নভেম্বর ২, ২০১৮
বেড়াতে এসেছি সুন্দরবন। কোথায় বাঘ দেখবো তা নয় কেবল জল আর জল। এতপর্যন্ত পড়েই বোধহয় ভাবছো আমার এবারের বেড়াতে যাওয়াটা পুরো মাঠে মারা গেছে তাহলে রোসো আগে আমার গল্প শোনো। আমিতো বেমালুম অবাক, শহরের মেয়ে গ্রাম সেভাবে দেখিনি, আর সুন্দরবন সেতো একেবারেই আলাদা। সোনারপুর থেকে ক্যানিং হয়ে যখন গদখালি এসে পৌঁছালাম তখনো জানিনা আগামী কয়েকটা দিন জলই হয়ে উঠবে ঘর বাড়ি। রাতের বেলায় লজে শুয়েও বোধ হবে দুলছি, কেবলই দুলছি। তা সেসব পরের কথা। উঠে পড়লাম আশালতায়। আমাদের লঞ্চ আশালতায় আনকোরা সাতটা বিছানা নতুন ধপধপে সাদা চাদর বালিশে মোড়া। চমৎকার বাথরুম। দেখে শুনে থ। আগে কাশ্মীরের ডাললেকে থেকেছি। সেখানে বোটে কুপ থাকে তাতে কাশ্মীরি কাজের কার্পেট আঁটা থাকে আগাগোড়া। সে আর এক আর এ, অনেক আলাদা। তো যাইহোক শুরু হলো আমাদের জলজ ভ্রমণ। নদীর পর নদী জল আর জল। এর শেষ কোথায়!! প্রথমদিনেই মনে হলো উফফ নামতে পারলে বাঁচি। চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন শূন্যতা গ্রাস করে ফেলতে চাইছে যেন। শরীরে ক্লান্তি নেমে আসছে ঘুম আসছে। ভীষণ ঘুম। জলপথে অনেকটা রাস্তা ঘুরে সন্ধ্যে বেলায় নামলাম পাখিরালয়ে। রাতটুকু কটেজেই থাকা। নেমে অনেকখানি ভালো লাগলো। ফ্রেস হয়ে রাতে আদিবাসীদের ঝুমুর, হাসান রাজার পালার নানা গান, সুন্দরবনের লোকগান আর নাচে মুগ্ধ হয়ে রইলাম আমরা।
নভেম্বর ৩, ২০১৮
সকাল ৬টায় আবার এসে উঠলাম আশালতায়। আবার যাওয়া। এবার একটু অন্যরকম। কি বিশাল নদী। কত রকমের নাম না জানা নদী এসে মিশেছে তাতে, কেউ বিদ্যেধরী কেউ রায়মঙ্গল। শহরের মেয়ে নদীর কি বুঝি আমি। আমার দৌড় বাঁকা, জল শুকনো দামোদর খুব বেশী হলে দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গা। এই প্রথম দেখছি নদী থেকে নদীতে নানারঙের জলের কি অপূর্ব সম্ভার। কখনো রোদ এসে পড়ছে তো কখনো মেঘ। সাদা মেঘ কখনো বা কালো। কখনো তীব্র রোদ আবার কখনো কেবলই বিভা। আর জল কখনো আকাশি কখনো নীল কখনো ঘোলাটে কখনো সবুজ। দূরে বনানীর শ্রেণী রোদ মেঘের ছায়ায় রঙ পাল্টাচ্ছে অবিরাম। ব্যাস ভালোবেসে ফেললাম। ভীষণ ভালো লেগে গেল হঠাৎ ই। মোহিত হয়ে গেলাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি এবার লক্ষ্য করলাম নদী কই। এতো সমুদ্র! কি ব্যাপার! লঞ্চের সারেং দীপক বাবু ব্যাপারটা খোলসা করলেন। এই যায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ফলে এখান থেকে আদিগন্ত কেবল জল ই জল গাছ নেই, ছাওয়া নেই কিচ্ছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু জল। এতক্ষন জোয়ার চলছিল। এবার এলো ভাটা। জল নেমে গেল গাছগুলোর শিকড় বেড়িয়ে এলো। শিকড়ের ঝুড়ি নেমেছে অজস্র। ছেলেবেলায় শ্বাসমূল ঠেসমূলের কথা পড়েছিলাম আজ চাক্ষুস দেখলাম। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। কখন যে বিদ্যাধরী হয়ে গেল বনইভরনী নদী আর কখনই বা হয়ে গেল নিতাই নদী সেকথা আমার পক্ষে জানা অসম্ভব। কোথায় কি জল একটু বেশী গাড় হয়েছিল! কোথায় যেন মনে হচ্ছিল নদীটা বড্ড সরু! কি জানি। দুই যায়গায় বাঘ দেখবো বলে গেলাম আমরা, দোবাঁকি আর নেতা ধোপানীর ঘাটে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের নিরাশ করল। বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই ফিরে আসতে হলো শেষ পর্যন্ত। মনসামঙ্গলের বিস্ময়টুকু মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো কেবল। নাহ বাঘ আমরা দেখিনি। কিন্তু নদীর সকাল দেখেছি, দেখেছি নদীর সূর্যাস্ত। নদীর জলের রঙ অস্তমিত সূর্যের আলোয় যখন রাঙা হয়ে উঠেছিল তখন গোধুলীর অস্তরাগ মেখে রাঙা হয়ে উঠল নদীর জল। ফাগ লেগেছিলো আগুন রাঙা জলে। আছাড়ি পিছাড়ি জলের ঢেউ বিদ্যাধরীর হাজার বছরের ধ্যান ভাঙছিল যেন। শান্ত জলে গরান গাছের ছাওয়া নাচছে। এ যেন কোন শতাব্দীর খুঁজে পাওয়া সেই হারানো বিকেল, অতল জলে নিবিড় হয়ে আছে। নানা রঙের পাখির মেলা আর হরিণ দেখেই মন শান্ত করতে হলো। আর দেখলাম চরায় শুয়ে ক্লান্ত বয়জ্যেষ্ঠ কুমীরমশাইকে।
নভেম্বর ৪, ২০১৮
আজ সবারই মন খারাপ। মুখ ভার। মেঘলা আকাশ ফেটে সূর্যের বিভা ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যাধরীর জলে। তবে কি আজ আর ঘোরা হবেনা, দেখা হবেনা বাঘ! মন কেমনের প্রহর গুনছি আর পাখিরালয়ে আদরের কুকুর গুলিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছি। লঞ্চ এসে লাগলো ঘাটে। আমরা অন্যপথ ধরলাম। এপথে অজস্র গোসাপ। এদিক ওদিকে রোদে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে চড়ায়। কালকের মতো আজও পেড়িয়ে গেলাম পঞ্চনদীর মিলনক্ষেত্র। এই পাঁচটা নদী হলো গোসাবা, নিতাই, নবাঁকি, হরিণভাঙা আর দেউলভরানি। আজ বিদ্যাধরী থেকে গোমতী নদী দিয়ে সুন্দরবনের আরো গভীরে প্রবেশ করলাম আমরা। এখানে নদী ভয়ঙ্কর রকম শান্ত। আশে পাশে দূরদূরান্ত অবধি কোনো গ্রামের রেখাটুকুও নেই। আছে কেবল গভীর জঙ্গল। দুপাশের সবুজ রঙ ঈষৎ গাঢ়। এমনকি চলতি পথে এক আধটা স্টীমারও চোখে পড়লোনা। শুনলাম এ পথে স্পেশাল পারমিশন করে আসতে হয়। সবাই অনুমতি পায়না। গোমতী ছেড়ে সুধন্যনদী ধরলাম। সবারই মনটা খচ খচ করছিল কেবল পাখি দেখছি হাজার হাজার, হঠাৎ এ যায়গাটা এতো চুপচাপ হয়ে গেল কেন? খুব ধীরে এগোচ্ছে আমাদের লঞ্চ। কোথায় এতটুকু শব্দ নেই। সাংঘাতিক নিস্তব্ধতা। দিনে দুপুরেও ভয় লাগছে, ভীষন ভয়। আমরা চলেছি সড়কখালি ১ নামক খাঁড়ি দিয়ে। খাঁড়িটা এতটাই সরু যে আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে দ্বিতীয় কোনো নৌকা যাওয়ার রাস্তাটুকুও নেই। হঠাৎ সারেং দীপকবাবু দেখলাম ছটফটিয়ে উঠলেন। বললেন জাহাজ ফেরাও, জাহজ ফেরাও। আমরা দমবন্ধ করে বসে আছি। একেবারে সাইলেন্ট। পুচকু গুলো খালি উত্তেজনায় কথা বলে উঠছে, আর বড়ো দের চোখরাঙানিতে আরো ব্যাকুল হয়ে উঠছে। এমনি সময় দেখলাম সেই কাঙ্খিত দৃশ্য। অদূরে জঙ্গলের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন বাঘমামা। বলতে যতখানি সোজা ততটা সহজে আমরা বাঘ দেখিনি অবশ্য। শুয়ে বসে চেয়ারে উঠে এপাশে বেঁকে,ওপাশে লাফিয়ে তবে দেখা গেছিল সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। আর চোখে যা দেখেছিলাম ক্যামেরাতে ধরা পড়েনি তার এক বিন্দুও। শুধু সেদিনের সেই ক্ষণকাল আঁকা হয়ে গেছিল হৃদয়ে। যাইহোক বাঘ দেখাতো হলো। তবুও দেখে দেখে আশ মেটেনা। লঞ্চ এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে আরো কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে এমনি সময় বাঘ বাবাজী উঠলেন। বোধহয় ইচ্ছে ছিল আড়মোড়া ভেঙে আমাদের দলের একটিকে নিয়ে ডিনার সারার। তবে আমরা আর তাকে সে অবসরটুকু দিলুম না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লঞ্চ নিয়ে পগারপার। তারপর টানা একঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রার পর আমরা আবার ফিরলাম বিদ্যাধরীতে। পৃথিবীর সেই আদিমতা সাময়িক উপভোগ তো করা যায়। কিন্তু প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। আদিমতা যেন গ্রাস করতে আসে। নিস্তরঙ্গতায় শ্বাসরোধ হয়ে যায়। সেই আদিমতম আদিমতায় প্রকৃতি ঋদ্ধ থাকুক। কয়েকশো বছর পিছিয়ে যাওয়া স্বীয় মুহূর্ত মুহুর্মুহু আমাদের পুলকিত করুক। এই সব ভাবতে ভাবতেই একসময় এ জংলাভূমি, বেঁচে থাকার লড়াই মুছে গিয়ে চারপাশ ভরে উঠল জনপদে। সুন্দরবনকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম আমাদের সুখী গৃহকোণে। পুনশ্চঃ আমাদের আশালতা লঞ্চে রান্না করেছিল টুকাই। প্রথমদিন দাঁতন মাছ আর দ্বিতীয় দিন পায়রাতোলি মাছের যা অনবদ্য রান্না করেছিল সে কথা আজো ভাবলেই মনে পুলক জাগে। একটা ছোটো প্রচেষ্টা রইলো পুরো ব্যাপারটা ৬মিনিটের মধ্যে ধরার। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |