ইটাচুনা রাজবাড়িতে “জামাই আদর”
ইটাচুনা রাজবাড়িতে জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষ্যে ৮ই ও ৯ই জুন বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিলো। আর এই বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার নাম দেওয়া হয়েছিলো “জামাই আদর”। এই “আদর” খাওয়ার লোভে ৯ তারিখ হাজির হলাম ইটাচুনা রাজবাড়িতে। আগে থেকেই বুকিং করা ছিলো। ১টার মধ্যে স্নান সেরে নিয়ে অপেক্ষা, কখন “আদর” খাবো। অবশেষে দুপুর ২টোর সময় এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন আমাদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হলো “জামাই আদর”। খাওয়া শুরুর আগে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে খাবারের ছবি তুললাম। তারপর শুরু হলো “জামাই আদর”। খাবারের গুনমান, স্বাদ, পরিমান ও সর্বোপরি পরিবেশন অতুলনীয়। “জামাই আদর”-এর বিভিন্ন পদগুলির একটি তালিকা দিলামঃ- ১) নুন ২) লেবু ৩) কাঁচা লঙ্কা ৪) গাওয়া ঘি ৫) সাদা ভাত ৬) বাসন্তি পোলাও ৭) লুচি ৮) আলু ভাজা ৯) কুমড়ো ভাজা ১০) উচ্ছে ভাজা ১১) বেগুন ভাজা ১২) কলমী শাক ভাজা ১৩) ভেজ ডাল ১৪) আলু-পটল পোস্ত ১৫) ধোকার ডালনা ১৬) মাছের চপ ১৭) ভেটকি মাছের পাতুরি ১৮) চিংড়ির মালাইকারি ১৯) খাসির মাংস ২০) পেঁপের চাটনি ২১) পাঁপড় ২২) লিচু ২৩) আম ২৪) কালো জাম ২৫) তরমুজ ২৬) কাঁঠাল ২৭) মিষ্টি দই ২৮) সন্দেশ ২৯) মিঠা পান আপনারো যদি এই “জামাই আদর” পেতে চান তাহলে অবশ্যই আগামী বছর জামাই ষষ্ঠীর আগে ইটাচুনা রাজবাড়িতে বুকিংটা করে নেবেন। এই বছরের “জামাই আদর”-এর খরচ ছিলো- মাথাপিছু ৯৯৯টাকা (জি.এস.টি সহ)
0 Comments
ঘুরে এলাম অরুণাচল ।
এককথায় বলতে গেলে খুব সুন্দর জায়গা । অসাধারণ অভিজ্ঞতা । প্রথমেই গ্রুপের সকলকে অনুরোধ করব একবার যান আর ঘুরে আসুন - অবশ্যই যাদের এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি । এবার আশা যাক আসল কথায়, মানে ঘোরার কথায় । অরুণাচল ঘুরতে গেলে প্রথমেই যেটা দরকার বা যেটা না হলে আপনাকে অরুণাচলে ঢুকতেই দেবে না তা হলো ILP (Inner Line Permit) । আমরা সব মিলিয়ে ষোল জনের একটি দল ছিলাম । পাঁচটি পরিবার । ১০ থেকে ১৮ র মধ্যে পাঁচ জন । একজন ৭৩+ । বাকিরা সব মধ্যবয়সী । যা কিছু করার আমি আর আমার বন্ধু (বয়েসে যদিও আমার চেয়ে ছোট) মিলেই করলাম । বন্ধু এসে বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম । ফ্লাইটের টিকিট সকলের জন্য কেটে নেওয়া হলো জানুয়ারিতে । ভ্রমণ পরিকল্পনা বা রুট প্ল্যানটা এরকম ছিল : - ৩১/০৩/১৯ - কলকাতা থেকে গৌহাটি ফ্লাইটে । ওখানে থেকে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে নেওয়া হবে । যেটা গৌহাটি থেকে গৌহাটি বুকিং করা থাকবে । গৌহাটি থেকে প্রথমে ভালুকপোং যাবো এবং রাতে ওখানেই থাকব । - ০১/০৪/১৯ ভালুকপোং থেকে দিরাং এর উদ্দেশ্যে খুব সকালে রওনা দেব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । রাতে দিরাং এ থাকব । - ০২/০৪/১৯ দিরাং থেকে তাওয়াং এর উদ্দেশ্যে খুব সকালে রওনা দেব । এখানে ০৪/০৪/১৯ পর্যন্ত থাকব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । রাতে তাওয়াং এ থাকব । এখানে তিনরাত থাকা হবে । এখানে প্রথমদিন আশপাশের দর্শনীয় স্থান দেখে নেওয়া হবে । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাবার জন্য আলাদা পাশ বা পারমিট লাগে যেটা তাওয়াং থেকেই পাওয়া যাবে । রাস্তা ঠিকঠাক থাকলে তবেই সেনাবাহিনী পাশ দেয় । পাশ পেলে সেটাও নিয়ে নেব । পরদিন বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাব যদি পাশ পাওয়া যায় । - ০৫/০৪/১৯ তাওয়াং থেকে খুব সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে বোমডিলা পৌঁছে সেখানে রাত্রিবাস করব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । - ০৬/০৪/১৯ বোমডিলা থেকে খুব সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে গৌহাটি পৌঁছে সেখানে রাত্রিবাস করব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । এখানে আমরা রিজার্ভ করা গাড়িটাকে ছেড়ে দেব । - ০৭/০৪/১৯ সকালে কামাখ্যা মাকে দর্শন করে বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা ফিরব । ILP বা পারমিট অনলাইনেও করা যায়, ১০০ টাকা লাগে । আমরা সল্টলেকে অরুণাচল ভবনে গিয়ে করিয়েছিলাম । ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছিলাম । তিনটে ফর্ম কিনতে হয়েছিল ১৬ জনের জন্য । ১০ টাকার ফর্মে এক একটাতে ৬ জনের নাম দেওয়া যাবে । সঙ্গে দু কপি পাসপোর্ট সাইজের ফটো, আধার কার্ড আর ভোটার আইডি লাগে । অপ্রাপ্তবয়স্ক বা যাদের ভোটার আইডি নেই বা হয় নি তাদের বার্থ সার্টিফিকেট লাগে । অরুণাচল ভবন থেকে সবকিছু জেনে ওদের কথামতো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে ফর্ম, ফটো, আধার কার্ড ইত্যাদি জমা দিয়ে এলাম । প্রত্যেকের জন্য পঞ্চাশ টাকা করে জমা দিতে হলো ( অনলাইনে যেটা একশ টাকা লাগে) । এক সপ্তাহ লাগে পারমিট পেতে । আমাদের ফোন করে জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল যে পারমিট হয়ে গেছে । সপ্তাহখানেক পরে গিয়ে সেগুলোকে নিয়ে এলাম । এছাড়াও পারমিট গৌহাটি বা ভালুকপোং থেকেও করানো যায় । তবে আগে থেকে করিয়ে নিয়ে গেলে আপনার সময় নষ্ট হবে না । পারমিট চেক করবে ভালুকপোং এ ঢোকার সময় । টিকিট আর পারমিট তো হলো । এবার গাড়ি আর হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে । ১৬ জনের জন্য গাড়ি চাই, সঙ্গে মালপত্রও থাকবে । অরুণাচল ভবনেই প্রথমে খোঁজ করেছিলাম । একতলায় পারমিট হয় আর দোতলায় একজন ভদ্রলোক আছেন যার কাছ থেকে গাড়ি আর হোটেলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলাম । সরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই । তবে উনি দুটো ট্রাভেল এজেন্সির নাম, ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন । সে দুটো ট্রাভেল এজেন্সির ঠিকানা সল্টলেকেরই । ফলে আমরা ওখানে গিয়ে খোঁজখবর করলাম । ১৬ জনের জন্য ১৭/২১/২৬ সিটের সবধরনের গাড়ির কথাই হলো । ১৭ আর ২৬ সিটের গাড়ি সহজেই পাওয়া যাচ্ছিল । কিন্তু আমরা চাইছিলাম ২১ সিটের গাড়ি যেটা নাকি সংখ্যায় খুব কম চলে । অনেকের সাথেই কথা হলো । প্রতিদিনের ভাড়া কেউ বলল ৮০০০/-, কেউ বলল ৮৫০০/- আবার কেউ চাইল ৯০০০/- টাকা । আমি ফেসবুকের ট্রাভেল গ্রুপ থেকেও অনেকের নাম ও নাম্বার পেয়েছিলাম । তাদের কেউ কেউ ট্রাভেল এজেন্ট বলেই বোধ হয়েছিল । যাইহোক অবশেষে চেনা পরিচিত একজনের দ্বারা গাড়ি ও হোটেল ভাড়া করে নিলাম । গাড়ির ভাড়া প্রতিদিন ৭২০০/- । আমরা ৭ দিনের জন্য মানে ৩১শে মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ভাড়া করে নিলাম ।
কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা দরকার । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাবার জন্য আলাদা পাশ লাগে । তাই সঙ্গে দু কপি ফটো, দু কপি করে আধার কার্ড ও ভোটার আইডির জেরক্স রাখতে হবে । ভোটার আইডি না থাকলে বার্থ সার্টিফিকেটের জেরক্স দু কপি । এছাড়াও সব অরিজিনাল সঙ্গে রাখতে হবে । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক ঘুরতে গেলে তাওয়াং থেকে আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হবে । যে গাড়িতে করে আমরা গৌহাটি থেকে গিয়েছিলাম সেসব গাড়িকে বুমলাপাশ ও মাধুরী লেকে যেতে দেওয়া হয় না । ঐ জায়গা পুরোপুরি সেনাবাহিনীর অধীনে । অতএব আপনাকে আলাদা করে গাড়ি ভাড়া করতেই হবে ।
আরেকটি কথা । সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র তো রাখবেন । এছাড়াও কোকা-৩০ ও কর্পূর রাখবেন । সেলা পাশ ১৩৪০০ ফুট, টাওয়াং ১০০০০ ফুট আর বুমলা পাশ ১৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্হিত । উচ্চতাজনিত কোনো অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্য এটা বলা । অক্সিজেন কম থাকার জন্য সমস্যা হতে পারে । কোকা-৩০ ও কর্পূর এক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী । আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রিজার্ভ করা টেম্পো ট্রাভেলারেই ছিলাম । ফলে সকালের জলখাবার, দুপুরের খাবার, বিকেলের টিফিন সব রাস্তাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে করতে হয়েছিল । সব জায়গায় আপনার পছন্দ মতো খাবার পাবেন না । সেজন্য আমরা সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে ড্রাই ফুড রেখেছিলাম । এটা রাখলে দেখবেন অনেক সুবিধা হবে ।
৩১/০৩/১৯
তিনটে পরিবার আমরা এগারোটায় গৌহাটি পৌঁছে যাই । একই ফ্লাইটে টিকিট না পাওয়ার জন্য বাকি পরিবার দুটি পরের ফ্লাইটে একঘন্টা পরে বারোটায় এসে পৌঁছাল । আমাদের গাড়ি এগারোটা থেকে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল । বার তিনেক কথাও হয় ড্রাইভারের সাথে । এরই মধ্যে আকাশ কালো করেছে । মনে হচ্ছে যেন দুপুর নয়, এখন সন্ধ্যা । এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছ অবধি যেতে গিয়ে পুরোপুরি ভিজে স্নান করে নিলাম । আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে । দুপুর সাড়ে বারোটায় আমরা গৌহাটি এয়ারপোর্ট থেকে ভালুকপোং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । বাইরে তখন বৃষ্টি হয়েই চলেছে । শেষ মুহূর্তে আমাদের ২১ সিটারের বাসের পরিবর্তে ২৬ সিটারের টেম্পো ট্রাভেলার বাস দিয়েছে । আমরা একটু আপত্তি করেছিলাম । আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ২৬ সিটারের বাস সব জায়গায় যেতে পারবে কিনা । যদিও আমাদের বলা হয়েছিল কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না । আসলে ভোটের বাজারে অনেক গাড়ি নিয়ে নিয়েছে ভোটের জন্য । বড় বাস পাওয়ার জন্য বাসে প্রচুর জায়গা । সবার মালপত্র পেছনে খালি জায়গায় আর সিটে রাখা হলো । গাড়ি চলতে শুরু করেছে । আস্তে আস্তে মজুত ভান্ডার থেকে খাবারও বের হতে লাগলো । আমরা কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে বুকিং করেছিলাম কলকাতায় (৩৫০০০/-) গাড়ি ও হোটেলের জন্য । এখানে আবার গাড়ি যিনি দিয়ে ছিলেন তাকে ২৫০০০/- টাকা দিলাম । আগে ৫০০০/- দেওয়া ছিল । সব মিলিয়ে ৫০৪০০/- টাকা দিতে হবে । বৃষ্টি কমেছে, সবার মুখ চলছে, গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে । ক্ষেত্রি অঞ্চলের খালোইবারিতে বাড়ুই লাইন হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । ডিম, মাছ,মাংস সবকিছু রয়েছে । খাবারটাও ভালোই লাগলো । এখানে অন্য একটি হোটেল অন্নপূর্ণা রেস্টুরেন্টে প্রথম গিয়েছিলাম । ১৬ জন শুনেই বলে দিল যে খাবার হবে না । খাওয়া হলো । সুন্দর ঝকঝকে রাস্তায় গাড়ি আবার তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে । বৃষ্টি বন্ধ আছে । সোয়া পাঁচটায় একজায়গায় আবার দাঁড়ালাম চা খাবার জন্য । সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমরা ভালুকপোং এ পৌঁছে গেলাম । খাওয়ার সময় বাদ দিলে মোটামুটি সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে ভালুকপোং আসতে । ভালুকপোং ঢোকার মুখেই চেক পোস্টে আমাদের পারমিট চেক করল । যা করার তা আলি মানে আমাদের ড্রাইভারই করল । ও আমাদের পারমিটগুলো নিয়ে রেখেছে । পথে আরো কিছু জায়গায় চেক করবে বলল । ওর সঙ্গে একজন হেল্পার রমেন রয়েছে যে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে । চেক পোস্ট পেরিয়েই আমাদের হোটেল ঈগল নেস্ট । টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল একটু আগেই । হোটেলে চেক ইন করে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম । হোটেলটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন । রাস্তার ওপরেই । খাবারের দরদাম ঠিকঠাক । মোটামুটি ভালোই ঠান্ডা আছে তাই সোয়েটার পরে নিতে হলো সকলকেই । আমরা ছেলেরা ক'জন বেরোলাম ঐ টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই । আশপাশে আরও হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে । বৃষ্টি আর ঠান্ডার জন্য দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে দেখলাম । রাতের খাবার ভালো করেছিল । ঠিক হলো পরদিন সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হবো । পরদিন দিরাং যাবার কথা । মাঝে একটা জায়গায় রাস্তা বন্ধ থাকবে ন'টার পর থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা । তাই তার আগে ঐ জায়গাটা পেরিয়ে যেতে হবে । ০১/০৪/২০১৯ ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙে গেল । স্নান করে তৈরি হয়ে গেলাম । হোটেলের ছাদে উঠে গেলাম চারপাশটা দেখার জন্য । গতরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে । এখন একটু ধরেছে । তবে আকাশ এখনও এমন গোমড়া মুখে বসে যা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে ঘোরাঘুরি তো মাটি হবেই তাছাড়া পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়াও বেশ বিপজ্জনক । আজ একটু পরেই আমাদের দিরাং এর উদ্দেশ্যে রওনা দেবার কথা । পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ি রাস্তা । যাক, বেশি ভেবে কাজ নেই । এখন পাঁচটা দশ । চারপাশটা বৃষ্টিস্নাত । মেঘ থাকার জন্য আলো ভালো করে ফোঁটে নি । চারিদিকে ছোটবড় পাহাড় । দূরের পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা মেঘগুলো যেন তাদের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে । সারারাত অনেক পরিশ্রম করেছে কিনা তাই বোধহয় এখন ঘুমানোর চেষ্টা করছে ।
নেমে এলাম ছাদ থেকে । নীচে গিয়ে দু'পা হেঁটে আশপাশটা দেখে নিলাম । আমরা সবাই তৈরি হয়ে গেছি । আলি আর রমেনের আরও কিছুটা সময় লাগবে । তাই ওদের কথামতো কামেং নদী দর্শনে হাঁটা লাগালাম । আমরা হাঁটতে হাঁটতে কামেং নদীর কাছে পৌঁছে গেলাম । হোটেল থেকে তিন চার মিনিটের হাঁটা পথ । কামেং নদী দৈর্ঘ্যে ২৬৪ কিলোমিটার । আগে এর নাম ছিল ভরলী নদী । এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম একটি মুখ্য উপনদী যা তেজপুরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে । নদীটা বেশ চওড়া তবে এখন জল কম । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে । কি ভদ্র, কি শান্ত এখন এই নদী ! অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন এই নদীর আশপাশ । বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ছবিটবি তুলে চলে এলাম । সকাল সকাল মনটা ভরে গেল । নদীর পাড় থেকে আসতেই চাইছিল না মনটা । সংসারী লোকজনের মনকে কখনো কখনো শৃঙ্খলে বাঁধতে হয় । পদে পদে তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় সেটা । আমিও তাই করলাম ।
বাস ছেড়ে দিল দিরাং এর উদ্দেশ্যে । দুরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার । এখন রাস্তা বেশ ভালো । চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এলাম ছয় কিলোমিটার দূরের Tipi Orchidarium । এখন ঘড়িতে আটটা । শুনশান পরিবেশ । কোনো লোকজনকে দেখা গেল না । Tipi Orchidarium এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম Orchidarium । ১৯৭২ সালে প্রায় ১১৩ একর জমি নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় । ৫০০০০ বেশি অর্কিড রয়েছে । এটি একটি রিসার্চ সেন্টারও বটে । এটা রবিবার বন্ধ থাকে । আমরা ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে সব দেখতে লাগলাম । মনে চিন্তা দোলা দিচ্ছে, রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে না তো । আলি সেই ভয়ে তাড়া লাগাচ্ছে । ভয় এমন একটা সংক্রমক ব্যাধি যে একে একে সকলের মনেই এই ভয়টা ঢুকে পড়লো নিজের অজান্তেই । যদি রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তবে কি হবে ? কতোক্ষন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে । চটপট কিছু ছবি তুলে আমাদের গাড়িতে উঠে পড়লাম । প্রকৃতি প্রেমিক যারা বা যারা এটাকে আরও ভালো করে দেখতে চান তাদেরকে বলব অনেকটা সময় নিয়ে এখানে আসবেন। দারুণ সুন্দর জায়গা । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । বেশ যত্ন সহকারে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে । হতাশ হবেন না এটুকু বলতে পারি । গাড়ি আবার ছুটতে লাগলো ঝকঝকে সুন্দর রাস্তা দিয়ে । দু পাশে পাহাড় ও জঙ্গলকে পেছনে ফেলে কামেং নদীর সাথে । অপূর্ব সুন্দর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । সবকিছু ভুলিয়ে দেয় । মনে হয় এখানেই থেকে যাই বাকি জীবনটা । পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে । দিরাং এর উচ্চতা ১০০০০ ফুট । অতএব আমাদের এবার উঁচুতে ওঠার পালা । প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল । দেখলাম সামনে আরও কিছু ট্রাক আর সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । তবে কি রাস্তা বন্ধ ? আমাদের কি এখানেই থেকে যেতে হবে ? নেমে জানতে পারলাম যে landslide হবার জন্য রাস্তা বন্ধ । বড় গাড়ি যেতে পারবে না । ছোট প্রাইভেট কারগুলো আসা যাওয়া করছে । লোকজন আছে, কাজে ব্যস্ত - রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য । রমেন দেখে এসে বলল, 'বোম ফুটবে । ইয়া বড়ো পাথর পড়ে রাস্তা আটকে দিছে । ওটা বোম দিয়ে ফুটাবে তারপর রাস্তা পরিষ্কার হবে ।' বোঝা গেল কপালে দুঃখ আছে । যাক, অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই ।
পাহাড়ের কান্না শুনেছেন ? আমি শুনেছি । অন্তত আমার তেমনি মনে হলো । জীবনে এই প্রথম শুনলাম ।
আমরা পুরুষেরা দু-তিনজন এগিয়ে গেলাম যেখানে শ্রমিকরা কাজ করছিল । দেখলাম এক বিরাটাকৃতির প্রস্তরখন্ড অর্ধেক রাস্তা জুড়ে পড়ে আছে । ওটাকে বারুদের সাহায্যে টুকরো টুকরো করার কাজে ব্যস্ত সমস্ত শ্রমিকরা । গতরাতের বর্ষায় ঐ প্রস্তরখন্ডটি বিশাল পর্বতের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে এসে অনাদরে রাস্তায় শুয়ে আছে । যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঐ শ্রমিকরা রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত । পরবর্তী কয়েক দিন আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখেছি এইভাবেই শ্রমিকরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে । তাওয়াং থেকে গৌহাটি যাওয়া-আসার পথে আরো বেশ কয়েকবার আমাদের এভাবেই দাঁড়াতে হয়েছিল । তাই সকলের কাছে অনুরোধ বর্ষাকালে এদিকে আসবেন না । আমরা যখন এসেছি সেটা বর্ষাকাল না হলেও বৃষ্টির ফলে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ধস নেমেছে দেখেছি । তবে বিশেষ কোনো অসুবিধে হয় নি । সর্বত্র শ্রমিকরা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে । পুরুষ মহিলা সমভাবে কাজ করে চলেছে । মহিলারা অনেকেই পিঠে বাচ্চা নিয়ে এই কঠিন শ্রম দান করে চলেছে । এই রাস্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে । অনবরত মিলিটারির ভারী ট্রাক, জিপ ইত্যাদির যাতায়াত দেখতে পাবেন । তাই এ রাস্তা বন্ধ হলে তাদের জন্য মুশকিল । গত কয়েকদিনের বৃষ্টির ফলে বহু জায়গায় রাস্তা ভাঙ্গাচোরা পেলাম । হঠাৎ রমেন চিল্লিয়ে বলল, 'চলেন, চলেন । এবার বোম ফুটবে । আগুন দিছে । ' দেখলাম ঐ শ্রমিকরাও হাতের ইশারায় আমাদের পালাতে বলছে আর নিজেরাও ছুটে পালাচ্ছে । দৌঁড়ে চলে এলাম গাড়ির কাছে । সবাই গাড়ি থেকে নেমে আগেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল । সশব্দে বোমাটা ফাটল । আর ঠিক তার পরই আমি পাহাড়ের কান্নাটা শুনতে পেলাম । নিকটবর্তী পাহাড় তো বটেই অনেক দূরদূরান্তের পর্বতশৃঙ্গগুলিও একটানা অনেকক্ষণ গুমরে গুমরে কাঁদল । হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন । বোমার আওয়াজের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অনেকক্ষণ চলল । আমাদের দলেরই এক সদস্য এর ভিডিও করেছিলেন যাতে কান্না থুরি শব্দটা ভিডিওতে বন্দি করতে পারেন । পরে সকলকে তা শোনালেনও । এ যেন আত্মীয় বিয়োগের কান্না । বড় পাথরটাকে টুকরো টুকরো করে সৎকার করা হলো । সব মিলিয়ে চল্লিশ মিনিট সময় নষ্ট হলো । রাস্তা পরিষ্কার হতেই আবার আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল । অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের মাঝে আমরা । চলেছি দিরাং এর উদ্দেশ্যে । পথে ছোট বড়ো অসংখ্য ঝর্ণা । কোনোটা শুকনো, কোনোটায় অল্প জল - যেমন লুমুম ফলস । কোনাটিই বেশ বড় । তেমনি একটি সবল ও স্বাস্থ্যবান ফলসের সামনে এসে আলি গাড়ি দাঁড় করালো । আমরা সকলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম । সশব্দে পাহাড় থেকে নেমে আসছে । কেমন একটা don't care ভাব । এর রূপ আমরা মনের গভীরে স্হাপন করার সাথে সাথে ক্যামেরা বন্দিও করে নিলাম ।
গাড়ি চলতে লাগল আবার । মাঝে এক-দুটো জায়গায় চেকিংও হলো । এবার এসে পড়লাম Foot Suspension Bridge এর কাছে । এখানে থেকে LOC ৯৮ কিলোমিটার মাত্র । শরীরে মধ্যে কেমন একটা রোমাঞ্চ হতে লাগলো । এটা Jamiri H.Q আর Jamiri Point এর মধ্যে অবস্হিত । টেঙ্গা নদীর ওপর । বেশ সুন্দর এই ব্রীজ । কাঠের পাটাতনের দোদুল্যমান ঝুলন্ত ব্রীজ এটা । প্রথমে একটু ভয় ভয় করলেও নিশ্চিন্তে এই ব্রীজ পেরিয়ে যেতে পারবেন । সেনাবাহিনী যেখানে আমাদের গাড়িটাকে দাঁড় করিয়েছিল সেখানে সব গাড়ি থামিয়ে সব কিছু চেক করা হচ্ছিল । আমাদের বলা হলো যে আমরা যেন জামিরি ব্রীজটা ঘুরে আসি । পাহাড়ি টেঙ্গা নদী কুল কুলিয়ে বয়ে চলেছে । কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল । ওপারে গিয়ে ব্রীজ থেকে নেমে নদীর জলে হাত ডুবিয়ে তার শীতল স্নিগ্ধতাকে স্পর্শ করে নিলাম । এতো সুন্দর জায়গা যে অনায়াসেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো যায় । আমরা যদিও কিছুসময় ঘুরে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম ।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি । গ্রুপের বন্ধুরা অনেকেই জানতে চেয়েছেন খাওয়া-দাওয়ার জন্য কেমন খরচ হয়েছে বা খাবারের কেমন দাম । আমাদের সম্পূর্ণ ভ্রমণে মানে গৌহাটি থেকে তাওয়াং এ খাবার-দাবার মোটামুটি সস্তায় হয়েছে । মাছ ভাত ১০০ বা ১২০ বা ১৫০ টাকা করে পরেছে । চিকেন ১৫০ বা ১৮০ টাকা । নিরামিষ ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে । রুটি ১০ টাকা পিস সঙ্গে সব্জি অথবা ৮০ টাকা প্লেট যাতে পাঁচটা রুটি ও সব্জি । ওমলেট কুড়ি টাকা করে এক একটা । সেদ্ধ ডিম দশ টাকা পিস । ওপরে বর্ণিত সবগুলোই প্লেট সিস্টেম বা মিল সিস্টেম । ফলে সুবিধা হলো যে ভাত, ডাল, তরকারি আপনি যত খুশি নিতে পারবেন, তারজন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না । অতিরিক্ত রুটি নিলে আলাদা পয়সা দিতে হবে । মোটামুটি ভাবে ৩৫০-৪০০ টাকার মধ্যে আপনার সারাদিনের খাবার মানে সকালের জলখাবার থেকে রাতের ডিনার সব হয়ে যাবে । তবে সঙ্গে পর্যাপ্ত ড্রাই ফুড রাখা দরকার । বেশিরভাগ সময় আপনাকে গাড়িতে কাটাতে হবে আর পাহাড়ি পথে সব জায়গায় আপনি খাবার পাবেন না । একমাত্র যেখানে বসতি আছে সেসব জায়গায় দোকান পাবেন । আবার সব জায়গায় আপনি আপনার পছন্দের খাবার পাবেন না অথবা শুনতে হবে যে খাবার শেষ হয়ে গেছে । তবে আপনি যে গাড়িতে যাবেন সেই গাড়ির ড্রাইভারা সব জানে । তাই ওরা ঠিক জায়গা মতো নামাবে খাবার জন্যে । কিছু না পেলে ম্যাগী বা ডিম সেদ্ধ ভরসা । ড্রাই ফুডের মধ্যে আমরা সঙ্গে রেখেছিলাম - মুড়ি, চিরে ভাজা, চাল ভাজা, ছোলা, বাদাম, চানাচুর, বিস্কুট, কেক, টফি বা চকলেট ( এটা উচ্চতা জনিত সমস্যায় ভালো কাজ দেয় ) । এছাড়া চা, কফি ইত্যাদিও সঙ্গে রাখা হয়েছিল । আর জলের বোতল । আজ যেমন পছন্দ মতো খাবার না পেয়ে জলখাবার হিসেবে ডিম সেদ্ধ কেনা হলো । আর কোনো কিছু কিনে খাওয়া হয় নি বা পাই নি । তবে কেউ না খেয়ে থাকে নি । সকালে বাস ছাড়ার সাথে সাথেই সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথমে চাল ভাজা আর পরে চিরে ভাজা । মাঝে একবার চা হয়েছে যেটা ফ্লাক্সে করে আনা হয়েছিল । এ যেন আমরা পিকনিক করতে বেরিয়েছি । হইহই করে সব চলেছে । প্রায় সকলের চোখ জানালা দিয়ে বাইরে পরে আছে । কেউ কিছু মিস করতে চাইছে না । প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি এ ভুখন্ড । কি নেই ? পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, পাহাড়ি নদী আছে, ঝর্ণা আছে । ওপরে নীল আকাশও আছে । এখন আর বৃষ্টির নামগন্ধ নেই । রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ । দূরে পাহাড়ের চূড়ায় কখনো কখনো জমা মেঘও দেখা যাচ্ছে । কয়েকজন বন্ধু জানতে চেয়েছেন হোটেলের ফোন নাম্বার ও গাড়ির বুকিং সম্পর্কে । এব্যাপারে আমি বলি, আপনারা আমার পুরো লেখাটা পড়ুন । অনেক কিছু জেনে যাবেন । ভালো মন্দ মিলিয়ে আছে । তবে যাই করবেন একটু যাচাই করে নেবেন । নইলে ঠকতে হবে । যেহেতু প্রায় সব টাকা আপনাকে আগেই দিতে হবে অতএব আপনি চাইলেও তখন কিছু করতে পারবেন না । মাঝে মাঝেই ভাঙ্গাচোরা বিপজ্জনক রাস্তা । সেসব পেরিয়ে দুটোর সময় একটা হোটেলে সামনে গাড়ি দাঁড়াল । নিরামিষ ভাত আর সঙ্গে ওমলেট । সেও তৈরি করে দিল । কারণ এরা একসাথে বেশি খাবার করে রাখে না । Dawa Hotel, 5 Mile । পেট পূজো করে আবার যাত্রা শুরু হলো । চারটে নাগাদ আমরা দিরাং মনেষ্ট্রিতে এলাম । এর নাম Thupsung Dhargyeling Monastery । পাহাড়ের ওপর এই মনেস্ট্রি । আয়তনে বিশাল । এখান থেকে দিরাং ভ্যালীর সৌন্দর্যে আমরা অভিভূত । মনেস্ট্রির গেট দিয়ে ঢুকে পা চালিয়ে আরো ওপরের দিকে উঠতে হলো । পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, সুন্দর সাজানো গোছানো । মন ভরে গেল । এটা অবশ্যই দেখবেন । দেওয়ালের গায়ে অসম্ভব সুন্দর পেইন্টিং । সাজানো বাগান, গাছ, রং বেরঙের ফুলের টব । খুব যত্ন নেওয়া হয় দেখেই বোঝা যায় । দূরের পাহাড়ের মাথায় শেষ বিকেলের নরম রোদ্দুর আজকের মতো বিদায় জানানোর অপেক্ষায় । চারিদিকের এই অপরূপ সৌন্দর্য মনকে কোন অজানা দেশে নিয়ে চলে যায় । ভেতরে ভগবান বুদ্ধর সাথে দলাই লামার ছবিও রয়েছে । বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এখান থেকে চললাম Hot Water Spring দেখতে । এখানে যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না আলি ও রমেনের । আমরা জোর করাতে অনিচ্ছা সহকারে নিয়ে গেল । অনেকটা নামার পর এই হট ওয়াটারটা পাওয়া গেল । আমরা যখন ক'জন আরো নীচে নদীর ধারে চলে গেলাম । অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে ছিলাম । সেটা মালুম হলো ওঠার সময় । দিরাং এর উচ্চতা ৪৯১০ ফুট । এখানে ঠান্ডা বেশ আছে । হট ওয়াটার স্প্রিং দেখে সাড়ে পাঁচটায় আমাদের হোটেলে এসে পৌঁছালাম । হোটেলের নাম Hotel Snow Lion । চেক ইন করে আমরা রাতের খাবারের অর্ডারও দিয়ে দিলাম । এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে । এরা কখনোই অতিরিক্ত খাবার বানায় না । তাই অরুণাচলের সবজায়গায় দেখলাম খাবারের অর্ডার মোটামুটি সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটায় না দিলে আপনি খাবার নাও পেতে পারেন ।
০২/০৪/২০১৯
আজ তাওয়াং যাবার কথা । পথে সেলাপাস । সেলাপাসে সেলা লেক হলো মূল আকর্ষণ । সকাল দেখে বোঝার কি কোনো উপায় আছে দিনটা কেমন যাবে ? না বোধহয় । রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল । খুব ভোরে উঠে গিজারের গরম জলে শরীরটাকে তরতাজা করে তৈরি হয়ে নিলাম । বাকিরা সব তৈরি হচ্ছে । আমি সোজা ছাদে । রাতে তাপমাত্রা ৪/৫ ডিগ্রি থাকলেও এখন ৬/৭ এর মধ্যে আছে । মিষ্টি মধুর ঠান্ডায় সকালের নরম রোদ যেন শরীরের ওপর এক মোলায়েম চাদর জড়িয়ে দিয়েছে । হোটেলের চারপাশে অনেক প্রাইভেট বাড়ি । অনেক বাড়িতেই কমলালেবুর গাছে অসংখ্য কমলালেবু ঝুলছে । দেখলেই মনে হয় ছুটে গিয়ে কটা তুলে আনি । সেটা সম্ভব নয় । তাই মনের ইচ্ছেটাকে মনেই চেপে রাখতে হলো । দূরে গতকালের দেখা মনেস্ট্রিটাও পরিস্কার দৃশ্যমান । আশেপাশে মেঘ গায়ে জড়িয়ে পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা তো আছেই - যেন বলছে, এসো, দেখো, তোমাদের জন্যই তো আমরা অপেক্ষা করে থাকি । হোটেলের ছাদটা বেশ বড়ো । দলের অনেকেই তখন ছাদে এসে নানান পোঁজে ছবি তুলতে ব্যস্ত । সেলাপাসের উচ্চতা ১৩৪০০ ফুট । গুগলে দেখলাম সেখানে তাপমাত্রা -২ ডিগ্রি । ছটায় -৩ ডিগ্রি ছিল । এখন আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়বে । আলি বলল, বরফ দেখার আশা কম । গতকাল যারা ফিরেছে তাদের কাছ থেকে সে জেনেছে । কিছুটা হতাশ হলাম । সেলাপাসে না পেলেও বুমলাপাসে বরফ পাবো সেই আসায় মনকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে । বরফ না দেখতে পেলেও সেলা লেকটাকে তো দেখতে পাবো এই আশায় রইলাম । আটটা নাগাদ আমাদের যাত্রা শুরু হলো সেলাপাসের দিকে । দিরাং থেকে ৬৩ কিলোমিটার। সকালে বেরোনোর আগে একরাউন্ড জলখাবার সকলের হয়ে গেছে । নিজেদের আনা খাবার দিয়ে সেটা হয়েছে । আমাদের গাড়ি চলেছে দিরাং নদীর পাশ দিয়ে । ১৭ কিলোমিটার দূরে Nyukmadung War Memorial এ আমরা প্রথম থামলাম । সময় ৮:৪০ মিনিট । এখানেই একজন মহিলা আর্মি অফিসার তার ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন । ওনার কাছ থেকে এই war memorial সম্পর্কে বেশকিছু কথা জানলাম । বেশ উঁচু লম্বা এই অফিসার, কলকাতার মেয়ে । দশ বছরের ওপর উনি এখানে আছেন । ওনার সাথে আমাদের পরে আবার Jaswant Garh War Memorial এ দেখা হয় তখন উনি আমাদের ওটার ইতিহাসও বলছিলেন । সে কথায় পরে আসব । এই Nyukmadung War Memorial স্হানটিতে ১৮ নভেম্বর ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের মধ্যে এক সাংঘাতিক লড়াই হয়েছিল । প্রচুর হতাহত হয় । সেই সেনাদের স্মরণে এটি তৈরি । সুন্দর সাজানো গোছানো । নানান বৃক্ষ দ্বারা যত্ন করে সাজানো হয়েছে । মিনিট পঁচিশেক পরে আবার গাড়ি চলতে লাগল । পাহাড়ি রাস্তায় মনোরম শোভা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি সেলাপাসের দিকে । মনে মনে ভাবছি সেলা লেক কেমন দেখব । মাথার ওপর রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ বুকে কিছু সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে । অনেকটা শরতের আকাশ বলে ভ্রম হতে পারে । বহুদূরের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে বরফ জমে আছে দেখলাম । তবে সেটা কিছু কিছু জায়গায় । আলি বলল, ঐদিকেই আমরা যাবো । আধঘন্টা চলার পর একজায়গায় দাঁড়ালাম জলখাবার খাওয়ার জন্য । খাওয়া সেরে আবার চলতে লাগলাম । ধীরে ধীরে মাথায় বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো অনেক কাছে চলে আসছে । বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । মনে হচ্ছে ওরা যেন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে । আমরা ক্রমশ বরফের সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ছি । পাহাড়ে আবহাওয়া নিমেষেই চেঞ্জ হয় । রোদ আর নেই । অল্প অল্প স্নো ফল হচ্ছে । পাহাড়ের গায়ে বরফ তো রয়েইছে, এবার অনেক জায়গায় দেখলাম গাছের মাথায় অল্প স্বল্প বরফ । আরও বিষ্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল ভাবতে পারি নি । রাস্তার দুপাশে প্রস্তরখন্ড ও ঢিবির মাথায় বরফ জমে রয়েছে দেখলাম । সবাই উল্লসিত হলাম । সেনাবাহিনীর গাড়ি চলেছে আগে পিছে । অল্প অল্প স্নোফল হয়েই চলেছে । আলি ওয়াইপার চালিয়ে রেখেছে । আরও উঁচুতে চলে এসেছি । এখন আর রোদ্দুর নেই, বরং মেঘ জমেছে । ১১:৪০ মিনিটে সেলাপাস পৌঁছলাম । সবাই বাস থেকে নেমে পড়েছি ।
চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ । এক জায়গায় দেখলাম কিছুটা জায়গায় জল তবে সেটা লেকের অন্তর্গত নয় বলেই বোধ হলো । স্নোফলের তীব্রতা আগের চেয়ে বেড়েছে । দলের ছেলে-বুড়ো, মহিলা, ছোটোরা আনন্দে উত্তেজনায় লাফালাফি, দাপাদাপি করতে শুরু করে দিয়েছে । আমরা একদল কিছুক্ষণ নেচেও নিলাম । এভাবে স্নোফল চাক্ষুষ করব এতোটা আশা আমরা কেউই করি নি । রাস্তা থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে সেলা লেকের দিকে । কিন্তু কোথায় লেক । সমস্ত বরফে ঢাকা । লেকের চতুর্দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা । পায়ে চলার রাস্তা আছে বলে বোধ হলো । এখন যদিও কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । শুধু বরফ আর বরফ । আমাদের পুরো দলটাই আনন্দে উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে গেছে । কখনো সকলে মিলে ড্যান্স করছে, কখনো রাস্তার পাশে ঘন বরফের ওপর শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে । ছোটোরা মুঠো মুঠো বরফ নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে । প্রায় সকলের ক্যামেরাই সমানতালে ছবি তুলে চলেছে । ছবি তুলতে তুলতে হাত ঠান্ডায় জমে লালচে হয়ে অসাড় হয়ে যাচ্ছে । গ্লাভস বের করে পরে নিয়ে গরম করছি, পরক্ষণেই গ্লাভস খুলে ছবি তুলছি ।
এক মূহুর্তও মিস করা চলবে না । ধীরে ধীরে ওয়েদার আরও খারাপ হলো । আকাশ কালো হয়ে গেছে । তীব্র গতিতে স্নোফল হতে শুরু করেছে । আলি তাগাদা দিতে লাগল । আগে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে বিপদে পড়তে হবে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের সকলকেই গাড়িতে উঠে পড়তে হলো । ঘড়িতে তখন প্রায় একটা । গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে দিয়েছে । আলির হাত খুব ভালো । পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আছে । রাস্তায়ও বরফ পড়েছে । তাই অতি সন্তর্পণে তাকে চালাতে হচ্ছে, বিশেষ করে টার্নিংগুলোত । পাহাড়ের ঢালে ঘন বরফ জমেছে । পাহাড়ের গায়ে গাছের পাতাগুলোতে বরফ জমছে । একটু আগে দেখা সবুজ বনানী সফেদ রং এ ঢেকে যাচ্ছে । আমরা এগিয়ে চলেছি । এ এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যা সারা জীবন মনে থাকবে । মুষলধারে বৃষ্টি হলে যেমন চারিদিকে আবছা সাদাটে হয়ে যায়, দূরের জিনিসও অস্পষ্ট হয়ে যায় তেমনি হয়েছে । এখানে বৃষ্টির পরিবর্তে বরফ পড়ছে । শত সহস্র পেঁজা তুলো যেন আকাশ থেকে নেমে আসছে । যে যেভাবে পারছে গাড়িতে বসে বসেই ছবি তুলে চলেছে । সকলেই উত্তেজিত, আনন্দে টগবগ করছে । এমনভাবে সেলাপাসকে পাব তা কেউ ভাবতে পারে নি । আর কিছু না দেখে এখান থেকে ফিরে গেলেও কোনো লোকসান হবে না, পয়সা পুরো উসুল । মিনিট চল্লিশ চলার পর একটা ওয়াটার ফলস পেয়ে নেমে পড়লাম । অঝোরে স্নোফল হয়ে চলেছে । তার মধ্যেই সকলে নামলাম ।
জায়গাটার কি নাম জানি না । গাড়িটা যেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল সেখানেই একটা রেস্টুরেন্ট । উল্টো দিকে ঝর্ণা । প্রায় সকলেই পড়ি কি মরি করে ঝর্ণার দিকে এগিয়ে গেল । চারিদিকের পাহাড়, বৃক্ষরাজি মাথা নত করে বরফ বর্ষণের মোলায়েম আদর উপভোগ করছে । ঈশ্বর যেন অকৃপণ হাতে সমস্ত আশীর্বাদ নিঃশব্দে তাঁর নিজের হাতে গড়া প্রকৃতির বুকে উজার করে দিচ্ছে । কি সুশৃঙ্খল ! কি নীরব তার অভিব্যক্তি ! ঘন বরফের আস্তরণে ধীরে ধীরে সবকিছু ঢেকে যাচ্ছে । সেই বরফ বর্ষণের মধ্যেই আমরা ঝর্ণার কাছে গিয়ে তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । দারুণ সুন্দর অথচ দুরন্ত । উচ্ছল জলরাশি তীব্র গতিতে পর্বতশৃঙ্গের মাথা থেকে ঢাল বেয়ে সশব্দে এসে ভূমি স্পর্শ করে উন্মাদ গতিতে ছুটে চলেছে । যেন তার খুব তাড়া আছে । মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে অসংখ্য পরী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে দ্রুত গতিতে । যেমন তাদের রূপ তেমনি তাদের সৌন্দর্য । সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে কতোবার মনে মনে ভাবতাম এই ঢেউটাই শেষ ঢেউ নয়তো ! মনের ভয় মনে ঢাকা পরে যেত পরবর্তী ঢেউগুলোতে । তেমনি এখানেও ভয় হচ্ছে । মনে মনে প্রার্থনা করছি সেই অসীম শক্তিধরের উদ্দেশ্যে যেন এই রূপের বৈচিত্র্য আদি অনন্তকাল থাকে । এই রূপ সুধা পান করে সকলের জীবন ধন্য হোক ।
সেলাপাসে বরফে অতোসময় থাকার জন্য সকলের শরীর তখন গরম কিছু খেতে চাইছিল । কিন্তু গাড়ি যেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল সেই রেস্টুরেন্টে চা পেলাম না ।লাঞ্চের সময়ও হয়ে গিয়েছিল । সেটাও তাড়াতাড়ি তৈরি হবে না এতোজনের জন্যে । দু ঘন্টা সময় লাগবে লাঞ্চ তৈরি করে দিতে । অগত্যা আবার আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটতে লাগলো । বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা ১৪০০০ ফুট উচ্চতার JaswantGarh War Memorial এ পৌঁছে গেলাম । এটা ২১ কিলোমিটার সেলা পাস থেকে । এখন সময় বেলা দুটো । অবিরাম স্নোফল হয়েই চলেছে । এখন যেন তার ঘনত্ব ও তীব্রতা আরও বেড়েছে । কিন্তু তাতে কি । কেউ এই নিয়ে ভাবছেই না । গাড়ি দাঁড় করানো মাত্র সকলে লাফিয়ে নেমে পড়লো । এক সুবৃহৎ প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে পড়লাম সকলে । মাথা ও শরীরে কুচো বরফ জমছে । রাইফেলম্যান জশয়ন্ত সিং এর স্মৃতি রক্ষার্থে তারই নামে এই war memorial । মর্মর মূর্তি রাখা আছে । তার বিছানা রয়েছে, সেখানে তার ব্যবহৃত পোশাক, কম্বল সমস্ত কিছু আজও যত্ন সহকারে রাখা । এগুলো রেগুলার কাঁচা, ধোয়া হয় । এখানেই আবার আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল সেই মহিলা সেনা অফিসারের । তিনি এর ইতিহাস বর্ণনা করলেন । ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের মধ্যে যে যুদ্ধ এখানে হয়েছিল । সেই যুদ্ধে ৪র্থ গাড়োয়াল রাইফেলস এর সৈনিক জসওয়ন্ত সিং রাওয়াতের বীরত্বের কাহিনী । একা তিনি চিনা সেনাবাহিনীকে ৭২ ঘন্টা আটকে রেখেছিলেন । ৩০০ চিনা সৈনিক তার হাতে নিহত হয় । তিনি যে একা এখানে আছেন ও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তা যাতে বুঝতে না পারে তারজন্য তিনি ক্রমাগত এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে চলে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন । প্রথমে চিনা সৈনিকরা মনে করেছিল এখানে অনেক ভারতীয় সেনা আছে । সেই কারণে যুদ্ধটা ৭২ ঘন্টা স্হায়ী হয়েছিল । স্হানীয়দের কথা অনুযায়ী তাকে সেলা ও নুরা নামে দুজন পাহাড়ি গ্রাম্য মেয়ে খুব সাহায্য করেছিল । তারা তার খাদ্য, অস্ত্রসস্ত্র এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে নিয়ে যেতে সাহায্য করে । সেই দুই বোনের নামে সেলা পাস ও নুরানাং ভ্যালির নামকরণ হয় । পরে যখন চিনা সেনারা বুঝতে পেরেছিল যে জসয়ন্ত একা আছে তখন প্রচুর সেনা তাকে ঘিরে ফেলে । সেই দুই বোনও মারা যায় । জসওয়ন্তকে ধরে চিনা সেনারা তার শিরচ্ছেদ করে মুন্ডু চিনে নিয়ে যায় । শুনতে শুনতে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে । মাত্র ২১ বছর বয়সী এই সৈনিক আমাদের ভারতমাতার রক্ষার জন্য অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয় । আজও এখানে সকলের বিশ্বাস সে এখনও জীবিত । একদিন সে ফিরে আসবে । সে এখনও আমাদের ভারতমাতার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরায় ব্যস্ত আছে । তাওয়াং এলে এটা অবশ্যই দেখবেন । খুব ভালো লাগবে । সেই '৬২ সালের যুদ্ধে চিনা সেনারা ভারতীয় ভুখন্ডের এই স্হান পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল । পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেটা পুনরায় উদ্ধার করে । এরপর আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম বাঙ্কারের কাছে যাবো বলে । প্রথমে কয়েকটা সিঁড়ি । এরপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম । চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো অসংখ্য বাঙ্কার - ছোট, বড়ো, মাঝারি বিভিন্ন সাইজের । কয়েকটির মধ্যে আমরা ঢুকলাম । আজ আমরা ট্যুরিস্ট হিসাবে এখানে এসে ঢুকে দেখছি । বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে অসম সাহসী সেই বীর সৈনিকের বীর গাথা । অদম্য সাহস আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলে বলীয়ান ইনি আমাদের সকলের কাছে প্রণম্য । বেশ খানিকক্ষণ ঘুরেটুরে ফিরে এলাম । এখানেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত একটি ক্যান্টিন আছে যেখানে গরম চা আর গরম জল বিনা পয়সায় খাওয়া যায় । মাথায় আর শরীরের বরফ ঝেড়েঝুড়ে ঢুকে পড়লাম সেখানে । সকলেই গরম চা খেতে ব্যস্ত । শরীরটাকে তো গরম করতে হবে । পরে এখানেই আমরা ধোসা খেয়ে লাঞ্চ সারলাম । সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এই ক্যান্টিন । দাম সস্তা । ইডলি, ধোসা, প্যাটিস ইত্যাদি নানান খাবার পাওয়া যায় ।সেনাবাহিনীর লোকজনও এখানেই খাওয়া দাওয়া করছে দেখলাম । খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তিনটের সময়ে Jaswantgarh war memorial থেকে রওনা দিয়ে চারটে নাগাদ নুরানাং ফলসে পৌঁছে গেলাম । Jaswantgarh war memorial থেকে দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার । আমরা বেশ খানিকটা নীচে নেমে আসার ফলে এখানে স্নোফল নেই, পরিবর্তে টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়ে চলেছে । কেউ কেউ তাই ছাতা মাথায় নেমে পড়ল । এটা জাং শহরের সন্নিকটে অবস্হিত । গাড়ি যেখানে দাঁড় করিয়েছিল সেখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি পেড়িয়ে নীচে নামতে হলো । এই ফলস থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় । তার পাইপলাইন ইত্যাদি নজরে এলো । এটা জাং বা জং ফলস নামেও পরিচিত । এই ফলসের জলরাশি ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট উচ্চতা থেকে পড়ছে । এটি সেলাপাস থেকে তৈরি হওয়া নুরানাং নদীর জল যা এখানে ফলস হয়ে পড়ে তাওয়াং নদীতে গিয়ে মিশেছে ।
অপূর্ব এই জলপ্রপাত । চারিদিকে পাহাড় । বর্ষাস্নাত বনানী যেন আরও সবুজ রংয়ে সেজেছে । সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মাথা থেকে তীব্র গতিতে নীচে পাথরের উপরে পড়ার ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় চারপাশে একটা কুয়াশার মতো আস্তরণ তৈরি হয়েছে । সেই জলকনা এসে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে । তাতে কি ! সকলে বাঁধন ছেড়া উদ্দাম আনন্দে বিভোর । ঝর্ণা, তা থেকে উৎপন্ন পাহাড়ি নদী, বিশাল বিশাল পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে ছোট ও মাঝারি প্রস্তরখন্ডকে টপকে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে জলরাশি । স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল । মনে হলো এখানেই থেকে যাই । এই রূপ, রস ফেলে কোথায় যাব ! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা আপ্লুত । ছোটোদের আনন্দ দেখার মতো । বোঝার উপায় নেই কার আনন্দটা বেশি - ছোটোদের না বড়োদের । সকলের ক্যামেরাই ব্যস্ত । কিছু যেন মিস হয়ে না যায় । এই অপূর্ব সুন্দর জায়গাতেই 'কোয়লা' ছবি র শুটিং হয়েছিল । শাহরুখ ও মাধুরী অভিনীত তানহাই গানের শুটিং এখানে হয় । আমি বৃষ্টির থেকে বাঁচতে ছাতা নিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু ছাতা মাথায় নিয়ে ছবি তুলব কিভাবে ! তাই ছাতা একজায়গায় রেখে আশপাশের বিষ্ময়কর সৌন্দর্যকে ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । প্রায় ঘন্টাখানেক থেকে ওপরে উঠে এলাম । প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে । আরও ৩২ কিলোমিটার দূরে তাওয়াং । গাড়ি ছুটতে লাগলো ।
তাওয়াং এ যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে । টিপটিপ বৃষ্টি হয়েই চলেছে । অবাক বিস্ময়ে দেখলাম রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির মাথা, কাঁচ সব ঘন বরফের আচ্ছাদন । রাস্তার ধারে ধারে বরফ জমে আছে । টিনের চালার বাড়িগুলোর মাথায় বরফ জমে রয়েছে । ওয়েদার একেবারে ঠান্ডা ঠান্ডা, কুলকুল । হোটেলে চেক ইন করার পর শুনলাম এসময় এখানে বরফ পড়ে না । কিন্তু এবছর পড়েছে । কপালটা ভাল বলতে হবে । তখন কি জানতাম যে পরদিন খারাপ খবর শুনব । যাইহোক আমরা ছেলেরা চারজনে বেড়িয়ে ৫০০ মিটার দূরের এক বাঙ্গালি হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে এলাম । তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে । বিছানায় শুয়ে মনে হোল কেউ যেন বিছানায় জল ঢেলে রেখেছে । উলিকট, সোয়েটার সব চাপিয়ে দুটো মোটা কম্বল গায়ের দিয়ে শুয়ে পড়লাম । মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে তাপমাত্রা দেখলাম -৩ ডিগ্রি । ঠান্ডা কাকে বলে মালুম হচ্ছিল ।
ভ্রমণ - অরুণাচল (৩১শে মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিল, ২০১৯) - ৬ষ্ঠ পর্ব/১
আজ ৩রা এপ্রিল । সকালে উঠে ব্যালকনিতে এসে মন ভরে গেল । চারিদিক রোদে ঝলমল করছে । তবে গতকালের চেয়ে বরফের ঘনত্ব যেন একটু বেশি বলেই মনে হলো । তারমানে রাতে আরও স্নো-ফল হয়েছে । চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ধারে, টিনের চালায়, কাছে ও দূরের পাহাড়ে সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বরফ জমে আছে । বেলা বাড়লে নিশ্চয়ই সব গলে যাবে । এবার খোঁজ নিতে হবে রাস্তার অবস্থা কেমন । ঠান্ডাটা জবরদস্ত আছে । আজ ও কাল আমরা তাওয়াং এর সব কিছু দেখে নেব এমন একটা সাদামাটা পরিকল্পনা ছিল, সকলের যেমন থাকে আর কি । যেমন দেখার কথা লোকাল সাইট সিয়িং, তেমনি যাওয়া ও দেখার কথা বুমলাপাস, মাধুরী লেক, পি টি সো লেক । হোটেলের ম্যানেজার তাপসবাবু গতকাল রাতে বলেই দিয়েছিলেন যে বুমলাপাস ও মাধুরী লেক যাবার আশা নেই বললেই চলে । বুমলাপাস যেতে হলে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হয় । রাস্তা খোলা থাকলে তবেই সেনাবাহিনী পারমিশন দেবে । যদি অতিরিক্ত স্নোফলের জন্য রাস্তা বন্ধ থাকে তাই উনি প্ল্যান বি মোতাবেক অন্য একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন । আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার নিয়ে বুমলাপাস, মাধুরী লেক বা পি টি সো লেক যাওয়া যাবে না । নতুন করে লোকাল ছোট গাড়ি (টাটা সুমো, ইনোভা ইত্যাদি) নিতে হবে - এটা আমাদের জানাই ছিল । যেহেতু আমরা ষোলজন তাই দুটো গাড়ি ভাড়া করতে হবে । মাধুরী লেক পর্যন্ত যেতে দিলে এক একটা গাড়ি ৩৫০০/- টাকা নেবে । আর যদি যেতে না দেয় তবে পি টি সো লেক পর্যন্ত ৩০০০/- টাকা করে এক একটা গাড়ি নেবে । বুমলাপাস গেলে আরো বেশি (আনুমানিক ৫০০০/- টাকা) । আমরা তাপসবাবুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম । যেহেতু গত দুদিন খুব স্নোফল হয়েছে তাই রাস্তা বন্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি । বুমলাপাস তো নয়ই, মাধুরী লেক, পি টি সো লেকও যেতে দেয় নি সেনাবাহিনী । যদি আমরা শেষ পর্যন্ত বুমলাপাস যেতে নাই পারি তবে আগামীকাল আমরা Zemithang যাবো ভাবছিলাম । Zemithang (৮৫ কিলোমিটার) যেতে এক একটা গাড়ি ৬০০০/- টাকা করে নেবে বলল তাপসবাবু । এদিকে গতকাল রাতেও খুব স্নোফল হয়েছে বলেই জানতে পারলাম । আমাদের গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না । আলিরা চেষ্টা করে চলেছে । এতো ঠান্ডায় বেচারা গাড়ির কি দোষ । সেও জমে বরফ । যদিও এখন আমরা যাবো না । আমরা যখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে মাধুরী লেক কেন আমরা পি টি সো লেকও যেতে পারব না তখন আমরা ভাবছিলাম ফার্স্ট হাফটা কি করব । আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ন'টার সময় লোকাল গাড়িতে বেড়িয়ে পি টি সো লেক ইত্যাদি ঘুরে একটার মধ্যে ফিরে আসার কথা । লাঞ্চ করে আবার দুটো আড়াইটার মধ্যে বেড়িয়ে আশেপাশের দ্রষ্টব্য স্হানগুলো আমাদের টেম্পো ট্রাভেলারে ঘোরার কথা । এদিকে আমরা চাইছিলাম গাড়ির ভাড়া একটু যাচাই করে নিই । তাপসবাবু সঠিক ভাড়া বলছে কিনা জানা দরকার । একটি গাড়ির সাথে কথা বলে ভাড়াগুলো জেনে গেলাম । তাপসবাবু সবগুলোতেই ৫০০/- থেকে ১০০০/- টাকা বাড়িয়ে বলেছেন । হয়তো তার নিজের কমিশন । Zemithang এর ক্ষেত্রে ৫০০০/- টাকা চাইল এই গাড়ির ড্রাইভার যেখানে তাপসবাবু ৬০০০/- টাকা চাইছিলেন । সে বলল যে ওরা যে ভাড়া বলবে হোটেল সব সময় তার চেয়ে ৫০০-১০০০/- টাকা বাড়িয়ে বলে কমিশন খাবে । যাইহোক শেষ পর্যন্ত এই গাড়ির ড্রাইভারদের থেকে জেনে Hanging Bridge বা Chagzam bridge যাওয়া ঠিক করলাম । এখানেও তাপসবাবুর পাঠানো সুমো/ইনোভা গাড়ি এক একটা ৩০০০/- টাকা করে চাইল । কিন্তু অন্য গাড়ি বলল ২৫০০/- টাকা ভাড়া । এগুলো বলার একটাই কারণ যাতে আপনারা বুঝতে ও ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন গাড়ি বুক করার সময় । যাইহোক ২৫০০+২৫০০ মানে ৫০০০ টাকায় দুটো গাড়ি বুক করে ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী Hanging Bridge দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । মিনিট ৪৫ এর জার্নি । আজ ঠান্ডার জন্য আমি স্নান করি নি । গিন্নি অবশ্য স্নান করে নিয়েছে । গতকালের সেই হোটেল জয় গুরুতে সকালের জলখাবার খেয়ে সাড়ে নয়টায় বেরিয়ে দশটা পনেরো নাগাদ পৌঁছে গেলাম । প্রথম দলাই লামার একজন শিষ্য টাংটন গ্যালোপো যিনি ছিলেন একজন স্থপতি, দার্শনিক এবং আয়রন চেইন সেতু প্রস্তুতকারী তিনি এই ব্রীজটি তৈরি করে ছিলেন । তিনি হিমালয় অঞ্চলের 100 টিরও বেশি লৌহ সেতু নির্মাণের কাজ করেছিলেন বলে জানা যায় । ১৪২০-১৪৩০ সালের মধ্যে তাওয়ং-চু নদীর উপর এই সেতুটি তৈরি করেছিলেন । আজ থেকে এতো বছর আগে পঞ্চদশ শতকের এই অত্যাশ্চর্য ব্রীজটি আমাদের সকলকে অবাক করে দিল । রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে বেশকিছুটা নিচে নেমে যেতে হয় । সম্পূর্ণ লোহার এই ঝুলন্ত ব্রীজটি । ব্রীজের তলা দিয়ে তাওয়ং-চু নদী তন্বী মেয়ের মতো পাহাড়ি পথ বেয়ে নাচতে নাচতে চলেছে । কল কল করে বয়ে চলা জলরাশি ছোট, বড়, মাঝারি সমস্ত ধরণের প্রস্তরখন্ডকে অবলীলায় ডিঙিয়ে সদর্পে বয়ে চলেছে । চারিদিকে পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে তার পথ । পরিস্কার ঝকঝকে জল । লোহার ঝুলন্ত ব্রীজে উঠেই প্রথমে একটু ভয় ভয় করবে । ব্রীজটা দুলছে । ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি বলে কথা । দুরে দু একজনকে যেতে দেখে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে চললাম । বেশ মজাদার । ততক্ষণে ভয়ডর সব হাওয়া ।
ব্রীজের অপর প্রান্তে পৌঁছে গেলাম । কিন্তু ওদিকে নামা গেল না । গেট বন্ধ রয়েছে । পঞ্চদশ শতকের এই প্রাচীন লোহার ঝুলন্ত ব্রীজের পাশেই আধুনিক কালের একটি স্টিলের ব্রীজ রয়েছে । যাঁরা পুরনো ব্রীজে উঠতে ভয় পাবেন তাঁরা আধুনিক কালের ব্রীজে উঠতে পারবেন । তবে পঞ্চদশ শতকের ব্রীজে আমরা বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা প্রায় সকলেই উঠলাম । ভয়ের কোনো কারণ নেই । প্রায় ছ'শত বছর আগের তৈরি এই ব্রীজটি দেখে আমরা এককথায় বিস্মিত ও চমৎকৃত হলাম ।
ফিরে চললাম সেই হোটেল জয়গুরুতে । দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে এসেছিলাম । এই হোটেলটি বেশ ভালো । পুরনো মার্কেট এরিয়ায় অবস্হিত । দামও ঠিকঠাকই লেগেছে আমাদের । ফিরে এসে ফোন করে জানতে পারলাম আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার গাড়ি এখনো ঠিক হয় নি । স্টার্ট হচ্ছে না । সকাল থেকে চেষ্টা করে মিস্ত্রী যাকে পেয়েছে সে দুপুর একটা দেড়টার সময় আসবে । এবার কখন গাড়ি ঠিক হবে , আদৌও ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না । যার কাছে আমরা গাড়ি ও হোটেল বুক করেছিলাম তার সাথে যোগাযোগ করে অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলা হলো । তাপসদা মারফত আলিরা আমাদের জন্য দুটো টাটা সুমো বুক করে দিল । টাকা গাড়ির মালিক দেবে । আমরা লোকাল সাইট সিয়িং দেখতে বেরিয়ে পড়লাম । সকলের লাঞ্চ করা আগেই হয়ে গেছিল । প্রথমে আমরা বুদ্ধ পার্কে এলাম । গৌতম বুদ্ধের এক সুবিশাল স্ট্যাচু । দূরের পাহাড়ের গায়ে জমা বরফ মুক্তোর মালা মতো ঝুলছে । অপূর্ব সে দৃশ্য । কখনো কখনো এক টুকরো কালো মেঘ সুয্যি মামাকে ঢেকে দিচ্ছে । এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যস্হল তাওয়াং মনেস্ট্রির উদ্দেশ্যে । তাওয়াং মনেস্ট্রি, ভারতের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম (লাসার Potala Palace এর পর ) এই সুদৃ্শ্য মঠটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার বা ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্হিত । এটি Gaden Namgyal Lhatse নামেও পরিচিত । মূল প্রার্থনা গৃহে ঢুকে পড়লাম । বিশাল দরজা নিজেরাই খুলে নিয়েছি । বাঁদরের উপদ্রবের জন্য দরজাটি বন্ধ রাখা হয়েছিল । প্রায় ৮ মিটার উচ্চতার বিশাল বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে এই প্রার্থনা গৃহে । সর্বত্র এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজমান । বৌদ্ধ স্হাপত্যের ঐতিহ্যগত শৈলী, দেওয়াল জুড়ে সুন্দর সুন্দর স্কেচ ও রঙিন চিত্র ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে যা মন ভরিয়ে দেয় । মনেস্ট্রি থেকে হিমালয় পর্বতমালার তায়াংচু ভ্যালির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যাবে । এটার বয়েস প্রায় চারশত বছর । বিশাল এলাকা জুড়ে এটি অবস্হিত । প্রায় শ'তিনেক ভিক্ষুকের আবাসস্থল এটি । এখানে একটি লাইব্রেরী আছে যেখানে ঢুকতে গেলে কুড়ি টাকার টিকিট কাটতে হবে । সময়াভাবে আমরা আর সেটা দেখি নি । তাওয়াং এর অন্যতম মূল আকর্ষণ এই মনেস্ট্রি । এবার আমরা এলাম Ugyenling Monastery তে । এখানে ৬ষ্ঠ দলাই লামা Tsanyang Ghatso জন্মে ছিলেন । তাই এটি ৬ষ্ঠ দলাই লামা জন্মস্থান নামেও পরিচিত । এটি তৈরি করেছিলেন Ugyen Zangpo ১৪৮৭ খ্রীষ্টাব্দে । তাওয়াং শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্হিত, তাওয়াং ওয়ার মেমোরিয়ালের কাছাকাছি । সাধারণ ভাবে ট্যুরিস্টরা এটা দেখতে আসেন না । সবাই তাওয়াং মনেস্ট্রি দেখেই চলে যান । ১৭০০ শতকে এটা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে এটি ছোট আকারে পরিনত হয়েছে । গেট দিয়ে ঢুকতে ডানহাতে একটি গাছ আছে যা ৬ষ্ঠ দলাই লামা নিজের হাতে বসিয়ে ছিলেন বলে জানা যায় । এবার আমরা এসে পড়লাম Dorjee Khandu Memorial Mesume আর Jangchub Chorten । ৯ই এপ্রিল ২০১৭ সালে চতুর্দশ দলাই লামা এটির উদ্বোধন করেছিলেন । Dorjee Khandu ছিলেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী । ৩০শে এপ্রিল ২০১১, হেলিকপ্টারে তাওয়াং থেকে ইটানগর যাবার পথে দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল । তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এটি তৈরি করা হয়েছিল । মিউজিয়াম বন্ধ থাকার জন্য আমরা ঢুকতে পারি নি । তাতে অবশ্য খুব একটা মন খারাপ হলো না । কারণ সুন্দর সাজানো গোছানো ও পরিস্কার এই পার্কের মধ্যে Jangchub Chorten রয়েছে । কিভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল তা কেউ আমরা বুঝতেই পারলাম না । দূরের পাহাড়ের গায়ে পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ রোদ আর মেঘের খেলা বড়ই আনন্দদায়ক । এরপর চলে এলাম Thegtse Sang-ngag Choekhorling Monastery । এই মঠটি অনন্য । এটি তাওয়াং এ খিন-মী গ্রামে অবস্হিত । এটি বৌদ্ধধর্মের ভিন্ন একটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যা নিংমা সম্প্রদায় নামে পরিচিত । এই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা লম্বা চুল রাখতে পারে ও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে । এখানে একটি ছোট্ট চিড়িয়াখানা মতো আছে । সেখানে হরিণ, খরগোশ, রাজহাঁস ইত্যাদি আছে দেখতে পেলাম । অনেক বড়ো জায়গা নিয়ে এটি । মূল উপসনালয়টি একটু ভিন্ন প্রকৃতির যা অন্য মনেস্ট্রি থেকে আলাদা । খুব সুন্দর ও রঙিন চিত্রে ভরা সমস্ত দেওয়াল । দূরের পাহাড়ের গায়ে ধীরে ধীরে মেঘ জমছে । দেখে মনে হবে ওরা যেন খুব ব্যস্ত । নিজের পছন্দ মতো বন্ধু খুঁজে নিয়ে গল্প গুজবে মশগুল । তাই পাহাড়ের কোলে লেপ্টে পড়ে আছে । নীচে তাওয়াং চু ভ্যালির অপরূপ সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয় অনায়াসে । এমন সুন্দর জায়গায় বারে বারে এলেও মন ভরবে না । এরপর চলে এলাম তাওয়াং War Memorial এ । ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের যুদ্ধে সকল শহীদদের (২৪২০ জন) স্মরণে এই ৪০ ফুটের রঙিন স্মৃতিসৌধটি নির্মিত ও উৎসর্গকৃত । এটি Namgyal Chorten নামেও পরিচিত । এর নকশাটি একটি বিশাল স্তুপ আকৃতির । ঢোকার মুখেই এক রঙিন সুবিশাল গেট পেলাম । এটি পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন । একজন সেনা অফিসার আমাদের সকলকে একত্রিত করে এর সম্পর্কে সবিস্তারে বললেন । আমরা সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তুলে নিলাম । এখানে দু-একটি ছাড়া সব জায়গায় ছবি তোলা যাবে । বোর্ফস কামান, বুদ্ধ মূর্তি, ইত্যাদি দিয়ে সাজানো জায়গাটা । একেবারে ঝকঝকে চকচকে । সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু জায়গায় সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ । এতোজন ভারতীয় বীর মৃত্যু বরণ করেছেন ৬২' যুদ্ধে ! স্যালুট জানাই তাদের সকলকে । এখানে দুটি হল আছে যার একটিতে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রসহ নানান সামগ্রী সংগৃহীত করে রাখা হয়েছে । অন্য হলঘরটিতে লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয় । লাইট এন্ড সাউন্ড শো যে হলটিতে হয় তার প্রবেশদ্বারটি পাশে রয়েছে আলাদা করে । আমরা যখন সেখানে পৌঁছোলাম তখন প্রথম শো'য়ের টিকিট না থাকার ফলে দ্বিতীয় শো (৬:৩০ মিনিট) এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় রইল না । প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বেশি সময় বাইরে থাকা মুশকিল । তবে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ব্যবহৃত ঘরে আমাদের সকলকে বসতে দিল । ঠিক সাড়ে ছ'টার একটু আগেই টিকিট দেওয়া শুরু হলো । দশ বছরের ওপর প্রত্যেকের জন্য তিরিশ টাকা করে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম । ১৯৬২ সালের সেই ইন্দ-চিনের যুদ্ধের উপর এটি দেখানো হলো । বেশ চমকপ্রদ অনুস্ঠান । অনেক অজানা কথা জানা হলো । তাওয়াং এর অন্যতম আকর্ষণ এই স্মৃতিসৌধটি এবং অবশ্যই লাইট এন্ড সাউন্ড প্রোগ্রামটি । আমাদের গাড়ির ড্রাইভারদ্বয় গাড়ি নিয়ে চলে গেছিল । ফোন করার সাথে সাথেই তারা আবার এসে আমাদের নিয়ে হোটেল জয় গুরুতে পৌঁছে দিল । রাতের খাবারের জন্য আগেই বলা ছিল । খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম । রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য বুমলা পাস, মাধুরী লেক ও পি টি সো লেক যাওয়া হবে না এ যাত্রায় । তাই আগামী কাল Zemithang যাওয়া ঠিক করলাম । সেই যে গাড়ি বলেছিল ৫০০০/- টাকা নেবে তাকেই বলে দেওয়া হয়েছে । সকাল ৬:৩০ মিনিটে বেরোতে হবে । যেতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে । যতক্ষন বাইরে আছি বা সোয়েটার, জ্যাকেট পরে আছি কোনো অসুবিধে নেই । কিন্তু ঘরে ঢুকে বিছানায় শোবার কথা চিন্তা করলেই ভয় হয় । সমস্ত কিছু মনে হচ্ছে বরফ জলে ভেজা । রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাও বাড়তে শুরু করেছে । তবে আজ আর রাস্তায় বরফ জমে থাকতে দেখি নি গতকালের মতো । টেম্পারেচার এক অথবা দুই হবে । কিন্তু মনে হচ্ছে তার চেয়েও কম । যাই হোক ঈশ্বরের নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম । কাল তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে যে ।
খাদের ধারের রেলিংটা ☺️☺️☺️দার্জিলিং (The Queen of Hills)❤️❤️❤️……।। (হোমাগ্নি ঘোষ)
প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি ছিল কফিহাউস ,কলকাতায় মানুষ হলেও আমার শৈশবের দীর্ঘ সময় কেটেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা বাগানে ,তিস্তা নদীর পাশে হটাত করে নাম না জানা প্রজাপতির সাথে। পাহাড় জঙ্গলে অনেক সময় কাটালেও একটা যায়গা ছোটবেলা থেকে ভীষণ প্রিয় আর কাছের হয়ে গেল আমার কাছে ,মন খারাপ হলেই আমি যার কাছে এখনও ছুটে ছুটে যাই ,যার খাদের ধারের রেলিং বেয়ে আমি আজো আমার শৈশব খুঁজি ,যেখানে গেলে আমার মনে হয় আমার বাবা আমাকে বলছে – জানিস বাবি এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় । এসো আজ তোমাদের বলি আমার সেই প্রেমিকার কথা আমার দার্জিলিঙের কথা । দার্জিলিঙে পৌঁছেই প্রথমেই চল যাই ম্যাল এ, ভারতবর্ষের বহু শৈল শহরে গেছি কিন্তু মেঘ রোদ বৃষ্টির খুনসুটিতে মেতে থাকা দার্জিলিঙের ম্যাল তাকে সবার থেকে স্বতন্ত্র আর অনন্যা করেছে। আপনি আনমনে হাটছেন এক রোদেলা দুপুরে হটাৎ করে এক দলা নীল কুয়াশা এসে ভিজিয়ে দিল আপনার সারা শরীর ,অনেকে বলে আমার প্রিয় দার্জিলিং নাকি ঘিঞ্জি নোংরা , আমি বলি তুমি দেখার দৃষ্টি অনুভূতির মাত্রা বাড়াও, রঙ বেরঙ্গের পোশাক পরা মিষ্টি নেপালি বাচ্চার হাসি, গরীব ঘোড়াঅলাদের হটাত একটানা কাজের ফাকে বিড়ি ধরানো , দুরে ভুট্টা বিক্রি করা সেই দরিদ্র মেয়েটার একরোখা জেদ আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে ,জীবনের মানে একটু হলেও উপলব্ধি করেছি। মোদ্দা কথা দার্জিলিঙের সেই হটাত করে বৃষ্টি, শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া,নেপালি কিশোরীর হাসি, পথচলতি সেই মাতালের এলোমেলো পায়ে পথ চলা ,সেই প্রচণ্ড দরিদ্র মানুষগুলোর হেরে যেতে যেতেও জীবনের কাছে হার না মানার চ্যালেঞ্জ আমাকে দার্জিলিঙের প্রেমে ফেলেছিল। প্রথমেই চল যাই দার্জিলিং জু তে আর তার সাথে HMI(HIMALAYAN MOUNTAINING INSTITUTE) পথে যেতে পড়বে দারুন সুন্দর St.Andrews church অদ্ভুত তার স্থাপত্য, ১৮৪৩ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এইটা তৈরি হয়েছিল ভুমিকম্পে প্রচণ্ড ক্ষতি হওয়ার পর পুনরাই ১৮৭৩ সালে এটা ঠিক করা হয়। মুলত স্কটিশ সৈন্য আর ইংলিশ টি প্লান্টের রা এখানে উপাসনা করত। আকা বাকা উঁচু নিচু চড়াই উতরাই পথ ধরে চলতে থাকি চলুন, তেষ্টা পেয়ে গেল যে কোন চিন্তা নেই, রাস্তায় পড়বে hot stimulating caffe বলে ছোট্ট দোকান, ভেজ মোমও আর তার সাথে কফি ,দোকানের উলটোদিকেই nightingale park তাতে ফুটে আছে অজস্র রঙ বেরঙের ফুল।
১৯৫৮ সালে প্রায় ৭০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত পদ্মাজা নাইদু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্ক যার অন্যতম আকর্ষণ রেড পাণ্ডা,তুষার চিতা,হিমালয়ান নেকড়ে। এছাড়াও আছে অর্কিড ,নানান স্তন্যপায়ী, পাখি, সরিস্রিপ। এখানে তুষার চিতার ক্যাপটিভ জনন বেশ সাফল্য পেয়েছিল। এর পর চল যাই hmi মিউজিয়াম দেখতে সেখানে দেখব বিখ্যাত তেঞ্জিং নোরগের সমাধি এবং EVEREST EXPEDITION ইতিহাসের অমুল্য সব তথ্য।
হালফিলের টুরিস্টরা তো এরপর চেনা জায়গা গুলোতে যায় ,তুমি চল আমার সাথে একটু অজানা দার্জিলিং কে দেখতে। সন্ধ্যা নামছে আমার পাহাড়ে সারা আকাশ জুড়ে কমলা রঙের সামিয়ানা, বাতাসে ভেসে আসছে গ্লেনারির কেক র পেস্ট্রির গন্ধ ,আমরা চললাম দার্জিলিং বিগ বাজারের দিকে,ঠিক রিঙ্ক মলের বিপরীতেই joeys pub…অঞ্জন দত্তের গানের লাইন টা মনে পরে যাবে – দার্জিলিঙের শ্যাওলা ভেজা গলির ভিতর জয়িস পাব… ছোট জায়গা, নিভু নিভু আলো আধারি, সারা বিশ্বের অনেক বিদেশী পর্যটক, সবাই বুদ পুরান দাজুর গীটারের সুরে,আমিও মাতলাম সেই সুরে হাল্কা বিয়ারের নেশায়, মিশিয়ে দিলাম নিজেকে সারা দুনিয়ার সাথে, সারা পৃথিবী হল আমার ঘর সেই ঘরের কাঠামো তৈরি ভালোবাসা আর বন্ধুত্তে। মনে পড়ছিল জন লেননের সেই কথাটা everything and everyone is connected by a chain of love my brother….আজ এতোটাই থাক আরেকদিন নিয়ে যাব আমার প্রিয় দার্জিলিঙের অন্য প্রান্তে, যাবার আগে চল একসাথে গলা মিলাই কয়েকটা লাইন এর সাথে, আজকের হিংসা মাখানো পৃথিবীতে কথাগুলো খুব জরুরী Imagine there is no heaven its easy if you try, no hell below us above us only sky. Imagine all the people living for today….Imagine there is no countries, it is not hard to do. Nothing to kill or die for and no religion too. Imagine all the people living life in peace…YOU MAY SAY I AM A DREAMER BUT I AM NOT THE ONLY ONE,I HOPE SOMEDAY YOU WILL JOIN US AND THE WORLD WILL BE AS ONE. ............ দার্জিলিং গেলে আপনি অবশ্যই যাবেন - HMI and Zoo, দার্জিলিং রোপওয়ে, টাইগার হিলের সূর্যোদয়, বাতাসিয়া লুপ, দার্জিলিং মল চৌরাস্তা, রক গার্ডেন আর গঙ্গা মাইয়া পার্ক, জাপানিজ টেম্পল আর প্যাগোডা, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট, মহাকাল মন্দির, টিবেটিয়ান রিফিউজি সেন্টার, ঘুম মনেস্ট্রি আর দার্জিলিং সেন্ট পলস স্কুল ❤️❤️❤️❤️ অবশ্যই খাবেন কেভেন্টার্সের সসেজ, গ্লেনারির কফি আর পেস্ট্রি সন্ধ্যায়, পেনাম, ওয়াশিংটন, কুঙ্গু রেস্টুরেন্টের দুর্দান্ত মোমো ❤️❤️❤️❤️❤️অনেকের প্রশ্ন কোথায় থাকবো ভালো ভিউ দেখবো তাদের জন্যে mayfair darjeeling, darjeeling himalayan gateway residency, hotel ivy castle, Little tibet, pahari soul homestay খুব ভালো এখান থেকে প্রাণ ভরে দার্জিলিং কে উপভোগ করুন..... হোমাগ্নি ঘোষ ।
অনেক দিনের ইচ্ছে পূরণে চললাম পাহাড়ি জগতে, ছেলেবেলা থেকেই তার ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য আমার কোনোদিন ছিল না! রওনা দিলাম দার্জিলিং... যতই দেখি নতুন লাগে ততই, সময় মতন দিন ক্ষণ স্থির ছিল তাই কিছুই সমস্যা হইনি পৌঁছাতে, হোমস্টে র আপন পরিবেশে আমার 5 বছরের কন্যা কে নিয়ে কোনো চিন্তা হইনি, মেঘের দেশ দুহাত বাড়িয়ে আপন করে নিল আরো একবার...
নিজের মতন করে একটু সময় নিয়ে চা বাগান, তিস্তা, ঘুম স্টেশন সবই আমার পরম পাওয়া... সত্যজিত রায় থেকে ঋত্বিক ঘটক ! বরফি থেকে মেঘে ঢাকা তারার নীতা সবাই দার্জিলিং এর আনাচে কানাচে আজও হাতছানি দিয়ে চলে যায়, চাই শুধু খুঁজে নেওয়ার চোখ..... ম্যাল এর উপরে " Kaventer's" র "Glenaryes" র সাথে কাটানো সময় টুকু যে আমার মতন মানুষের কাছে শুধুই কিছু মুহূর্ত নয় বরং বাঙ্গালী হিসাবে গর্বিত হাওয়ার বিষয় তা নতুন করে বলার নেই..... ভালো লাগার মতন অনেক কিছুই আছে! সেটা রও একবার ঘুরে না আসলে হইতো বোঝা যায় না....চাই শুধু সময় কে পকেটে পুরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ কিছু ছবির সম্ভার রইলো আশা করি ভালো লাগতে পারে.....
দেবভূমি হিমাচল প্রদেশের সিমলা কুফরি ট্যুর গাইড
হিমাচল প্রদেশে তিনটে সার্কিট - সিমলা কুলু মানালী কিংবা সিমলা সারাহান কলপা কিন্নর অথবা চাম্বা খাজিয়ার ডালহৌসি যে রুটেই যাওয়া হোক না কেনো সিমলা আপনাকে আসতেই হবে । (তবে তৃতীয় সার্কিট চাম্বা খাজিয়ার ডালহৌসি পাঠানকোট দিয়েও যাওয়া যায়) । সিমলা সত্যিই দেবভূমি । দার্জিলিং, শিলং, গাংটকের মতো সিমলা বাঙালির এক প্রিয় রোমান্টিক শৈল শহর । সিমলা ম্যাল রোডে কালী বাড়ী দর্শন না করলে বাঙালীর হিমাচল দর্শনই অসম্পূর্ণই রয়ে যায় । আজ আলোচনা করি দেবভূমি সিমলা এবং তারসাথে কুফরী ফাগু নিয়ে । সিমলা কালী মন্দিরের ডানদিকে মঙ্গলচন্ডী, বামে শ্যামলা মা । এই শ্যামলা কালী মা থেকেই শহরের নাম সিমলা । কিভাবে যাবেন : ----------------------- কলকাতা বা দিল্লি বা যেকোনো জায়গা থেকে কালকা, চন্ডীগড়, আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে গাড়ীতে কমবেশী ঘন্টা তিনেকের জার্নিতে পৌঁছে যাবেন সিমলা । যারা কালকা স্টেশনে নেমে সিমলা যাবেন তারা কালকা সিমলা হেরিটেজ টয় ট্রেন চড়ে বিভিন্ন টানেল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে যেতে পারেন । শিবালিক টয় ট্রেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এই ট্রেনের টিকেট পাওয়া বিশাল চাহিদার । এই ট্রেন ছাড়াও আরো অনেক টয় ট্রেন কালকা স্টেশন থেকে আছে । এছাড়া দিল্লি থেকে ভলভো এসি বাসে ঘন্টা দশেকের যাত্রাতেও সিমলা সরাসরি পৌঁছানো যায় । সিমলা তে কি কি দেখবেন : ----------------------------------- যেদিন ট্রেন থেকে নেমে গাড়ী বা টয় ট্রেনে সিমলা পৌঁছাবেন সেদিন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাবে । ওইদিন সিমলা ম্যাল রোড ঘুরে দেখার জন্য রেখে দিন । ওইদিন ছাড়াও মিনিমাম আরো দুদিন দরকার পুরো সিমলা এবং তারপাশের চেল, নালদেহরা, কুফরী, ফাগু ঘুরে দেখার জন্য । সিমলা শহরে যে গুলো প্রথমেই দেখবেন সেগুলো আলোচনা করা যাক : ১) সিমলা ম্যাল রোড, সিমলা কালী বাড়ী, ক্রাইস্ট চার্চ : সিমলা একমাত্র শৈল শহর যেখানে পাহাড়ের উপরে উঠতে লিফট সিস্টেম আছে । একদিকে সিমলা কালী বাড়ী আর অন্যদিকে ক্রাইস্ট চার্চ । চার্চের দিকেই লিফট । মাঝখানে পুরো এরিয়া তাই হলো সিমলা ম্যাল রোড । যেকোনো একদিক দিয়ে প্রবেশ করুন । এক এক করে পায়ে হেঁটে দেখে নিন সিমলা কালী বাড়ী, ম্যাল রোড, চার্চ । মার্কেটিং করতে পারেন । তবে সিমলায় দাম তুলনামূলক বেশী । মনে রাখবেন, সিমলা ম্যাল রোডে কোনো গাড়ী চলে না । ২) জাখু মন্দির : সিমলা ম্যাল থেকে রোপওয়ে (প্রতিজন ভাড়া আপ ডাউন ২৫০ টাকা) করে পৌঁছে যান সিমলা শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা জাখু মন্দিরে । রোপওয়ে করে না গিয়ে নিজেদের গাড়ী ভাড়া থাকলে সেই গাড়িতেই জাখু মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন । এটি একটি হনুমান মন্দির । বিশাল হনুমান মূর্তি আছে । জীবন্ত হনুমান থেকে সাবধান থাকবে । ওরা মানুষের চশমা সানগ্লাস দেখলেই আক্রমন করে চশমা সানগ্লাস খুলে নেয় । জাখু মন্দির ম্যাল থেকে ৩ কিমি দূরে, ৮০০০ ফুট উপরে অবস্থিত । এটাই সিমলার সবচেয়ে উঁচু স্থান । অপরূপ সিমলার ভিউ পাওয়া যায় । ৩) হেরিটেজ আর্মি মিউজিয়াম এবং সিমলা গল্ফ কোর্স : সিমলার অন্যতম সুন্দর সাইটসিন স্পট হলো আর্মি মিউজিয়াম । ভারত পাকিস্থান কিম্বা ভারত চিন যুদ্ধের অনেক তথ্য, সেনাবাহিনীর দ্রষ্টব্য জিনিস এই মিউজিয়ামে আছে । অনেক বড় এই মিউজিয়াম ভালো ভাবে দেখতে ঘন্টা দুয়েক সময় নেবেই । আর্মি মিউজিয়ামের পাশেই আছে সিমলা গল্ফ কোর্স । এটাও ঘুরে দেখা যায় । ৪) ভাইসরয় লজ বা সিমলা রাষ্ট্রপতি নিবাস: সিমলা ম্যাল থেকে ৪ কিমি দূরে অবজারভেটরি হিলে অবস্থিত ভাইসরয় লজ বা সিমলা রাষ্ট্রপতি নিবাস । ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন গরমকালে থাকতে এটি নির্মাণ করে । ভারত ভাগের চুক্তি (সিমলা চুক্তি) এইখানেই হয়েছিলো । এখন এটি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউশন অফ এডভান্স স্টাডিজ সেন্টার এবং সিমলায় রাষ্ট্রপতি নিবাস । বিশাল গার্ডেনের মাঝে এই বিল্ডিং টা । ভাইসরয় লজের পাশেই সিমলা হিমালয়ান বার্ড পার্ক । এটাও ঘুরে নেওয়া যায় ।
৫) চেল রাজপ্রাসাদ
আমরা যারা থ্রী ইডিয়টস সিনেমা দেখেছি তারা চেল রাজপ্রাসাদ দেখেনিয়েছি । এটি বর্তমানে হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল । পাঞ্জাবের রাজা ভূপিন্দর সিং এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন । সিমলা থেকে ৪৫ কিমি দূরে সাল, পাইন, দেবদারু, ওক গাছের মনোরম পরিবেশে এই চেল রাজপ্রাসাদ । সিমলা ভ্রমণে চেল রাজ প্রাসাদ অবশ্যই দর্শনীয় স্পট । প্রতিজনের প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা । ৬) কুফরী ফাগু : চেল থেকে ২৬ কিমি এবং সিমলা থেকে ১৬ কিমি দূরে অপরূপ জায়গা কুফরী । এটি সিমলা থেকে অনেক উঁচু জায়গা । শীতকালে এখানে তুষারপাত হয় । স্কি খেলার আসর বসে । গরমের সময় একটু শিলাবৃষ্টি হলেই বরফের মতো জমে যায় কুফরী । কুফরী থেকে আরো ৬ কিমি হলো ফাগু । দুটো জায়গায় ভ্যালির ভিউ, আপেল বাগান ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত । কুফরী তে ফান জোন বা ফান পার্ক ট্যুরিস্টদের কাছে খুব আকর্ষণীয় । এডভেঞ্চারস এবং আমাউসমেন্ট দুইরকম স্পোর্টস এই পার্ক গুলো তে আছে । টিকিট মূল্য ৭০০ টাকা করে । দুটোয় খেললে ১০০০ টাকা প্রতিজন । পার্কের প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা। এটি কুফরী ভ্রমণের অন্যতম জনপ্রিয় স্পট । কুফরী থেকে ঘোড়ায় চড়ে চার কিমি উপরে ভ্যালি এবং ফাগু যাওয়া যায় । ঘোড়ার ভাড়া প্রতিজন ৫০০ টাকা । এছাড়া কুফরী তে মিনি জু, গ্রীন ভ্যালি, নেচার পার্ক আছে । সেগুলো ঘুরে দেখা যায় । ৭) নালদেহরা : হাতে সময় থাকলে সিমলা থেকে গাড়িতে ঘুরে আসতে পারেন গল্ফ কোর্স, ভ্যালি, পাহাড়ী ভিউ এলাকা নালদেহরা । ২/৩ রাত সিমলায় কাটানোর পর এবার বেরিয়ে পড়ুন কুলু, মান্ডি হয়ে মানালী পথে অথবা নারকান্দা, সাহারান হয়ে কলপা, কিন্নর । হোটেল : --------- সিমলা শহরে থাকার হোটেলের অভাব নেই । তবে পিক সিজনে হোটেলের বিশাল ডিমান্ড । এপ্রিল মে মাস পিক টাইম । ওদিকে পূজার সময় অক্টোবর মাসেও ভালো ভিড় হয় । এইসময় হোটেল বুক করেই আসা ভালো । মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড হোটেল ভাড়া ১৫০০ টাকা । বাকি সময় অফ টাইমে অনেক কম ভাড়ায় স্পট বুকিংয়ে হোটেল পাওয়া যায় । গুগল ওয়েবসাইট সার্চ করলেই হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইট এড্ড্রেস পাওয়া যাবে । এছাড়া অনেক হলিডে হোম ও আছে । উদাহরণ স্বরূপ এলাহাবাদ ব্যাংক কর্মচারী সংগঠনের হলিডে হোম হোটেল পঙ্কজ নাম করা যায় । হোটেল পঙ্কজ নিজেও হোটেল ভাড়া দিয়ে থাকে । (এটি শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করলাম) আর একটি কথা উল্লেখ করা যায় গাড়ীর ব্যাপারে । হিমাচল প্রদেশ যে সার্কিটেই ট্রিপ করা হোক না কেনো ৭/১০ দিন পুরো ট্রিপের জন্য স্টেশন থেকে স্টেশন গাড়ী বুক করে নেওয়া ভালো । দিন প্রতি ৩০০০-৩৩০০ টাকা হিসাবে গাড়ি ভাড়া পাবেন বর্তমান রেটে ।
২ বছর ধরে কত প্ল্যান যে কারনে, আজ তার সামনে বসে আছি। বাবা তুঙ্গনাথ এর সামনে।।
আচ্ছা শুরু থেকেই শুরু করা যাক । আমাদের ট্রেক গ্রুপ " Argonaut "এর সব সদস্য মিলে ঠিক করা হয়েছিল এবার যাবো "তৃতীয় কেদার বাবা তুঙ্গনাথ" এর কাছে।।।। সেই অনুযায়ী সময় মতো টিকিট হোটেল বুকিং সব করা হলো।। অবশেষে এলো ৪ঠা মে , যাত্রা শুরু এবং ৪ ঘন্টা ৪৫ মিনিট দেরি তে হরিদ্বার পৌঁছানো গেল ৬ ই মে।।। হরিদ্বার এ 2 দিন কাটিয়ে শরীরটাকে সইয়ে নেওয়া গেল আবহাওয়ার সাথে, তারপর ৮ই মে ভোর ভোর শুরু হলো আমাদের ট্রেকিং শুরু করার পয়েন্ট , " সারি গ্রাম "এর উদ্দেশ্যে যাত্রা।।।।। দীর্ঘ্য ৯ ঘন্টা শরীরের এর সব হাড় এর জায়গা পরিবর্তন ও অবশেষে বিকেল ৩ তায় সারি তে পৌঁছানো ।।। কিন্তু এখন ও যে আমাদের বিশ্রাম নেওয়ার সময় আসেনি, কারণ মুখে কিছু দিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে দেওরিয়া তাল এর উদ্দেশ্যে।। যা কিনা সারি থেকে ২.৫ কিমি ট্রেক করে পৌঁছতে হয়।।। দেওরিয়া তাল নাম হওয়ার কারণ এখানে নাকি দেবতারা স্নান করতে আসতেন।।।।। যাই হোক চারিদিকে রোডোডেনড্রোন এর শোভা দেখতে দেখতে ট্রেক শুরু হলো , ১ কিমি যাওয়ার পর পড়লো বাবা ওমকারেশ্বের এর মন্দির।।।।। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার পথ চলা।।।। চরাই এর কষ্ট সামলে যখন শেষ একটা বাঁক নিলাম , মনে হলো এ সত্যি ই বুঝি দেবতাদের স্নানভূমি।। সামনে বিশাল সবুজ উপত্যকার মাঝে সবুজ টলটলে জল এ ভরা দেওরিয়া তাল, যার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত শুভ্র " চৌখাম্বা "।।। চারিদিকে কত জানা অজানা পাখির কুজন।।।।। নিমেষে পৌঁছে গেলাম সব মানসিক চিন্তা ভাবনার উর্ধে।।।। আজ রাত টা আমরা তাঁবু তেই কাটাব।।ভিউ পয়েন্ট এ বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করা জীবনের এক সেরা প্রাপ্তি।।।। এদিকে ঠান্ডা ও বাড়ছে।।। মুঠোফোনে দেখাচ্ছে তাপমাত্রা ৭ এ নেমেছে, যেটা কিনা রাতে আরো নামার চোখ রাঙানি দেখাচ্ছে।। তাড়াতাড়ি তাবু তে ফিরে গরম গরম রুটি দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে কম্বল এর নিচে সেটিয়ে যাওয়া। কারণ ভোর বেলায় যে সূর্যোদয় দেখতে ৫ টায় উঠতে হবে।।। অপূর্ব সূর্যোদয় দিয়ে দিনের শুরু করলাম পর দিন।।।। কিন্তু হাত এ যে কোনো সময় নেই তাড়াতাড়ি প্রাতঃ রাশ সেরে ১৪ কিমি ট্রেক করে পৌঁছতে হবে চোপতা , যা কিনা এশিয়ার " মিনি সুইটজারল্যান্ড " নাম এ পরিচিত।।। দীর্ঘ রাস্তা চরাই উৎরাই করে অবশেষে পৌঁছানো গেল " রোহিনী বুগিয়াল "।।।। আরো কিছু ট্রেক করে প্রায় ১০ ঘন্টা পর পৌঁছানো গেল চোপতা।। পৌঁছেই " জটায়ুর সেই উক্তি " মনে পড়ে গেলো " এ কোথায় এলাম মশাই , এ কোথায় এলাম "।। হোম স্টের বারান্দা থেকে সামনে তাকালেই হিমালয়ের বরফ ঢাকা সব বিখ্যাত শৃঙ্গ - কেদারনাথ, কেদার ডোম , নন্দা দেবী , নন্দা ঘুনটি আর পুরো যাত্রায় আমাদের সঙ্গ দেওয়া চৌখাম্বা।।।।।। আজ কের রাত তা চোপতাতেই কাটাব।।।। আসল ব্যাপারটাই বলা হয়নি এখনো।।। আমরা তুঙ্গনাথ ওঠার দিন ঠিক করেছিলাম ১০ই মে, যা কিনা এবার তুঙ্গনাথ মন্দির খোলার দিন ও।।।। ভাগ্যের এই সহায়তা আর কোনো দিন পেয়েছি বলে তো মনে পরে না।।।। যাই হোক তুঙ্গনাথ জি তো ৯ই মে ভক্ত দের কাঁধে ডুলি যাত্রা করে রাত ৮ টায় চোপতায় পৌঁছলেন , একদিন বিশ্রাম নিয়ে পর দিন নিজের বাড়ি তুঙ্গনাথ মন্দিরে যাবেন , এই উদ্দেশ্যে।।। পরদিন সকাল সকাল উঠে প্রস্তুত হওয়া তুঙ্গনাথ জির সাথেই তার বাড়ি যাওয়ার উদ্যেশ্যে (১২৮০০ ফুট) ।।।।।
সকাল ৯টায় শুরু হলো ডুলি যাত্রা, তুঙ্গনাথ জি চললেন ভক্তের কাঁধে চেপে, আর আমরা চললাম তার পিছে পিছে।।
চারিদিকে লাল, সাদা, বেগুনি, গোলাপি গুরাস এর দল আর মাঝে মাঝে সবুজ বুগিয়াল এর মাঝে মধ্যে দিয়েই চরাই পথ চলেছে।। পাশে পাশে চলেছে হিমালয়ের সব শৃঙ্গরা।।। অবশেষে ২.৩০ মিনিট ট্রেক করে পৌছালাম অভীষ্ট লক্ষে।।।। আজ রাত টা তুঙ্গনাথ এই কাটাব।।।। দিনের তাপমাত্রা এখানে ৬।। কিন্ত রাত এ সেটা নেমে দাঁড়ালো ২ এ।।।।। প্রচন্ড ঠান্ডা।।।।। কিন্তু আমাদের যে পরদিন ভোর ৪ টায় বেরোতে হবে আমাদের শেষ লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে " চন্দ্রশিলা " যার কিনা আসল নাম " রামচন্দ্রাশিলা "।।।।। যার উচ্চতা ১৪০০০ ফুট।।। ভোর ৪ টায় যাত্রা শুরু করে পৌঁছানো গেল ৫.১৫ তে।।। আমাদের পথ প্রদর্শক বললেন তাপমাত্রা এখন -১ ।।।কিন্তু কপাল মন্দ সূর্যোদয় এবার আর দেখা হলো না।।। সব বিখ্যাত শৃঙ্গ এবং সূর্যদেব মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছেন।।। যাই হোক কিছু সময় কাটিয়ে নেমে আসা আবার তুঙ্গনাথ এ।।।।। আজ ই আমরা চোপতা নামবো।। পরের দিন হরিদ্বার ।।।।। এবারের মতো যাত্রা এখানেই শেষ।।। আবার সেই একঘেয়ে শহুরে জীবন।।। তবে যান্ত্রিক ক্যামেরা ও মনের ক্যামেরায় যা যা তুলে নিয়ে এলাম টা দিয়ে পরের ট্রেক পর্যন্ত সময় কাটিয়ে দিতে পারব এই আসা নিয়ে চললাম ।।।।।।। কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য ------- হরিদ্বার থেকে সারি গাড়ির ভাড়া কম বেশি ৭৫০০/ চোপতা থেকে হরিদ্বার কম বেশি ৭০০০/ সবজান্তা গুগুল এর দয়ায় সবাই এখন সব কিছু জেনে নিতে পারেন।।। তাই তুঙ্গনাথ মন্দিরের ইতিহাস লিখে আর আপনাদের সময় নষ্ট করলাম না।।।।।
আজ আপনাদের শোনাই এক অপেক্ষাকৃত নতুন পাহাড়ি গ্রামের গল্প।
গত শুক্রবার রাতে আমরা স্কুলের ৫ বন্ধু sealdah থেকে special train এ উঠে শনিবার সকালবেলা পৌঁছলাম NjP। সেখানে আগে থেকে গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাতে করে রওনা হলাম Sittong এর উদ্দেশ্যে। পথে প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম সেবক পার হয়ে। এরপর গাড়ি দৌড়ালো birik পার করে sittong এর দিকে। পথে পরলো চুচেদুঙ্গা, নামথিং পখিরি (লেক টি শুকিয়ে গাছে যদিও)। প্রায় দুপুরবেলা গিয়ে পৌছালাম মেঘবিতান cottage। এটি upper sittong e অবস্থিত। দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। পাহাড়ের ঢালে চারদিকে চা বাগানের মধ্যে হঠাৎ দুটি ঘর। সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের সম্ভার। অসাধারণ জায়গা। অপেক্ষা করছিলেন সমীর বাবু, যিনি এই cottage এর সবকিছু। আমাদের ৫ জনের একটি ঘরেই হয়ে গেলো। ২ টি খাট, dinning table, tea table সমেত সুন্দর একটি কাঠের ঘর। ঘরে পৌঁছে দুপুরের স্নানআহার সেরে বিকেলে সমীর বাবু নিয়ে গেলেন আশপাশের মন্দির, লেপচা গ্রাম, ৪০০ বছরের পুরনো মনাস্ট্রি দেখাতে। বিকেলের পরন্ত আলোতে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ঝিঁঝি পোকা আর নাম না জানা পাখির ডাক শোনা, চারপাশের পাহাড়ের ঢালে ঢালে গ্রামগুলোর জোনাকির মতো জ্বলে থাকা আলো, সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। রাতে ফিরে ভাত, মুরগি সহযোগে আহার সেরে ঠান্ডায় এক ঘুমে রাত কাবার। পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে গাড়ি নিয়ে বেরোনো হলো পারিপার্শ্বিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। প্রথমে এলো কমলালেবু বাগান। দার্জিলিঙের এই গ্রামটি বিখ্যাত কমলালেবুর জন্যই। গাছে গাছে থোকা থোকা কমলালেবু হাতের নাগালে পাওয়া এক আশ্চর্যের বিষয়। যদিও এখন সবুজ অবস্থায়। তবুও ২-১ টি পাকা কমলালেবু দেখে খাওয়ার লোভ সামলানো গেলো না। এরপর রিয়াং নদীর পার করে পৌছালাম অর্কিড বাগান। পার্বত্য এই ফুলটির একটি আলাদাই সৌন্দর্য্য। পথে রিয়াঙ নদীর ধারে কিছু নিজস্বী তোলার বিরতি তো ছিলই। সেখান থেকে পৌছালাম কবিগুরুর স্মৃতিমুখর মংপু। এখানের এই বাগানবাড়িতে কবিগুরুর বেশ কিছুদিন কাটান। সেই বাগানবাড়ি অবস্থানগত এবং স্থাপত্যের দিক থেকে সত্যি দর্শনীয়। ঘুরে দেখলাম ভেতরের ঘরগুলি, বিভিন্ন পুরনো পুঁথি, কবির হাতে লেখা কবিতা, গদ্য। সেখান থেকে পৌছালাম লেপচা জলপ্রপাত। গাড়ি নিচে রেখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে ওপরে উঠতে হয়। কিন্তু নয়নাভিরাম জলপ্রপাতটি রাস্তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। এরপর শেষ গন্তব্য ছিল আহালদারি view point। পাহাড়ের মাথায় অসাধারণ একটি point, যার চারদিক ঘিরে আছে পাহাড়, নিচে দেখা যায় তিস্তা নদী। এই জায়গার সৌর্ন্দয্য ভাষায় বর্ণনা করতে আমি অপারগ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়ায় দাড়িয়ে থাকা দায়। এখানে কিছু থাকার ব্যবস্থাও আছে।
ঘোরাঘুরি শেষ করে cottage এ ফিরে এসে সেদিন কাটিয়ে দিলাম জমে থাকা গল্পের ঝুলি খুলে, পুরনো স্মৃতিচারণ আর খাওয়াদাওয়া করে।
পরদিন সকালে ভারাক্রান্ত মনে প্রাতঃরাশ সেরে গাড়ি করে শিলিগুড়ির দিকে রওনা হলাম। তারপর... থাক সময়টা ওখানেই থমকে যাক। আসা করি আবার খুব তাড়াতড়ি ফিরে আসবো শিলিগুড়ি, আবার কোনো এরকম ছবির মত গ্রামে। ততদিন ’স্মৃতিটুকু থাক’। ??? আপনাদের বলি, যদি প্রকৃতির কোলে, নিরিবিলিতে ২ দিন কাটিয়ে আস্তে চান তাহলে অবশ্যই চলে যান sittong আর থাকুন মেঘবিতানে। এক বাঙালি কিভাবে সব স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে ওই নির্জন স্থানে নেপালিদের সাথে মিলে homestay চালাচ্ছেন না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। Caretaker সমীর (হ্যাঁ এই নেপালি ছেলেটির নামও সমীর), নেপালী driver বিধানের আন্তরিকতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। শেষ দিন ওরা আমাদের বিদায় জানালো নেপালি খাদা গলায়ে পরিয়ে। পরিশেষে আপনাদের জন্য রইল টুকরো টুকরো কিছু স্থিরচিত্র। বি: দ্র: এই ২ দিনে ২ জন একদম ই আমাদের মুখ দেখালেন না। একজন হলেন salamander, যে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীটি ওখানে সংখ্যায় প্রচুর। আর এক অহংকারী মেঘের ঢালে নিজেকে আড়াল করে রাখলেন (পরিষ্কার আকাশে ঘরের জানলা থেকেই ওনার দর্শন পাওয়া যায়)। আশা করি আপনাদের সাথে এমন হবে না। ??? |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |