের বাজারের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সওদার মধ্যে কাপড় ও সাজগোজের জিনিসের আধিক্য বেশি। তবে নান্দনিক শো-পিস, খেলনা, মনোহরি সামগ্রী ও তৈজসপত্রও রয়েছে। তবে প্রচলিত বাজারের চেয়ে ভিন্ন ঢংয়ের। এখানে অনেক কিছুই পাওয়া যায় যা আর কোথায় চোখে পড়বে না। যেহেতু আমরা সোমবার এই হাটে এসেছি তাই হাটে ক্রেতা রয়েছে তবে গিজগিজ নেই। অধিকাংশই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। আসল হাট শনিবার জমে ওঠে। সূর্য যতো পশ্চিমে ঢলে পড়ে ততোই জমে ওঠে হাট। ঢোকার সময়ই কানে ভেসে আসছিল ঢোল আর মাদলের শব্দ। হাটের একপাশে সাঁওতাল দল মাদলের তালে তালে নাচে মগ্ন। গোল হয়ে নাচ চলছে। মাঝখানে গামছা পাতা, নাচ দেখে যার ভালো লাগছে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন।
0 Comments
“মায়াবী মানালি”
জঙ্গলে গিয়ে বাঘ পেলাম কিনা আর পাহাড়ে গিয়ে বরফ পেয়েছি কিনা, বেড়িয়ে এসে এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন দুটোর সম্মুখীন হতে খুব খারাপ লাগে। বাঘ ছাড়াও শুধু জঙ্গল টাও যে উপভোগ করা যায় তা এবার ফেব্রুয়ারী মাসে নর্থ বেঙ্গল ঘুরে এসে বেশ বুঝেছি। বাঘ দেখতে পাওয়া অবশ্যই উপরি পাওনা। যাই হোক , এবারে আমাদের গন্তব্য শুধুই ‘মানালি’ আর তাকে ঘিরে কাছাকাছি দু একটা জায়গা।হ্যাঁ, বরফের লোভে মার্চ মাসটাকে ই বেছে নিয়ে ছিলাম। কোলকাতা থেকে অমৃতসর এয়ার পোর্টে পৌঁছলাম প্রায় দেড় টা নাগাদ। ওখান থেকে গাড়ী তে মানালি প্রায় বারো ঘন্টা। অহেতুক strain এড়াতে আমরা ‘মান্ডি’ তে night stay রেখেছিলাম।২৯০ কিমি পৌঁছতে প্রায় সন্ধে পেরিয়েই গেল।এই মান্ডি জায়গাটা নিয়ে দু এক কথা বলতেই হয়। পরদিন সকালে সত্যিই অবাকই হলাম। খুব ছোট্ট শহর এই ‘মান্ডি’ কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।দূরের পাহাড় গুলো সব বরফ দিয়ে ঢাকা। শান্ত, স্নিগ্ধ ছোট্ট একটা হিল স্টেশন।শুধু মান্ডি তে এসে অনায়াসে দু একদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।পরদিন খুব বেশীক্ষণ আর ‘মান্ডি’র সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল না। নটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হল মানালির উদ্দেশ্যে।জায়গাটা ছেডে আসার সময় একটু হলেও মন কেমন করছিল বৈকি। রাস্তা সব জায়গায় খুব ভাল না থাকায় ১১০ কিমি দূরে মানালি পৌঁছতে প্রায় ছ ঘন্টা লেগেই গেল। তবু দিনের বেলায় পাহাড়ী রাস্তায় চলতে বেশ ভালই লাগে।প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যেন নতুন নতুন সৌন্দর্য , নতুন কিছুর আবিষ্কার। নতুন কোন অজানা অচেনা ফুল দেখতে পেয়ে তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে হঠাৎ নেমে গিয়ে তার বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলা, দল বেঁধে যাওয়া কিছু স্কুল student দের সরল হাসির সাথে হাত নাড়া, এ সব কিছুর মধ্যেই এক অদ্ভুত ভাললাগা যাত্রার একঘেয়েমি কাটিয়ে দেয়।আর আছে পাশ দিয়ে সাথে সাথে চলতে থাকা ‘বিয়াস’ নদী। এক এক কোণ থেকে এক এক রকম রূপ তার।সে রূপ ক্যামেরা বন্দী করতে কার না মন চায়! কার ছবি টা বেশী ভাল সে নিয়ে তর্ক চলতেই থাকে।যত মানালির দিকে এগোচ্ছি , বরফে ঢাকা পাহাড় গুলো তত যেন হাতের কাছে চলে আসছে । অবশেষে প্রায় তিনটে নাগাদ মানালি পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে ব্যালকনির দরজা টা খুলতেই যে অপরূপ দৃশ্য সামনে এল তাতে যাত্রার সব ক্লান্তি এক নিমেষে কেটে গেল।দুধ সাদা বরফে ঢাকা বিশালকায় পর্বত শৃঙ্গ গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। পাঁচজনের মনের কথা তখন একই। লান্চ তো রোজই সময় মত করি, আজ না হয় এই দৃশ্যটাই আরেকটু ক্ষণ চেটেপুটে খাই। সেদিন সন্ধে টা ম্যালের মার্কেট টাই ঘুরে কাটালাম।
পরদিনের গন্তব্য ‘সোলাং ভ্যালি’।রোটাং পাসের রাস্তা বন্ধ থাকায় এখন এটাই আকর্ষণ।সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম । যত এগোচ্ছি তত বিস্মিত আর মুগ্ধ হচ্ছি । দুপাশে বরফ ঢাকা পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মাঝে এক জায়গায় নেমে একটা দোকানে waterproof dress আর গামবুট পরে নিতে হল।নিজেকে কেমন যেন তুষার মানবের মত লাগছিল।কিছুদূর পরেই গাড়ী ছেড়ে নেমে পড়তে হল আমাদের।আমরা পাঁচজন বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি খুবই সতর্ক হয়ে। একটু দাঁডিয়ে চারপাশ টা একবার চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি, আবার হাঁটছি। কারো মুখে কথা নেই। প্রতিটি মুহুর্ত প্রাণ ভরে উপভোগ করতে করতে চলেছি। আমার ছোট্ট বন্ধুর সরল প্রশ্ন, “আচ্ছা , সুইজারল্যান্ড কি এর থেকেও সুন্দর ?” উত্তর দিতে পারিনি।অবশেষে চারিদিক বরফে ঢাকা একটা সমতল ভূমি তে এসে পড়লাম। বিভিন্ন ধরনের sports event চলছে সেখানে। paragliding এ সাহস পেলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ observe করার পর মনে হল ski টা চেষ্টা করাই যেতে পারে।প্রথমে adjust করতে একটু সময় লাগলো বটে, তারপর কিন্তু ব্যাপার টা বেশ মজার।তবে সমতল ভূমি বলেই এটা সম্ভব হোলো, ঢালু থাকলে risk নিতাম না। আমার ছোট্ট বন্ধু ও অনায়াসে এটা করে ফেলল।এরপর ropeway করে সবাই আরো এক ধাপ ওপরে চলে এলাম।এখানে এসে তো রীতিমতো চমৎকৃত হবার পালা।এ কোথায় এলাম! চারপাশে গাছগুলো সব সাদা, মাঝে মাঝে দু একটা সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে । চতুর্দিকে শুধু গুঁড়ো বরফ, পা ঢুকে যাচ্ছে । সবাই একসাথে বসে পড়লাম ।আরো বেশ কিছু ট্যুরিস্ট ওখানে আগেই চলে এসেছিল। এ কোন বরফের রাজ্যে চলে এলাম। এতো বরফ একসাথে কখনো দেখেছি বলে মনেই করতে পারছিনা।আট থেকে আশি সবাই তখন একদল শিশু তে পরিণত হয়েছে।কেউ বরফের তাল নিয়ে আরেকজন কে ছুঁড়ে মারছে, কেউ বা বরফের গোলা পাকিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারছে, আবার কাউকে দেখছি গ্লাভস্ সহ হাত দুটো বরফের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছে, কেউ বা বেমালুম চুপ করে শুয়ে পড়েছে । সে এক অদ্ভুত ভাললাগায় আমরা তখন আচ্ছন্ন। আমার এক বন্ধুর বাড়ীর পরিচারক একবার আমায় বলেছিল,” কি যে এতো বরফ বরফ করেন দাদা বুঝিনা বাপু, ফ্রীজ খুললেই তো কত বরফ দেখা যায়।” তাকে কি করে বোঝাই দুই বরফের তফাত ।কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছিল না ওই জায়গা ছেড়ে । কতক্ষণ যে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ ই শুরু হোল snowfall আর মুহুর্তে পরিবেশ গেল পাল্টে। সবাই চিৎকার করছে আনন্দে। সবার মাথায়, মুখে, গায়ে বরফের গুঁড়ো তুলোর মত উড়তে উড়তে এসে পড়ছে । প্রকৃতির হঠাৎ এই পরিবর্তন কে তখন অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করছি আর ভাবছি আজও এ জিনিস দেখার ভাগ্য আমার ছিল। শেষ দেখেছিলাম ছাংগু লেকে, বেশ কয়েক বছর আগে।তার ও আগে ১৯৭৯ সালে অমরনাথ যাবার সময় মহাগুনাস্টপ এ।যাইহোক কতক্ষণ যে ওখানে ছিলাম জানিনা। রোপওয়ে করে নেমে এসে বাকী পথ টা হেঁটে আবার এসে গাডীতে।হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে ।
পরদিন মানালির local sightseeing. হিডিম্বা মন্দির, club house, বনবিতান সবই দেখলাম বটে কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে মনের মধ্যে তখন একটাই নাম ‘সোলাং ভ্যালি’।
পরের দিন চললাম ‘পালামপুর’। মানালি থেকে চার ঘন্টার রাস্তা। বেশ জমজমাট একটা হিল স্টেশন। ওখানকার ‘হোলি উৎসব’ সম্বন্ধে কিছুটা আগে থেকেই জানা ছিল। সেদিন পৌঁছে ওখানে ‘চামুন্ডা মন্দির’ আর ‘ধৌলাধার’ নেচার পার্ক দেখে নিলাম।আর পরদিন ওখানে হোলি উৎসব টা ওদের মত করেই উপভোগ করলাম। বিশাল একটা মাঠ। সেখানে সবাই সবার মত করে আবির খেলছে। একধারে বিরাট মেলা, সেখানে live function চলছে বিশাল এক মন্চে। পান্জাবী ভাষায় গান, নাচ সবই। কোন রং এর ব্যাপার নেই, শুধুই আবির। এ ওকে আবির মাখিয়ে রঙীন করে দিচ্ছে আর নিজেও রঙীন হচ্ছে ততোধিক।কোন বিশৃঙ্খলা নেই, কোন জোর জবরদস্তি নেই, কোন মাত্রা ছাড়া ব্যাপার নেই।সবটাই আন্তরিকতা আর ভালবাসায় মাখানো। জায়গায় জায়গায় লঙ্গরখানা, কোথাও হালুয়া, কোথাও লস্যি , কোথাও খিচুড়ি বিতরণ চলছে।ওদের এই কালচার কে খুব সম্মান করতে ইচ্ছে হল। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে অবশেষে হোটেলে ফেরা।
পরদিন ওখান থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে সোজা চন্ডীগড় । প্রায় বিকেল হয়ে গেল পৌঁছতে । ওখানে ‘রক গার্ডেন’ টা দেখলাম। বেশ নতুনত্ব লাগলো পুরো পরিকল্পনা টাতে।চন্ডীগড়ে থাকা টা শুধু মাত্র পরদিন সকালের ফ্লাইট টা ধরবো বলে। পরদিন যথাসময়ে উড়ান ধরে সোজা কোলকাতা । দু থেকে আড়াই ঘন্টার journey, conveyer belt এ luggage এর জন্য অপেক্ষা করা, গাড়ী করে জ্যাম পেরিয়ে বাড়ী ফেরা, কোন কিছুই আর মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী করছে না একেবারেই কারণ তখন মনের সবটা যে দখল করে ফেলেছে একটাই ছবি ‘সোলাং ভ্যালি’। হ্যাঁ এবার ফিরে গিয়ে কোন প্রশ্ন কেই আর অস্বস্তিকর মনে হবে না। পরিশেষে, অভিজ্ঞতা থেকে দু একটা জরুরী উপদেশ। ১) মানালির পক্ষে মার্চ মাস টাই বোধহয় উপযুক্ত সময়। ২)অনলাইনে গাড়ী fix না করে গাড়ী টা দেখে নিয়ে বুক করাই ভাল, বিশেষ করে টায়ার এর condition , চলতি ভাষায় যাকে বলে গুটি। ৩)ড্রাইভার খুব অল্প বয়সী ছেলে ছোকরা না হওয়াই বান্ছনীয়। ৪)সিমলা, কুলু, মানালি র তথাকথিত tour plan থাকলে আলাদা কথা, অন্যথায় হোলি উৎসব না থাকলে পালামপুরের থেকে ‘মান্ডি’ দু একদিন কাটানোর পক্ষে আদর্শ জায়গা। ৫)পাহাড়ে রাতের journey খুব boring. সময় বেশী লাগলেও দিনের বেলার journey সবসময় exciting. ৬)সোলাং ভ্যালি তে যাবার সময় waterproof পোশাক আর গামবুট একটু ভাল standard এর দোকান থেকেই নেওয়া উচিত কারণ তা না হলে ভেতরের পোশাক পুরো ভিজে যেতে পারে। ৭)পাহাড়ে খাওয়া দাওয়া টা একটু simple রাখাই ভাল।
।।। জটার দেউল ।।।
মন্দিরের প্রতি আকর্ষণ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, আর সেই টানেই আমাকে নিয়ে চলেছে বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। অনবরত ছুটেই চলেছি মন্দিরের বিভিন্ন রূপ ও কারুকার্য নিজের চামড়ার চোখে ধরে রাখার জন্য এবং এই মুহূর্তগুলো স্মৃতির সিন্দুকে ধরে রাখার জন্য ক্যামেরা নামক যন্ত্রটি সাহায্য করে চলেছে। আর সেই অনুভূতি গুলি ভাগ না করে নিলে মনের ভালো লাগার পরিমান কমে যায়। প্রথম ইচ্ছাই ঘোষের দেউল দর্শনের মাধ্যমেই আমার মানস কলসে মন্দিরের দেউল শৈলীর পরিচয়। এরপর একের পর এক দেউল এর সন্ধানে এগিয়ে চলা। আজ জটার দেউল কে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। অবাক লাগে এই জটার দেউল এর অবস্থান। সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলের মাঝে কি ভাবে বা কেন গড়ে উঠলো জটার দেউল তা আজও রহস্যময়। ১৮৭৫ সালে প্রাপ্ত একটি তাম্র লিপি অনুযায়ী রাজা জয়চন্দ্র এই মন্দির স্থাপন করেন খ্রিষ্টীয় ৯৭৫ সনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই তাম্র লিপি উধাও হয়ে যাওয়ায় জটার দেউলের ইতিহাস আজও রহস্যময়। দেউল শৈলী যদিও জৈন ধর্মের মন্দির হিসাবে পরিচিত হলেও সুন্দরবন এলাকায় এই ধর্মের তেমন চল ছিল বলে তার বিশেষ প্রমান নেই। কাজেই লোকশ্রুতি হিসাবে ধরে নেওয়াই যায় এটি একটি শিব মন্দির। জটাধারী শিবের নাম অনুসারে জটার দেউল নামে সমধিক পরিচিত। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় একাদশ শতক এই দেউল এর নির্মাণ কাল ASI অনুযায়ী। ইষ্টক নির্মিত এই দেব দেউলটি পঞ্চরথ ভিত্তির উপর এক শিখর বিশিষ্ট। দেউল এর প্রবেশ পথ ক্রমবর্ধমান খিলান যুক্ত। মন্দির এর দেওয়াল টেরাকোটার কাজে অলঙ্কৃত হলেও তার বেশি ভাগই সময়ের জালে অবলুপ্তির পথে। দেউল এর শিখর প্রায় ৬৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য প্রস্থ যুক্ত বর্গাকার এই মন্দির। মন্দিরের সামনের অংশটি দেখলেই বোঝা যায় যে দেউলটি রথের ন্যায়, এই পঞ্চরথ শৈলী বেশি ভাগ দেউল এই অবলুপ্ত। কাজেই জটার দেউল সেই দিক দিয়ে অবশ্যই দর্শনীয়। দেউলটি একটি মাটির ঢিপির উপর অবস্থিত হওয়াতে আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। বিস্তীর্ণ খেতি জমির মাঝে উঁচু মাটির ঢিপির উপর জটার দেউল যেন শিবের উপস্থিতি প্রকট ভাবে জানান দেয়, সঙ্গে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে জটার দেউল আরও আকর্ষণীয়। দেউল এর গর্ভে শিব লিঙ্গ এবং আরও অনেক দেব দেবীর ছবি পূজিত হন। জটার দেউল এ শিব আরাধ্য হলেও যেসব মূর্তি পূজিত হয় তাঁর প্রাগৈতিহাসিক মূল্য না থাকলেও স্থানীয় মানুষের কাছে ভক্তির মূল্য যথেষ্ট, তারই নমুনা মন্দিরের লোহার প্রবেশ পথে অসংখ্য লাল হলুদ সুতোয় ইঁট এর টুকরো বাঁধা যা কিনা মানসিক এর প্রতীক। ASI এর অধীনস্ত হওয়ায় আশারাখি পরবর্তী প্রজন্ম এই মন্দির শৈলী চাক্ষুস করতে পারবে।
পথনির্দেশ :- শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা লোকাল ট্রেন এ প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মথুরাপুর স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেকার বা বাস বা অটো করে ঘন্টা খানেকের মধ্যে রায়দীঘি পৌঁছে যান। এরপর মুড়ি নদীর উপর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে মোটর ভ্যান বা লাদেন গাড়ি, এতে করেই গ্রাম্য পথে আধা ঘন্টার মধ্যেই জটার পূর্ব গ্রাম ও পশ্চিম গ্রাম এর মাঝেই পিচকালো রাস্তার ধারেই জটার দেউল আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই রাইদিঘী হল সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশপথ। মুড়ি নদী বেয়েই চলে যাওয়া যায় সুন্দরবনের গভীরে। এই পুরো পথেই গ্রাম্য সতেজতা আর বিভিন্ন পাখিরা আপনাকে সঙ্গ দেবে। আর আছে কিছু গ্রাম্য সরল মানুষ, যারা আপনাকে প্রতি নিয়ত সাহায্য করবে জটার দেউল এ পৌঁছাতে।।।
পুনঃ:- প্রতি বছর ২ রা বৈশাখ এই জটার দেউল এ ঘোড়া দৌড় এর এক অনন্য আয়োজন হয়ে থাকে। প্রচুর লোকসমাগম এবং ছোট খাটো মেলার আকার নিয়ে জটার দেউল এই বিশেষ দিনে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আলাদা মাত্রায়।
।।চাঁদের ভেলায় বেথুয়াডহরী।।
এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে চেপে ধরল বন্ধুরা, দোলে কোথাও একটা যেতেই হবে – সময় হাতে মাত্র একটি দিন। খুব একটা ভিড়ভাট্টা চলবে না একেবারেই। মহা ধন্দে পড়লাম। মনে পড়ল সম্ভবতঃ এই গ্রুপে বা অন্য কোনো ট্রাভেল গ্রুপে কোনো এক ভদ্রমহিলা বেথুয়াডহরী নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন সপ্তাখানেক আগেই। ওনাকে উত্তর দিতে গিয়ে জায়গাটা নিয়ে একটু আধটু ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম। সেটাই কাজে লাগালাম। সর্বসাকুল্যে আমাদের জন সংখ্যা ১২ মানে গোটা পাঁচেক পরিবার আর বন্ধুরা। তাই জঙ্গলের ঘরে কুলোবে না। নেট খুঁজে পেয়ে গেলাম থাকার আস্তানা। পূজা লজ – মালিক ভক্তিবাবুর সাথে দূরভাষে কথা বলেই মনে হল মানুষটি নিপাট ভদ্রলোক (৯৯৩২৩৭৮৮৪৯ / ৯৭৩২১৩৬০৫৩)। ঘরের ভাড়াও বেশি নয়, নন-এসি মাত্র ৭০০/- আর এসি ৯৯০/-। বলতেই হোয়াটসয়্যাপে পাঠিয়ে দিলেন বেশ কিছু নন-এসি ঘরের ছবি। পছন্দ হবারই মত। এরপরেই ট্রেন, যথারীতি বুকিং ততক্ষণে ওয়েটিং লিস্টে ১৮য় পৌঁছে গেছে। এক বন্ধুকে বলায় সে তড়িঘড়ি ছুটল কাউণ্টার বুকিং করতে। শেষে নেচেকুঁদে জানিয়ে দিল – “বুকিং হয়ে গেছে, ওয়েটিং লিস্টে সব্বাই”। সে হোক ট্রেন জার্নি বেশিক্ষণের নয়। সকাল ৬/৫০ এ হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস কোলকাতা স্টেশন ছেড়ে সকাল ৯/৫০ নাগাদ পৌঁছে যায় বেথুয়াডহরী স্টেশনে – ভাড়া সিটিং রিসারভেশনে মাত্র ৭০/- - অবশ্যি এও নন-এসি। তা আমাদের মত ভবঘুরেদের খুব একটা ঠান্ডাযন্ত্রের দাক্ষিণ্য এখনো লাগেনা । আর বারোমাসে তেরো ভ্রমণ করতে গেলে সেটা এমনিই চাপের হয়ে যায় আর কি। এবারে দিন গোনার পালা। দেখতে দেখতেই এসে গেলো দোলপূর্ণিমা। সক্কাল সক্কাল সবাই মিলে চড়ে পড়লাম হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে। বলা হয়নি, ঠাকুরের কৃপায় সব টিকিট কনফার্মড হয়ে গেছে দেখলাম। হৈহৈ করতে করতে ঠিক ১০/০০টায় পৌঁছে গেলাম বেথুয়াডহরী স্টেশনে, যাত্রাপথে সিটে ১০/১৫ মিনিটও বসেছিলাম কিনা সন্দেহ। স্টেশন থেকে বেরিয়েই ডান হাতে মিস্টির দোকান জলযোগ, আরও বেশ কিছু দোকান আছে। সুবিধামত তার একটায় বসে প্রাতঃরাশ সারা হল। সামনেই গাদা গাদা টোটো – তারই দুখানা বুক করে নিলাম। বেথুয়াডহরী স্টেশন থেকে পূজা লজ মিনিট পাঁচেকের পথ – ভাড়া পার হেড ১০/- মাত্র। লজে পৌঁছতেই মালিক ভক্তিবাবু সশরীরে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হলেন হাসিমুখে, সাথে ওনার ম্যানেজার। বেশ বড় হোটেল, নীচের তলায় বিয়েবাড়ী ভাড়া হয়, দোতলায় গেস্টদের ঘর আর তিনতলায় উনি নিজেই সপরিবারে থাকেন, তার ওপরে বিশাল লন টেনিস খেলার মত ছাদ। ম্যানেজারবাবু ওনার নির্দেশে দোতলার পাঁচটা ঘর খুলে দিলেন। ছবিতে যেমন দেখেছিলাম ঘরগুলো তার চেয়েও বেশী সুন্দর। একটু ফ্রেশ হয়েই সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম রঙ আবির নিয়ে ছাদে দোল খেলতে, সাথে খাওয়াদাওয়ার বিবরণ আর দিলাম না। দুপুরের ভুরিভোজের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠিক চারটেয় বেরলাম বেথুয়াডহরী ফরেস্টের উদ্দেশ্যে – বাহন টোটো – ভাড়া ১০/- জনপ্রতি। ঠিক ৪/১০ এ হাজির হলাম ফরেস্টের প্রবেশদ্বারে। জানলাম টিকিট দেওয়া ৪টেয় বন্ধ হয়ে যায়, অনেক অনুরোধেও সাড়া না পেয়ে বিফল মনে চেপে বসলাম টোটোয়। আমাদের মন খারাপ দেখে টোটোচালক ভাই বললেন “দাদা মন খারাপ করবেন নি, কাল দেখিয়ে দেব, আজ চলেন পাটুলি গঙ্গার ঘাট আর ফেরার পথে এখানকার বইমেলা দেখাব”।
বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চললাম পাটুলি গঙ্গার ঘাট। পথে সঙ্গ দিল গ্রাম বাংলার নিরালা সবুজ ক্ষেত, মাঠ, ঘাট। মিনিট ত্রিশেকে চলে এলাম গঙ্গার ঘাটে । জায়গাটা খুবই নিরিবিলি, আবার বিপজ্জনক বোর্ডও ঝুলছে দেখলাম গঙ্গার ঘাটে । স্থানীয় একজনের সাথে কথা বলে জানলাম এখানে চোরাস্রোত আছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বন্ধুদের পড়ন্ত সোনালী আলোয় ফোটোস্যুটের আসর। ঘাটে বাঁধা নৌকায় চড়ে, ঘাস বনের আনাচেকানাচে, ভাঙ্গা ঘাটের ধাপে ধাপে আবির গোলা জল ঢেলে সূর্য পাটে না যাওয়া অবধি আনন্দে ভেসে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল টেরও পেলাম না। ফেরার পথে গেলাম বইমেলা।
আভিজাত্যে কোলকাতা বইমেলার মত নাহলেও মেলাটি বেশ বড়, প্রচুর বইয়ের স্টল, রকমারি বই আর খাবারদাবার, অনুষ্ঠান মঞ্চটিও বেশ বড়, সেখানে সগৌরবে চলছে ১৬তম বেথুয়াডহরী বইমেলার বর্ণাঢ্য নানা অনুষ্ঠান। প্রায় একঘন্টা কাটালাম সেখানে। ছেলের জন্য কেনা হল “বাঁটুল সমগ্র” আর নিজের জন্য ডঃ শ্যামল চক্রবর্তীর লেখা একটা ভ্রমণমূলক বই “চলো বেড়াই”, ওটা অবশ্য আমার ভ্রমণপাগলীকেই গিফট করলাম। এরপর হোটেলে ফেরার পালা। সেখানেও যে এক দুর্দান্ত বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল জানতাম না। একটু ফ্রেশ হতে না হতেই সন্দীপ, আমার এক বন্ধু, আমাদের ছাদে যেতে বলল। ছাদে গিয়ে দেখি পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ, তারই মাঝে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে চলছে আমার ছেলের অগ্রিম জন্মদিনের প্রস্তুতি। অদিতি কোলকাতা থেকেই কেক নিয়ে গেছিল, অন্যরাও নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছিল যা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি। ফেবু নোটিফিকেশনের সৌজন্যে চুমকিই এই প্রোগ্রামের মাথা বুঝলাম বেশ পরে। অতিথিদের মধ্যে ভক্তিবাবুর স্ত্রী, মেয়ে, জামাইও এসে ভিড় জমিয়ে ফেলল। আলোর অপ্রতুলতা ঢেকে দিয়েছিল স্বচ্ছ আকাশের পূর্ণচন্দ্র । মোমবাতি জ্বালিয়ে, কেক কেটে, খানাপিনা আর নাচগান করে কেটে গেল সারাটা সন্ধে। এত পরিশ্রমের পর রাতের খাবার খেয়ে দুধসাদা বিছানায় সবাই শরীর এলিয়ে দিল রাতপরীর সাথে। ঠিক সকাল সাড়ে পাঁচটা – যথারীতি আমার ঘুম গেল ভেঙ্গে। রাতে ঠাণ্ডার আমেজ থাকায় ঘুমটা জব্বর হয়েছে। উঠে দেখি মোবাইলে প্রমিতের তিনখানা মিসকল। মানে ব্যাটা আরো আগেই উঠে পড়েছে। তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে দেখি সুব্রত, চুমকি, প্রমিত ততক্ষণে রেডি । সিদ্ধার্থ যেতে পারবে না, অফিস থেকে ওকে ডেকে পাঠিয়েছে, বেচারা তৈরি হচ্ছে সকাল নটার ট্রেন ধরতেই হবে ওকে, আর বাকিরা তখনো ঘুমে অচেতন। দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম হাইরোডের উল্টোদিকে – গ্রামের কাঁচা পথ ধরে। আজ সন্ধ্যার ট্রেনেই তো আবার জঞ্জালে ফেরা, তাই যতটা পারি অক্সিজেন ভরে নিতে হবে যে ফুসফুসে। আঁকাবাকা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল আম, সবেদা আর লিচু গাছের বন। বেশ কিছু ছবি তোলার ফাঁকে দেখতে পেলাম রকমারি পাখির ঝাঁক – বুলবুলি, বসন্তবৌরি, ছাতার, টিয়া, ফিঙে – আরো নাম না জানা পাখির দল। দুঃখের বিষয় কারো কাছেই ভালো কোনো ক্যামেরা ছিল না। মোবাইলের দাপটে এসব তো আমরা আজকাল আর নিতেই চাই না। তাছাড়া দোলের রঙ লেগে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে আমার এসএলআরটাও আমি বাড়ীতেই রেখে এসেছি। অগত্যা মোবাইলে যতটুকু পারলাম তুলতে থাকলাম সবাই মিলে। আরো কিছুটা এগোতেই পেলাম শাল, অর্জুন আর সেগুন গাছের জঙ্গল । দূরে চোখে পড়ল কিছু তাল, নারকেল আর খেজুর গাছের সারি – বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে বললাম “চল ওদিকে – নিশ্চয়ই জলাভূমি আছে”। ঠিক তাই, কিছুটা যেতেই দুধারে বড়সড় দুটো পুকুরের মাঝখান দিয়ে সরু পথ চলে গেছে – ধারের জঙ্গলে ফেন্সিং – বুঝলাম অজান্তেই এসে পড়েছি বেথুয়াডহরী ফরেস্টের পিছনের দিকে। এদিকে কেউ আর নেই। অজস্র ছবি তুললাম আর প্রাণ ভরে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিলাম – এর জন্যেই তো ইঁট-কাঠ-পাথরের শহর ছেড়ে পাড়ি জমানো। প্রায় একঘন্টা থাকার ফাঁকে ফেন্সিং এর ওধারে ঘন জঙ্গলে প্রায় সাত আটটা হরিণের দল একঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল আরো গভীরে – বোধহয় মানুষের ঘ্রাণ পেয়েই – আর দেখা পেলাম না ওদের। ইতিমধ্যে দুজন পোষাক পরা বনকরমী এসে আমাদের চলে যেতে বললেন ওখান থেকে। বাধ্য হয়েই ফিরে এলাম আমাদের লজে। সিদ্ধার্থ ততক্ষণে রেডি – আমাদের বিদায় জানিয়ে মলিন মুখে বেরিয়ে গেল ও – এমনই বিড়ম্বনা চাকরীর।
পূজা লজের খাওয়া দাওয়ার মান খুবই ভালো, দামও একদম ঠিকঠাক। দুপুরের আহারে মাংসের স্বাদ আর ওখানকার রাজভোগের স্বাদ ভোলা অসম্ভব।
আজ আর দেরী নয়। দ্বিপ্রাহরিক আহার পর্ব মিটিয়ে ঠিক ২/১০ এ হাজির হলাম ফরেস্টের প্রবেশদ্বারে। বলে রাখি এখানে প্রবেশ করতে গেলে টিকিট মূল্য ৫০/-, সময় সকাল ৯টা থেকে ১২টা, তারপর আবার দুপুর ২টো থেকে ৮টে অবধি। ভিতরে ঢুকতেই ডানদিকে ফরেস্টের খান দুই গেস্টহাউস – ভাড়া ৫০০/- করে। এখানে থাকলে প্রবেশ মূল্য লাগেনা। ঘরগুলোর অবস্থান ভাল হলেও মেন্টিন্যান্স তেমন লাগল না। আরো জানিয়ে রাখি ফরেস্টে ঢোকার পর ধূমপান চলবে না বা মাদকাসক্ত অবস্থায় ঢুকতে পারবেন না। তবে খাবার জলের সিলড বোতল অবশ্যই নিয়ে যাবেন কারন ভেতরে প্রায় ৩ কিমি পথ পায়ে হাঁটতে হবে এবং কোনো খাবার বা জল পাবেন না। প্রবেশের পর নির্ধারিত পথে আমরাও হাঁটতে থাকলাম। এখানেও সেই শাল, অর্জুন আর সেগুন গাছের জঙ্গল, এছাড়া কিছু জলাভূমির উদ্ভিদ যেমন ব্যারিংটোনিয়া অ্যাকুটাংগুলা ইত্যাদি। জঙ্গলের প্রাণীবৈচিত্রের মধ্যে ঘুঘু, বেনেবউ, সারস, বুলবুলি, টিয়া, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, ডাহুক, পেঁচা ইত্যাদি প্রায় ২৫ প্রজাতির পাখি, রকমারি প্রজাপতি, শেয়াল, হরিণ প্রভৃতি আছে। আর আছে বদ্ধ পরিসরে ময়ূর , উটপাখি, খরগোশ, ঘড়িয়াল কুমির, কিছু বিদেশী পাখি – এইসব। এই ৩ কিমি নির্ধারিত পথে আমরা বেশ কিছু পাখি, প্রজাপতি, ঘড়িয়াল কুমির আর বদ্ধ পরিসরে ময়ূর , উটপাখি, খরগোশ ছাড়া কিছু দেখতে পাই নি। সাধারণ ভাবে বন্য প্রাণী দেখার আদর্শ সময় হল সকাল বা সন্ধ্যা বেলা। অদ্ভুত ভাবে ওইসব সময়ে কোনো প্রবেশাধিকারই দেওয়া হয় না – যেটা অন্য যেকোনো অভয়ারণ্যের তুলনায় আলাদা। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ঘোরার পর বেশ তৃষ্ণার্ত অবস্থায় আমরা হাজির হলাম প্রবেশ দ্বারের ঠিক বামপাশে অবস্থিত নেচার ইনটারপ্রিটেশন সেন্টারে – যেখানে আলাদাভাবে ২/- করে প্রবেশ মূল্য লাগে। সুবিধার মধ্যে বাইরে ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছিল, বৃষ্টি শুরুর প্রাক্কালে কেকাধ্বনিসহ ভারতের জাতীয় পাখির পেখম তোলা দেখতে পাওয়াই আমাদের উল্লেখ্য প্রাপ্তি হয়ে রইল। নেচার ইনটারপ্রিটেশন সেন্টারের ভিতরে কিছু মাটির পুতুলের মাধ্যমে আঞ্চলিক বিবর্তন দেখান আছে, আর আছে জারে ভরা সাপের ডিম, ময়ূরের ডিম, কুমিরের ডিম, মরা কুমির ছানা – আর একজন আধা ঘুমন্ত দ্বাররক্ষী কাম টিকিট কালেক্টর। এখানেও খাবার জলটুকুও পেলাম না। ইতিমধ্যে বেশ ভালোরকম বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। নেচার ইনটারপ্রিটেশন সেন্টারে লোডশেডিং, বসার সুবিধামত জায়গা না পেয়ে বাইরে এসে সিঁড়িতেই বসলাম। বৃষ্টিহাওয়ার হিমেল পরশ যেন সমস্ত ক্লান্তি কেড়ে নিচ্ছিল। মেঘের গুরুগম্ভীর নিনাদের সাথে জঙ্গলের গন্ধ আর পড়ন্ত বিকেলে পাখীদের কিচিরমিচির মিলে এক অদ্ভুত শব্দকল্পদ্রুম রচনা করেছে। আমরা ছাড়া আর তেমন ট্যুরিস্ট চোখে পড়ল না, আঞ্চলিক কিছু ছাড়া। বৃষ্টি থামতেই বেরিয়ে পড়লাম ট্রেন ধরার তাড়ায় – বিদায় বেথুয়াডহরী, হয়ত আর কোনোদিন এপথের ধুলো মাখা হবে না, কিন্তু মনে থেকে যাবে পাটুলির ভাঙ্গা গঙ্গার ঘাট, বেথুয়াডহরী বইমেলা, চাঁদনি রাতে খোলা ছাদে ছেলের অগ্রিম জন্মদিন পালন, জঙ্গলের পিছনের বেড়াতারে ভোরবেলা হানা দেয়া, অজস্র পাখপাখালির কলতান আর ছোটবেলার অকৃত্রিম কিছু বন্ধুসঙ্গ যারা এই সামান্য স্থানকে তাদের আপন আপন রঙের মাধুরী মিশায়ে অনবদ্য করে তুলেছিল এই ছোট্ট হোলিভ্রমণে। প্রলয়। ২৬/৩/২০১৯ পুনশ্চঃ এই ভ্রমণে আমাদের সবকিছু মিলিয়ে মাথাপিছু খরচ পড়েছে ১৫০০/- করে।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগন্জ...
চাঁপাইনবাবগন্জ... আম আর আম। গাছে গাছে ঝুলছে কাঁচা-পাকা আম। রাস্তার দুই ধারে যত দূর চোখ যায়, কেবলই আমের বাগান। ইচ্ছা করলেই মাটিতে দাঁড়িয়ে, এমনকি শুয়ে-বসেও ছোঁয়া যায়। চাইলে দু-একটা পেড়ে খেতেও পারবেন। যাঁরা এই অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাঁরা এখনই চলে যেতে পারেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের বাগানে। প্রখর এই রোদেও ছায়াঘেরা বাগানগুলোতে পাবেন স্নিগ্ধ, শান্তিময় এক পরিবেশ। দেখবেন বিস্তৃত বাগানে একের পর এক গাছ থেকে পাড়া হচ্ছে আম। ঝুড়িতে করে নিয়ে সেই আম তোলা হচ্ছে ভ্যানে। এরপর সেই ভ্যান যাচ্ছে হাটে। সেখানে সারি সারি মানুষ মণকে মণ আম বিক্রি করছেন। তবে ৪০ কেজিতে নয়, এখানে ৪৫ বা ৪৮ কেজিতে মণ ধরা হয়। কারণ, কিছু আম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানকার শিবগঞ্জ উপজেলাকে বলা হয় আমের রাজধানী। রাজশাহী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সড়কপথে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পুরোটাই নাকি ছিল আমের বাগান। এখনো শহরের আদালতপাড়া, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং কলেজের পুরো অংশই আমবাগান। শহরটা ঘুরলে মনে হবে, আমবাগানের মধ্যেই যেন মানুষের বসতি। সদর উপজেলা ছাড়াও শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর- এই উপজেলাগুলোও আমবাগানের মধ্যে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে বের হয়ে মহানন্দা সেতু পেরিয়ে শিবগঞ্জের দিকে রওনা দিলে রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়বে হাজার হাজার আমের বাগান। শহর থেকে শিবগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। সঙ্গে গাড়ি থাকলে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে যেতে পারবেন। রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়বে আমের ভ্যান, আমের গাড়ি, মানুষের হাতে আম, মাথায় আম।
শিবগঞ্জের সেনের বাগান, মোজাফফর মিয়াদের বাগান, কানসাটের রাজার বাগান, কানসাটের পাগলা নদীর পশ্চিম পারের চৌধুরীদের বাগানসহ আরও অনেক নামকরা আমের বাগান রয়েছে। চাইলে রাস্তার পাশের যেকোনো আমবাগানে ঢুকে যেতে পারবেন।
সারা বছর আমবাগানগুলোতে ব্যস্ততা থাকলেও এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই—এই সময়টা আমবাগানে ঘোরার জন্য ভালো সময়। কারণ, চাইলে এই সময়ে আম খেতেও পারবেন। শিবগঞ্জে এসে আপনি যেকোনো বাগানে ঘুরতে পারবেন। বিশ্রাম নিতে পারবেন আমবাগানের মধ্যে থাকা ছোট্ট ঘরে। আমবাগান তো ঘুরলেন, আমের হাটে যাবেন না? শিবগঞ্জ ঘুরতে এসে কানসাট না যাওয়াটা বিশাল বোকামি। কানসাটেই সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট। এখানে যত দূর চোখ যায়, দেখবেন আমের বেচাকেনা। ফজলি, ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, বোম্বাই, লক্ষ্মণভোগ, ফনিয়া, হিমসাগরসহ শত শত প্রজাতির আম। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখবেন হাটে গাড়ি ঢুকছে, বের হচ্ছে, লোকজন আসছে-যাচ্ছে, মনে হবে এ যেন আমের স্বর্গ। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে হাটের পাশের ছোট দোকানগুলোতে বসে খেতে পারবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত কালাই রুটি। এই হাট থেকে যত খুশি আম কিনতে পারবেন। শিবগঞ্জ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই সোনামসজিদ স্থলবন্দর। চাইলে সেখানেও একবার ঘুরে আসতে পারেন।
কোতুলপুর - বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সাব ডিভিশনে একটি অল্পখ্যাত গ্রাম। মাঝে মাঝেই যেমন একটু বেরিয়ে পড়ি - জানা অজানা কোনো স্থান বা মন্দিরের খোঁজে, তেমন ভাবেই জানুয়ারির এক রবিবারে কলকাতা থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম বিষ্ণুপুর থেকে মোটামুটি তিরিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটিতে। যাঁরা ভ্রমণে বেরোন - তাঁদের অনেকেরই পছন্দের জায়গা ওই বিষ্ণুপুর, যা বিখ্যাত তার অসাধারণ টেরাকোটা মন্দিরগুলির জন্যে। আমাদের এবারের ভ্রমণে কিন্তু আমরা বাদ দিয়েছিলাম সেই বিষ্ণুপুরকেই - কারণ বিষ্ণুপুর আছে আর থাকবে তার মহিমা নিয়ে, সেখানে গেলে আমাকে থাকতে হবে অন্তত তিনটে দিন - সব কিছু মোটামুটি ভাবে দেখতে ও জানতে গেলে। কিন্তু এবারের যাত্রা মাত্র একদিনের, কলকাতা থেকে সকালে বেরিয়ে রাতেই ফিরে আসা - তাই বিষ্ণুপুরের পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয়েছিল অল্পখ্যাত এই কোতুলপুর, সেই সঙ্গে কাছের গোকুলনগর আর জয়পুরকেও। লিখতে বসে আজ প্রথমেই তাই বলবো এই কোতুলপুরের কথাই।
বাংলার অনেক ছোট গ্রামেই হঠাৎ করে এমন কিছু মন্দির বা স্থাপত্য চোখে পড়ে, যে প্রথম দর্শনেই একটু চমকে যেতে হয়। কোতুলপুরে এমনই একটি বিশাল তোরণের সামনে যখন নামলাম - তখন মনে হলো যেন কোনো বিশাল প্রাসাদ বা দুর্গের তোরণদ্বার। দুদিকে তিনটি করে মোট ছটি থামের ওপর দাঁড়িয়ে এই অর্ধচন্দ্রাকৃতি তোরণ - তার দুদিকে বিস্তৃত wings বা তোরণটির বর্ধিত অংশ - যেগুলিকে আসলে দোতলা বাড়ীই বলা যায়। তোরণের অবস্থা জীর্ণ, অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে, তবু সহজেই অনুমান করা যায় - একসমযে কি বৈভবের নিদর্শন ছিল এই তোরণ। তোরণটি সেই সময়ে ছিল এখানকার তদানীন্তন জমিদার নিরঞ্জন ভদ্রের খাস তালুকে প্রবেশের ঠিকানা, এখনও সেটির মাথার ওপরে একটি ভগ্ন ফলকে “ ভদ্র” লেখাটি পড়া যায়, বাকি অংশ বিলুপ্ত। তোরণের বাইরে একটু দূরে প্রাচীন একটি ঠাকুরদালান, আর সামনেই দুদিকে দুটি করে চারটি অপেক্ষাকৃত নতুন শিবমন্দির - যেগুলি কিন্তু এই প্রাচীন তোরণের মহিমার সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যহীন।
তোরণ দিয়ে এবার ভেতরে প্রবেশের পালা। না , কোনো বাড়ীর মধ্যে নয় - সেটির ভেতর দিয়ে রাস্তা গেছে গ্রামের আরো ভেতরে। তোরণ দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে একটু দূরে একটি সুন্দর সাদা রাসমঞ্চ, সামনে একটি দুর্গাদালান, আর ডানদিকে পরপর দুটি স্থাপত্য - প্রথমে পাথরের তৈরি একটি গিরি গোবর্ধন মন্দির, আর তার পাশেই একটি ছোট নবরত্ন দোলমঞ্চ। আবার সেই দোলমঞ্চের পরেই একটি বড় পঞ্চরত্ন মন্দিরের চূড়ো। দুর্গাদালানের এক কোণে একটি ফলক, যা থেকে জানা যায় ১৮৮০ সালের দুর্গা সপ্তমীর দিন শ্রী রামকৃষ্ণের এই গ্রামে পদার্পণের কথা। ডান দিকে পাথরের গিরিগোবর্ধন মন্দিরে বেশ কিছু মূর্তি - আছে দুদিকে দুজন দ্বারপাল, ওপরে যশোদা-কৃষ্ণ, গরুড় বাহন বিষ্ণু, দুপাশের প্যানেলে দশাবতার এই ধরণের অনেক টেরাকোটা মূর্তি। এই দুটি মন্দির ছাড়িয়ে পরে যে বড় পঞ্চরত্ন মন্দির - সেটিই এখানকার মূল মন্দির, ভদ্রদের কুলদেবতা শ্রীধর জীউ মন্দির। বাইরের রাস্তা থেকে কিছু বোঝা না গেলেও, ভেতরে ঢুকে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের কাজ গুলি। একটি ছোট প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু বেদীর ওপর তিন খিলানের তিরিশ ফুট উঁচু এই পঞ্চরত্ন শ্রীধর মন্দির - তার সামনের অংশে টেরাকোটার অজস্র কাজ।নীচের দিকে ফুলের অলংকরণ, ওপরের প্যানেলের বাঁদিক থেকে যথাক্রমে রাম রাবণের যুদ্ধ, কৃষ্ণের মথুরা পরিত্যাগ, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ - এমন অনেক ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরের দালানে কিছু ফ্রেসকোর কাজ - সেগুলোও আকর্ষণীয়। এছাড়া আছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলক - তার পাঠোদ্ধার বর্তমানে একটু কষ্টকর হলেও শতাব্দ ১৭৫৪, ১৭৫৫ আর বঙ্গাব্দ ১২৩৯ আর ১২৪০ কিন্তু এখনো পড়া যায় ।
নিরঞ্জন ভদ্রের পারিবারিক এই মন্দির ছাড়িয়ে এবার পাশেই ভদ্র পরিবারের আর এক শরিক সুধাকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ী। তবে তার আগে, শ্রীধর মন্দির থেকে বেরিয়েই বিপরীত দিকে একটা বিশাল প্রাসাদের আভাস। শুধু পড়ে আছে একটা ভাঙা দেওয়াল আর খোলা আকাশের নীচে একটা সিঁড়ি বয়ে একটা ভাঙা ছাতের ওপরে উঠে যাওয়া - বোঝা যায় এককালে এখানে একটি বিশাল বাড়ী ছিলো - যা আজ সম্পূর্ণই নিশ্চিহ্ন। সুধাকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ীর প্রবেশদ্বারের বাইরেও চারটি শিবমন্দির - প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। বাড়ীর ভেতরে আবার একটি রাসমঞ্চ, ঠাকুর দালান আর চারটি শিবমন্দির। কিন্তু এই বাড়ির এলাকার সবচাইতে দর্শনীয় হলো একটি দোতলা বাড়ী। আসলে বাড়ীর মত দেখতে হলেও এটি কিন্তু আদতে একটি দোতলা মন্দির - কোনো বাসস্থান নয়। মন্দিরের ছাদ থেকে শুরু করে নীচ অবধি পাশে, মাঝখানে, বারান্দায় - ছোট ছোট টেরাকোটার কাজ । হয়তো খুব উন্নত নয় , কিন্তু অলংকরণ এমন ভাবে করা যাতে সেই বাড়ী বা মন্দিরের দোতলা চরিত্র নষ্ট না হয়। ছোট ছোট টেরাকোটার কাজ, দেবদেবীর মূর্তি, তার মধ্যেই আবার অনেক মূর্তিতে সাহেবী মুখ আর পোশাকের আদল। সব মিলিয়ে বেশ নতুনত্ব। বাড়ীর বাইরেই একটি বড় পুকুর, সেই পুকুরের ওপর দিক থেকে এখানকার চারটি শিবমন্দিরের অবস্থান বোঝা যায়। কোতুলপুর নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকটা বড় হয়ে গেল। আসলে আমাদের বাংলার একটি গ্রামের প্রায় অখ্যাত আর অবহেলিত কিছু মন্দির - তারাই যে উঠে আসতে চাইলো আমার লেখার মধ্যে দিয়ে। পেরিয়ে গেলাম প্রায় আড়াইশো বছর - যখন এ গ্রাম ছিল হয়তো অনেক বর্ধিষ্ণু, কোলাহল আর রাজকীয় মহিমায় ভরপুর। আজ সে সবই ইতিহাস - অপেক্ষায় থাকে হয়তো আমাদেরই মতো কোনো অনুসন্ধিৎসু পথিকের। ভ্রমণ পরিচালনা ও তথ্য সহায়তা - ইতিহাসসন্ধানী ব্লগার অমিতাভ গুপ্ত।
আসানসোল , মাইথন, কল্যানেশ্বরী, পাঞ্চেত, গড়পঞ্চকোট উইকএন্ড ট্রিপ গাইড
আসানসোল : --------------- মাইথন , কল্যানেশ্বরী খুবই কমন উইকএন্ড সার্কিট । কিন্তু আসানসোল একটু অজানা । প্রথমেই বলি নবনির্মিত বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রাঞ্চ আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরের কথা । শহরের মধ্যে গত ২০ জানুয়ারী, ২০১৯ সদ্য উদ্বোধন হয়েছে এই রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির টি । খুব সুন্দর শান্ত পরিবেশে এই মন্দির টি । ভোগ এবং থাকার ব্যবস্থা ও আছে । যোগাযোগের জন্য আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে । এছাড়া ঘুরে নিন ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতা মন্দির । খুব জাগ্রত ঠাকুর । আর আছে চন্দ্রচূর শিব মন্দির । এটিও আসানসোল থেকে ঘুরে দেখে নেওয়া যায় । কল্যানেশ্বরী : ------------------ আসানসোল থেকে ২৫ কিমির মধ্যে এবং মাইথন থেকে চার কিমি আগে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বিখ্যাত এবং জাগ্রত মন্দির কল্যানেশ্বরী মন্দির । একটা পুরানো কাহিনী এখনও মানুষের মুখে মুখে বিরাজ করে । শোনা যায় এক চুড়ি বিক্রেতা বনের পথে চলতে চলতে একটি পাথর খন্ডের উপর এক সুন্দরী কন্যাকে দেখতে পান । এই সুন্দরী কন্যা তাঁর কাছে এক জোড়া চুড়ি তাকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । চুড়ি বিক্রেতা চুরীর বিনিময়ে তাঁর কাছে পয়সা চায় । কন্যা রূপী মা কল্যানেশ্বরী তাকে বলে রাজার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিতে । একই সময় রাজা স্বপ্নে দেখা পান মা রূপী কন্যা তাঁর কাছে এক জোড়া চুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন । রাজা যখন চুড়ি বিক্রেতার কাছে এই কাহিনী শুনলেন তখন রাজা মাকে দেখা দেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে মাকে ডাকতে লাগলেন । তখন মা কল্যানেশ্বরী তাঁর ডাকে সন্তুষ্ঠ হয়ে তাকে নদীর মধ্য থেকে হাত তুলে হাতের চুড়ি জোড়া দেখিয়ে দিলেন । এখনও মন্দির প্রাঙ্গনে মায়ের পদচিহ্ন লক্ষিত হয় । কথিত আছে অতীতে এখানে মানুষ বলী হতো । সন্তানহীন মহিলারা এখানে আসেন এবং মায়ের কাছে কামনা করেন সন্তান লাভের জন্য । প্রচুর ভক্তগন এখানে আসেন এবং মন্দিরের সামনে ডালিম গাছে ঢিল বাঁধেন তাদের মনষ্কামনা পূরনের জন্য । মনষ্কামনা পূরন হলে আবার তারা ঢিল খুলে দিয়ে মায়ের মন্দিরে পূজা দেন । যারা মাইথন ঘুরতে আসেন তাঁরা একবারের জন্য হলেও মায়ের মন্দিরের দর্শনে আসেন । মন্দিরের পাশে অসংখ্য থাকার হোটেল আছে ।
মাইথন :
---------- কলকাতা থেকে কমবেশি ২৫০ কি.মি. দূরত্বে রয়েছে একদিনের জন্যে ঘুরে আসার জন্য একটি নিরিবিলি এবং মনোরম জায়গা, যেটি হলো মাইথন । রেলপথে যেতে হলে বরাকর অথবা কুমারডুবি তে নামতে হয় । সেখান থেকে গাড়িতে আরও 20 মিনিট মত লাগবে পৌঁছাতে । মাইথন জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ড সীমান্তবর্তী একটি জায়গা । মাইথন ড্যাম পেরোনোর সাথে সাথেই শুরু হয়েছে যাচ্ছে ঝাড়খন্ড । এখানে বেশ কিছু ভালো ভালো হোটেলও আছে । মাইথন ড্যাম এর সাথেই আছে নৌকা বিহার এর সুব্যাবস্থা । বিকালের দিকে নৌকায় অনেকটা সময় কাটানো ও যায় এবং নৌকায় করে সবুজ দ্বীপ থেকে ঘুরে আসা যায় । এর চারিদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ অপূর্ব । মন মোহিত করার মতন চারিদিকে সৌন্দর্য । জলাধারের গা থেকে ছোট ছোট পাহাড় উঠে এসেছে এই পাহাড়্গুলি গাছপালা এবং জংলি ফুল এত সুন্দর যে চোখ জুড়িয়ে যায় এই জলাধারটি সুবিশাল । এক কথায় সপরিবারে সপ্তাহের শেষে দুদিন ছুটি থাকলে ঘুরে আসার পক্ষে উপযুক্ত । কি কি দেখবেন: ------------------ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: এখানে দেখার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে জলাধারটি অনেকদূর লম্বা বাঁধ দিয়ে জল আটকে জল বিদ্যুৎ তৈরি করা হচ্ছে । তাছাড়া এখানে জলকে আটকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন এর জল সরবরাহ করা হয় । ডিয়ার পার্ক : এই বাঁধ এর দক্ষিণ দিকে সুন্দর ডিয়ার পার্ক আছে বাঁধের উপর থেকে এই ডিয়ার পার্ক এর হরিণ গুলি কে দেখা যায় । এখানে হরিণের সংখা প্রচুর , ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০ । মিলেনিয়াম পার্ক : খুব সুন্দর একটা পার্ক. জলাধারের পাশেই অবস্থিত । এই পার্কে খুব সুন্দর সুন্দর মূর্তি, আছে ফুলের বাগান, গাছপালা, আরো অনেক কিছু দেখার মতন জিনিস রয়েছে । বিকালের দিকে ঘন্টা তিন চার এখানে সময় কাটানো যেতে পারে । পাহাড় : এখানে ছোট ছোট অনেকগুলি পাহাড় জলাধারের গা থেকে উঠে গেছে। এই পাহাড় গুলি অনভিজ্ঞ লোকেদের পক্ষে ট্রাকিং করা খুব সহজ । এই পাহাড়ের উপর উঠে চারিদিকে সৌন্দর্য অবলোকন করলে মন জুড়িয়ে যায় । পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট পাথরের টিলা, টিলা গুলি এত ছোট দেখলে মনে হবে এই বুঝি এই গুলো গড়িয়ে পড়বে একটু ঠেলা দিলেই । ঘন্টা দুই তিন সময় এখানে কেটে যাবে । বোটিং পয়েন্ট : এখান থেকে বোটে করে জলাধার এর মধ্যে ঘোরাফেরা করতে খুব ভালো লাগে । নীল জলরাশি মধ্যে ঘুরতে আর মৃদু মধুর বাতাস খেতে খুব ভালো লাগে । ভান্ডার পাহাড় : এখানে আছে ভান্ডার পাহাড়, প্রায় ৩০০ টি সিঁড়ি ভেঙে উঠলে পৌঁছে যাবেন অমরনাথ শিব মন্দিরে ।
পাঞ্চেত এবং গড়পঞ্চকোট :
----------------------------------- মাইথন থেকে একটা গাড়ী ভাড়া করে ঘুরে নেওয়া যায় পুরুলিয়া জেলার পাঞ্চেত এবং গড়পঞ্চকোট । পাঞ্চেতে আছে ড্যাম যা মাইথন ড্যামের তিন চার গুন বড় । কিন্তু কোনো বোটিং এর ব্যবস্থা নেই । নিচে আছে নেহেরু পার্ক । আর আছে স্নেক পার্ক । মাইথন থেকে কমবেশি ৩০ মিনিটের দূরত্বে আছে গড়পঞ্চকোট । এখানে আছে গড়, এখানকার মূল আকর্ষণ হলো পঞ্চতন্ত্র মন্দিরের ধংসস্তূপ, এবং অতুলনীয় টেরাকোটার কাজ । এছাড়াও আরও সংলগ্ন অনেক জায়গা আছে (যেমন জয় চন্ডী পাহাড়) যা হয়তো একদিনের জন্য গিয়ে দেখে ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না । কিভাবে যাবেন : ------------------- হাওড়া থেকে অনেক ট্রেন বরাকর যায় । তবে সকালের দিকে ট্রেনে যাওয়াই ভালো । ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস ৬:১৫ হাওড়া ছাড়ে, বরাকরে পৌঁছোবে দশটা দশ । ওখান থেকে অটোয় করে মাইথন ড্যাম আধ ঘন্টা রাস্তা । এ ছাড়া আছে জম্মু তাই এক্সপ্রেস হাওড়ায় ছাড়ে ১১:৪৫ । শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস ১:১০ । তবে সকালের দিকেই যাওয়া ভালো । কোথায় থাকবেন : --------------------- মাইথন ড্যামে অনেকগুলি হোটেল আছে । মাইথন ফরেস্ট গেস্ট হাউস, ডব্লিউ বি টি ডি সি মাইথন লজ, জিয়া গেস্ট হাউস, হোটেল শান্তি নিবাস, হোটেল মাইথন, ইত্যাদি । প্রতিটি হোটেলে ভাড়া ৭০০-৮০০ টাকা থেকে শুরু । এসি নন-এসি সবরকম রুম পাওয়া যায় । শীতকালে পিক সিজন, রুমের চাহিদা অনেক বেশী । এছাড়া কল্যানেশ্বরী মন্দিরের কাছেও অনেক হোটেল আছে । আশা রিসোর্ট, হোটেল যাত্রীনিবাস ইত্যাদি ।
পলাশ পার্বণ
প্রদীপ হাজরা অদ্ভুত একটা পালাই পালাই ভাব গ্রাস করে প্রতিবছর এই সময়টা এলেই । চারপাশে প্রকৃতির হোলি খেলা শুরু হয়ে যায় ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকেই । প্রকৃতির একান্ত নিজস্ব এই রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠা দেখতে হলে ব্যাগ গুছিয়ে পালাতেই হবে বাঁকুড়া-বীরভূম-পুরুলিয়া কিম্বা ঝাড়খণ্ড ওড়িশার ছোটোনাগপুর ঘেঁষা এলাকাগুলোতে । আমার বরাবরই পুরুলিয়ার প্রতি একটা আলাদা প্রেম , আলাদা ভালোলাগা রয়েছে । রুখুসুখু এই জেলার ভাণ্ডারে বিবিধ রতনের খোঁজ যারা একবার পাবেন , তাঁরা বারেবারেই ছুটে যাবেন পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে । আমার সহপাঠী ডাক্তার পার্থসারথি নাগের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল পুরুলিয়ারই একজন বিশিষ্ট সরকারি আধিকারিক তাপস মাহাতো-বাবুর । এমন একজন নিপাট পরোপকারী ভালোমানুষের সান্নিধ্য কিম্বা সহযোগিতা পেলে যেকোনো গন্তব্যই হয়ে ওঠে রেশম মসৃণ । আমাদের হঠাৎ আবদারে সাড়া দিয়ে বাগমুণ্ডির টাটা হোটেলে থাকার সুবন্দোবস্ত করে দিলেন উনি । ব্যাস আর কি , দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাতের আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে । বরাভুম স্টেশন পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরেই দুপাশে শুরু হলো রঙের খেলা । ট্রেনে আসার পথে দুপাশে প্রচুর পলাশ দেখেছি ঠিকই , কিন্তু কাছে গিয়ে তার রঙ রূপ সৌন্দর্য অনুভব করার মধ্যে একটা আলাদা মাদকতা আছে । কিছুদুর গিয়েই তাই গাড়ি থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল... পলাশ বনে ক্ষণিক হারিয়ে যাওয়া । দুপাশে চোখ মেলে তাকালেই লাল আবিরের আলিঙ্গন ! পলাশের সঙ্গী কুসুমও । এসময় কুসুম গাছে নতুন পাতা আসে... টুকটুকে লাল পাতা...দূর থেকে দেখে কৃষ্ণচূড়া বা পলাশ বলে ভ্রম হয় । এই এলাকায় কুসুমও অঢেল । ২০১৭ সালের পুজোর পরেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়েছিলাম । তাই এবার আর ট্যুরে অযোধ্যাকে রাখিনি ইচ্ছে করেই । আমাদের প্ল্যানই ছিলো গতবারে সময়ের অভাবে মিস হয়ে যাওয়া খয়রাবেড়া ড্যাম দর্শন আর বাগমুণ্ডির আশপাশের এলাকায় পলাশবনে ঘুরে বেড়ানো এবং নিখাদ ছুটি কাটানো । টাটা হোটেলের ঘরগুলো বেশ ছোটো ছোটো ,সদ্য চালু হওয়ায় অনেক পরিকাঠামোগত ভুলচুক আছে , কিন্তু হোটেলের মালিকের মন বেশ বড় আর উদার...সবসময় একটা মৃদু হাসি ঠোঁটে লেগেই আছে । আপনার যেকোনো সমস্যার কথা একবার জানালেই হল ! সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উদ্যোগী হবেন তার সমাধানে । আর খাওয়াদাওয়াও বেশ সস্তা এবং গুণগত মান খুবই ভালো । আমরা সন্ধ্যার দিকটা স্রেফ সময় কাটানোর জন্য পরপর দুদিন চিকেন আর মাটন রান্না করলাম নিজেরাই, এককথায় ভদ্রলোক অনুমতি দিয়ে দিলেন ! উনি সবই ব্যবস্থা করে দিলেন রুমের বাইরের করিডোরে ... গ্যাস , ওভেন , মশলাপাতি সবই । আর একজন স্টাফ সব ব্যাবস্থাপনা করে দিলেন আমাদের হাতে হাতে । বাগমুণ্ডির এই এলাকাটাতে পলাশ আর কুসুমের ছড়াছড়ি । হোটেলের সামনের উঠোনে , পাশের ফাঁকা মাঠে আর রাস্তার ওপারে অনেকগুলো পলাশগাছ দিগন্ত লাল করে রেখেছে সবসময় । গ্রামের শুরুতেই এই হোটেলের অবস্থান । সকাল হতেই একদল কচিকাঁচা আপনার দরজায় কড়া নাড়বে সদ্য ঝরা টাটকা একগাদা পলাশ নিয়ে সুপ্রভাত জানাতে । সামান্য দু- দশটাকা ওদের হাতে সেগুলোর বিনিময়ে তুলে দিয়ে দেখুন, একটা স্বর্গীয় হাসি উপহার পাবেন । হোটেলের রেস্টুরেন্টের পাশের ফাঁকা জমিটা ছাড়ালেই প্রথম বাড়িটাই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যের । আমরা প্রথমদিনে বেড়াতে বেরিয়েই সাদর অভ্যর্থনা পেলাম । সদ্য পাকা কুলের ভারে ন্যুব্জ একটা কুলগাছ বাড়ির উঠানেই রয়েছে । আমাদের সঙ্গীসাথীরা একবার নাম কা ওয়াস্তে অনুমতি নিয়েই একগাদা কুল প্যাকেটবন্দি করে ফেললো । গ্রামের ভিতরের দিকে যতো এগোবেন পলাশের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে । গ্রামের বাড়িগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে ৫০ মিটার এগোলেই একটা বিশাল পলাশবন । চরাই উতরাই পেরিয়ে একটা উঁচু জায়গা আছে বনের মধ্যেই । সেখান থেকে দূর পাহাড়ের সীমা পর্যন্ত শুধুই পলাশ আর পলাশ গাছ । বেশিরভাগ গাছে সদ্য ফুল ফুটতে শুরু করেছে , কিছু গাছে এখনও কুঁড়ি আসেনি । সব মিলিয়ে মনে হবে কোনও স্বপনপুরিতে এসে উপস্থিত হয়েছেন । দুদিনে আমরা ঘুরে দেখলাম খয়রাবেড়া ড্যাম , পাখি পাহাড় , মাঠা পাহাড় , দুয়ারসিনি জঙ্গল , ছৌ নাচের গ্রাম চড়িদা এবং আদিবাসি অধ্যুষিত গ্রাম নিশ্চিন্তপুর । খুব বেশি দৌড়নোর ইচ্ছে নিয়ে আমাদের এই ট্যুরের পরিকল্পনা কড়া হয়নি , তাই একটু ধীরেসুস্থে সময় নিয়েই আমরা ছোটো এলাকার মধ্যে আমাদের ঘোরাঘুরি সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলাম । তবে হাতে সময় থাকলে আর ইচ্ছে থাকলে অযোধ্যা পাহাড়ের পুরো এলাকা ঘুরে নিতে পারেন একটা গোটা দিন বরাদ্দ করে । আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পলাশ দর্শন... সেই উদ্দেশ্য আমাদের ২০০% পুরণ হয়েছে । থাকা ও খাওয়াঃ টাটা হোটেল ও শান্তি ট্যুরিসট লজ (৮৯৭২৫৩০৯৪৮ /৯৭৩৫৮৮০৫৪১ / ৯০৬৪৩০৩০২২) মা মঙ্গলা ট্যুরিসট লজ ( ৯৮০০৯৩৮৯৫৯ / ৯৫৭২৯৭০৮৮৪ ) এছাড়া বাগমুণ্ডি , চড়িদা , মাঠা পাহাড়ের আশে পাশে অনেকগুলো ছোটোখাটো হোটেল রিসোর্ট গরে উঠেছে । যাওয়া-আসাঃ রাতের আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে বরাভুম স্টেশনে নেমে ৫০০-৬০০ টাকায় গাড়ি নিয়ে ২৫ কিমি দুরের বাগমুণ্ডি ।। প্রদীপ হাজরা
গোকুলনগর। বাংলার আর একটি অল্পখ্যাত গ্রাম, কিন্তু এবারে এটি বাঁকুড়ায়। আর এখানেই আছে এই জেলার সবচাইতে বড় পাথরের মন্দির - গোকুলচাঁদ মন্দির। চারপাশের ধূ ধূ মাঠের মধ্যে একেবারে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাটেরাইট পাথরের এই বিশাল মন্দিরটি - তার দুর্গের মত প্রাকারের মধ্যে বন্দী হয়ে। চারপাশে উঁচু পাথরের প্রাচীর - তার ভেতরে এক পাশে এই মন্দির আর অন্যদিকে তেমনই বিশাল নাটমন্দির। প্রাচীরের বাইরেই আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ড জানিয়ে দিচ্ছে - এই মন্দিরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা - যেটি তৈরি হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ প্রথম রঘুনাথ সিংহের আমলে। প্রাচীরের গায়ে ভিতরে যাওয়ার জন্য খিলানাকৃতি প্রবেশ পথ, তার পাশেই প্রাচীরের সেই গায়েই স্তম্ভের আভাস। ভেতরে ঢুকলে ডানদিকে একটি উঁচু বেদী বা প্লাটফর্মের ওপর সেই মন্দির, বা দিকে নাটমন্দির। প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফিট উঁচু মন্দিরটি পঞ্চরত্ন, মাঝখানের সবচাইতে উঁচু শিখরটি অষ্টভুজাকৃতি, চার কোণের চারটি ছোট শিখর কিন্তু আবার চতুষ্কোণ আকৃতির। মন্দিরটি চওড়া বেদীর মাঝখানে, তার চারপাশেই পরিক্রমার রাস্তা সেই বেদীর ওপর দিয়েই।মন্দিরের সামনে আর দুই পাশে তিন খিলানের বারান্দা। পাথরের মন্দিরের গায়ে অনেক ছোট ছোট মুর্তির কাজ, তবে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ছাপ তাদের ওপর স্পষ্ট। তবু তার মধ্যেই চেনা যায় দশাবতারের মূর্তিকে, কিন্তু পড়া যায়না ওপরের প্রতিষ্ঠা ফলকটিকে। মন্দিরের মধ্যে কোনো মূর্তি নেই, শোনা যায় মূল মূর্তি নাকি বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে। বিপরীত দিকের নাটমন্দিরের মাথার মাঝখানের চাল অনেকদিন আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, তবু একটি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাওয়া যায় ছাতের প্রান্তের অংশে। আর সেখানে উঠলে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যায় সমস্ত এলাকাটি। নাটমন্দির আর মন্দিরের মাঝখানে আর একটি অনেকখানি খোলা উঁচু বেদী, তারপর পাথরের একটি তুলসী মঞ্চ - সেই বেদী আর মন্দিরের মাঝখানে। নাটমন্দিরের দুদিকে তিনটি করে খিলান, দুপাশে ভেতরে যাওয়ার বিশাল প্রবেশপথ। নাটমন্দির এমনভাবে তৈরি যে মন্দিরের দিকের মাঝখানের খিলানের ভেতর থেকেই পুরো মন্দিরটি দেখা যায়। আর নাটমন্দিরের ছাদে উঠলে দেখা যায় মন্দির প্রাচীরের বাইরে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত। মাঠ আর সবুজের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে একাকী এই মন্দির।
শোনা যায়, গোকুলনগর গ্রামে আরো বহু মন্দির ছিল একসময়, যা নাকি ধ্বংস হয়েছিল কালাপাহাড়ের আক্রমণে, শুধু এই মন্দিরটিই কোনোভাবে টিঁকে গেছে। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকতো বিভিন্ন সব মূর্তি, পরে সেগুলির স্থান হয় বিভিন্ন মিউজিয়ামে। এখনো খোলা আকাশের তলায় কিছু শিবলিঙ্গ এখানে ওখানে দেখতে পাওয়া যায়। এমনই একটি আধভাঙা বরাহ মূর্তি আছে এই গোকুলনাথ মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরে - কিছুটা জঙ্গলের মধ্যে। মুর্তির কোমরের নীচের অংশটি মাটিতে প্রোথিত, ওপরের হাতগুলি ভাঙা। তবে মুখ আর মাথার শিরস্ত্রাণ অক্ষত। চারপাশে ভাঙা পাথরের চিন্হ দেখে মনে হয়, এখানেও হয়তো একটি মন্দির ছিল আগে, যা এখন ধূলিসাৎ। কোন রকমে একটি সাময়িক ছাউনি গ্রামের লোকেরা করে দিয়েছেন মাটিতে প্রোথিত সেই সুপ্রাচীন বরাহ মুর্তির ওপরে। আবার একটু দূরে আছে আর একটি মন্দির, সেটি নতুন ভাবে করা, কিন্তু তার মূর্তিগুলি প্রাচীন। ভেতরে দুটি মূর্তি - তার মধ্যে একটি বরাহ মূর্তি। কিন্তু তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে সেটি স্ত্রী বরাহ মূর্তি - যা কিন্তু খুব বেশী দেখা যায় না। বাংলার অনেক অঞ্চলেই এই ভাবে অনেক সম্পদ, অনেক মণি মাণিক্য ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে খোঁজ পাই, হঠাৎ করে পৌঁছে যাই এক বর্ণময় অতীতে - এই সব চিহ্নের পথ ধরে। অতীত কথা বলে ওঠে বর্তমানের কানে, বর্তমান ঘুরে বেড়ায় অতীতে। তবু এক সময়ে সেখান থেকে আবার ফিরে আসতে হয় সেই আলো ঝলমল বর্তমানেই, অতীত পড়ে থাকে তার নিজস্ব আলো হারানো অন্ধকারে। ভ্রমণ সঙ্গী ও তথ্য সূত্র - ইতিহাস সন্ধানী ও ব্লগার - অমিতাভ গুপ্ত। অন্যান্য সূত্র - সোমেন সেনগুপ্ত - দি টেলিগ্রাফ
|
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |