সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি
ডিসেম্বরের শেষ, ঠান্ডাটাও এবারে পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। হওয়ার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ একটা উৎসব উৎসব মেজাজ। আমাদের অফিসই বা এই মেজাজের ব্যতিক্রম হবে কেন, রব উঠলো একটা পিকনিক করতে হবে। সেই মত শুরু হলো তোড়জোড় আর আলোচনা। সবার ইচ্ছা একটু নিরিবিলি আর offbit জায়গা। তবে জায়গাটা হতে হবে কোলকাতার কাছাকাছি, যেখানে দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসা যাবে। কারণ আমাদের অনেকজনই আছে যারা বাইরে রাত কাটাতে পারবে না। অবশেষে বহু আলোচনার পর ঠিক হলো ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ আমরা যাব পিকনিকে। আর জায়গা? জায়গা হলো সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ঝড়খালি। কোলকাতা থেকে দূরত্ব একটু বেশিই (১০০ কি.মি. এর সামান্য বেশি ), কিন্তু একদম ভোরবেলা নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে দিনে দিনে ফিরে আসা যেতেই পারে। শুরু হলো তোড়জোড়। প্রথমেই খোঁজ করা হলো মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের। internet ঘেঁটে দেখলাম Royal Sundarban Wild Resort টি বেশ সুন্দর। অবশেষে এলো সেই দিন। আমার pickup point ছিলো সকাল ৬:৩০ মিনিটে exide মোড়ে। সেইমত ভোর ৫টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। তখনো সূর্য্যিমামার ঘুম ভাঙ্গতে বেশ কিছুক্ষণ সময় বাকি আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই চলে এলো হাওড়া স্টেশন যাবার বাস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশন। সোয়া ছটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম Exide মোড়ে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো সবার আসার জন্য। সবাই আসতে আমরা এগিয়ে চললাম পরবর্তী peekup point শিয়ালদহর জন্য। সবাইকে নিয়ে আমরা যখন শিয়ালদহ ছাড়লাম ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। Science City পার করার পর বাইপাসের বাঁদিকের পাশের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে আবার বাঁদিক ঘুরে পরলাম বাসন্তী হাইওয়েতে। পথে বানতলার কাছে দেখি একটা দোকানে গরম গরম লুচি ভাজা হচ্ছে। ভোরবেলা কারোরই কিছু খেয়ে আসা হয়নি। অতএব যাত্রায় সাময়িক বিরতি। গরম গরম লুচি আলুর তরকারি আর জিলিপি দিয়ে বেশ জমে গেলো সকালের জলখাবার। জলখাবার খেয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা। কখনো দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত কখনো ছোটো গ্রাম আবার কখনো ছোটো শহরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের বাস। ক্যানিং পেরিয়ে কিছুটা যেতে পড়লো মাতলা নদী। দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম ঝাড়খালি বাজারে। ঝড়খালি বাজার থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে আমাদের রিসর্ট। রিসর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা ১২টা বেজে গেলো। রিসোর্টে ঢুকেই মনটা ভরে গেল। গেটের সামনেই রয়েছে ছোট্ট একটা জলাশয়। জলাশয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে পরপর সাজানো ছোটো ছোটো কটেজগুলি। কি সুন্দর তাদের নাম আমুদি, পুঁইমাচা, টগরী ... আরও কত কি। সব নামই জঙ্গলের সঙ্গে মিলিয়ে। সারা রিসোর্টটা জুড়ে ফুটে আছে গাঁদা, জবা, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগঝুটি আরো কতরকমের ফুল। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। সোমবার বলেই বোধহয় রিসর্টে আর কোনো অতিথি ছিল না। রিসোর্টের বাগানে শীতের মিঠে কড়া রোদ্দুরে ঘুরতে বেশ ভালোই লাগছিলো। মাঝে এলো গরম গরম চিকেন পকোড়া আর চা। চা পকোড়া খেয়ে বেরিয়ে এলাম রিসর্টের বাইরে। রিসর্টের ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে সুন্দরবনের বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ গাছের ঘন জঙ্গল। দেখলাম জঙ্গলের মধ্যে একটা নৌকাও রাখা আছে। তার মানে জোয়ারের সময় ওই পর্যন্ত জল চলে আসে। আসে পাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলে কেটে গেলো আরো বেশ কিছুটা সময়। ইতিমধ্যে ডাক পরলো মধ্যাহ্ন ভোজনের। সবাই এসে জড়ো হলাম রিসর্টের রেস্তোরাঁতে। একে একে সকলের খাবার পরিবেশিত হলো। খাবারের স্বাদ ও পরিমাণ বেশ ভালো।
দুপুরের খাবার শেষ হতে হতে প্রায় আড়াইটে বেজে গেলো। এরপর আরও কিছুটা সময় গল্পগুজব আর ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে, বিকাল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা রিসর্ট থেকে check out করে বের হয়ে পড়লাম ঝড়খালি জেটি ঘাটের উদ্দেশ্যে। এখান থেকেই বিদ্যাধরী নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর লঞ্চ ভাড়া করতে হয়। কিন্তু বাস বা গাড়ি কোনোটাই পুরোপুরি জেটিঘাট অব্ধি যায় না। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হয় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। বড় মনোরম সেই রাস্তা। এখানে রয়েছে ভারতের প্রথম Tiger rescue centre। আর আছে ছোট্ট একটা পার্কও। এই পার্কের মধ্যে একটি পূর্ণ বয়স্ক বাঘকেও রাখা আছে। তবে সময়ের অভাবে আমাদের আর পার্কে ঢোকা হয়ে ওঠেনি। রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম জেটিঘাটের দিকে। আগেই সাবধান বাণী নজরে এসেছিলো, এবার স্বচক্ষে দেখলাম। বেশ কয়েকটা কয়েকটা মোটাসোটা হৃষ্টপুষ্ট বাঁদর বসে আছে রাস্তার মাঝখানে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম জেটিঘাটে।
জেটিঘাটে পৌঁছে দেখলাম পুরানো জেটি বন্ধ হয়ে গেছে। লঞ্চ booking অফিসের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এখন লঞ্চে উঠতে হয়। ঘন্টা হিসাবে লঞ্চ ভাড়া পাওয়া যায় এখানে। আমরা ২ ঘন্টার জন্য একটি লঞ্চ ভাড়া করে, তাতে উঠে পড়লাম। লঞ্চের নিচের দিকে রয়েছে চারটি double বেড কেবিন আর উপরে রয়েছে বসার ডেক। রয়েছে সুন্দর washroom এর ব্যবস্থাও। বসার জন্য় ডেকে চিয়ার পাতা রয়েছে অনেকগুলো। আমরা সকলেই উপরের ডেকে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে বনের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললো লঞ্চ। সুন্দরী, গড়ান, গেঁওয়া আরও কত জানা অজানা গাছ আর পাখি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম বিদ্যাধরী নদী মধ্যে দিয়ে। কখনো দেখলাম মাছরাঙ্গা পাখি একনিষ্ট মনে জলের দিকে চেয়ে বসে আছে শিকারের আশায়, কখনো আবার দেখলাম একদল সি-গাল মাছধরা নৌকার পিছু পিছু ধাওয়া করে উড়ে চলেছে। বিদ্যাধরীর ব্যাপ্তি এখানে বিশাল, ভুল হয় সমুদ্র বলে। একুল থেকে ওকুলকে মনে হয় একটা সরু কালো সুতোর মত। তীরে সবুজের সমারহ আর বিদ্যাধারীর কালচে সবুজ জলে তার প্রতিফলন দেখতে দেখতে কখন যে একঘন্টা কেটে গেলো খেয়ালই করা গেলো না। এখান থেকে লঞ্চ তার মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরলো। এদিকে সূর্যদেবও তার দিনের পাট চুকিয়ে ঢলে পড়েছেন পশ্চিম দিকে। নদীর জলে আস্তে আস্তে লাগতে শুরু করেছে লালের ছোঁয়া। ঝড়খালিতে লঞ্চের মধ্যে বসে সূর্যডোবার দৃশ্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রকৃতি যে কত রকমের রং দিয়ে নিজেকে সাজাতে পারে তা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সময় যত এগোতে থাকে, যত সূর্যের আলো কমতে থাকে তত বাড়তে থাকে রঙের বাহার। ক্যামেরায় সে দৃশ্য বন্দী করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছবিতে যা উঠলো তার থেকেও অনেক সুন্দর সেই দৃশ্য। একসময় আস্তে আস্তে প্রকৃতির সব আলো ম্লান হয়ে গেলো, নেবে এলো রাত। জ্বলে উঠলো লঞ্চের আলো। আস্তে আস্তে আমাদের লঞ্চ আবার এসে ভিরলো জেটিঘাটে। এবার ফেরার পালা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোকে পাথেয় করে ফিরে চললাম আমাদের বাসের কাছে। দূষণহীন কালো আকাশে তখন মিটমিট করে জ্বলছে সপ্তর্ষি, কালপুরুষ আরো অসংখ্য় তারারা সেও এক মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা….
0 Comments
সুন্দরবন
মাতলা নদীর বুকে দুইদিন প্রায় ঘন্টা চারেকের অপেক্ষার পর বোট আসে পৌঁছলো কেল্লায়।রাত তখন আটটা ,পিয়ালী নদী ধরে অন্ধকারে মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের বোট।দূর থেকে ছুটে আসা জেলে দের বোটের কৃত্তিম আলো ছাড়াও আমাদের মাথার ওপর জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল অসংখ্য নক্ষত্র।অনেক বছর আগের সেই কোন ছোট বেলায় দেখেছিলাম এত সুন্দর একটা নক্ষত্র খচিত আকাশ।সেই আদিম ধ্রুবতারা কে পাথেয় করে বোট যখন কৈখালী এসে পৌঁছলো রাত তখন ১০.৩০ প্রায়। ইঞ্জিনের শব্দে যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর ৫.২৫ প্রায়।ব্ল্যাংকেট সরিয়ে ডেকে আসতেই মনটা সতেজ হয়ে গেল।ঠিক এরকম একটা সূর্যোদয় দেখা হয়নি বহুদিন হয়তো বা বহুবছর। কৈখালী থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম আবার।গত রাতের অন্ধকারে যে ম্যানগ্রোভ অরণ্য দেখা যায়নি তা সকালের আলোয় আমাদের অবাক করে দিলো।এত সুন্দর বনাঞ্চল দেখা হয়নি আগে।সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বনভূমি।সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। আমাদের বোট দুই ধারের সুন্দরী,গড়ান,কেওড়া ও হেতালের বনের মাঝ দিয়ে খাঁড়ি পথে এগিয়ে চললো।সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর মুহূর্ত,আমাদের সকলের চোখ তাক করে আছে দুই ধারের বনাঞ্চলের দিকে।বেশ কয়েকটা খাঁড়ি ঘুরেও বাঘের দেখা মিলল না।ক্লান্ত চোখ ও নিরাশ মন নিয়ে আমরা বনী ক্যাম্প ঘুরে ঝড়খালী পৌঁছলাম সন্ধের পরে।সেই রাত সেখাইনেই নোঙ্গর করা হলো বোট। পরেরদিন আবার বোট চললো বাঘ দেখার আশা বুকে নিয়ে।এরপর সজনেখালী ,সুধন্যখালী, পাখিরালয় ও দোবাঁকি ঘুরে কিছু হরিণ আর কুমিরের দেখা মিললো। নাহ সুন্দরবনের রাজা রয়্যাল বেঙ্গল আর দেখা হলনা,কিন্তু দেখেছি সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য,বহুদিন না দেখা একটা অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয়,আর দেখেছি প্রীতিকূল পরিবেশে স্থানীয় মানুষের অন্ন সংস্থানের জন্য প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত জীবন বাজী রেখে জীবিকা নির্বাহ।শহরের দামী রেস্তরাঁয় খাবার নষ্ট করা মানুষ গুলো যদি একবার এই দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর কঠীন জীবন সংগ্রাম দেখতো তাহলে হয়তোবা তাদের বোধোদয় হত। নিজেদের শ্রেষ্ঠ জীব মনে করা মানুষগুলো যখন সেখানে গিয়ে বক্স বাজিয়ে নাচগান করছে,খাবার এর পাতা গ্লাস প্লাস্টিক নদীতে ফেলে এসে বনাঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছে তখন নিজেদের সত্যিই নিকৃষ্ট জীব মনে হয়।
নভেম্বর ২, ২০১৮
বেড়াতে এসেছি সুন্দরবন। কোথায় বাঘ দেখবো তা নয় কেবল জল আর জল। এতপর্যন্ত পড়েই বোধহয় ভাবছো আমার এবারের বেড়াতে যাওয়াটা পুরো মাঠে মারা গেছে তাহলে রোসো আগে আমার গল্প শোনো। আমিতো বেমালুম অবাক, শহরের মেয়ে গ্রাম সেভাবে দেখিনি, আর সুন্দরবন সেতো একেবারেই আলাদা। সোনারপুর থেকে ক্যানিং হয়ে যখন গদখালি এসে পৌঁছালাম তখনো জানিনা আগামী কয়েকটা দিন জলই হয়ে উঠবে ঘর বাড়ি। রাতের বেলায় লজে শুয়েও বোধ হবে দুলছি, কেবলই দুলছি। তা সেসব পরের কথা। উঠে পড়লাম আশালতায়। আমাদের লঞ্চ আশালতায় আনকোরা সাতটা বিছানা নতুন ধপধপে সাদা চাদর বালিশে মোড়া। চমৎকার বাথরুম। দেখে শুনে থ। আগে কাশ্মীরের ডাললেকে থেকেছি। সেখানে বোটে কুপ থাকে তাতে কাশ্মীরি কাজের কার্পেট আঁটা থাকে আগাগোড়া। সে আর এক আর এ, অনেক আলাদা। তো যাইহোক শুরু হলো আমাদের জলজ ভ্রমণ। নদীর পর নদী জল আর জল। এর শেষ কোথায়!! প্রথমদিনেই মনে হলো উফফ নামতে পারলে বাঁচি। চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন শূন্যতা গ্রাস করে ফেলতে চাইছে যেন। শরীরে ক্লান্তি নেমে আসছে ঘুম আসছে। ভীষণ ঘুম। জলপথে অনেকটা রাস্তা ঘুরে সন্ধ্যে বেলায় নামলাম পাখিরালয়ে। রাতটুকু কটেজেই থাকা। নেমে অনেকখানি ভালো লাগলো। ফ্রেস হয়ে রাতে আদিবাসীদের ঝুমুর, হাসান রাজার পালার নানা গান, সুন্দরবনের লোকগান আর নাচে মুগ্ধ হয়ে রইলাম আমরা।
নভেম্বর ৩, ২০১৮
সকাল ৬টায় আবার এসে উঠলাম আশালতায়। আবার যাওয়া। এবার একটু অন্যরকম। কি বিশাল নদী। কত রকমের নাম না জানা নদী এসে মিশেছে তাতে, কেউ বিদ্যেধরী কেউ রায়মঙ্গল। শহরের মেয়ে নদীর কি বুঝি আমি। আমার দৌড় বাঁকা, জল শুকনো দামোদর খুব বেশী হলে দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গা। এই প্রথম দেখছি নদী থেকে নদীতে নানারঙের জলের কি অপূর্ব সম্ভার। কখনো রোদ এসে পড়ছে তো কখনো মেঘ। সাদা মেঘ কখনো বা কালো। কখনো তীব্র রোদ আবার কখনো কেবলই বিভা। আর জল কখনো আকাশি কখনো নীল কখনো ঘোলাটে কখনো সবুজ। দূরে বনানীর শ্রেণী রোদ মেঘের ছায়ায় রঙ পাল্টাচ্ছে অবিরাম। ব্যাস ভালোবেসে ফেললাম। ভীষণ ভালো লেগে গেল হঠাৎ ই। মোহিত হয়ে গেলাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি এবার লক্ষ্য করলাম নদী কই। এতো সমুদ্র! কি ব্যাপার! লঞ্চের সারেং দীপক বাবু ব্যাপারটা খোলসা করলেন। এই যায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ফলে এখান থেকে আদিগন্ত কেবল জল ই জল গাছ নেই, ছাওয়া নেই কিচ্ছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু জল। এতক্ষন জোয়ার চলছিল। এবার এলো ভাটা। জল নেমে গেল গাছগুলোর শিকড় বেড়িয়ে এলো। শিকড়ের ঝুড়ি নেমেছে অজস্র। ছেলেবেলায় শ্বাসমূল ঠেসমূলের কথা পড়েছিলাম আজ চাক্ষুস দেখলাম। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। কখন যে বিদ্যাধরী হয়ে গেল বনইভরনী নদী আর কখনই বা হয়ে গেল নিতাই নদী সেকথা আমার পক্ষে জানা অসম্ভব। কোথায় কি জল একটু বেশী গাড় হয়েছিল! কোথায় যেন মনে হচ্ছিল নদীটা বড্ড সরু! কি জানি। দুই যায়গায় বাঘ দেখবো বলে গেলাম আমরা, দোবাঁকি আর নেতা ধোপানীর ঘাটে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের নিরাশ করল। বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই ফিরে আসতে হলো শেষ পর্যন্ত। মনসামঙ্গলের বিস্ময়টুকু মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো কেবল। নাহ বাঘ আমরা দেখিনি। কিন্তু নদীর সকাল দেখেছি, দেখেছি নদীর সূর্যাস্ত। নদীর জলের রঙ অস্তমিত সূর্যের আলোয় যখন রাঙা হয়ে উঠেছিল তখন গোধুলীর অস্তরাগ মেখে রাঙা হয়ে উঠল নদীর জল। ফাগ লেগেছিলো আগুন রাঙা জলে। আছাড়ি পিছাড়ি জলের ঢেউ বিদ্যাধরীর হাজার বছরের ধ্যান ভাঙছিল যেন। শান্ত জলে গরান গাছের ছাওয়া নাচছে। এ যেন কোন শতাব্দীর খুঁজে পাওয়া সেই হারানো বিকেল, অতল জলে নিবিড় হয়ে আছে। নানা রঙের পাখির মেলা আর হরিণ দেখেই মন শান্ত করতে হলো। আর দেখলাম চরায় শুয়ে ক্লান্ত বয়জ্যেষ্ঠ কুমীরমশাইকে।
নভেম্বর ৪, ২০১৮
আজ সবারই মন খারাপ। মুখ ভার। মেঘলা আকাশ ফেটে সূর্যের বিভা ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যাধরীর জলে। তবে কি আজ আর ঘোরা হবেনা, দেখা হবেনা বাঘ! মন কেমনের প্রহর গুনছি আর পাখিরালয়ে আদরের কুকুর গুলিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছি। লঞ্চ এসে লাগলো ঘাটে। আমরা অন্যপথ ধরলাম। এপথে অজস্র গোসাপ। এদিক ওদিকে রোদে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে চড়ায়। কালকের মতো আজও পেড়িয়ে গেলাম পঞ্চনদীর মিলনক্ষেত্র। এই পাঁচটা নদী হলো গোসাবা, নিতাই, নবাঁকি, হরিণভাঙা আর দেউলভরানি। আজ বিদ্যাধরী থেকে গোমতী নদী দিয়ে সুন্দরবনের আরো গভীরে প্রবেশ করলাম আমরা। এখানে নদী ভয়ঙ্কর রকম শান্ত। আশে পাশে দূরদূরান্ত অবধি কোনো গ্রামের রেখাটুকুও নেই। আছে কেবল গভীর জঙ্গল। দুপাশের সবুজ রঙ ঈষৎ গাঢ়। এমনকি চলতি পথে এক আধটা স্টীমারও চোখে পড়লোনা। শুনলাম এ পথে স্পেশাল পারমিশন করে আসতে হয়। সবাই অনুমতি পায়না। গোমতী ছেড়ে সুধন্যনদী ধরলাম। সবারই মনটা খচ খচ করছিল কেবল পাখি দেখছি হাজার হাজার, হঠাৎ এ যায়গাটা এতো চুপচাপ হয়ে গেল কেন? খুব ধীরে এগোচ্ছে আমাদের লঞ্চ। কোথায় এতটুকু শব্দ নেই। সাংঘাতিক নিস্তব্ধতা। দিনে দুপুরেও ভয় লাগছে, ভীষন ভয়। আমরা চলেছি সড়কখালি ১ নামক খাঁড়ি দিয়ে। খাঁড়িটা এতটাই সরু যে আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে দ্বিতীয় কোনো নৌকা যাওয়ার রাস্তাটুকুও নেই। হঠাৎ সারেং দীপকবাবু দেখলাম ছটফটিয়ে উঠলেন। বললেন জাহাজ ফেরাও, জাহজ ফেরাও। আমরা দমবন্ধ করে বসে আছি। একেবারে সাইলেন্ট। পুচকু গুলো খালি উত্তেজনায় কথা বলে উঠছে, আর বড়ো দের চোখরাঙানিতে আরো ব্যাকুল হয়ে উঠছে। এমনি সময় দেখলাম সেই কাঙ্খিত দৃশ্য। অদূরে জঙ্গলের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন বাঘমামা। বলতে যতখানি সোজা ততটা সহজে আমরা বাঘ দেখিনি অবশ্য। শুয়ে বসে চেয়ারে উঠে এপাশে বেঁকে,ওপাশে লাফিয়ে তবে দেখা গেছিল সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। আর চোখে যা দেখেছিলাম ক্যামেরাতে ধরা পড়েনি তার এক বিন্দুও। শুধু সেদিনের সেই ক্ষণকাল আঁকা হয়ে গেছিল হৃদয়ে। যাইহোক বাঘ দেখাতো হলো। তবুও দেখে দেখে আশ মেটেনা। লঞ্চ এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে আরো কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে এমনি সময় বাঘ বাবাজী উঠলেন। বোধহয় ইচ্ছে ছিল আড়মোড়া ভেঙে আমাদের দলের একটিকে নিয়ে ডিনার সারার। তবে আমরা আর তাকে সে অবসরটুকু দিলুম না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লঞ্চ নিয়ে পগারপার। তারপর টানা একঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রার পর আমরা আবার ফিরলাম বিদ্যাধরীতে। পৃথিবীর সেই আদিমতা সাময়িক উপভোগ তো করা যায়। কিন্তু প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। আদিমতা যেন গ্রাস করতে আসে। নিস্তরঙ্গতায় শ্বাসরোধ হয়ে যায়। সেই আদিমতম আদিমতায় প্রকৃতি ঋদ্ধ থাকুক। কয়েকশো বছর পিছিয়ে যাওয়া স্বীয় মুহূর্ত মুহুর্মুহু আমাদের পুলকিত করুক। এই সব ভাবতে ভাবতেই একসময় এ জংলাভূমি, বেঁচে থাকার লড়াই মুছে গিয়ে চারপাশ ভরে উঠল জনপদে। সুন্দরবনকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম আমাদের সুখী গৃহকোণে। পুনশ্চঃ আমাদের আশালতা লঞ্চে রান্না করেছিল টুকাই। প্রথমদিন দাঁতন মাছ আর দ্বিতীয় দিন পায়রাতোলি মাছের যা অনবদ্য রান্না করেছিল সে কথা আজো ভাবলেই মনে পুলক জাগে। একটা ছোটো প্রচেষ্টা রইলো পুরো ব্যাপারটা ৬মিনিটের মধ্যে ধরার। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
ঘুরে এলাম মৌসুনি দ্বীপ,
শিয়ালদহ থেকে সাতটা দশ নামখানা লোকাল ধরে নামখানা নামলাম দশটা কুড়িতে ,টোটো করে গেলাম নারায়নপুর ফেরিঘাট, ফেরি পারহতে লাগল দুটাকা ,ওখান থেকে টোটোকরে বকখালি য়াবার বাস যেখান থেকে ছাড়ে সেখান, আমরা ছোটো গাড়ি ভাড়া করে চললাম দূগাপুর ফেরিঘাট ,৩৫০টাকা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিলো ,আবার নৌকো করে পার হলাম ,নদির নাম চিনাই নদি ,নদির ওপারে বাঘডাংগা সেখানথেকে চললাম মৌসুনি ,টোটোতে মোটামুটিি ৩০ মিনিট লাগে ,পৌঁছেগেলাম মৌসুনিতে , শিয়ালদহ থেকে ৫.১২র নামখানা লোকাল এ চড়ে বসলাম. গন্তব্য? না এখন বলবো না| আড্ডা, গল্প আর টুকটাক মুখ চালাতে চালাতে কখন যে ৩ঘন্টা কেটে গেল টের ই পাইনি. ৮.০৫ নাগাদ পৌছলাম নামখানা. সুন্দর সাজানো ছোট্ট ষ্টেশন| ষ্টেশনের বাইরে থেকে মোটর ভ্যান করে পৌছলাম ফেরিঘাট| বোটে করে পেরিয়ে গেলাম হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী| ভাবছেন বকখালি চলেছি? ধীরে বন্ধু ধীরে| চমক এখন ও অনেক বাকি| নদী পেরিয়ে টোটো নিয়ে গেলাম নামখানা বাস স্ট্যান্ড| সুরজিৎ আগে থেকেই গাড়ী বলে রেখেছিল সেখানে| গ্রাম বাংলার মধ্যে দিয়ে ঝকঝকে পিচ ঢালা পথে মিনিট ৪০এর মধ্যে পৌঁছে গেলাম চিনাই নদীর ধারে দুর্গাপুর খেয়াঘাটে| চিনাই, কি মিষ্টি নাম না? ফেরিঘাটের পরিবেশটাও মনোরম| জোয়ারের জল ঢুকে এসেছে অনেকটা| দুপাশের সবুজ ম্যানগ্রোভগুলো জলে অর্ধেক ডুবে| মাঝে লাল ইটের পথ| কিন্তু থামলে তো চলবে না| সামনে অজানার হাতছানি| অতএব চরৈবেতি| চিনাই কে অতিক্রম করে বাগডাঙ্গা ফেরিঘাটে নেমে আবার চড়ে বসলাম টোটোতে| একটু এগোতেই অবাককান্ড| নজর করলে একটু দূরে সমুদ্রের ঢেউ চোখে পরছে না? হ্যা তাই তো| জোয়ারের জল ঢুকে পরেছে গ্রামে| কোথাও কোথাও গাড়ী যাবার ঢালাই করা রাস্তার উপরদিয়ে বয়ে চলেছে সেই জল| আর অদ্ভুতভাবে প্রকৃতির এই খেলায় অভ্যস্ত মানব জীবন বয়ে চলেছে তার আপন নিয়মে| ভয়ঙ্কর সুন্দর সে দৃশ্য| নদীর ভাঙ্গন আর আয়েলার দান এটা| জল আর জীবনের এই খেলা দেখতে দেখতে মিনিট ৩০শের মধ্যে পৌঁছে গেলাম এক স্বর্গরাজ্যে| সবাই যখন থাকার জায়গা দেখতে ব্যস্ত, আমি তখন কোনো রকমে napsack টা নামিয়ে রেখে দলের বাকিদের উপর টেন্ট দেখার দায়িত্ব দিয়ে এক ছুটে চলে গেলাম অতল জলের আহ্বানে| যা দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা আমার ধৃষ্টতা মাত্র| আমাদের থাকার Tent এর সীমানা যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু জলরাশি| সামনে একসারি বাবলা গাছ| পিছনে ঝাউয়ের বন| বাবলা গাছের তলায় বাঁশের বেদী| সেখানে বসতেই পায়ের তলায় ছলাৎছল জলের স্পর্শ| স্হানীয় এক মহিলা জাল টেনে টেনে মীন ধরছেন| একটি ছোটো মেয়ে স্কুল পালিয়ে আপন মনে ঢেউ এর সাথে খেলা করছে| একটু দূরে জলে ভাসছে কয়েকটা জেলে নৌকা| সামনে বামদিকে দেখা যাচ্ছে জম্বুদ্বীপ| আরো বামে গেলে হেনরী আইল্যান্ড, দূরে ডানদিকে দেখা যাচ্ছে সাগরদ্বীপ| তাদের মাঝে ঝাউ আর বাবলা গাছে ঘেরা, ঈশ্বরের নিজের হাতে আঁকা এই দ্বীপের নাম? “মৌসুনি”| জোয়ার চলছে, তাই আমাদের এখন জলে নামা বারণ| খানিক বাদে জল একটু নামতেই সবাই এক ছুটে জলে| শ্রী আর ঋষি, আামাদের দুই খুদে সদস্য বালি খুঁড়ে পুকুর বানাচ্ছে| জুটে গেল স্হানীয় কচিকাঁচার দল| আঁজলা করে সাগরের জল এনে তারা ভরে দিচ্ছে বালির পুকুর| শহর আর গ্রামের শৈশব আজ মিলেমিশে একাকার| ঘন্টা দুয়েক জলে দাপিয়ে যখন উঠলাম তখন পেটে ছুঁচোদের ভারী উৎপাত| খাবার তৈরীই ছিল| গাছতলায় প্রকৃতির মাঝে বসে, ধোঁওয়া ওঠা লাল চালের ভাত, ডাল, আলুভাজা, পটল-চিংড়ি, স্হানীয় পুকুরের মাছের ঝোল আর কাঁচা আমের চাটনি, উফ্ যেন অমৃত! জঠরানল স্তিমিত হলে, পথশ্রমে ক্লান্ত সবাই যখন দিবা নিদ্রায় মগ্ন অতি উৎসাহী আমি বেরিয়ে পরলাম পাড়া বেড়াতে| প্রথমে বলি আমরা যেখানে আছি তার কথা| আমাদের টেন্ট গুলো ঘিরে রেখেছে ছোট বড় নিমগাছ| পাশে বিশাল বাবলা আর ঝাউবন| নানারকম পাখীর ডাক ভেসে আসছে| বেনেবৌ, কোকিল, কাঠঠোকরা, হাঁড়িচাচা, দোয়েল, পাপিয়া আরো কত কি| উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রঙের প্রজাপতি| জেলেরা তাদের জাল সারিয়ে নিচ্ছে| মাছ ধরার মরশুম সামনে| জল এখন অনেক দূরে সরে গেছে| রুপালী বালির সৈকত দেখা যাচ্ছে| ফণিমনসসা গাছে হলুদ ফুল ফুটেছে| খানিক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমিও নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম প্রকৃতির মাঝে আশ্রয় নিলাম টেন্টের বাইরে নিমগাছে বাঁধা হ্যামক এ| পাখীদের গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টেরই পাইনি| ঘুম ভাঙলো সুস্মিতার ডাকে. আইভিদি sunset দেখতে যাবে না? সবাইমিলে একছুটে গেলাম বীচে| জল তখন আরো পিছিয়ে গেছে| বিস্তীর্ণ সৈকতে আমরা ৯জন ছাড়া জনমনিষ্যি নেই| একটু এগোতেই ৪টি সারমেয় আমাদের সঙ্গী হলো| এ যেন আমরা চলেছি মহাপ্রস্হানের পথে| জলে এখন অস্তগামী সূর্যের রঙের খেলা| কনে দেখা আলোতে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মোহময়ী| আমরাও রাঙিয়ে নিলাম নিজেদের আকাশের অস্তরাগে আর সাক্ষী হলাম এক অপূর্ব সূর্যাস্তের| একটু পরেই ভাস্বতী বললো মেঘের পাশ দিয়ে ওটা কি উঁকি মারছে? একফালি চাঁদ না! তাই তো! ঈদের চাঁদ! কাল তো ঈদ. ঈদলফিতর| পরদিন আজানের শব্দ আর পাখীর কলতানে ঘুম ভেঙে গেল| চৈতি, মৌসুমিদি আর আমি ঝাউবন আর গ্রামের মধ্যে ঘুরে ঘুরে মানুষ আর পাখীর সঙ্গে কিছু ভাব জমালাম| আজ ঈদ| গ্রামে উৎসবের আমেজ| আমাদের তারা দাওয়াৎ দিলেন| কিন্তু উপায় নেই| প্রাতরাশ সেরে একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে| অনেকটা পথ ফিরতে হবে তো আমাদের| তাই আাবার আসব কথা দিয়ে ফিরে এলাম টেন্ট এ| আসতে তো হবেই আবার| এই সুন্দর প্রকৃতির মাঝে একদিনে কি মন ভরে? সে তো বারবার ই হারিয়ে যেতে চায় ওই ঝাউবন আর জলের হাতছানিতে| Post By:- Ivy Majumdar
নানা কারণে জীবনটা যখন একঘেয়েমিতে ভরে ওঠে।সেই ১০টা ৫টা অফিস,না হয় অন্য কোন কর্মক্ষেত্রে ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলতে চলতে আপনি যখন চরম ভাবে বিরক্ত।মনটা যখন বলবে না এরকম ভাবে আর চলছে না! কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে,আমি বলি কি চলে যান পৃথিবীর সেরা ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি একেবারেই ঠোকবেন না। একদিন বা দুদিন কাটিয়ে আসুন বাদাবন আর দক্ষিণ রায়ের রাজত্বে।মন আপনার ভালো হয়ে উঠবেই। লঞ্চের পাটাতনে বা চেয়ারে বসে ভেসে পরুন নদীর জলে,বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে করতে নয়ন স্বার্থক করে দেখে নিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল,আর তার জীবনের বৈচিত্র্যকে। আমাদের সুন্দরবন মোট সুন্দরবনের মাত্র ৪২০০ বর্গকিলোমিটার যা মোট সুন্দরবনের ৪০ভাগের মতো,৬০ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত।১৯৭৩ সালে মূল এলাকাটি ব্রাঘ্য প্রকল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়।১৯৮৪ সালের ৪ ঠা মে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়।১৯৮৭সালে ইউনেস্কো বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ অরন্য সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে। সুন্দরবন আমি অনেক বারই গেছি।কখনো রায়দীঘী থেকে তো কখনো আবার সোনাখালী থেকে,আবার দু এক বার ক্যানিং থেকেও গেছি। দেখিছি কলসদ্বীপ,ভগবতপুর কুমির প্রকল্প, সজনেখালি,সুধন্যখালি ,পিরখালি গাজিখালি,মোল্লাখালি,দোবাকি,বুড়ির ডাবরী , নেতা ধোপানির ঘাট,পঞ্চমুখানী প্রভৃতি জায়গায়। থেকেছি সজনেখালি পাখিরালয় আর লঞ্চের খোলা ডেকে। দেখেছি এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য পথের বড় বড় নদী আর ভয়ানক সব খাড়ি। সুন্দরবন নিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা আমি আগেই "সুন্দরী সুন্দরবন", "দক্ষিণ রায় আছেন"এই কাহিনী গুলিতে ব্যক্ত করেছি। এই নদী পথে অলস ভাবে দেহটাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ টাকা যথা সম্ভব সজাগ রেখে শুধু এপাশে ওপাশে আর দুরে তাকিয়ে থাকুন।মাঝে মাঝে জলের দিকে নজর অবশ্যই রাখবেন,হয়তো বা দেখবেন কোন ডলফিন আপনার লঞ্চের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে কখন ভুস ভুস উঠেছে আবার ডুবছে। দেখে নিন সুন্দরী,গড়ান,গেওয়া,হেতালের বাদাবন। কাদার মধ্যে উঁচু হয়ে থাকা শ্বাসমূল,বড় বড় ঠেস মূল ওয়ালা গাছ,কখনো জোয়ারের জল সব ডুবিয়ে জঙ্গলের গভীরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে।হেতালের পাতার রঙ আর দক্ষিণ রায়ের গায়ের রঙ একই রকম,সেই হেতাল বনের ভেতরের সরুঢালু পথ যা নদীতে এসে মিশেছে আপনার দৃষ্টি ভ্রম হতেই পারে। ভাটার সময়ই হচ্ছে পশুদের দেখার উপযুক্ত সময়।এই সময় অনেকখানি পার উন্মুক্ত হয়।পশুরা এই সময়ে ঐ উন্মুক্ত প্রান্তরে আসে। তবে ভাটার সময় বিপদও আছে।একবারএইরকম বিপদের সন্মুখীন আমাদেরকে হতে হয়েছিল।কাদার মধ্যে লঞ্চের প্রপেলার ঘুরছিলনা।এককথায় লঞ্চ অনেকক্ষন আটকে পরেছিলো।আহা !সে এক অন্যরকম গা ছমছমে অনুভূতি। দুধারের ঘন জঙ্গল আপনার প্রায় কাছাকাছি তার মাঝে আপনি লঞ্চে,"নট নরন চরন"।আবার কখন জোয়ার আসবে তার অপেক্ষায়।কেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাগবে বলুন তো! ভাটার সময় দেখতে পাবেন বা এক পা এক পা করে এগুচ্ছে বক ও লম্বা ঠোঁট ওয়ালা সারস মাছের আশায়,আর টপাটপ করে মাছ ধরে কপাৎ করে গিলে নিচ্ছে। কাঁকড়ার ইতি উতি ছোটাছুটি আর টুক করে গর্তে ঢুকে যাওয়া।গাছের ডালে বসে আছে নিরাশক্ত ভাবে মাছরাঙা,লক্ষ কিন্তু জলের দিকে। কোনো কোনো সময় ঝপাং করে জলে ড্রাইভ মারছে। আবার কখনও জল না থাকা থকথকে কাদার মধ্যেই হরিণ পা তুলে ওপরের গাছের পাতা খাবার চেষ্টা করছে,বন শুয়োর কি যেন খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে,লালমুখো বাঁদরের দল সজাগ চোখে জঙ্গলের দিকে নজর রেখে তাড়াতাড়ি জলে কি যেন ধুয়ে নিচ্ছে। নদী পথে দেখা হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ অভিমুখী মালবাহী ট্রলারের। নজরে পেয়ে যেতে পারেন অলস ভাবে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে হাঃ করে কোন কুমির হয়তো বা শুয়ে আছে।আপনি হয়তো বা ভাববেন লঞ্চটা আরেকটু কাছে যাক তারপর ছবি তুলবো,আপনি ভুল করলেন ! হঠাৎ আপনাকে কোন সূযোগ না দিয়েই ঝপাং। আমার একবার এইরকম হয়েছিল।একটা হরিণ ফাঁকা জায়গায় জলের ধারে বসেছিলো।ভাবলাম আর একটু লঞ্চটা এগিয়ে যাক তারপর ছবি তুলবো,হলোনা!হরিণটা হঠাৎ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পালালো,অবিশ্বাস্য ভাবে দেখলাম হরিণটা যেখানে বসেছিল তার কাছেই জলটা দারুন ভাবে ঘুলিয়ে উঠলো।দেখে চমকে উঠলাম।একটা কুমির হরিণটাকে তাক করেছিল।হরিণটা তা বুঝতে পেরেই লাফ দিয়ে উঠে পালালো। আফশোষ রয়ে গেলো কোন ছবিই নিতে পারলাম না। অনেকে তো আবার অন্য কাউকে দেখানোর জন্য ডাকে ,তাহলে তো হলোই,জঙ্গলে সবাইকেই চোখ কান সজাগ রাখতে নজর রাখতে হবে ডায়ে বাঁয়ে দূরে ।আপনার সারেঙ্গ যেই লঞ্চের এক্সিলেটার কমাবে তখনই বুঝতে হবে তার নজরে কিছু পরেছে। আপনি যদি সৌভাগ্যবান হন তাহলে সাক্ষাত হতে পারে #দক্ষিন #রায়ের সঙ্গেও।ভয়ানক সাহসী ও ধূর্ত এই জঙ্গলের রাজা। হয়তো আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না,সে কিন্তু সব সময় আপনাকে নজরে রেখে চলেছে। ভাবতেই পারবেন না যে নদীর দুকূল দেখা যায় না,অবলিলায় ক্রমে কিভাবে এরা সাঁতরে এপার ওপার করে খাবারের সন্ধানে। কিভাবে নৌকা থেকে পাশে ঘুমন্ত মানুষকে না জানিয়ে আরেকজনকে মুখে তুলে নিয়ে চলে যায় একদম নিঃশব্দে। নিদারুণ এক ভয় ভীতির পরিবেশে মাঝিরা নৌকায় রাতে ঘুমায় ভাবুন তো!কিছু কিছু দ্বীপে নদীর চরে লাঠির ডগায় ছেঁড়া কাপড় উড়তে দেখতে পাবেন।বুঝবেন ওখানে কোনো হতভাগ্যের জীবন দক্ষিনরায়ের দক্ষিনায় গেছে। ঐ ভয়ঙ্কর জায়গায় আপনার দেখা হবে জীবন জীবিকার সন্ধানে কাঠুরিয়াদের নৌকার সাথে। দেখা হতে পারে মধূ সংগ্রহকারী মউলেদের নৌকার সাথে। ছিপ নৌকা বা বড় নৌকার জেলেদের সাথেও আপনার দেখা হবে। কিনে নিতেপারেন ট্যাঙরাপাবদা,পাটসে,ভাঙ্গনের মতো সুস্বাদু মাছ। সুন্দরবনের মহিলারা হাঙ্গর,কামট,কুমির ভরা ঐ জলের মধ্যে জীবনকে বাজি রেখে কিভাবে চিংড়ি মাছের মীন ধরে বেড়াচ্ছে তাও আপনার নজরে পরবে। তাৎক্ষনিক ভাবেএই সকল মানুষের জীবন জীবিকা সম্পর্কে আপনার শ্রদ্ধা,ভালোবাসা আস্তে বাধ্য। রায়মঙ্গল,বিদ্যাধরী,মাতলা,স্বরস্বতী,ও অনেক নাম না জানা এই নদী গুলিতে বিশেষ করে পঞ্চমুখানীতে যখন আপনার ছোট্ট লঞ্চটা মোচার খোলায় মতো উথাল পাথাল করবে হয় আপনি হয় ভয় পাবেন নাহলে এক অদ্ভুত অনুভূতি আপনার হবেই হবে! এক এক করে বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ারে যখন আপনি উঠবেন,সামনের ফাঁকা জায়গা থেকে আপনি চোখ সরাতে পারবেনা।মনে হবে এক্ষুনি হয়তো বা জঙ্গলের রাজা ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে একদিক থেকে অন্য দিকে যাবে। এমনি করেই এক এক বনবিবির থান সহ যখন সব কটি জায়গা দেখে আপনার লঞ্চ যখন সন্ধ্যায় সজনেখালির মাঝ নদীতে নৌঙ্গর করবে তখন সেখান থেকে দুধারের জঙ্গলকে দুর থেকে অনুভব করা আর লঞ্চের সাথে নদীর জলের ধাক্কার ছলাৎ ছলাৎ করে শব্দ শুনতে শুনতে নিজেদের মধ্যেও কি দেখলাম তাই নিয়ে কথা বলা বা গানের আসর বসিয়ে সঙ্গে অবশ্যই চা টিফিন সহযোগে দিনটা বা দিনগুলো কাটলো বল তো!আর সে যদি হয় জোৎস্না আলোকিত চাঁদনী রাত তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এই ভ্রমনের সাথে আপনি গোসাবার বিধবাপল্লী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো কেও অন্তভূর্ক্ত করতে পারেন। এক অসাধারণ ভ্রমণ আপনার হাতের কাছেই। সবই আপনার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে। Post By:- Chandan Dutta Roy
বেশ কিছু বছর প্রজেক্ট সাইটে কাজ করে যখন মানসিকভাবে বেশ বিরক্ত, তখনই কলকাতায় একটা চাকরী জুটে যায়....আর ঠিক তার পরের মাসেই ট্রিপ প্ল্যান...পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ....আমরা চার বন্ধু.... মাত্র দুদিনের ট্রিপ কিন্তু উত্তেজনার পারদ চড়ে গিয়েছিল অনেকটাই.....আগের রাতে বন্ধুর ফ্ল্যাটে জড়ো হয়ে পরদিন খুব ভোরে ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদা....সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে ক্যানিং....তারপর ট্রেকার নিয়ে নদীঘাট....নিতাই দার লঞ্চ আগে থেকেই বুক করা ছিল....প্ল্যান ছিল রাতে লঞ্চে থাকার..... লঞ্চের ভিতরে ঢুকেই চমক.....সুন্দর পরিপাটি চারটে বিছানা, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, রান্নাঘর....এতটা আশা করিনি....নদীর ওপারে গোসাবা থেকে বাজার করা দিয়ে রোমাঞ্চের শুরু....চাল,ডাল,চা,তেল থেকে পমফ্রেট, পাবদা, গলদা, কাঁকড়া, মুরগি.....আমার প্রথম বার বাজার করা, এবং অবশ্যই নিতাইদার তত্বাবধানে....... শুরু হল আসল যাত্রা....লঞ্চে আমরা চার বন্ধু, লঞ্চচালক নিতাইদা, কুক সন্যাসী ও তার হেল্পার.....একটু পরেই সবাইকে চা দিয়ে সন্যাসী নিজের ক্লাস বোঝালো.....এত সুন্দর চা কবে খেয়েছি মনে করতে পারলাম না.....এরপর শুধুই নদী আর আমরা, দুদিকে ম্যানগ্রোভ এর জঙ্গল....এসে গেল জলখাবার, লুচি তরকারী চাটনী....সন্যাসী তখন আমাদের কাছে সাক্ষাত বাবা অন্নপূর্ণা...... সজনেখালি থেকে পারমিট নেওয়া, সঙ্গে বাধ্যতামূলক গাইড বিষ্ণুদা....ইচ্ছা না থাকলেও নিতে হবে, এমনই নিয়ম...কিন্তু পরে বুঝেছিলাম বিষ্ণুদার উপকারিতা...বাঘ দেখতে না পেয়ে সারাটা রাস্তা বিষ্ণুদার মাথা খেয়েছিলাম, কিন্তু সদাহাস্য মানুষটা একবারও বিরক্ত হয়নি..... বাঘ দর্শন না হলেও হরিণ, কুমির, বাঁদর, হরেক রকমের পাখি, কাঁকড়া, নদীর নির্জনতা, বাঘের জন্য সদা সতর্ক থাকা এবং সর্বোপরি সন্যাসীর হাতের রান্না করা ভাত ডাল আলুভাজা পাবদার ঝাল, চিংড়ির মালাইকারী, চাটনী দিয়ে মধ্যাহ্ণভোজ সারা....জমে গিয়েছিল সারা দিনটা........ তবে সেরা অভিজ্ঞতা অবশ্যই লঞ্চে রাত কাটানো....সেই রাতটা কখনো ভুলবো না....... বি. দ্র. : শুধু বাঘ দেখার আশায় সুন্দরবন এলে আশাহত হবার সম্ভাবনা ৮০%, বা তারও বেশী.....এই চিন্তাটা ঝেরে ফেলতে পারলে উইকএন্ড ট্রিপের অন্যতম সেরা গন্তব্য অবশ্যই এই সুন্দরবন..... পুনশ্চ: ছবিগুলো বেশীরভাগই Samsung মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ( 2 MP )....তখন এটাই ছিল আমার ছবি তোলার একমাত্র সম্বল..... Post By:- Sovan Ray
খারাপ ভালো দুইরকমের অভিজ্ঞতাই হলো, সেগুলোই ভাগ করে নিলাম সবার সাথে। বেশীরভাগটাই ভালো অভিজ্ঞতা, তাই সেই গল্পই আগে শোনানো যাক। মৌসুনী দ্বীপের কথা প্রথম শোনার পর থেকেই আমার যে কারনে ওইখানে যাওয়ার ইচ্ছা হয়, তার অন্যতম দুটো কারন হল ১) নির্জন সমুদ্র সৈকতকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা এবং ২) সমুদ্র সৈকতের লাগোয়া তাবুতে(Tent) থাকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা, কারন আমি এর আগে কোনদিন তাবুতে থাকি নি। যাই হোক, এরপর হন্যে হয়ে ভ্রমণসঙ্গী খুঁজতে লাগলাম নাম না জানা এই সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য। স্কুল কলেজ পাড়া এবং হালফিলের কাছের সব বন্ধুদেরই মোটামুটি বলেছিলাম কিন্তু লোকজন চেনা-পরিচিত জায়গাতে যতটা আগ্রহ দেখায়, নাম না জানা জায়গাগুলোতে যেতে ততোটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আমার আবার নাম না জানা জায়গা ঘুরতেই বেশী ভালো লাগে। অবশেষে সব বন্ধুমহল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মনমরা হয়ে একটা ছোট্ট ওয়াটসআপ গ্রুপে ঘুরতে যাওয়ার কথাটা পাড়লাম। এই গ্রুপে প্রথমে বলি নি, তার কারন এই গ্রুপের সবাই বিলাসবহুলভাবে থাকাখাওয়া করতে ভালোবাসে, আর আমি যেখানে ঘুরতে যেতে চাইছি সেখানে বিলাসিতা দূরের কথা, থাকতে হবে তাবুতে এবং ভাগ করে নিতে হবে কমন টয়লেট। ঘুরতে যাওয়ার নাম শুনেই যে প্রথমেই রাজি হল যে গ্রুপের সবথেকে কনিষ্ঠ মেম্বার সৈকত। তারপর রাজী হল অর্জুন দা, আগামী বুধবার রাশিয়াতে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাবে, তা সত্ত্বেও একদিনের জন্য উইকএন্ড ট্যুরে যেতে রাজি। এরপর শুভজিৎ দাও রাজি হল, যে শুভজিৎ দা বাড়ী থেকে বাজার যেতে হলেও গাড়ী ছাড়া নড়তে পারে না সেও কোন এক অজানা কারনে একবার বলতেই রাজি হয়ে গেল। এরপর একদিন কল কনফারেন্সে সবাই মিলে সিদ্ধার্থ দাকে নিলাম, এই দাদার আবার এসির হাওয়া গায়ে না লাগলে ঘুম আসে না, তাই প্রথম থেকে এই মোসুনী দ্বীপ যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধীতা করে আসছিল কারন যেখানে আমাদের যাওয়ার কথা সেখানে এসিতো দূর কি বাত, ইলেক্ট্রিসিটিই পোঁছায় নি এখনো। 😂😂 তবুও কল কনফারেন্সর সকলের প্রচেষ্টাতে ওনাকে রাজি করানো হল। এইবার সৌমাল্য দা, এই দাদাকে ঘুরতে যাওয়ার কথা কিছু বলাই হয় নি কারন নিজে ড্রাইভ করে গাড়ী চালিয়ে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া এই দাদা কোথাও ঘুরতে যান না। আর আমরা যেখানে যাওয়ার কথা ভাবছি সেখানে গাড়ী করে যাওয়া সম্ভব নয় তাই ভেবেছিলাম এই দাদাকে কোনভাবে রাজী করানো যাবে না কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই দাদাও রাজী হয়ে গেল। অতঃপর এই ছয়জনের দল তৈরি হল আমাদের এবং ওইদিনিই Izifiso Backpackers' Camp-er ওয়েবসাইট (www.mousuni.com) থেকে ৬নের থাকার তাবু এবং খাওয়া দাওয়া সমেত ১২০০টাকা প্রতিজন প্রতিরাত্রি হিসেবে বুক করে দিলাম আর দিন গুণতে থাকলাম আমাদের রওয়ানা হওয়ার দিনের যেটা ছিল শুক্রবার (১৫/০৬/২০১৮)। এইবার এলো ঘুরতে যাওয়ার দিন। সকাল ৭.১৪মিনিটের ট্রেন শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা থেকে ধরতে হবে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে, তাই আগেরদিন রাতে ঘুম হল না সেভাবে। ওয়াটসআপে এইটা ব্যাগে নিবি ওইটা ব্যাগে নিবি করে আড্ডা মারতে মারতেই সকাল হয়ে গেল। এরপর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম অজানা সেই দ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। শিয়ালদহ স্টেশনে বেশকিছুটা আগেই পৌঁছে গেলাম সবাই। তারপর শিয়ালদহ থেকে নামখানা যাওয়ার টিকিট(Rs25) কাটলাম। আনন্দ করতে করতে ট্রেনে উঠে একসাথে সবার জায়গা দখল করে যাচ্ছিলাম ভালোই। হকার ভাইদের থেকে জল লিচু পেয়ারা ঝালমুড়ি ছোলাসেদ্ধ সহযোগে দেদার মুখ চলছিল। তখনও অবধি গরম খুব একটা অনুভব করি নি কেউই। এইবার ট্রেন লক্ষীকান্তপুর দাঁড়াতে স্টেশন থেকেই পুরি সব্জী সহযোগে প্রাতরাশ করে চললাম নামখানার দিকে। নামখানাতে ট্রেন সঠিক সময়েই পোঁছে দিল, সময় নিল ৩ঘন্টা। তারপর সেখান থেকে টোটো(Rs10/ per head) ধরে গেলাম খেয়াঘাট, সময় নিল মিনিট দশেক। খেয়াঘাট পৌঁছে নৌকাতে(Rs2/ per head) উঠে পাড় হলাম হাতানিয়া-দোতানিয়া নদী, সময় নিল ২-৩মিনিট। এরপর একটা ভ্যানে(Rs5/ per head) উঠে পৌঁছালাম বাসস্ট্যান্ড, সময় নিল ৩-৪মিনিট। বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে একটা ম্যাজিক গাড়ী ভাড়া করলাম এবং পৌঁছালাম বাগডাঙ্গা ঘাট। পুরো গাড়ী ভাড়া করতে নিল ৩৫০টাকা এবং বাগডাঙ্গা ঘাট পৌঁছাতে সময় নিল ৪৫মিনিট মতো। ঘাটে পোঁছে চেনাই নদী পার হতে সময় নিল ২-৩মিনিট যার নৌকা ভাড়া ২টাকা প্রতি জন। এরপর ঘাট থেকে একটা টোটো নিয়ে পৌঁছালাম 'সল্ট' নামের এক জায়গাতে। সময় লাগলো ৩০মিনিট মতো এবং টোটো ভাড়া ২০টাকা প্রতিজন। সল্টে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল Izifiso-এর জয়দেব। ছোট্ট ভাইটা আমাদের গ্রাম্য পথ দেখিয়ে ২-৩মিনিট হাঁটিয়ে নিয়ে গেল আমাদের তাবুর সামনে। চড়া রোদে এতগুলো যানবাহন পালটে দুপুর ১২.৩০মিনিটে এতদূর আসার পর স্বাভাবিক ভাবেই সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ক্লান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে দুটো ছোট্টখাট্টো ছেলে আমাদের জন্য নিয়ে এলো কচি ডাব। সেটা খেয়েই পিঠের ব্যাগগুলো তাবুর মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসে পড়লাম খড়ের ছাঁয়নী বেষ্টিত বাঁশের তৈরি পাটাতনের উপর। একদম চোখের সামনে সমুদ্র সৈকত এবং সেইসাথে তুমুল হাওয়া চোখ এবং মন জুড়িয়ে দিচ্ছিল। প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ চাক্ষুষ করে ক্লান্তি হার মেনেছিল সৌন্দর্যের কাছে। 😍 আমার আর তর সইছিল না। জামাকাপড় ছেড়েই ঝুপ করে ঝাঁপ মাড়ালাম সমুদ্রতে। পুরো সমুদ্র সৈকতে আমি তখন একা রাজা, চারিপাশে কেউ নেই। এরপর একে একে সবাই যোগ দিল। ঘন্টাখানেক সমুদ্র স্নান করে আমাদের তাবুর পাশেই একটা পুকুরে ঝাঁপ মারলাম এবং সেখানেও স্নান করলাম প্রায় আধঘণ্টা মতো। জলের সাথে এতো কুস্তি করার পরে পেটেও টান মারা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভীজে জামাকাপড় ছেড়ে সেগুলো রৌদ্রে মেলে দেওয়ার পরে বসলাম সবাই একসাথে দুপুরের খাওয়ার খেতে। সুস্বাদু ভাত ডাল আলুভাজা ঢ্যাঁড়সের তরকারী রুইমাছের তরকারী দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করে একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল, তাই তাবুর ভীতরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মাটির কটেজ তৈরী করা হচ্ছে বলে তাবুগুলোর মুখ সম্প্রতি পরিবর্তন করা হয়েছে আর সেটা এমনভাবে হয়েছে যে হাওয়াই ঢুকছিল না তাবুর ভিতর। সামনে পিছনে তাবুর সবকটা পর্দা খুলে দিয়েও হাওয়া পেলাম না একটুও। দরদর করে ঘামছি তখন, সে কি গরম কি গরম বলে বোঝানো যাবে না। নাঃ, প্রথম তাবুতে শোয়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো হলো না আমাদের। এরপর কখনো দড়ির দোলনাতে, কখনো কাঠের পাটাতনের উপর শোয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু সবই বিফলে গেল। ক্যাম্প সংগঠকরা কয়েকটা যদি চেয়ারের ব্যবস্থা করতেন যেটাতে পিঠটা হেলান দিয়ে বসা যায় অন্তত, তাহলে বেশ কিছুটা আরাম পাওয়া যেত। এতটা জার্নি করে গিয়ে ঠিকমতো বসা শোয়ার জায়গার অভাব অনুভব করছিলাম বেশ ভালোই। এরপর সূর্য ডোবার পালা। সূর্যাস্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম। এইসময় গরম বেশ কমে গিয়েছিল আর সাথে ঠান্ডা সমুদ্রের হাওয়াতো ছিলই। বেশ কিছুটা হাঁটলাম বিচের উপর দিয়ে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখার জন্য। হেঁটে যখন ক্যাম্পের দিকে ফিরছি, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ভালো লাগছিল জায়গাটা এখন বেশ। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে টিমটিম করে, গ্রামের সারল্যতা ফুটে উঠছিল সেই সময় ওইখানকার কিছু বাচ্ছা এবং বয়েস্ক কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিয়ে। এরপর মুড়ি পেঁয়াজি চা দিয়ে গেল ক্যাম্পেরই একজন। দুপুরেই কাঁকড়া ফ্রাই এবং মাছভাজা আলাদা করে অর্ডার করেছিলাম সন্ধ্যেবেলার জন্য, যেটা ঐ ১২০০টাকার প্যাকেজের বাইরে ছিল। সব এক এক করে সদ্গতি করে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পরে রাতের খাওয়ার খেতে বসলাম রুটি আলুভাজা আর দিসি মুরগীর ঝোল দিয়ে। এরপর সবাই কিছুটা আড্ডা দিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার পালা। দুপুরে তাবুর ভিতরে ঘুমোতে পারি নি কিন্তু ভেবেছিলাম রাতে টেম্পারেচার কম থাকবে তাই হয়তো অসুবিধে হবে না কিন্তু সে ভাবনা ভুল ছিল। ৫মিনিটের বেশী কেউ আমরা তাবুর ভিতরে শুতে পারলাম না কারন তাবুর বাইরে তবুও সমুদ্রের হাওয়া আসছিল কিন্তু ভীতরে হাওয়াই ছিল না কোনরকম। আগেরদিন রাতে ভালো করে ঘুম হয় নি সকালে ট্রেন ধরবো বলে, এরপর সারাদিন প্রখর রোদে এতোখানি পথ অতিক্রম করে সারাদিন লম্ফঝম্প করে যদি রাতে ঠিক করে ঘুমানোর জায়গা না পাওয়া যায়, তার থেকে করুণ অবস্থা মনে হয় হতে পারে না। ঠিক করলাম তাবুর ভিতরের গদিগুলো তুলে নিয়ে তাবুর বাইরে বিছানা করে শুয়ে পড়বো কিন্তু পোঁকামাকড় সাপখোপের ভয় লাগছিল, যদিও গ্রামের লোকেরা আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল সাপখোক নেই সেখানে কিন্তু আশেপাশে চারিদিক জঙ্গল হওয়াতে ভয় লাগছিল। পোকামাকড়ের ভয় উপেক্ষা করে শুলাম মাটিতে বিছানা করে কিন্তু সমুদ্রর হাওয়াতে এত বালি উড়ে এসে চোখেমুখে পড়ছিল এবং মশা কামড়াছিল যে ঘুম আসছিল না। তারপর ক্যাম্পেরই একজন বিছানার চারিধারে জল ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষনের জন্য বালি উড়ার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল বটে কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘুম এলো না। আর শনিবার ঈদ হওয়ার জন্য ক্যাম্পের পাশে কোথাও একটা সারারাত জোড়ে মাইক চলছিল এবং গায়ের উপর মাঝেমধ্যে কাঁকড়া জাতীয় কিছু উঠে পড়ছিল। ভয়ে তখন আডভেঞ্চার শিঁকেয় উঠেছে তখন। যাই হোক একটা রাত না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম সবাইমিলে। সকাল হতেই অপেক্ষা করছিলাম সমুদ্রে জোয়ার আসার। চা এবং জলখাবারে লুচি ঘুগনী আর সিমুই খেয়ে সমুদ্রস্নান করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আবার যে ৭-৮টা যানবাহন চেঞ্জ করে ঐ রোদের মধ্যে বাড়ী ফিরতে হবে দুই রাত না ঘুমানো জান্ত লাশগুলোকে নিয়ে। শিয়ালদহে যখন বিকেল ৪.৩০মিনিট নামলাম তখন মারাত্মক গরম। একটা উবের বুক করে উবের ড্রাইভারকে এসির হাওয়াটা জোড়ে করতে বলে বাড়ীর পথে যখন আসছি তখন যে কি আরাম আগছিল কি বলবো। আর তারসাথে ভীষণভাবে মনে পড়ছিল মৌসুনী দ্বীপের ওই গ্রামটার কথা, যেখানে গ্রামের লোকগুলো কোত কষ্টের মধ্যে থেকেও কোত হাসিখুশিতে রয়েছে। সমুদ্রের জল তাদের চাষের জমিতে ঢুকে গিয়ে চাষবাস নষ্ট করে দিয়েছে। মৌসুনী দ্বীপের এই গ্রামগুলো আস্তে আস্তে সমুদ্রর গ্রাসে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এইভাবে একদিন হয়তো এই দ্বীপের কোনপ্রকার অস্তিত্বই থাকবে না। বেশ মন খারাপ করছিল গ্রামগুলোর জন্য। তবে এই গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এসেছে ইতিমধ্যে। খুব তাড়াতাড়ি ক্যাম্পেও আলো চলে আসবে, তারপর আশা করি তাবুগুলোতে পাখার ব্যবস্থা করা হবে, তাহলে আর সেভাবে কষ্ট হবে না হয়তো। নগরকেন্দ্রিক জীবনে আমরা এতটাই আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছি যে, সামান্য কষ্টলভ্য একদিনের জীবনও আমাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠেছে। গতকাল বিকেলে বাড়ী পৌঁছেই এসিটা অন করে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। আজ রবিবার, সকালে ঘুম থেকে উঠে ল্যাধ খেতে খেতে প্রাতরাশ মধ্যাহ্নভোজন করে এই লেখা যখন লিখছি তখন জানলা দিয়ে উকি মেরে দেখছি যে আকাশের মুখ ভাড় এবং হাল্কা হাল্কা বৃষ্টিও হচ্ছে। এই দেখে এখন ভীষণ ভীষণ আফশোষ হচ্ছে, যদি এইরকম আবহাওয়া গত দুদিন থাকতো তাহলে কিন্তু দারুণ হতো। Post By:-Subir Das
|
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |