লাদাখ, হিমালয়ের কুম্ভমেলা এবং তার পৌরাণিক ও ভূতাত্ত্বিক গুরুত্ব :-Muktagopal Bhattacharyya10/15/2020
কুম্ভমেলা কথাটার মধ্যেই আমাদের মধ্যে একটা কৌতুহল মিশে আছে। তার মধ্যে আছে কিছুটা ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং কিছুটা মিলনমেলা। কিন্তু শুধুমাত্র মিলনমেলা বা ধর্মীয় ভাবনার কথা বললে বোধহয় কুম্ভমেলার বিষয়ে অনেক কিছু বাকি থেকে যায়। বারো বছর অন্তর ভারতের চারটি জায়গায় অনুষ্ঠিত হওয়া পূর্ণকুম্ভ এবং সিংহস্থকুম্ভ মেলাকে শুধুমাত্র এটা ধর্মীয় মেলা ভাবলে বোধকরি ভুল হবে। এই সত্যটি কোনোমতেই অস্বীকার করা যায়না যে আজকের বানিজ্য ও বিপননের যুগেও যে কোটি কোটি ভারতবাসীর মনের মধ্যে যে একটা অন্তঃসলিলা ‘ভারতবর্ষ’ তপমগ্ন মহাতাপসের মতো আপন মনে বয়ে চলেছে। সেই তপমগ্ন মহাতাপসের স্পর্শ পাওয়ার জন্য এবং অহংবোধের খোলস কুম্ভমেলার সময় পবিত্র নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে নিজের মনের অন্তরের ক্ষুদ্রত্ব অনুভব করার জন্য বোধহয় নানান জীবিকার মানুষ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসে এই কুম্ভমেলায় মনের পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে। এই কারণেই বোধহয় কুম্ভমেলাগুলি নদী কেন্দ্রিক। প্রতিটি মেলার সঙ্গে এক বা একাধিক নদী জড়িয়ে আছে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে পুণ্যস্নানই হল কুম্ভমেলার প্রধান অংশ। স্থান নির্বাচিত হয় বৃহস্পতি ও সূর্যের অবস্থান অনুসারে। বৃহস্পতি ও সূর্য সিংহ রাশিতে অবস্থান করলে নাসিকের ত্র্যম্বকেশ্বরে; সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করলে হরিদ্বারে; বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে এবং সূর্য কুম্ভ রাশিতে অবস্থান করলে প্রয়াগে; এবং সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করলে উজ্জয়িনীতে মেলা আয়োজিত হয়। আবার সূর্য, চন্দ্র ও বৃহস্পতির রাশিগত অবস্থান অনুযায়ী মেলা আয়োজনের তিথি বা তারিখ নির্ধারিত হয়। আমাদের অর্থাৎ সমস্ত ভারতীয়দের কুম্ভমেলা নিয়ে ধ্যান ধারণা বা পৌরাণিক ভাবনা চিন্তা শুধুমাত্র এই চারটি জায়গায় অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলা নিয়ে। কোথাও অর্ধকুম্ভ, কোথাও পূর্ণকুম্ভ বা সিংহস্থ কুম্ভ আবার কোথাও মহাকুম্ভ। অবশ্য মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয় ১৪৪ বছর পর পর। অর্থাৎ এগারোটি পূর্ণকুম্ভের পর দ্বাদশতম পূর্ণকুম্ভোই হলো মহাকুম্ভ।
--২--- আমার এই প্রতিবেদনটি ভারতবর্ষের ওই চারস্থানের কুম্ভমেলাকে নিয়ে নয়। এটি হিমালয় পর্বতের ১২০০০ফুট উচ্চতার উপর লাদাখের হেমিস গুম্ফা এবং তার সংলগ্ন এলাকায় আয়োজিত আমার দেখা "হিমালয়ের কুম্ভমেলাকে" নিয়ে। যদিও লাদাখ পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত ওই কুম্ভমেলা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিলনা এবং আমার উদ্দেশ্য ছিল লাদাখ নামের ওই সাদা স্বর্গ দেখা, যে স্বর্গ বছরের প্রায় সাত মাস বরফের তলায় থাকে। কিন্তু ওই হিমালয়ের কুম্ভমেলা ও তার সংলগ্ন এলাকা দেখার পর, আমার মন ও চোখের সামনে ভেসে এসেছিল ভূবিজ্ঞান মিশ্রিত পূরাণ সম্পর্কিয় কিছু রহস্য যার সমাধান আমি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি।
--- ৩------
২০১৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় দিল্লি থেকে লাদাখগামী গোএয়ারের ফ্লাইট ধরেছিলাম লাদাখ যাবার উদ্দেশ্যে। লাদাখ যাবার সময় ফ্লাইটের জানলা দিয়ে হিমালয় পর্বতমালার তুষারাবৃত হিমাদ্রি শিখরগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম, আমরা সুবিশাল বরফে ঢাকা গিরিরাজ হিমালয়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি, যার সুদীর্ঘ এবং আগাগোড়া বরফে আচ্ছন্ন শৃঙ্গগুলো যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের ছোঁয়ার জন্যে তাকিয়ে রয়েছে। সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ ওই তুষার-ধবল আর্দ্র পর্বতশৃঙ্গগুলোতে হিল্লোলিত হয়ে নানান বর্ণের সমাবেশে প্রতি মূহুর্তে এক অপূর্ব সৌন্দর্য প্রতিফলিত করে চলেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম ওই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করা তো কোন ছাড়, পৃথিবীর কোনো চিত্রকরের তুলিতেই সেই অপূর্ব দৃশ্যের সামান্য প্রতিকৃতিও অঙ্কিত হতে পারে না। ওই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মনেহলো, বতর্মান জগতের আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত মানুষের ক্ষমতার গর্ব, এই বিরাট বিশাল নগ্ন সৌন্দর্যের কাছে এসে স্তম্ভিত হয়ে, প্রতি মুহূর্তে নূতন বর্ণে সুরঞ্জিত অভ্রভেদী শৃঙ্গগুলোর দিকে তাকিয়ে, নিজের ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে করতে, নতজানু হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে আমাদের বিমান হিমালয় পর্বতমালার শিবালিক, ধৌলাধর, গ্রেটার হিমালয় ও ঝনস্কার রেঞ্জ পার হয়ে লাদাখ রেঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে ভারতের সর্বোচ্চ এবং উচ্চতার নিরিখে পৃথিবীর বাইশতম উচ্চ, লেহ শহরের লাগোয়া কুশক বাকুলা রিমপোচি বিমান বন্দরে নেমে পড়েছিল। আমরাও ১০৬৮২ ফুট উচ্চতার কোনো বিমান বন্দরে প্রথম পদার্পণ করেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে লেহ শহরে যাবার পথে গাড়িতে বসেই দেখছিলাম বিশাল বিশাল পোস্টার, হিমালয়ের কুম্ভমেলার। প্রতি বারোবছর পর আয়োজিত কুম্ভমেলার শুরু হয়েছিল ১৬-০৯-২০১৬ থেকে। আমরা লাদাখ পৌঁছেছিলাম ১৩-০৯-২০১৬, অর্থাৎ তার তিন দিন পূর্বে। হিমালয়ের কুম্ভমেলার সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণাই ছিলনা। তাই হিমালয়ের কুম্ভমেলা দেখবার আশায় মনটা খূশীতে ভরে উঠেছিল। (ক্রমশ - পরবর্তী পর্ব ১৬/১০/২০২০ র পর)
0 Comments
লাদাখের রিং পোঁচে বিমানবন্দরে যখন উড়োজাহাজের চাকা ছুলো তখন ঘড়িতে ঠিক সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিট । দিল্লি থেকে লেহ শহরে আসতে সময় নিয়েছে প্রায় ১ ঘণ্টা। বিমানের ভেতর বসে শুনতে পেলাম বলছে বাইরের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী, তাই গায়ের টি শার্টের উপর চাপিয়ে নিলাম নরম জ্যাকেটটা আর বিমানের বাইরে আসতেই দূর ধূসর পাহাড়ের শীতল রুক্ষ হাওয়ায় কেঁপে গেল শরীর । যেদিকে চোখ যায় শুধু খয়েরী রুক্ষ ধূসর পাহাড়ের সারি যার মধ্যে সূর্যের প্রথম আলো মিশে তৈরি করেছে এক বিচিত্র পাহাড়ি নেশা। কনকনে হাড় হিমকরা শীতল রুক্ষ বাতাস, দিগন্তবিস্তৃত ধূসর পাহাড়ের সারি, মাথার উপর অসীম নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা আর তার ছায়া এসে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে, ভারতের সবচেয়ে উঁচু বিমানবন্দরে তথা লেহ শহরে আপনাকে স্বাগত ।
ব্যাগপত্র নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখি সারি সারি গাড়ী, তারমধ্যেই বেশ টিকালো নাক অনেকটা ওয়াসিম আক্রমের মত দেখতে গাড়িচালকের গাড়ীতে চললাম লেহ শহরের ভিতরে। আমার মত বোহেমিয়ানরা আগে থেকে কিছুই ঠিক করে রাখেনা এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি এদিক ওদিক ঘুরে ঠাই হল ইরফান গেস্ট হাউসে। এখানে থাকার দুটো কারন পাশেই অনেক রেস্তোরাঁ তাতে অনেক বিদেশী খাবার পাওয়া যায় আর ঘরের ভাড়াও খুব সস্তা আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু গেস্ট হাউসের ভিতরের একটা আপেল গাছ তাতে ছেয়ে আছে লাল টুকটুকে আপেল। ফ্রুট জুস, দই চিজ লেতুশপাতা দিয়ে তৈরি salad চিকেন কিমা দিয়ে বানানো sandwich সাথে পাঁঠার কলিজার ডিপ frayed কিমা, ডিমের পোঁচ, সাথে হট চকলেট। ইস্রায়েলি এই ডিশ শেষ করতে অনেকসময় লেগে গেল। যেহেতু দিল্লি থেকে লেহ মাত্র ২ ঘণ্টায় এসেছি এতটা উচ্চতায় তাই আজ বিশ্রাম পাহাড়ি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে acclimatization. দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং বহু পাহাড়ে ট্রেক করে এইটা জেনেছি পাহাড়ে গিয়ে আপনাকে আগে তার পরিবেশ তার উচ্ছতার সাথে নিজের শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে তারপর অন্য কাজ। আজ তাই লেহ শহরে একটু হাঁটাহাঁটি, দুপুরে লেহ প্রাসাদ এক্সপ্লোর আর বিকেলের দিকে শহরের মাঝে অবস্থিত মনাস্ত্রিতে নিজেকে মিশিয়ে দেবো পাহাড়ি আধ্যাত্মিকতার সাথে। কারন পরশু থেকে শুরু হবে মারখা ভ্যালি ট্রেক তার আগে কাল ইতিহাস প্রসিদ্ধ লেহ শহরের বিখ্যাত গুম্ফা গুলোকে আবিস্কার করার পালা। পরেরদিন সকালে জাসুং গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে বলল-today is your day man, Lets explore leh the city of castles.যাত্রা শুরু করার আগে সামনের বুদ্ধ মূর্তির দিকে তাকিয়ে নিজের মনকে একাগ্র করার চেষ্টা করছিলাম, সামনে দুজন বিদেশি ধ্যানে সম্মোহিত হয়ে হারিয়ে ফেলেছে কালের সিমা। মনে মনে বলছিলাম- অহংকার নয়,হিংসা নয়,ego নয়, মানুষকে ভালোবাসো প্রান খুলে পৃথিবীর উষ্ণতা নয় মনের উষ্ণতা বাড়ুক।
দাখকে বলা হয় city of gumphas বুদ্ধের দেশ,তাই লক্ষ্য ছিল ৩ টে অতি প্রাচীন শাশ্বত গরিবান্বিত হেমিস,থিক্সে আর সে গুম্ফা। প্রথমেই আমাদের গাড়ি ছুটল হেমিস monastryr পথে,পাশে দেখা হল সিন্ধু নদের সাথে। এগারো দশকের আগে স্থাপিত এই হেমিসের ইতিহাস আজও আমাদের স্তব্ধ করে দেয়, শোনা যায় প্রভু যীশুও এখানে এসে বৌদ্ধ ধর্মের শান্তির পবিত্রতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। গুম্ফার ভিতরের মিউজিয়াম টা দেখতেই হবে, এছাড়াও প্রভু রিং পচেকে সম্মান করে সারা পৃথিবী খ্যাত হেমিস উৎসব অসাধারণ। লামাদের নৃত্য ও তাদের গভীর মন্ত্রোচ্চারণ আপনাকে পাহাড়ের বুকে প্রশান্তির বানী শুনাবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি লাল বস্ত্র পরা সব লামারা ব্যাস্ত নিজেদের কাজে, যেহেতু নভেম্বরের শেষের দিক তাই বেশ টাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, হটাত শরীরে স্পর্শ করল স্নেহের পরশ। এক সৌম্যদর্শন বৌদ্ধ লামা আমাকে পরিয়ে দিল মোটা পশমের চাদর। শুনছিলাম প্রাচীন এই মনাস্ত্রি ১৬৭২ সালে রাজা সেন গে নেমেগাল নতুন করে এই গুম্ফা সংস্কার করেছিলেন। বিদায়ের পথে খয়েরী পাথরের বুকে সাদা হেমিস মনাস্ত্রি হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।
Hemis monastery থেকে আমাদের গাড়ী ছোটা শুরু করলাম ২৫ কিলোমিটার দুরের থিক্সে মনাস্ত্রির পথে। লেহ শহরের গর্ব এই থিক্সে গুম্ফা প্রায়১১৯০০ ফুট উঁচুতে সিন্ধু নদের উপত্যকার গায়ে অসংখ্য স্তুপ, থাংকা,দেওয়ালে আকা প্রতিকৃতি নিয়ে তৈরি। ১৫ শতাব্দীর শেষের দিকে সংপা বলে একজন ধর্মগুরু তার এক অনুগামী সেরাব জাংপকে একটি আমিত্যর মূর্তি ও নিজের রক্ত দিয়ে সেই মূর্তিকে স্থাপন করতে বলেন, পরবর্তী কালে জাংপ সেই মূর্তি লাদাখের রাজাকে দান করলে রাজা খুশী হয়ে জমি দান করেন এবং সেখানেই এই থিক্সে গুম্ফার কাজ শুরু হয়। এই গুম্ফার প্রধান আকর্ষণ মৈত্রেয় বুদ্ধ। ৪৯ ফুটের এই বিশাল বুদ্ধ মূর্তি লাদাখের অন্যতম।
থিক্সে গুম্ফার ইতিহাস গায়ে মেখে আমরা ছুটলাম সে গুম্ফার পথে,লেহ শহরের দক্ষিণে ১৫ কিমি দূরে এই গুম্ফার স্থাপনকাল প্রায় ১৬৫৫ সাল। মানালি থেকে লেহ আসার পথে সড়কপথে এই গুম্ফা পরে। shey ছিল লাদাখের প্রাচীন রাজধানী কেউ কেউ বলে এই গুম্ফার বয়েস নাকি হেমিস গুম্ফার থেকেও বেশী। থিক্সে গুম্ফা থেকে ধুলোমাখা শীতল মরুভুমি আর তার মাঝে শ্বেতশুভ্র chorten পেরিয়ে অনেকে আসে সে গুম্ফাতে। লেহ শহরের প্রাচীন ইতিহাস বহন করে এই তিন গুম্ফা, ইতিহাসে বুঁদ হয়ে আমরা চললাম শান্তি স্তূপের পথে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে। হোমাগ্নি ঘোষ ।
সাত সকলে পাটনি টপের ঠান্ডায় গরম গরম ফুলকো লুচি সহযোগে আলুর তরকারি দিয়ে সকালের খাওয়া সেরে আমরা রেডি হয়ে নিলাম পরবর্তী গন্তব্যস্থল পহেলগাঁও যাবার জন্য। এতো সুন্দর একটা হোটেল আর ততোধিক সুন্দর একটা জায়গা ছেড়ে আসতে মন না চাইলেও যেতে হবেই, তাই মনোকষ্ট নিয়েই উঠে পড়া বাসে। প্রায় ঘণ্টা আটেকের একটা লম্বা জার্নি কিন্তু আশপাশের সৌন্দর্যের কারনে সেটা আমরা সবাই বেশ উপভোগ করছিলাম। রাস্তায় পড়লো কুখ্যাত অনন্তনাগ, গাইড বলছিলেন এই সময় আমরা যেন একটু সাবধানে থাকি আর বাস থেকে যেন ছবি না তুলি। দেখছিলাম যে শহরটা কিন্তু খুব সুন্দর আর বর্ধিষ্ণু। চওড়া রাস্তা, বাড়ি ঘরগুলো ভীষণ সুন্দর আর প্রতিটাই আলাদা আলাদা রকমের, তবে দোতলা তিনতলার বেশী উঁচু কোনো বাড়ি বিশেষ চোখে পড়লো না। কোনো গন্ডগোলের চিহ্নও দেখতে পেলাম না, সেটা আমাদের জন্য ভালোই হোলো। এবার রাস্তার ধারে পড়তে লাগল মাথায় বরফের সাদা টুপি পড়া নাম না জানা সব পর্বতশৃঙ্গ, বাসের মধ্যে তখন কে কিভাবে সেই সব দৃশ্য ক্যমেরাবন্দি করতে পারে তার উত্তেজনা। যত গাড়ি এগোচ্ছে তত পাহাড়গুলো কাছে চলে আসছে। এবার রাস্তার অন্য পাশে দেখা দিলো লিডার নদী, সূর্য্যের আলোয় চিক চিক করছে তার জলধারা আর সে চলেছে তার নিজের ছন্দে লাফাতে লাফাতে। ছবি কি পারে এ দৃশ্য ধরে রাখতে, তবে চেষ্টা করতে তো আর কোনো দোষ নেই। এদিকে বাসের মধ্যে আমরা ব্যতিব্যস্ত সবার সেই চেষ্টার চোটে। এক দিকে পাহাড় আর অন্য দিকে নদী দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম পহেলগাও। এই হোটেলটা আগেরটার মতন ভালো না হলেও একদম লিডার নদীর ধারে আর সামনেই বিরাট পাহাড়, জানলার পর্দা সরালেই অপূর্ব দৃশ্য। রাস্তায় নামার আগেই আমরা ঘেরাও হয়ে গেলাম শালবালা আর আখরোটবালাদের ভীড়ে এরা আমাদের জন্য হোটেলের নিচে অপেক্ষা করছিল আমরা বাস থেকে নামা ইস্তক। এতো সস্তায় এতো ভালো মাল যে আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয় সেটা আমাদের বুঝিযেই ছাড়বে। তবে সামনেই আছে অনেক দোকান, সবার নামের শেষে "শাল ফেক্ত্রী"। মেয়েদের আর রাখে কে, শুরু হয়ে গেলো কেনাকাটা। অতএব রাস্তায় নামা, কিন্তু সামনের চৌমাথায় পৌছানোর আগেই দেখি আকাশের মুখ ভার। কালো মেঘ জমছে সাদা পাহাড় চূড়ার আশেপাশে। নেমে গেলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমরা কোনোরকমে দৌড়ে হোটেলে ফিরলাম। রাস্তা ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলো, ঠান্ডাও পড়তে লাগল জাঁকিয়ে। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলার পর্দা সরাতেই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। সামনের পাহাড়টার পুরো মাথাটা ঢেকে রয়েছে বরফে, অবিস্ম্ণরণীয দৃশ্য। আজ আকাশ পরিস্কার, আস্তে আস্তে আলো ফুটতে শুরু করলো, বরফের উপর সেই আলো পড়তে মনে হলো যেন পাহাড় গুলোর মাথায় আগুন ধরে গেছে। এ জিনিস আগে কখনও দেখি নি। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা আলাদা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ঘুরতে প্রথমে আরু ভ্যালী - সবুজ মখমলের মতন ঘাসে ঢাকা বিরাট এক প্রান্তর, একদিক ঘেরা চীনার গাছে আর অন্য দিকে দাঁড়িয়ে বিরাট পাহাড় যার মাথা ঢাকা সাদা বরফে, শুনতে পেলাম এখানে শুটিং হয়েছে প্রচুর জনপ্রিয় হিন্দী ফিল্মের। ছবি তোলা সাঙ্গ করে সেখান থেকে বেরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম বেতব ভ্যালি। এখনেই শুটিং হয় বেতাব সিনেমার। জায়গাটা কিন্তু অপূর্ব, সবুজ ভ্যালির মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে লিডার নদী। দূরে দেখা যাচ্ছে বরফে মোড়া পাহাড়শ্রেণী, সিনেমার শুটিং হয়েছিল বা এখনো হয় বলে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটা কাঠের বাড়ি। সেগুলো দেখতেও যত সুন্দর আবার নদীর ধারে সবুজ ঘাসের উপর সেগুলো হয়ে উঠেছে আরো মনমুগ্ধকর। ঘুরে বেরিয়ে 100/- টাকা টিকিটের পুরটাই উসুল। তাই ফেরার রাস্তাতেও গাড়ির মধ্যে থেকেও চললো ছবি তোলার পর্ব। এরপরের গন্তব্যস্থল চন্দন বাড়ি। অমরনাথ যাত্রার হাঁটা পথের শুরু এখান থেকে। পাথুরে রাস্তায় একটু এগিয়েই চোখে পড়লো বরফ। এই ট্যুরে আমাদের এই প্রথম বরফ দর্শন, যদিও ধুলোয তাতে ছোপ পড়েছে কিন্তু তাতে কি বরফতো। চললো দৌড়া দৌরি আর একটু উঠেই নামার সময় সব পড়তে লাগলো ধপাধপ। গুঁড়ো বরফ দারুন পিছল হলেও আছাড় খেয়েও উৎসাহের কোনো কমতি নেই কারো। এখান থেকে আমাদের ফেরা হোটেলে আর তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বের হলাম বাজার করতে। শুনতে পেলাম যে এখানে জিনিষ পত্রের দাম শ্রীনগরের তুলনায় কিছুটা সস্তা। ফলে জা হওয়ার তাই হোলো, সব দোকান বন্ধ হবার পর সবাই ফিরল হোটেলে। আগেরবার যেখানে ছিলাম সেটা খুঁজে না পেলেও স্মৃতি কিছুটা সাথ দিচ্ছিলো মনে পড়ে যাচ্ছিলো অনেক কিছু। তবে পহেলগাঁও এক কথায় অসাধারণ। রাতটা এখানে কাটিয়ে এবার যেতে হবে শ্রীনগর॥ সেটা জানাব এর পরের তৃতীয় পর্বে ....
পহেলগাঁও থেকে প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের বাস জার্নি করে পৌছলাম শ্রীনগরে। রাস্তায় পড়লো সদ্য চালু হওয়া চোদ্দ কিলোমিটার লম্বা সেই সুড়ঙ্গ পথ যেটা উদ্বোধন করেন আমাদের PM। এতে আমাদের চলার রাস্তা কমে গেলো বেশ খানিকটা। রাস্তা অপূর্ব পাহাড় আর নদীতে মেলানো। হু হু করে গাড়ি চলেছে মখমলের মতো সমান রাস্তা দিয়ে। প্রচন্ড রোদ কিন্তু এখানের নিয়মে বাসের জানলায় পর্দা দেওয়া যাবে না তাই বাসের জানলায় সঙ্গের শাল টাঙ্গিয়ে কোনো রকমে সামাল দেওয়া গেলো ওই কড়া রোদের। বাসথেকেই দেখতে পেলাম এক জায়গায় প্রচুর লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট ব্যাট বিক্রি করছে, গাড়ি দেখতে পেলেই এগিয়ে আসছে জানলার কাছে, জানলাম এখানেই এগুলো তৈরি হয়। সারা রাস্তায় প্রচুর মিলিটারি পাহারা দিচ্ছেন কিন্তু কেউ আমাদের অহেতুক বাস থামিয়ে বিরক্ত করলেন না, একবারে গিয়ে বাস দাঁড়ালো পামপুরের একটা বড় দোকানের সামনে। শুনেছিলাম এইখানেই চাষ হয় কেশরের, দোকানে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের ড্রাই ফ্রুট সঙ্গে কেশর আর শীলাজীত। ওরা জানালেন যে কেশরের ফুল ফোটে oct - nov মাসে। অতএব কেনা হোলো ডিবেতে প্যাক করা কেশর, দাম প্রতি গ্রাম 250/-।
শ্রীনগরের হোটেলটা একেবারে ডাল লেকের পাশেই কিন্তু ঘরের জানালা দিয়ে ডাল লেক দেখা যায়না। আমরা অক্লান্ত তাই এতটা জার্নির পরেও মাল পত্র রুমে রেখেই ওই দুপুর রোদে আমরা সোজা ডাল লেকের সামনে। ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম প্রায় 40বছর আগে দেখা স্মৃতির ডাল লেক। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে প্রচন্ড রোদের মধ্যেই আমরা দর দস্তুর করে উঠে পরলাম একটা শিকরাতে। শিকরায রাজোর মতন বসে ভেসে চললাম ডালের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে চললো পুরনো স্মৃতি রোমন্থন। আশে পাশে চলে আসছে লোকাল শিকারায ভেসে বেড়ানো দোকান, তাতে পাওয়া যাচ্ছে তাজা ফুল, ঠান্ডা আইসক্রিম, পোড়ানো ভুট্টা, কেশর প্রভৃতি। আমরা কিনব না আর বিক্রেতারাও নাছোড়, চলেছে আমাদের পাশাপাশি। আমাদের আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল কারুর সঙ্গে কড়া কথা না বলার জন্য, তাই আমরা হাঁসি হাঁসি মুখেই ওদের প্রত্যাখ্যান করছিলাম। আমাদের শীকারার মাঝিও ততক্ষণে আমাদের ব্যপারটা বুঝে গিয়ে ছিল তখন সেও তার লোকাল ভাষায় এই প্রত্যাখ্যানে আমাদের সাহায্য করছিলো। হটাৎ সে বোট দাঁড়করালো লেকের মাঝে একটা বড় বোটের গায়ে, কিনলো চায়ের মতো কি একটা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওটা কাশ্মিরী চা ''কাবা", শুনে আমার গিন্নীও নিলেন এক কাপ। আমাদের সামনেই জাফরান, বাদাম ও কিছু মশলা মিলিয়ে তৈরী হোলো কাবা আর সেটাতে চুমুক দিয়ে বৌ -মেয়ে দুজনই ফিদা। আমরা যেখান থেকে শীকারায উঠলাম সেটা ডাল ক্যানাল আর তার পরের বিরাট অংশটা হচ্ছে ডাল লেক। জলে কিন্তু একটা পঁচা দূর্গন্ধ আর জলের তলায় প্রচুর শ্যেওলা। তবে শুনতে পেলাম যে সরকার দুটো বিরাট বিরাট মেশিন চালিয়ে লেকের শ্যাওলা পরিষ্কার করছেন। কাজ শেষ হলে লেকটি বেশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। লেকের ধারে ও মাঝে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের হাউস -বোট আমরা চললাম সেগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে। কিছু কিছু জায়গায় জলে নোংরা এতো বেশী যে তোর ওপর চাষ আবাদ হচ্ছে, তাকে নাম দেওয়া হয়েছে hanging garden। রয়েছে মিনা বাজার, যেখানে বড় বড় হাউস বোটের উপর তৈরি হয়েছে দোকান আর সেখানে বিক্রি হচ্ছে কাশ্মিরী কাজের নানা জিনিষ পত্র, দাম কিন্তু একটু বেশীই। সব ঘুরে ফিরতে ফিরতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তখন ডালের আরেক রূপ। নিকষ কালো লেকের জলে তখন ঝলমল করছে হাউস বোটের আলো তৈরি করেছে এক অপার্থিব আলো ছায়া। এই সব কিছু ধরে রাখলাম মনের মিণিকোঠায় আর চেষ্টা করলাম তার কিছু ধরে রাখতে ছবির মাধ্যমে॥ পরের পর্ব আবার পরে
আজ 02-06-2018 শ্রীনগর বন্ধ, কিন্তু আমরা আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী বাসে উঠে চললাম শোনমার্গ। গন্ডগোলের কথা মাথায় রেখে একটু সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম, রাস্তা ঘাট একদম ফাকা ফলে গাড়ি ছুটলো সাঁই সাঁই করে। প্রায় ঘণ্টা চারেকের জার্নি, মাঝে দু-এক বার গাড়ি থামলেও কিছু টহল দেওয়া মিলিটারী ছাড়া কিছুই চোখে পরে নি। বেলা বারোটা নাগাদ পৌছালাম শোনমার্গ। চারিদিক সবুজে সবুজ এমনকি বাড়িগুলোর মাথাও সবুজ, পাহাড়ী ঢালে বাড়ি গুলাকে লাগছে খুব সুন্দর। মাথার উপর কটকটে রোদ, শুনলাম বরফ পেতে গেলে যেতে হবে '0' পয়েন্ট। সেটার জন্য ভারা নিলাম লোকাল জীপ। জীপ উঠতে লাগল পাহাড়ের উপরে, একদিকে সবুজ পাহাড়ী ঢাল আর তারপরেই বরফে ঢাকা পাহাড়। রাস্তায় যে বরফ ঢাকা পিক গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে সেগুলো চলে এলো একেবারে হাতের মুঠোয়। আর তারপর রাস্তার দুধারে শুরু হোলো বরফের আস্তরণ। জমে থাকা বরফে পড়েছে ধুলোর প্রলেপ ফলে আমরা ব্যপারটা বুঝতেই পড়ছিলাম না। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতেই হাতের মুঠোয় ওই বরফ তুলে আমাদের হাতে দিতেই আমাদের হইচই শুরু। তখন কারুর যেন আর তর সইছে না গাড়ি থেকে নামার জন্য। তবে আর একটু এগিয়েই জীপ এসে দাঁড়ালো পাহাড়ের নিচের একটা ফাঁকা প্রান্তরে, সামনে সাদা বরফের রাজ্য। গায়ে গরমের জামা চাপিয়ে পায়ে গামবুট পরে সবাই নেমে পড়লাম বরফে। কি মজা, এর জন্যেই তো এতো দূর আসা। পায়ের তলায় ঠান্ডা বরফ আর মাথার উপর গনগনে রোদ, সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ঘেমে ভিজে যাচ্ছি কিন্তু গরম জামা রাখতে যেতে হবে সেই জিপের কাছে। অতটা সময় নষ্ট করতে মন চাইছে না, তাই অত গরমেও গায়েই রইল সব কিছু। ঘণ্টা খানেক বরফে কাটিয়ে ড্রাইভারের ডাকে আসতে মন না চাইলেও ফিরে আসতে হোলো জিপে। তারপর আবার শ্যোনমার্গএ ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা ধরলাম ফেরার রাস্তা। আজ কিন্তু বরফ দেখে মন ভরে গেছে। ফেরার পথে বাসের ড্রাইভারকে অনেক জপিযে ঘুরে নিলাম হজরত বাল মসজিদ, এখানে রাখা আছে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের একটা চুল যেটা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। আমরা যখন ওখানে পৌঁছেছি তখন ওখানে চলেছে নামাজ পাঠ, তাই আমাদেরকেও ঢুকতে হোলো রুমাল দিয়ে মাথা ঢেকে। ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেল, তখন পড়ন্ত বিকাল। যাওয়া ও আসার দুই বারই বাস গিয়েছিল ডাল লেকের গায়ের রাস্তা ধরে তাই প্রাণ ভরে দেখে নিলাম ডালের রূপ। কালকের ঘটনার জেরে আজ শ্রীনগর বন্ধ কিন্তু কাপড় জামার বাজার বসেছে ডাল লেকের গায়ের রাস্তা বরাবর, যদিও নেটও বাজার দুটোই বন্ধ রয়েছে। কাল শ্রীনগরে আমাদের শেষ দিন, বাকি আছে মোঘল গার্ডেনগুলো ঘুরে দেখা আর বাজার করা। এগুলো জনাবো পরের পর্বে
কাশ্মীর ভ্রমণের শেষ অংশটা আর সময় মতো লেখা হোলো না কেবল মাত্র নিজের অলসতায়। যাইহোক সেই ব্যাপারে এখন জানাচ্ছি। শ্রীনগরের শেষ দিনের সকালের জল খাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মোঘল গার্ডেন গুলো ঘুরতে। ডাল লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে চলার শুরু। তবে কিছুটা গিয়েই বাস ডানদিকের একটা রাস্তা ধরে পৌঁছালো চশ্মেশাহীর সামনে। এখন সব মোঘলগার্ডেনে ঢোকার জন্য টিকিট লাগে, তাই টিকিট কেটেই লম্বা সিঁড়ি দিয়ে উঠে লাল পাথরের গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম বাগানে। সুন্দর ফুলে ঘেরা সাজান বাগান, দেখে মন জুড়িয়ে যায়। কত যে সিনেমার শুটিং হয়েছে এই সব বাগানে তার আর ইয়ত্তা নেই। এখানে একটা জলের উৎস আছে যাতে সেরে যায় অনেক পেটের অষুখ, আমরা অবশ্য সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করিনি। মাথার উপর তখন গনগনে সূর্য্য, অনেকেই ঘুরছেন ছাতা মাথায়। তাতেও পুরো বাগানটা ঘোরা প্রায় অসম্ভব তাই কিছুটা ঘুরে বেরিয়েই নেমে এসে বাসে বসে বিশ্রাম নিলাম। দেখলাম বয়স্ক যাত্রীদের অনেকেই একই পথের পথিক। এর পর নিষাদ বাগ, শালিমার বাগ ঘুরে হেঁটে হেঁটে আর সিঁড়িতে ওঠা নামা করে করে আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। সব বাগান গুলোই বিরাট বিরাট আর ফুলের গাছ দিয়ে সুন্দর করে সাজান আর সব বাগানের মাঝ বরাবর আছে একটা জলের ধারা আর তাতে রয়েছে অগুন্তি ফোয়ারা। এগুলো এমন ভাবেই তৈরি যে সবসময় জল বয়েই চলেছে। বিকালটা রাখা ছিল কেনাকাটার জন্য। ডাল গেটের বাজারটাও অবশ্য আমাদের হোটেলের কাছে, আর হোটেলের পাশেই রাস্তার ধারে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বসে যায় জমজমাট বাজার পাওয়া যায় কাশ্মিরী কাজ করা শাল, কাজ করা গরম কাপড়ের সালোয়ার পিস, সোয়েটার, জ্যাকেট প্রভৃতি। চলে দর দস্তুর, মেয়েদের আবার তাতেই আনন্দ। ফলে সহজেই যোগ হয়ে গেলো আর একটা বাড়তি লাগেজ। দলের কয়েকজন ওখান থেকেই প্লেনে ফিরে গেলেন কলকাতা কিন্তু আমরা যাব কাটরা হয়ে, voishna devi দর্শন করে। পরের দিন সকালে ঘণ্টা আটেকের বাস জার্নির শেষে আমরা পৌছালাম কাটরা, এবার চিন্তা পাহাড়ে উঠে দেবী দর্শনের। দেখেছিলাম ওখানে হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে আর তার টিকিট পাওয়া যায় অনলাইনে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেটা ম্যানেজ করতে না পেরে চিন্তা ছিলো আমার গিন্নীকে নিয়ে কেননা ওর হার্টের অপারেশান হয়ে গিয়েছে আর আমাদের কারুরই অতটা হাঁটার অভ্যাস নেই। যদিও অনলাইনে দেবী যাত্রার ছবি দেখে দেখে হেঁটে ওঠার জন্য কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেছিলাম। তবুও মনে ভয় একটা ছিলই। কাটরার হোটেলটি খুব আরামদায়ক, ac গুলোও ভালো কাজ করছে কিন্তু আমরাতো রাত্রে হাঁটবো তাই ওদিকে আর তাকাচ্ছিলাম না। আমি কলকাতার থেকে অনলাইনে আমাদের সবার যাত্রা পরচি নিয়েছিলাম কিন্তু সেটা কোনো কাজে আসলো না, তাই আমাদের সবাইকে হেঁটে গিয়ে ছবি তুলিয়ে নতুন পরচি নিতে হোলো। একটু কম খেয়ে রাত নটা নাগাদ হোটেল থেকে অটো নিয়ে পৌছালাম বানগঙ্গা চেকপোস্টে, অত রাতেও প্রচুর লোক চলেছেন দেবী দর্শনে। পরচিতে ছাপ মাড়িয়ে আমরা হেঁটে উঠতে লাগলাম দেবী দর্শনে, আর ঘোড়াবালারা দর হাঁকচে ঘোড়া প্রতি দুহাজার করে কেবল যেতে। ওরা এতই বদমাইশ যে বলার কথা নয়, আমাদের সঙ্গে এঁটে আছে এটুলির মত। কিছুক্ষন চলার পর রাস্তার দুদিকে শুরু হোলো বিভিন্ন জিনিষের দোকান, পাওয়া যাচ্ছে খাবার দাবার, লাঠি ইত্যাদি। আমরাও সবাই একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম, চলতে চলতে সেই লাঠিতে ভর দিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। বেশ চলছিল এই ভাবেই। হটাৎ একটা বাচ্চা মেয়েকে পিঠে নিয়ে একটা ঘোড়া খেপে গিয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ধাক্কা মারল গিন্নিকে, আর সে পপাত ধরণীতলে। এতো জোর লেগেছিলো যে আমরা দৌড়ে গিয়ে ধরা সত্তেও উঠে বসতে পারছিল না। আশেপাশের দোকানদাররাও ছুটে এলেন ওর সাহায্যের জন্য। ধরাধরি করে কোনরকমে ওকে বসান হোলো ওই দোকানের একটা বেঞ্চে, ভাবলাম যে আমাদের যাত্রা বোধহয় এখনেই শেষ। কিন্তু দেবী চাইলে কি না হয়, কিছুক্ষণ বসার পর গিন্নী আস্তে আস্তে সুস্থ্য হতে লাগলেন আর হাত ও পায়ের ওই রকমের যন্ত্রণা সহ্য করেও আস্তে আস্তে আবার উঠে দাঁড়ালেন। এবার আর রিস্ক নেওয়া গেলো না, দর দস্তুর করে প্রত্যেকে উঠে পড়লাম আলাদা আলাদা ঘোড়ায়। অর্ধকুমারী পর্যন্ত নিয়ে যাবে বলে কথা থাকলেও নামিয়ে দিলো তার অনেকটা নিচের একটা আস্তাবলে। এর পরের রাস্তা বেশ খাড়াই হলেও আমরা তখন নিরুপায়। কষ্ট হলেও উঠছি আস্তে আস্তে, লঠিতে ভর করে। ডানদিকে পড়লো একটা ছোট্ট হাসপতালের ঘর, রাত্রি বলে তার সামনের ফাঁকা জায়গায় সপরিবারে শুয়ে আছেন অনেক ভক্ত। তাদের মাঝখান দিয়েই সাবধানে কাটিয়ে কুটিযে ভেতরে ঢুকেই দেখা পেলাম এক ডাক্তারবাবুর, সব শুনে একটা কাগজে একটু ব্যাথা কমার মলম লাগাতে দিলেন আর দিলেন একটা খাবার বড়ি। তিনি অভয় দিলেন এতেই হেঁটে হেঁটে দেবী দর্শনে যাওয়া যাবে। ওষুধ খেয়ে, লাগিয়ে আর ডাক্তারের অভয় পেয়ে গিন্নী তখন একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। অর্ধকুমারীর কাউন্টারে আমাদের সময় দেওয়া হোলো যে দর্শন হবে চার দিনের পর যেটা সম্ভব নয়। তাই দূর থেকেই অর্ধকুমারীর মন্দিরের মা কে প্রণাম জানিয়ে পায়ে পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম মূল মন্দিরের দিকে। এবার রাস্তা কিন্তু বেশ ভালো, পরিষ্কার আর ঘোড়ার উৎপাত বিহীন। জানতে পারলাম যে ঘোড়া চলে অন্য রাস্তায়, তবে এই রাস্তায় আছে পালকি আর বাচ্চাসহ প্রম। দিনের বেলায় এই রাস্তায় অটো চলে, কিন্তু রাতে সে সব বন্ধ। কি আর করা যায়, আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে, রাতের অন্ধকারে দূরে দেখা যাচ্ছে ভবনের আলো। পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে গেছি বলে একটু ঠান্ডার আমেজও পাওয়া যাচ্ছে । আমরা একটু চলছি, বসছি রাস্তার পাশের চেয়ারে। কখনো বিশ্রাম নিচ্ছি দাঁড়িয়ে, লাঠিতে বা রাস্তার ধারের লোহার বিমের উপর ভর দিয়ে। কত মানুষ, কাচ্চা বাচ্চা, বুড়ো বুড়ি সবাই চলেছে "মা" এর দর্শনে। রাস্তা যেন আর শেষ হয় না, দেখতে পাচ্ছি সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলেছে রাস্তা, রাস্তা ভর ঠাকুরের নাম গান হয়ে চলেছে মাইকে চলেছে নানা রকমের ঘোষণাও। হটাৎ দেখি রাস্তার ধারের ডানদিকে রয়েছে জুতো রাখার লোহার তাক, তবে তার কাছে যাওয়া যাচ্ছেনা কারন সেখানে জনগণ ঘুমাচ্ছে পরম নিশ্চিন্তে। যাইহোক মন্দিরে ঢোকার ঠিক আগে একটা তাকে জুতো রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম দেবী দর্শনের লাইনের দিকে, কেননা আমরা মোবাইল, ক্যমেরা, দেশলাই প্রভৃতি সব কিছুই রেখে এসেছিলাম হোটেলে। নাহলে ওসব জমা রাখতেই চলে যেতো আরো এক-দেড় ঘণ্টা। মন্দিরে ঢোকার পর লাইনটা চলেছে উঠে নেমে আর মাঝেই মাঝেই মিলিটারিরা চেকিং চালাচ্ছে দর্শনার্থীদের। আমার হাতে একটা জলের বোতল ছিলো, ফেলে দিতে হোলো সেটাও আর তার আগেই ফেলে দিতে হয়েছিলো আমাদের সাহায্যকারী সেই লাঠিটাকে। লাইন দিয়ে চলতে চলতে দেখি মন্দিরের মাথার থেকে ঝোলানো অনেক পিতলের ঘণ্টা আর লাইনের লোকজন তা বাজানোর জন্য লাফা লাফি শুরু করে দিয়েছেন। না বুঝেই সেই ঘণ্টা বাজালাম আমরাও আর তারপর পৌছালাম একটা ফাঁকা জায়গায়, সামনেই পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা আর লাইনটা ঢুকে গেছে সেই গুহার ভেতরে। কিছুটা এগিয়েই ডানদিকে আলোয় ঝলমলে রঙ্গীন দেবী মূর্তি আর বাঁদিকে সোনার সিংহাসনে উপবিষ্ট আসল দেবীরা। তেনাদের সামনেই বসে এক পুরোহিত, যদিও এখানে পূজা দেওরার কোনো উপায় নেই তাই দেবী দর্শনেই মুক্তি। এখানে একই সঙ্গে অবস্থান করছেন দেবী দূর্গা, লক্মী আর সরস্বতী। দর্শন শেষে লাইনের ভিড়টা একটু হাল্কা হোলো, আমরা বেরিয়ে এলাম সেই ফাঁকা জায়গায়। নামার সময় ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে ঘোড়াতেই নামব পুরোটা, তাই প্রথমেই ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়লাম। ঘোড়া নামতে লাগলো ঘুরে ঘুরে voiro ঘাঁটি হয়ে। হাতি মাথা ঘুরে এই রাস্তাটা খুব চড়াই (ওঠার সময়) .যদিও আমাদের নামতে হচ্ছে নিচের দিকে। রাস্তাটা এতটাই ঢালু যে নামতে গেলে পায়ে ব্যাথা হওয়া অবসম্ভআবি। ঘোড়াতে করেও নামতে আমাদের লাগলো প্রায় পাঁচ ঘণ্টা, কোমরে ব্যাথা হয়ে গেছে আর হেঁটে নামলে যে কি হতো বুঝতে পারছি না। নিচে নেমে অটো ধরে হোটেলে পৌছে বুঝলাম, ac রুমের উপকারিতা। ঠান্ডা সরবৎ আর সকালের বানানো কচুরী খেয়ে সেই যে ঘুম দিলাম সে আর ভাঙ্গতেই চায় না। অনেক ডাকাডাকির পর উঠে কোনরকমে একটু নাকে মুখে গুঁজে আবার আমরা বিছানায়। আমাদের ফেরার ট্রেন ছিলো রাত্রি নটা নাগাদ কাটরা স্টেশান থেকে । অপূর্ব স্টেশনটা, গোটাটাই মাটির নিচে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঠিক যেন বিদেশী ছবিতে দেখা রেল স্টেশান। ঘোরা শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা ... ...
Post By-Debasis Singha
অতি সম্প্রতি লাদাখ ঘুরে আসার পর এই লেখাটা লিখতে বসে মনে একটা সন্দেহ হচ্ছে যে আদৌ এটার কোন দরকার আছে কি না। কারন লাদাখ নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে বহু সদস্যে র বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং তার মধ্যে কিছু লেখা এতই সুন্দর এবং অতুলনীয় যে তারপর লাদাখ কে বর্ণনা করে কিছু লেখার ধৃষ্টতা আমার নেই। এই লেখার মধ্য দিয়ে লাদাখের দ্রষ্টব্য স্থান গুলি নিয়ে আমি কোন আলোচনা করব না কারন সেগুলি নিয়ে এত লেখা হয়েছে যে নতুন করে আর কিছু আলোচনা করার আছে বলে মনে হয় না এবং লাদাখের সৌন্দর্জের বর্ণনাও করছি না কারন সে ক্ষমতা আমার নেই। এই লেখাটার মধ্যে দিয়ে আমি সুধু কিছু তথ্য এবং আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছি এই ভেবে যে আগামী দিনে লাদাখ ঘুরতে গিয়ে যদি কার কোন সাহায্যে লাগে। যদি সত্যিই কারো কাজে লাগে তবে মনে করব এই লেখা সার্থক হয়েছে। আমার মতে লাদাখ যাওয়ার জন্য সব থেকে উপযুক্ত সময় হল মে র মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথমে অথবা অগাস্টের একদম শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত। মানালি থেকে লেহ্-মানালি হাইওয়ে দিয়ে যাত্রা শুরু করে লাদাখ পৌঁছানোর পরিবর্তে শ্রীনগর থেকে জোজিলা পাস এবং দ্রাস, কার্গিল হয়ে লাদাখ পৌঁছানই শ্রেয়। কারন মানালি থেকে লেহ্ পৌঁছাতে গেলে পাঁচটি হাই অল্টিচিউড পাস অতিক্রম করতে হয় কিন্তু সেই তুলনায় শ্রীনগর দিকে এক মাত্র ফোতু লা ( ১৩,৭০০) ছাড়া আর কোন উঁচু পাস অতিক্রম করতে হয় না ফলে Acute Mountain Sickness (AMS) হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আর যাদের AMS সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে তারা নিশ্চই জানেন এটি কি ভয়ানক। আর যাদের অভিজ্ঞতা নেই তাদের এই টুকুই বলতে চাই যে AMS আপনার সম্পুর্ণ ভ্রমনটা নষ্ট করে দিতে পারে। অতএব সব সময় চেষ্টা করা উচিত AMS থেকে বাঁচার। এক্ষেত্রে একটা কথা বলতে চাই যে যদিও অনেকে জোজিলা পাস কে পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর রাস্তা হিসাবে বর্ণনা করেন তবে আমার নিজের খুব একটা ভয়ঙ্কর মনে হয় নি। আমার মতে শ্রীনগর থেকে শ্রীনগর- লেহ্ হাইওয়ে দিয়ে যাত্রা শুরু করে লেহ্ - মানালি হাইওয়ে দিয়ে মানালি তে যাত্রা শেষ করলে তবেই লাদাখ ভ্রমন ঠিকভাবে সম্পুর্ণ হয়। যাঁরা বিমানে লেহ্ পৌঁছে লাদাখ ঘুরে আবার বিমানেই ফিরে আসেন তাঁদের লাদাখ দর্শন অসম্পুর্ণই থেকে যায়। লেহ্ তে অজস্র হোটেল এবং গেস্ট হাউস আছে যে গুলির ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত। যদি কেউ মরসুমের শেষ দিকে জান যখন ভীড় কম থাকে এবং ঠিক মত দর দাম করতে পারেন তবে ৮০০/১০০০ টাকার মধ্যে ভাল গেষ্টহাউসে ডবল বেডরুম পেয়ে যাবেন। লেহ্ তে খাবার জন্য অত্যন্ত দামি রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে ভাল কিন্তু সাধারন মানের অজস্র হোটেল আছে। একটু খুঁজে নিলে ১০০/১২০ টাকার মধ্যে ভাল নিরামিষ থালি পাওয়া যায় যে গুলির মান যথেষ্ট ভাল। এছাড়া ২০০/২৪০ টাকার মধ্যে ভাল মানের চাইনিজ বা টিবেটান খাবার পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে পুরো লাদাখ জুড়ে নিরামিষ থালির রেট মোটামুটি ১৩০/১৫০ টাকার মধ্যে এবং অধিকাংশ জায়গায় নিরামিষ থালি এবং ডিম ছাড়া আর অন্য কিছু পাওয়া মুসকিল। এ ছাড়া অনেক জায়গায় ম্যাগি (৩০/-) ও নুডুলস (১০০/-) পাওয়া যায়। এবার লেহ্ থেকে সম্পুর্ণ লাদাখ ঘোরার ব্যাপারে একটু আলোচনা করা যাক। সাধারণত যাঁরা লাদাখ বেড়াতে জান তাঁরা লেহ্ থেকে নুব্রা ভ্যালি, একই পথ ধরে যাতায়াত করেন। প্যাংগং সো ও সোমোরিরির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু এতে একই পথে বারবার যাতায়ত করার ফলে নতুনত্ব থাকে না এবং সময় ও লাগে অনেক বেশি। উপরন্তু এই পথ ও জায়গা গুলি বড় বেশি পর্যটকের ভিড়ে আক্রান্ত। আমার মতে ভীড় এরিয়ে লাদাখের অপরুপ সৌন্দর্জ যদি সত্যিই দেখতে ও অনুভব করতে হয় তবে পরিচিত পথ ছেড়ে একটি থেকে আরেকটি জায়গা লাদাখের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। এক কথায় লাদাখের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। আমি এখন এ ব্যাপারেই আলোকপাত করতে চেষ্টা করব যদিও জানি না এ ব্যাপারে কতটা সফল হব। 📌লেহ্ থেকে নুব্রা হয়ে প্যাংগং সো📌 লেহ্ থেকে লাদাখ ভ্রমন দুই দিক থেকে শুরু করা যায়। প্রথমে নুব্রা ভ্যালি দিয়ে শুরু করে সোকার হয়ে লেহ্ অথবা মানালি তে শেষ করা যায় অথবা সোকার দিয়ে শুরু করে নুব্রা ভ্যালি দিয়ে লেহ্ তে বা লেহ্ হয়ে মানালিতে শেষ করা যায়। এখানে বলে রাখা যেতে পারে যে যদি কেউ লে-মানালি হাইওয়ে ধরে লেহ্ তে আসতে চান সেক্ষেত্রে সোকার দিয়ে শুরু করে নুব্রা দিয়ে শেষ করা যেতে পারে তাহলে ১২০ কিমি পথ কমে যাবে। যদিও সেটা করা উচিত হবে না কারন এই পথ ধরে শুরু করলে AMS হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অনেক বেশি। আমার মতে লেহ্ থেকে খারদুং লা, খারদুং হয়ে পরিচিত পথে নুব্রা ভ্যালি পৌঁছে লাদাখ দর্শন শুরু করাই ভাল। কারন এক্ষেত্রে যদিও খারদুং লার মত সর্বোচ্চ পাস পার হতে হয় তবুও যেহেতু নুব্রাতে রাত্রিবাস করতে হয় এবং নুব্রার উচ্চতা ততটা বেশি নয় ( লেহ্ র থেকেও নিচে ) তাই শরীর উচ্চতাজনিত অসুবিধার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় পায় অনেক বেশি ফলে সুস্থ শরীরে সুন্দর ভাবে ভ্রমন শেষ করা যায়। নুব্রাতে পৌঁছে ডিসকিট্ মনাস্ট্রি দেখে হুন্ডারে থাকাই সব দিক থেকে উপযুক্ত। কারন প্রথমত হুন্ডার অনেক শান্ত এবং নিরিবিলি। দ্বিতীয়ত দুই কুঁজ বিশিষ্ট উঁটে চড়তে হলে হুন্ডারে আসতে হবে এবং প্রথম দিন হুন্ডারে রাত্রিবাস করে পরের দিন তুরতুক্ যাওয়া অনেক সহজ হবে। এখানেও ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে মোটামুটি ভাল মানের গেষ্টহাউসে ডবল বেডরুম পাওয়া যায়। তবে এখানে একটির বেশি কোন ভাল রেস্টুরেন্ট আমার চোখে পড়েনি। তাই গেস্টহাউসেই খাবার ব্যাবস্থা করা ভাল। দুই দিনে নুব্রা ভ্যালী দর্শন সম্পুর্ণ করে চলুন প্যাংগং সো র পথে। নুব্রা থেকে সোজা প্যাংগং পৌঁছানর জন্য দুটি পথ আছে। 🚔তার একটি হল:-নুব্রা-খালসার-আগম-শায়ক গ্রাম- দুরবেক-টাঙ্গস্টে হয়ে প্যাংগংসো 🚔আরেকটি হল:- নুব্রা-খালসার-আগম-ওয়াড়ি লা-শক্তি-চাং লা-ডুরবেক-টাঙ্গস্টে হয়ে প্যাংগং। সাধারনত অধিকাংশ পর্যটক প্রথম পথ আর্থাৎ আগম - শায়ক রোড টি ব্যাবহার করেন কারন দ্বিতীয় পথটির তুলনায় এই পথের দুরত্ব অনেক কম (১৪০ কিমি) ফলে সময় ও লাগে অনেক কম। এই পথে ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে নুব্রা থেকে প্যাংগং পৌঁছান যায়। যাঁরা এই পথ দিয়ে যাত্রা করেছেন তাঁরাই জানেন এর অপরুপ সৌন্দর্যের কথা। পুরো পথটাতে শায়ক নদী আপনার সঙ্গী হবে। সুতরাং এই পথ ধরেই নুব্রা থেকে প্যাংগং পৌঁছান উচিত। তবে এই পথে যাওয়ার আগে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে যদিও আগের তুলনায় অধিকাংশ জায়গায় এখন রাস্তার প্রভুত উন্নতি হয়েছে ফলে রাস্তা এখন যথেষ্ট ভাল এবং যানবাহন ও অনেক বেশি তবুও কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা এখনো অত্যন্ত খারাপ বা নেই বললেই চলে এবং যথেষ্ট নিরিবিলি। এই রাস্তায় অনেক সময় বিশেষত জুলাই-অগাস্ট মাসে কিছু কিছু জায়গায় শায়ক নদী রাস্তার উপর দিয়েই বহে গিয়ে রাস্তা কে গ্রাস করে নেয়। ফলে রাস্তায় জল বৃদ্ধি পেলে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে পরে। উপরন্তু কিছু কিছু জায়গা ধ্বসপ্রবন। যেহেতু এই পথ এখনো যথেষ্ট নিরিবিলি ফলে কোন কারনে গাড়ী খারাপ হলে বা আটকে গেলে বা অসুবিধায় পড়লে সাহায্য পেতে যথেষ্ট সময় লাগতে পারে যদিও আগের তুলনায় এখন সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক কথায় এখনো এই রাস্তা কিছুটা দুর্গম। যাঁরা এই পথে যাবেন তাঁদের উচিত হবে খালসার বা শায়ক গ্রামে পৌঁছে রাস্তার অবস্থা জেনে নিয়ে সব ঠিক থাকলে তবেই অগ্রসর হওয়া অর্থাৎ কোন রকম ঝুঁকি নাওয়া উচিৎ নয়। 📌প্যাংগং সো থেকে হানলে📌 একথা এখন মোটামুটি সবারই জানা যে ১৩৪ কিমি লম্বা প্যাংগং লেকের যতটুকু ভারতের মধ্যে অবস্থিত তার দৈর্ঘ প্রায় ৫০ কিমি। যদি লেহ্ থেকে পরিচিত পথে বা নুব্রা থেকে শায়ক রোড ধরে প্যাংগং পৌঁছান যায় তবে লুকুং এ লেক শুরু হবার পর ১৬ কিমি গেলেই পড়বে স্পাঙ্গমিক এবং অধিকাংশ পর্যটক এইখানেই রাত্রে থেকে পরের দিন লেহ্ ফিরে আসেন। ফলে তাঁরা প্যাংগং লেকের খুব সামান্য অংশই দর্শন করেন এবং এই লেকের অপরুপ সৌন্দর্যের প্রায় সবটাই তাঁদের অদেখা থেকে যায়। উপরন্তু যেহেতু স্প্যাঙ্গমিকে প্রায় সমস্ত পর্যটক থাকেন তাই এখানে পর্যটকের ভীড় অত্যন্ত বেশি। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে এখানে কিন্তু থাকার জন্য চাদ্দর টেন্ট থেকে সুরু করে তাঁবু,গেস্ট হাউস, হোম স্টে প্রভৃতি বিভিন্ন দামের নানা ব্যাবস্থা প্রচুর পরিমানে আছে যেটা অন্য জায়গায় ততটা পরিমানে উপলব্ধ নয়। তবে আমার মতে যদি নিরিবিলি তে প্যাংগং লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় তবে স্প্যঙ্গমিকে না থেকে লেকে র পাড় ধরে ২০ কিমি এগিয়ে মেরাকে রাত্রিবাস করা উচিত। তাহলে প্রথমত ভীড় এড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে লেকের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। দ্বিতীয়ত প্যাংগং এর আরো ২০ কিমি প্রথমেই দর্শন হয়ে যায় এবং তৃতীয়ত পরের দিনের যাত্রা পথে ২০ কিমি এগিয়ে থাকা যায়। তবে এখানে স্প্যাঙ্গমিকের মত লেকের পাড়ে থাকার জন্য তাঁবুর ব্যাবস্থা নেই। গেস্ট হাউস বা হোম স্টে পাওয়া যায়। স্প্যাঙ্গমিক বা মেরাকের গেস্ট হাউস গুলিতে ৮০০ টাকার মধ্যে মোটামুটি মানের ডবল বেডরুম পাওয়া যায়। আর ২৫০০ টাকার মধ্যে ফোর বেডেড তাঁবু পেয়ে যাওয়া উচিত। আমার মতে সেপ্টেম্বরে গেলে তাঁবুতে না থেকে গেস্টহাউসে থাকাই উচিত কারন রাত্রে লেকের প্রচন্ড ঠান্ডা হওয়া তাঁবুতে প্রবেশ করার ফলে কষ্ট হতে পারে। মেরাকে এ রাত্রি বাস করে পরের দিন হানলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে প্রথমে লেকের পাড় ধরে এগিয়ে প্রায় ৩০ কিমি যাবার কিছু পরে চুসুলে পৌঁছান যাবে। স্প্যাঙ্গমিকের পর থেকে চুসুল পর্যন্ত ৫০ কিমি পুরোটাই নুড়িপাথরে ভরা কাঁচা রাস্তা এবং যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু এই পুরো পথটাতে প্যাংগং লেকের পাড় বরাবর যাওয়ার ফলে প্যাংগং লেকের ৩৫ সম্পুর্নটাই দেখা হয়ে যায়। আর এই পথের সৌন্দর্জ কতটা তা নিজে চাক্ষুষ না করলে বলে বোঝান সম্ভব নয়। যদিও চুসুল একটি ছোট গ্রাম কিন্তু এখানেই ভারত এবং চীনের সেনাবাহিনী র মধ্যে ৪ টি ফ্ল্যাগ মিটিং সম্পন্ন হয়েছে এবং এখানে একটি এডভান্স মিলিটারি এয়ারবেস ছিল। এই চুসুল থেকে সোমোরিরি যাবার পথে মাহী পর্যন্ত দুটি পথ আছে 🚔একটি হল:- চুসুল- সাগা লা/চাগা লা- সাগা- লোমা - নিয়োমা- মাহী (১২৫ কিমি) 🚔দ্বিতীয় টি হল:- চুসুল- মিটপাল সো- কাকাসাঙ্গ লা- হোর লা- ইয়াই সো- মাহী (৭৭ কিমি) কিন্তু যেহেতু আমাদের গন্তব্য হানলে সেহেতু আমরা চুসুল থেকে প্রথম পথটা ধরে ৭৬ কিমি পথ পেরিয়ে লোমা তে পৌঁছাব। চুসুল থেকে এই পথে গেলে তিন টি হাই অল্টিচিউড পাস পার হতে হয় কিন্তু যেহেতু চড়াই ততটা বেশি নয় তাই প্রায় বোঝাই যায় না যে কখন পাস গুলি পার হয়ে গেল। চুসুল থেকে সাগা অব্দি রাস্তা বলে কিছু নেই সুধুই বালি এবং নুড়িপাথরের কাঁচা পথ, কোন দিক নির্দেশ নেই উপরন্তু বেশ কিছু যায়গায় পথের উপর দিয়ে বরফ গলা জল বহে যাচ্ছে ফলে যেকোন সময় জলের মধ্যে গাড়ীর চাকা আটকে যাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু সাগা থেকে লোমা পর্যন্ত রাস্তা পিচের এবং যথেষ্ট ভাল। লোমা পৌঁছানোর পর সোমোরিরি র রাস্তা না ধরে বাঁ দিকে ঘুরে ৫৫ কিমি গেলে হানলে পৌঁছান যাবে। এই রাস্তা টি যথেষ্ট ভাল। হানলে হচ্ছে ভারতের শেষ গ্রাম। হানলে বোধ হয় সম্পুর্ন লাদাখের দ্রষ্টব্য স্থান গুলির মধ্যে সব থেকে শান্ত ও নিরিবিলি। এই হানলে কে বলা হয় নরওয়ে অব ইন্ডিয়া। Indian Institute Of Astro Physics এর টেলিস্কোপটি এখানেই অবস্থিত যেটা সাইবেরিয়ার পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত। তবে ভুলেও একথা ভাববেন না যে এই টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যটক দের আকাশের গ্রহ নক্ষত্র দেখানো হয়। সুধু টেলিস্কোপ টি দেখিয়ে তার কার্যপ্রনালীর বিবরন দেওয়া হয়। তবে হানলের আকাশে রাত্রে খালি চোখে গ্রহ নক্ষত্র দেখাও একটা অপার্থিব অভিজ্ঞতা। এখানেও ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে মোটামুটি মানের গেষ্ট হাউসে ডবল বেডরুম পাওয়া যাবে কিন্তু খাবার ব্যাবস্থা গেষ্টহাউসে না করে কোন উপায় নেই কারন আলাদা কোন খাবার রেস্টুরেন্ট আমার চোখে পরে নি। আরেকটা কথা মনে রাখা জরুরী যে IIAP র টেলিস্কোপটি বিকাল ৬টা পর্যন্ত টুরিস্ট দের দর্শনের জন্য খোলা থাকে। এই পুরো জায়গাটি চুমাথাঙ্গ ভ্যালির অন্তর্গত এবং এই চুমাথাঙ্গ ভ্যালি ই হচ্ছে সম্পুর্ন লাদাখের মধ্যে অন্যতম সুন্দর এবং অনাঘ্রাত সেক্টর। এর সৌন্দর্যের বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। যদি জনমানব হীন রুক্ষ নিষ্ফলা ধুধু প্রান্তর, যার জন্য লাদাখ বিখ্যাত সেটা প্রত্যক্ষ করতে হয় তবে এই চুমাথাঙ্গ ভ্যালি আদর্শ জায়গা। এই পথ ধরে যাওয়াটা একটা অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর অভিজ্ঞতা। এই পথের অনেকটাই ইন্দো-চীন সিমান্তের একদম গা ঘেঁসে গেছে ফলে এই পথে যাওয়ার সময় কয়েক বার মিলিটারি চেকিং এর সন্মুখিন হতে হবে। এই পথেই পড়বে মেজর শয়তান সিং এর স্মৃতি সৌধ। সেই অমর শহিদ মেজর শয়তান সিং এবং তার বাহিনীর ১১২ জন জওয়ান যাঁরা ১৯৬২ সালের চীনের সঙ্গে যুদ্ধে অমিত বিক্রমের সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করে নিজেদের প্রান বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমরা কত জনই বা জানি বা জানতে চেষ্টা করি তাঁদের সেই অবিশ্বাস্য বীরত্বের কাহিনী, কত জনই বা খোঁজ রাখি দেশের জন্য তাদের প্রান বলিদানের সেই অমর ঘটনা। জনমানবহীন ধুধু প্রান্তরে তাঁর স্মৃতি সৌধের সামনে দাড়িয়ে একথা মনে করে এক আশ্চর্য অনুভুতি হচ্ছিল এই ভেবে যে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গায় যেখানে আজ থেকে ৫৬ বছর আগে ভারতীয় এবং চীনের সেনাবাহিনী মুখোমুখি যুদ্ধ করে ছিল। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা উচিত যে যদিও ইদানিং এই পথে যান চলাচল বেড়েছে তবুও এখনো এই পথ অত্যন্ত নির্জন ফলে কোন অসুবিধার সন্মুখীন হলে কতক্ষনে সাহাজ্য পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই এবং যতক্ষন না কোন গা়ড়ী আসছে ততক্ষন কোন সাহাজ্য পাওয়া সম্ভাবনা নেই বললেই চলে কারন এই সম্পুর্ণ পথটাতে কোন থাকা বা খাবার ব্যাবস্থা, পেট্রল পাম্প, মেকানিক এমনকি ফোন বা মোবাইলের কানেকশানও পাওয়া যায় না। এই পথের অনেকটা অংশে রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বা নেই বললেই চলে। ফলে যে গাড়ীর গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স অনেকটা এবং চালক অত্যন্ত দক্ষ তাতে করেই যাওয়া উচিত। এই অপরুপ পথ ধরে প্যাংগং থেকে হানলে পৌঁছতে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা সময় লাগে। 📌হানলে থেকে সোমোরিরি📌 হানলেতে একটা রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে সোমরিরি হ্রদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। প্রসঙ্গত এটা বলা দরকার যে যদি কেউ হানলেতে না আসেন তবে তিনি প্যাংগং থেকে সোজা সোমোরিরি পৌঁছাতে পারেন। হানলে থেকে সোমোরিরি যাওয়ার জন্য প্রথমে একই পথ ধরে লোমা পর্যন্ত আসতে হবে। যেহেতু রাস্তা এখানে যথেষ্ট ভাল তাই এই পথটা আসতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। এরপর লোমা থেকে বাঁ দিকে ঘুরে নিওমা হয়ে মাহী পর্যন্ত আরো ৫০ কিমি যেতে হবে। রাস্তা এখানে যথেষ্ট ভাল এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারন রকম সুন্দর। এই পথের বেশ কিছুটা অংশে সিন্ধু নদ আপনার যাত্রা পথের সঙ্গী হবে। অনেক টা সময় ধরে এই সিন্ধু নদের পাড় ধরে যেতে হবে। কোথাও সিন্ধু শীর্নকায় আবার কোথাও বিশাল চওড়া। এই পথের সম্পুর্ন রুপ নিজে চাক্ষুষ না করলে বর্ণনা করে বোঝান অসম্ভব। মাহী থেকে এর পর সুমডো- নামাসাঙ্গ লা হয়ে আরো ৬৩ কিমি পথ অতিক্রম করে সোমোরিরি ( কার্যোক ) পৌঁছাতে হবে। মাহী থেকে সুমডো পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি ভাল। সুমদোর ঠিক পরেই নামাসাঙ্গ লার চড়াই শুরু হবে কিন্তু যেহেতু চড়াই খুব শক্ত নয় এবং রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ নয় ফলে খুব একটা কষ্ট হবেনা। কিন্তু নামাসাঙ্গ লার পরে কার্যোক পর্যন্ত পুরো টাই রাস্তা বলতে নুড়িপাথর আর ধুলা মিশ্রিত কাঁচা রাস্তা। কিছু দুর যাওয়ার পর একটি ছোট কিন্তু খুব সুন্দর হ্রদ দেখা যাবে। এটাই কিয়াগর সো। কিয়াগর সোকে বাঁ পাশে রেখে আর এগিয়ে গেলে সোমোরিরি র দেখা পাওয়া যাবে। হানলে থেকে সোমোরিরি পৌঁছতে সাধারনত ৪/৫ ঘন্টা মত সময় লাগে। সোমরিরি হ্রদ টি প্যাংগং এর থেকে ছোট কিন্ত সৌন্দর্জের দিক থেকে কোন অংশে কম নয়। আসলে আমার মনে হয় দুটির সৌন্দর্জ দুই রকম। দুটিই অসাধারন সুন্দর। শান্ত ও নিস্তব্ধ পরিবেশে সোমরিরি কে অপার্থিব মনে হয়। সোমরিরি তে পৌঁছে লেকের পাড় ধরে প্রায় ১০ কিমি যাবার পরে কার্যোকে রাত্রিবাস করতে হবে। এখানেও ৮০০ টাকার মধ্যে গেস্টহাউসে সাধারন মানের ডবল বেডরুম পাওয়া যায়। এছাড়া হোটেল বা তাঁবুর ব্যাবস্থাও আছে। এছাড়া যেখানে থাকার ব্যাবস্থা করবেন সেখানেই খাবার বন্দোবস্ত করা উচিত। 📌সোমোরিরি থেকে সোকার হয়ে কেলং অথবা লেহ📌 সোমরিরি তে রাত্রি বাস করে পরের দিন তাড়া তাড়ি যাত্রা শুরু করা উচিত কারন আজ অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। সোমরিরি থেকে প্রথমে একই পথ সুমডো পৌঁছে সেখান থেকে পুগা- পোলোকঙ্গা লা পেরিয়ে সোকার পৌঁছতে আরো ৪৩ কিমি পথ অতিক্রম করতে হবে।সোকারে পৌছে হ্রদ টি দর্শন করুন। ১৪৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই লেকের রুপ আমি বর্ণনা করব না কিন্তু কয়েকটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। সোকার লাদাখের দক্ষিনে রুপসু ভ্যালিতে অবস্থিত। এই লবনাক্ত হ্রদের পাড়ে এতটাই লবন জমা হয় যে দেখতে সাদা লাগে। কিছু বছর আগে পর্যন্ত চাঙ্গপা সম্প্রদায়ের লোকজন এখান থেকে লবন সংগ্রহ করত। শীতকালে এখানে তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। এখানেই বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায় যার মধ্যে কালো গলার সারস অন্যতম। এখানেই তিব্বতী বুনো গাধা, কৃষ্ণসার,নেকড়ে, শিয়ালের দেখা পেলেও পেতে পারেন। এখানে থাকার জন্য তাঁবু বা হোটেল থাকলেও যাঁরা থাকতে চাইবেন তাঁদের উচিৎ হবে লেহ্ থেকে বুক করে আসা উচিত।সোকারে কিছুক্ষন কাটিয়ে যাত্রা করতে হবে ২২ কিমি দুরে লেহ্ মানালি হাইওয়ের উদ্দেশ্যে। লেহ্ মানালি হাইওয়েতে পৌঁছে এবার ঠিক করতে হবে কোন দিকে যাবেন। যদি কেউ লেহ্ তে ফিরে আসতে চান তবে এই হাইওয়ে ধরে লাদাখের দ্বিতীয় উচ্চতম পাস তাংলাং লা(১৭৫০০ ফুট ) পেরিয়ে ডেবরিঙ্গ- রুমসে- উপসী- কেরু হয়ে প্রায় ১৫০ কিমি পথ অতিক্রম করে লেহ্ পৌছতে ৩/৪ ঘন্টা মত সময় লাগবে। আর যদি লেহ্ মানালি হাইওয়ে ধরে মানালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তবে বাঁ দিক ধরে পাঙ্গ- লাচুং লা- নাকি লা- গাটা লুপ- সারচু- ভরতপুর- বরলাচা লা- জিংজিং বার- দরচা- জিসপা- গ্রামফু অতিক্রম করে সন্ধা নাগাদ কেলং এ পৌঁছবেন। সোমোরিরি থেকে কেলং এর দুরত্ব ৩৩৬ কিমি অতিক্রম ১০ ঘন্টা সময় লাগে। লেহ্ মানালি হাইওয়ে কে বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুধু এই টুকু বলতে পারি আমার কাছে এই পথ অতিক্রম করা সারা জীবনের জন্য একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। কোথাও রুক্ষ ধুসর পাথুরে নিষ্ফলা পরিতক্ত ভুমি আবার কোথাও সবুজ তৃনভুমি, কোথাও পাহাড়ী ছোট্ট জনপদ বা যাযাবর মেষ পালকের দল, বরফে ঢাকা সুউচ্চ পর্বত শিখর বা পাঁচটি সুউচ্চ পাস, গাটা লুপের পরপর ২১ খানা হেয়ার পিন বেন্ড বা চন্দ্রভাগা নদী, কাকে ছেড়ে কার কথা বলব, কি নেই এখানে? আমার কাছে সুধু এই পথ টা অতিক্রম করাই একটা সম্পুর্ণ ভ্রমন। শেষে সুধু একটা কথাই বলব যে বড় ভয়ঙ্কর সুন্দর এই পথ। এর কোন তুলনাই হয় না। কেলং এ রাত্রি বাস করে পরের দিন তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করে খোকসার, প্রসিদ্ধ রোটাং পাস অতিক্রম করে মারহি হয়ে মানালি পৌঁছাতে ঘন্টা চারেক মত সময় লাগবে এবং এখানেই আমি আমার লেখা শেষ করব কারন মানালির পরে কে কি ভাবে ফিরবেন সেটা নিয়ে লেখার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। শেষে একটা কথাই শুধু বলব। লাদাখ ভ্রমন কিন্তু অন্যান্য জায়গায় ভ্রমনের তুলনায় আলাদা। আমার মতে কিছু বিশেষ জায়গা দর্শন করা মানেই লাদাখ ভ্রমন করা নয়। উপরে অবর্ণনীয় নীল আকাশ কে সঙ্গী করে রৌদ্রোজ্জল দিনে লাদাখের জনমানবহীন, রুক্ষ, ধুসর, নিষ্ফলা পরিত্বক্ত প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে লাদাখকে দেখাটাও লাদাখ ভ্রমনের একটা অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ এবং সম্ভবত লাদাখের আসল রুপ দর্শন করা। লাদাখের সৌন্দর্জ যতটাই অসাধারন এর প্রকৃতি ও আবহাওয়া ততটাই কঠিন। লাদাখ কিন্তু যে কোন মানুষের শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা নেবে। সেই বাধা অতিক্রম করে যাঁরা লাদাখ ভ্রমন সম্পুর্ণ করবেন তাঁরা বোধহয় জীবনের একটি অতুলনীয় ভ্রমন সম্পন্ন করবেন। আমার এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছি ও মতামত দিয়েছি ফলে অন্য কারো অভিজ্ঞতা ও মতামত আমার সঙ্গে নাও মিলতে পারে এবং যদি কোন তথ্যগত ভুল থেকে থাকে তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। Post By:- Rajat Chowdhury
জয় মাতাদি... ..22nd February,2018 আমারা রওনা হলাম,বৈষ্ণদেবী দর্শনে। অবশ্যই দিল্লি হয়ে গিয়েছিলাম। দিল্লি কাটরা ট্রেন,রাত ১০টায়। পরেরদিন সকালে ৯, থেকে ৯.৩০মিনটে পৌছালাম কাটরা। ঝিরঝির বৃষ্টি, একদিকে পাহাড়, পরিচ্ছন্ন স্টেশন। অপূর্ব একটা অনুভুতি হয়েছিল। স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে অটো, গাড়ি ধরতে হয়। আমরা একটা অটো ধরে হোটেলে পৌছালাম। হোটেল টা ছিল মেইন রোড থেকে একটু নীচের দিকে। সুন্দর ফুলের বাগান। অনেক টা জায়গা নিয়ে। বিশাল রিশেপসন কাউন্টার।এ প্রসঙ্গে বলি মধুবন হলিডেস এই সংস্থা থেকে বুকিং করেছিলাম। যেমন দাম, তেমনি হোটেল। নাম ত্রিনয়নী প্যালেস। খাওয়া দাওয়া ও খুব ভালো। রুম অপূর্ব। ব্যলকনি থেকে পাহাড়ের দৃশ্য অভূতপূর্ব। ব্যালকনি থেকে মাতাদির মন্দিরের দৃশ্য বার বার আমায় ডাকে। সেদিনের মত খাওয়া দাওয়া করে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। একটু ইনফরমেশন কালেকশন করলাম। পরের দিন মাতাজী দর্শনে যাব। পরেরদিন দূপূরে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে হোটেলের গাড়ীই পৌঁছে দিল মন্দির যাওয়ার গেট অবধি। একটি নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত গাড়ি যায়। যাওয়ার পথে লাঠি,লাল রঙের জরির চূর্নী তিনটি রূপোর মূকূট কিনে,পরচার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। অবশ্যই আঁধার কার্ড,আই কার্ড দেখিয়ে ,ব্যাগ র্সাচ করে ঢুকতে দেবে।সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ করে রওনা হলাম। ঘড়িতে তখন দুপুর ৩টে। রাস্তার উপরে ছাউনী দেওয়া, দুধারে বেঞ্চ, খাওয়ার দেকানের অভাব নেই।তার সাথে সুন্দর টয়লেট এর ব্যবস্থা। প্রথম ৬কিমিপ্রায় অর্ধকুয়ারী পর্যন্ত ঘোড়ার খুবই উপদ্রব।কারন মানুষ, ঘোড়া,পালকী সব এক রাস্তায়। অর্ধকুয়ারী থেকে বাঁদিক এর রাস্তা একমাত্র দর্শনার্থীদের জন্য। এদিকে ঘোড়া ঢুকতে দেয় না। ঘোড়া করে যে সব দর্শনার্থী যায় তাদের ডানদিকে এর রাস্তা ধরতে হয়। কিছুটা হাটার পর একটু বিশ্রাম নিলাম। এভাবেই রাত ১০টায় পৌঁছলাম মন্দিরে।সবার মুখে একটাই কথা জয় মাতাদি। বিশ্বাস করুন একটু ও ক্লান্তি নেই,সদা হাস্যমুখে সবাই এগিয়ে চলেছে। এবার সব জমা করতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে লকারে সব রেখে পূজোর লাইনে দাঁড়িয়ে পরলাম । এখানে আলাদা লাইন নয়। তিনটে লাইন হয়েছিল। আমরা গুহার ভেতরে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। এক পাশে দিয়ে পাহাড়ের জল যাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা। ঠান্ডা জল বেরিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে মায়ের দর্শন। চূর্নীটা শীলা য় ঠেকিয়ে দিয়ে দিল,মূকূট গুলো নিয়ে নিল। একটি বড় পাথরের তিনটি মাথা," তমস" মাকালীর প্রতীক,"রজত" মা লক্ষ্মীর প্রতীক," সাত্ত্বিক" মা সরস্বতীর প্রতীক। এই তিন পাথর ই যুগযুগান্ত ধরে মাতা বৈষ্ণদেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। মনটা ভরে গেল। অদ্ভুত অনুভূতি।সিড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় দেখলাম দুটো পাথরের মাঝখান দিয়ে জল চুইয়ে পড়ছে। কোথায় থেকে আসছে অজানা। বেরিয়ে এসে নরকেল নিতে হয় কুপন দেখিয়ে, আমারা আর নিই নি। এবার লকার থেকে জিনিস গুলো নিতে হবে। সব নিয়ে, তখন কার মত সামান্য কিছু খেলাম। পাশেই খাবারের অনেক দোকান। প্রায় হেঁটে উঠতে ৮ঘন্টা লেগেছিল। রাত ১২টায় সব সেরে নীচে নামতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে বেঞ্চ এ বসে বিশ্রাম নিলাম। আবার কিছুটা পথ চললাম,একটু কফি খেয়ে আবার হাটা। হঠাৎ দেখি কয়েকজন বলল পা দাবাদু,বসে পড়লাম বেঞ্চ এ , ভালো ম্যাসাজ করে দিল,৫০টাকা নিল , দুজনের। সারারাত ধরে লোকের যাতায়াত, কোনো ভয়, ভীতির কারণ নেই। নীচে যখন নামলাম,৫.৩০ মিনিট। ,বানগঙ্গায় যখন পৌঁছলাম ,তখন ভোর ৬টা, আমাদের ফোন পেয়ে ,হোটেল থেকে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ীতে উঠে হোটেলে এসে প্রাতরাশ সেরে, বিছানায়। পা এ সামান্য ব্যথা হয়, একদিন গেলে ঠিক হয়ে যায়। কোন তেল থাকলে নিয়ে নেবেন,পায়ে ভালো করে মালিশ করে নেবেন। বলে রাখি ওখানে গিয়ে ওখানকার সিম মোবাইল এ ভরে নেবেন,তা না হলে যোগাযোগ করা যাবেনা। খুব ভালো রাস্তা,ভীষন নিরাপদ, অসংখ্য দোকান, কোন অসুবিধা নেই। যাদের সুগার,বা প্রেসার আছে , তাঁরা সিঁড়ি দিয়ে যাবেন না। প্লেন রাস্তা দিয়ে যান। পরেরদিন ট্রেনে দিল্লি ফিরে আসলাম। মনটা আনন্দে, শান্তিতে ভরে গেলো।জয় মাতাদি। Post By:- Madhumita Pal
কাশ্মীরের বেতাব উপত্যকার কথা সকলেই জানেন। তাই আর আলাদা করে কিছু বললাম না (আসলে কুঁড়েমিতে ধরেছে, ক্ষমা করে দেবেন) । কিছু পুরোনো ছবি ছিল, সেগুলোই দিলাম। সময়কাল ~ এপ্রিল, ২০১২ Post By:- Soumen Dey
|
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |