বাংলায় একটা কথা আছে না যে উঠলো বাই তো কটক যাই | আমাদেরও অবস্থাটা দাঁড়ালো ঠিক সেরকমই | কয়েকদিনের প্ল্যানেই আমরা দশজন সহকর্মী বন্ধু ঠিক করে ফেললাম বাড়ির থেকে খানিকটা দূরে কোথাও দুটো রাত্রি কাটিয়ে আসবো | মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা | ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি | ঠিক হলো এবার আর পরিবারের কেউ নয়, শুধু নিজেরাই যাবো | কয়েকজন মৃদু আপত্তি করলেও সেটা ধোপে টিকলো না | আসলে সবাই একটা ঝঞ্ঝাটহীন নির্ভেজাল আনন্দ করতে চাইছিলাম | এইবার জায়গা নির্বাচন | আসলে মার্চ মাসের একেবারে শেষ দিক | চারদিকে একটা ভ্যাপসা গরম | বেড়াতে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ সময় না | যাই হোক খুব বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হলো না | চলো সুন্দরবন | যাওয়ার দিন ঠিক হলো ৩১শে মার্চ, রবিবার সকালে | এবার আরেকটা সমস্যা | দশজন থাকি দশটা জায়গায় | তবে মোটামুটি বেশিরভাগই কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর অল্প কয়েকজন একটু দূরে | একটা চোদ্দো সিটারের টাটা সুইঙ্গার বুক করা হলো | ভাড়া নেবে কিলোমিটার প্রতি ২৫ টাকা | রুটটা ঠিক হলো তারাতলা বজবজ রোডের জিঞ্জিরাবাজার থেকে ঠিক সকাল ৮টায় গাড়িটা প্রথম দুজনকে তুলে তারাতলা টালিগঞ্জ ফাঁড়ি হয়ে আনোয়ার শাহ রোড ধরে যাদবপুর থানা থেকে রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক রোড বরাবর পথে যাদের বাড়ি পড়বে তাদের তুলতে তুলতে গড়িয়ার দিকে আসবে | সেখান থেকে পাটুলি কানেক্টর দিয়ে ই এম বাইপাস ধরে সোজা বারুইপুর | দুজন সেখান থেকে উঠবে | সেখান থেকে সোজা আমাদের গন্তব্যে |
শুধু সমস্যা ছিল আমাদের দলের একজন সদস্য অপূর্ব কুমার দাস কে নিয়ে | কারণ তার বাড়ি কোন্নগর | অতো সকালে তাকে কোথায় দাঁড়াতে বলবো বুঝতে পারছিলাম না | তবুও তাকে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে হাওড়া এসে কোনো টালিগঞ্জগামী বাস ধরে সকাল ঠিক সোয়া আটটার সময় আনোয়ার শাহ রোডের মুখে দাঁড়াতে বলা হলো | আমরা অনেকেই মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলাম যে অপূর্ব ওই সময়ে জায়গামতো পৌঁছাতে পারবে না | একে তো খানিকটা ঢিমেতালে চলার স্বভাব আবার তার উপর কলকাতার রাস্তাঘাটে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় | অবশেষে ৩১শে মার্চের সকাল এসে গেলো | পুরুষ মানুষের একা কোথাও যাওয়ার একটা ভারী সুবিধা হলো খুব বেশি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না | আর মাত্র দু রাত্রির তো ব্যাপার | একটা ছোট ব্যাগে তাড়াতাড়ি একটা পাজামা, একটা হাফ প্যান্ট , দাড়ি কাটার সরঞ্জাম , টুথব্রাশ পেস্ট, টাওয়েল আর সামান্য কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে আর কতই বা সময় লাগে | তাছাড়া আমি বলেই দিয়েছিলাম যে আনোয়ার শাহ রোডের থেকে অপূর্ব দাসকে পিক আপ করে যেন আমাকে ফোন করে জানায় | আর আমি নিশ্চিত ছিলাম অপূর্ব ঠিক সোয়া আটটায় ওখানে আসতে পড়বে না | দেরি হবেই | তাই একটু ঢিমে তালেই সব করছি | হটাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো | খবর পেলাম একদিন আগেই মানে মার্চ মাসের শেষ দিনে সবাইকে এপ্রিল ফুল করে অপূর্ব ঠিক সময়ই গাড়িতে উঠে পড়েছে | সর্বনাশ | ওখান থেকে আমার রামগড়ের বাড়িতে পৌঁছাতে গাড়িটার বড়জোর কুড়ি মিনিট লাগবে | চট করে স্নানটা কোনোরকমে সেরে সবে ব্রেকফাস্ট করতে বসবো, বাড়ির নিচে গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো | কোনোরকমে একটা রুটি মুখে গুঁজে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্যান্টের বেল্ট আটকাতে আটকাতে আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলাম | গাড়িতে তখন সঞ্জিত, সংগীত, শান্তনু, অপূর্ব আর আমাকে নিয়ে পাঁচজন | এরপর গড়িয়া কলেজের সামনে থেকে প্রবীরকে তোলা হলো | এবার ই এম বাইপাসের উপর ঢালাই ব্রিজের কাছ থেকে ধ্রুব আর পীযুষ | গাড়ি কামালগাজি ফ্লাইওভার পেরিয়ে বাইপাস ধরে সোজা বারুইপুর | বাইপাসটা হয়ে খুব সুবিধা হয়েছে | নাহলে এন এস বোস রোড ধরে মেন রাস্তা দিয়ে বারুইপুর পৌঁছাতে গেলে অনেকখানি সময় বেশি লাগতো | যাই হোক আমাদের গাড়ি বারুইপুর ফ্লাইওভারের মাঝ বরাবর দাঁড় করানো হলো | খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের শেষ দুই সদস্য তরুণ আর শিবু গাড়িতে উঠে এলো |
আগে বারুইপুর রেলগেট পার হওয়া ছিল একটা বিভীষিকা | ভয়ঙ্কর জ্যাম হতো | কয়েক বছর আগে এই নতুন ফ্লাইওভারের কল্যানে এখন সেই পথ অনেক মসৃন | আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে | ক্যানিং রোড | চারদিকে সবুজ বনানী | দুপাশে ছবির মতো গ্রাম বাংলার চেনা দৃশ্য | গাড়িতে এ সি চললেও গরম লাগছে | খুব জল তেষ্টা পেয়েছে | আমি দ্বিতীয় সিটের বাঁ দিকে জানলার পাশে বসেছি | সামনের সিটে বসা শান্তনু পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে একটা জলের বোতল দিলো | এক চুমুকে অনেকটা খেয়ে ফেললাম | খানিকক্ষণ বাদেই ভুলটা বুঝতে পারলাম | মাথাটা ঝিমঝিম করছে | জলটা খাওয়ার সময়ই স্বাদটা একটু সন্দেহজনক লাগছিলো | কি আর করা যাবে | দ্বিতীয়বার এপ্রিল ফুল হয়েছি | ইতিমধ্যে ক্যানিং এসে গেছে | মাতলা নদীর ব্রিজে ওঠার আগে ডানদিকে একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হলো | চা খাওয়ার বিরতি | ফ্রিজ থেকে একটা ট্রে বার করে চামচ দিয়ে মাখনের মতো একটা কি যেন চায়ের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে | ওটা নাকি মালাই | ক্যানিংয়ের বিখ্যাত মালাই চা | আমাদের কয়েকজন চায়ের খুব তারিফ করছে | অবশ্য যে কজন গাড়িতে ওই রহস্যময় জল পান করেছিলাম তাদের মালাই চায়ের স্বাদটা ঠিকমতো অনুভূত হলো না | ঘড়িতে তখন প্রায় দুপুর বারোটা | নদীতে জল খুব কম | অনেক জায়গায় চরা পড়ে গিয়েছে | নদীর মাঝবরাবর কয়েকটা নৌকা চলছে |
এইবার মাতলা নদী পেরিয়ে গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে | মিনিট চল্লিশ বাদে এলো বাসন্তী | আরো আধ ঘন্টা বাদে গদখালী | এখানে আমরা গাড়িটা ছেড়ে দিলাম | কারন এরপর আর গাড়ি যাবে না | গাড়িটা বেকার দুদিন বসে থাকবে | তার চাইতে গাড়িটা ফিরে যাক | ড্রাইভারকে বলা হলো পরের পরদিন মানে দোসরা এপ্রিল বেলা বারোটা নাগাদ আবার এখানে এসে আমাদের তুলে নিতে | মাইল মিটারে দেখলাম জিঞ্জিরাবাজার থেকে গদখালির দূরত্ব প্রায় ১০৪ কিলোমিটার | এবার জেটি ঘাট | গদখালী নদী পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে হবে গোসাবা | জেটিঘাট থেকে একটা বড়ো ভুটভুটি নৌকায় আমরা গদখালী নদী পেরোলাম | এবার আমরা সুন্দরবনের মূল অঞ্চলে | পেপারে তো মাঝে মাঝেই দেখি গোসাবার গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়েছে | এবার দুটো অটো রিক্সায় প্রায় ১০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে পৌছালাম গোমর নদীর ধারে ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম পাখিরালয়ে | নামটা লোকমুখে পাখিরালা | একসময় নাকি এখানে নানা ধরনের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসতো | তার থেকেই এই নাম | ভাবতেই পারিনি গোসাবার এই শেষ প্রান্তে পাখিরালয় গ্রামে এতো বড়ো বড়ো হোটেল আর রিসর্ট থাকতে পারে | সবটাই যেন ক্যানভাসে আঁকা | গায়ে লাগানো গোমর নদীর ওপারে সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে | পুরো জঙ্গলটাকে ১৮ ফিট উঁচু নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে | এই সব দেখতে দেখতে দেখতে আমরা আপনজন বলে একটা বড়ো তিনতলা হোটেলে পৌঁছালাম | তখন বেলা আড়াইটে | এদের নিজস্ব রিসর্টও আছে | এটাই এখানকার সবচাইতে বড়ো হোটেল | প্রচুর পর্যটক এসেছেন | বেশ কিছু বিদেশী টুরিস্ট দেখতে পাচ্ছি | একতলায় বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে সুন্দর করে সাজানো বিশাল ডাইনিং হল | ভাগ্যক্রমে পাঁচটা এ সি ডাবল বেডরুম পাওয়া গেলো | ঘর প্রতি একদিনের ভাড়া ১৭০০ টাকা | নিজস্ব জেনেরেটরও আছে | এবার দুপুরের খাওয়া | খাবারের কোয়ালিটি খুব ভালো | এবার খানিকটা বিশ্রাম | বিকালে সবাই মিলে হাটতে হাটতে গোমর নদীর ধারে জেটি ঘাটের কাছে পৌঁছে চারদিক দেখছি | বিরাট চওড়া নদী | অনেক ছোট বড়ো লঞ্চ, অনেক রকম নৌকা, ছোট ডিঙি দেখতে পাচ্ছি | ঠিক উল্টো দিকে ঘন জঙ্গলে ভরা কয়েকটা দ্বীপ | আসলে আমরা নিজেরাও একটা দ্বীপের মধ্যেই আছি | খানিকক্ষণ বাদে অন্ধকার হওয়ার মুখে নদীর ধারে একটা চায়ের দোকানে বসলাম | মালিকের নাম বাবুরাম | দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা | মাত্র দশজনের দল হলে কি হবে, চা হবে চার রকম | চিনি দেয়া আর চিনি ছাড়া লাল চা | আবার কারো চিনি দেয়া তো কারো আবার চিনি ছাড়া দুধ চা | বাবুরাম বাবু প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও সবার জন্যে ফরমায়েশ মতো চা বানিয়ে দিলেন | ওনার কাছ থেকে জানলাম যে এই গ্রামে পানীয় জল পাওয়া যায়না | অনেক দূর থেকে খাওয়ার জল আনতে হয় | আসলে বঙ্গোপসাগরের খুব কাছে বলে সব জল এখানে নোনতা | পর্যটকদের জন্যে এখানে পর্যাপ্ত পরিমানে মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হয় | মাঝে মাঝে এখানে বাঘ হানা দেয় শুনে আমাদের কয়েকজন তাড়াতাড়ি হোটেলের দিকে রওনা দিলো | ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে | দোকান পাট বন্ধ হচ্ছে | আমরাও হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম | এইবার হোটেলের ম্যানেজারের সাথে দেখা হলো | এই হোটেলের সুন্দরবন পর্যটনের জন্যে নিজস্ব তিনটে লঞ্চ আছে | যদিও প্রত্যেকটাতে চল্লিশ জন মানুষের বসার ব্যবস্থা আছে, আমরা একটা গোটা লঞ্চই বুক করে নিলাম | লঞ্চের ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা | সকাল ঠিক আটটায় ছেড়ে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ফিরিয়ে আনবে | দেখিয়ে আনবে বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থান | দুপুরের খাওয়া লঞ্চেই | চা-ও পাওয়া যাবে | সজনেখালি থেকে পারমিশন করাতে হবে | সুন্দরবন অভয়ারণ্যে ঘোরার জন্যে লঞ্চের পারমিট ফি ৫০০ টাকা | আর জনপ্রতি ১০০ টাকা করে এন্ট্রি ফি | যাই হোক সব কিছু ঠিক করে আমরা এবার প্রস্তুতি নিলাম সান্ধ্য আসরের | দোতালায় একটা বড়ো হলঘর খুলে দেয়া হলো | অর্ডার দেয়া হলো চিকেন পাকোড়ার | অবশ্য সেটা উড়ে গেলো নিমেষেই | রাস্তায় অনেকটা আঙ্গুর কেনা হয়েছিল | কিছু কাজু বাদামও ছিল | সব মিলিয়ে সান্ধ্য আসর বেশ ভালোই জমে উঠলো | দুএকজন কয়েক কলি গানও গেয়ে ফেললো | কখন যে বেশ রাত হয়ে গেছে মালুম পাইনি কেউ | পরদিন আবার বেশ ভোরে উঠে রেডি হতে হবে | এবার সবাই ডাইনিং হলে | দেশি মুরগির ঝোলটা দারুন বানিয়েছিলো |
আজ পয়লা এপ্রিল | হোটেলের ক্যান্টিনে আগের দিন রাত্রেই বলা ছিল যেন খুব ভোরে ঘরে চা বিস্কুট পাঠিয়ে দেয় | ঘুমটা ভাঙলো দরজায় নক করার আওয়াজে | ছিটকিনি খুলে দেখি বিরাট একটা ফ্লাস্ক হাতে একজন ক্যান্টিন বয় দাঁড়ানো | কাগজের কাপে এক কাপ লাল চা আর দুটো বিস্কুট পেলাম | ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সকাল সাড়ে ছটা | সাড়ে সাতটায় সকালের টিফিন দেয়ার কথা | চা খেয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ছুটলাম | দাড়ি কেটে জামা প্যান্ট পড়ে নিচে যখন নেমে এলাম তখনও সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি | তার মানে নদীর ধারে বাবুরাম বাবুর দোকানে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে | দোকানে পৌঁছে দেখি বেশ ভিড় | আমাদের কয়েকজন আগেই ওখানে হাজির | চা খাচ্ছে | সামনের বেঞ্চ দুটো ভর্তি | গাঁয়ের লোকজনও রয়েছে | চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে দেখি সামনের ছোট জেটিটার সামনে ‘আপনজন’ লেখা আমাদের লঞ্চটা দাঁড়ানো | খাবার দাবার তোলা হচ্ছে | অনেক ট্যুরিস্টরাও দেখলাম এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে | এরমধ্যেই একজন খবর দিলো যে সকালের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা আরম্ভ হয়েছে | আমরাও হোটেলের নিচতলার ডাইনিং হলে ফিরে এলাম | একটা থালায় বেশ কয়েকটা লুচি আর বাটিতে আলুর তরকারি | সাথে একটা ডিম্ সেদ্ধ | পিছনের টেবিলে একজন বিদেশী ভদ্রমহিলা তার স্বামী ও শিশু কন্যাকে নিয়ে বসে খাচ্ছেন | তাদের খাবার মেনু অবশ্য আলাদা | সামনের একটা প্লেটে অনেক গুলো কমলা লেবু রাখা আর প্রত্যেকের সামনে অনেকটা পাস্তার মতো দেখতে কিছু একটা খাবার | সেই টেবিলে কয়েকজন বাঙালি মাঝবয়েসী ভদ্রলোকও লুচি তরকারি খাচ্ছিলেন | তাদের মধ্যে বেশি উৎসাহী একজন প্রানপনে ওই বিদেশি ভদ্রমহিলাকে সুন্দরবন সম্বন্ধে বিচিত্র ইংরেজিতে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন | ভদ্রমহিলা খুব সম্ভবত আমেরিকান | মাঝে মাঝে উনি কিছু প্রশ্ন করছেন | কিন্তু না তো ওই বাঙালি ভদ্রলোক কিছু বুঝতে পারছেন না বোঝাতে পারছেন | একটা বিচিত্র পরিস্থিতি | সোয়া আটটা বাজে | এবার আমরা হেটে গিয়ে জেটি থেকে লঞ্চে উঠলাম | দোতালা লঞ্চ | একতলায় বিশ্রাম করার জন্যে কয়েকটা বিছানা পাতা | পেছনদিকে রান্নার জায়গা | সুন্দর একটা কমোড বসানো টয়লেটও আছে | আমরা সবাই দোতালায় উঠে এলাম | সামনের দিকে সারেংয়ের কেবিনের সামনে চারকোনা গদি পাতা একটা বসার জায়গা | আমি ওখানেই ক্যামেরা হাতে বসলাম | আমার পাশে শান্তনু | বাকিরা পেছনে ডেকের উপর প্লাস্টিকের চেয়ারে | সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি | আমরা তো সাকুল্যে মাত্র দশ জন | ঠিক সাড়ে আটটায় লঞ্চ স্টার্ট করলো | সকাল আটটার জায়গায় সবে সাড়ে আটটা | বাঙালি হিসাবে যথেষ্ট ভালো টাইমিং আমাদের | ভাগ্যিস আমরা সবাই একা এসেছি | পরিবার সাথে থাকলে নির্ঘাত দশটা বাজতো | লঞ্চে তারস্বরে স্পিকারে গান বাজছে | অনেক বলে আওয়াজটাকে কমানো গেলো | যেমন গানের বাণী, তেমন গলার আওয়াজ | ছেলের না মেয়ের গলা সেটা বোঝাই যাচ্ছে না | একটা গানের প্রথম দুটো লাইন শুনুন | 'চাঁদের আলোয় ভাঙা ঘরে টোকা দিলো কে ? ওরে মাইয়া উইঠা পইরা দরজা খুইলা দে ‘ | শুনে হাসবো না কাঁদবো সেটাই বুঝতে পারছি না | প্রথমেই যাবো সামান্য দূরে গোমর নদীর উল্টো পাড়ে সজনেখালিতে | তবে শুনে আস্বস্ত হলাম যে সজনেখালির পৌঁছনোর কিছু আগেই গান বন্ধ হবে |
সজনেখালি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি | এখানকার বনবিভাগের অফিস থেকেই লঞ্চে করে সুন্দরবন ঘোরার পারমিট নিতে হবে | লঞ্চের জন্যে ৫০০ টাকা আর জনপ্রতি ১০০ টাকা ধরে দশ জনের জন্যে ১০০০ টাকা জমা করতে হলো | এছাড়াও একজন স্বীকৃত গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক | তার জন্যে আরো ৫০০ টাকা | সাকুল্যে সাত হাজার টাকা | আমাদের গাইডের নাম শ্রী বিকাশ মিস্ত্রি | উনি লঞ্চে পুরো ট্যুরটাতেই আমাদের সাথে থাকবেন | বুকে বন দফতর থেকে দেওয়া সচিত্র পরিচয় পত্র ঝোলানো | উনি এবার আমাদের সবাইকে সজনেখালি দ্বীপের দ্রষ্টব্য জিনিসগুলো দেখাতে আরম্ভ করলেন | এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩২ স্কোয়ার কিলোমিটার | প্রথমে ঢুকেই একটা বিরাট চৌবাচ্চা | চারদিকে সাড়ে চার ফিট পাঁচিলের উপর সম্পূর্ণটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা | ভেতরে জলের মধ্যে নাকি বড়ো বড়ো কচ্ছপ আছে | অনেক টুরিস্ট এসেছেন | অনেকে পা উঁচু করে জালের মধ্যে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কচ্ছপ দেখার চেষ্টা করছে | অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকেও আমি কিছু দেখতে পেলাম না | অবশ্য কেউই পায়নি | ডানদিকে ছড়ানো ছেটানো বেশ কয়েকটা খুব সুন্দর সিমেন্টের ছাউনি দেয়া গোল বসার জায়গা রয়েছে | এবার বিকাশ বাবুর তত্ত্বাবধানে আমরা ওনার পিছু পিছু এগোচ্ছি | যাতায়াত করার সব রাস্তার দুপাশে প্রায় আঠেরো ফিট উঁচু লোহার জাল লাগানো | আসল বাঘ না দেখতে পেলেও ভিতরে প্রমান সাইজের দুটো কংক্রিটের বাঘ দাঁড় করানো | কৃত্রিম হরিণও আছে | ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের সবুজ রঙের তিনতলা নতুন পাকা গেস্ট হাউস দেখলাম | আগাম অনুমতি নিয়ে এখানে ঘর বুক করা যায় | এর আগে ২০০১ সালে আমি পাড়ার বন্ধুদের সাথে সুন্দরবন ঘুরতে এসেছিলাম | তখন সজনেখালিতে এই নতুন গেস্ট হাউস তৈরি হয়নি | তখন ছিল অনেকগুলো উঁচু কাঠের খুঁটির উপর সম্পূর্ণ কাঠের একটা গেস্ট হাউস | সেটা এখনো আছে | সেটায় বোধহয় এখন আর কেউ থাকে না | বিভিন্ন ধরনের প্রচুর গাছ রয়েছে | প্রত্যেকটা গাছের গায়ে নাম লেখা | সুন্দরী গাছ দেখলাম | একদম খাড়া | হাটতে হাটতে বাঁ দিকে জালের ঠিক গায় একটা বিরাট গুইঁ সাপ শুয়ে আছে দেখছি | চলতি নাম গোসাপ | একটা যেন ছোট খাটো কুমির | একটা মিউজিয়াম আছে | আমরা আর ভিতরে ঢুকিনি | মিউজিয়ামের সামনে বিরাট একটা ম্যাপ | তাতে সুন্দরবন অঞ্চলের সমস্ত খুঁটিনাটি রয়েছে | বিকাশ বাবু আমাদের সব বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন |
নতুন গেস্ট হাউসের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা বিরাট জলাশয় | চারদিক ঘিরে জাল দিয়ে ঘেরা বাঁধানো সুন্দর রাস্তা | ওখানে নাকি অনেক কুমির আছে | অনেকক্ষন ধরে আমরা কুমির দেখার চেষ্টা করছি | অনেকই দাঁড়িয়ে আছে | অনেক পরে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে পাড়ের কাছে কি একটা যেন মাথাটা উঁচু করেই ভুস করে আবার ডুবে গেলো | মনে হয় ওটা কুমিরেরই মাথা ছিল | আমি অবশ্য খেয়াল করতে পারিনি | সম্পূর্ণ দ্বীপটাই খুব সুন্দর | পরিচ্ছন্ন | এক কোনায় গিয়ে আমাদের মধ্যে একজন একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতেই বিকাশ বাবু ছুটে গিয়ে বাধা দিলেন | সুন্দরবনে যে কোনো দ্বীপেই ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ | একটা চারতলা বিরাট ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে | আমরা সবাই চার তলায় উঠে এলাম | এখন থেকে সম্পূর্ণ সজনেখালি দেখা যায় | যতদূর চোখ যায় চারদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল | তবে মাঝখানে মাঝখানে বেশ কিছু জায়গা সম্পূর্ণ নেড়া | দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে কাদা মাটিতে ভরা | আর সেগুলোর মধ্যেই রয়েছে কিছু মিষ্টি জলের ছোট পুকুর | গাইড বিকাশ বাবুর কাছ থেকে জানলাম যে বাঘ আর অন্য অনেক জন্তু জানোয়ার খুব সকালে আর সন্ধ্যায় এখানে জল খেতে আসে | নরম মাটির উপর অনেক রকম পায়ের ছাপ স্পষ্ট | সব মিলিয়ে দুর্দান্ত লাগছে | এবার আবার আমরা একসাথে পিছনের একটা গেট দিয়ে সজনেখালি ছেড়ে বেরিয়ে অন্য একটা জেটিতে এলাম | কি আশ্চর্য ! আমাদের লঞ্চটাও দেখি এই জেটিতে চলে এসেছে |
আমরা সবাই লঞ্চে উঠে পড়েছি | এবার আমরা যাবো সুধন্যখালি দ্বীপে | প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা | অনেক আগে সুধন্য বলে একজন কাঠুরেকে বাঘে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো বলে নাকি জায়গাটার এই নাম | লঞ্চে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি | ডানদিকের ধারে চেয়ার পেতে অপূর্ব আর তার ঠিক পেছনে সংগীত বসেছে | কাল গাড়িতে ওঠার পর থেকেই দেখছি ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করে চলেছে | ফেরি পার হওয়ার সময়ও একই জিনিস | রুমটাও দুজনে একসাথে শেয়ার করলো | আজ ভোরে ঘুম থেকেও উঠে দেখেছি দুজনে সামনে সামনি দুটো চেয়ারে বসে কথা বলছে | আসলে দুজনেই বাল্য বন্ধু | কোন্নগরে একই স্কুলে পড়তো | এতদিন বাদে একসাথে | কত গল্প যে জমা হয়ে আছে | তবে অপূর্বই একনাগাড়ে বলে চলেছে | গল্পে অপূর্ব কখনো নৈনিতালের লেকে আবার পরমুহূর্তেই হুগলির কোনো গন্ডগ্রামে | গল্প কন্যাকুমারিকার বিবেকানন্দ রক থেকে উঠে আসছে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে | সংগীত এমনিতেই শান্তশিষ্ট মানুষ | মুখে একটা সুন্দর হাসি লেগেই থাকে | অপূর্বর কথার খেই হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়লেও রক্ষা নেই | অপূর্ব হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আবার বলতে শুরু করবে | চা দেয়া হবে শুনে আমি আর শান্তনু সামনের দিকের জায়গাটা ছেড়ে পিছনে চলে এসেছি | প্রবীর সারেংয়ের কেবিনের সামনের সেই চারকোনা গদি পাতা জায়গাটায় শুয়ে পড়েছে | কাল হোটেলে ঢোকার পর থেকেই ধ্রুব সারাক্ষণ একটা হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুরছে | লঞ্চেও একই পোশাক | ডানদিকে রেলিং বরাবর পীযুষের পিছনের চেয়ারে বসা | সবসময়ই কারো না কারো পিছনে লাগে | যেমন এখন পড়েছে পীযুষকে নিয়ে | পীযুষের শরীরটা একটু নাদুসনুদুস বলে বাঘ নাকি ওকেই প্রথমে ধরবে | পীযুষ কিন্তু সবসময় হাসি মুখে থাকে | তরুনের চেহারা এতোটাই ছোটোখাটো যে মাঝে মাঝে খুঁজেই পাওয়া যায়না | শম্ভু আর ওর বাড়ি এক জায়গায় বলে একটু বেশি ঘনিষ্ট | লঞ্চের পেছনের দিকে দুটো চেয়ারে বসে গল্প করছে | সঞ্জিত আমাদের গাইড বিকাশ বাবুর সামনে বসে কথা শুনছে | ইতিমধ্যে কাগজের কাপে সবাইকে লাল চা দেয়া হলো | বিকাশ বাবু মাঝবয়সী শিক্ষিত মানুষ | ওনার মুখ থেকেই জানলাম যে ওনার মতো চল্লিশজন সুন্দরবন বন বিভাগের স্বীকৃত গাইড আছেন | এমনিতে ওনাদের কোনো নির্দিষ্ট মাইনে নেই | সজনেখালি থেকে লঞ্চ পিছু একজন করে গাইড বুক করা বাধ্যতামূলক | তবে সিজন ছাড়া রোজ সবাই কাজ পায়না | তবে যে কজন কাজ পাবে তাদের টাকাটা একজায়গায় করে সবার মধ্যে সমান ভাগ করে দেয়া হয় | তাতে হয়তো সারাদিন খেটে বিকাশ বাবুর ভাগ্যে জুটবে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা | তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত মাত্র চল্লিশ জনে কুলায় না | তখন আরো অতিরিক্ত চল্লিশজনকে বনবিভাগ গাইড হিসাবে নিযুক্ত করে |
দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি জায়গা জুড়ে সুন্দরবন অঞ্চল | এর মধ্যে ৬০ শতাংশের মতো বাংলা দেশের সীমানার মধ্যে আর ভারতের মধ্যে বাকি ৪০ শতাংশ | ভারতের অংশের মধ্যে ছোট বড়ো মিলিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একশো দুটো দ্বীপ আছে যার অর্ধেকের বেশি জায়গায় কোনো মানুষ থাকে না | যে কয়েকটা দ্বীপে মানুষ বসবাস করে তার অধিকাংশ জায়গাতেই বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি | বন দফতরের অফিসগুলো জেনারেটরে চলে | ২০০২ সালের গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে পাঁচশোর বেশি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল | ২০১৮ সালের ব্যাঘ্রশুমারিতে সেই সংখ্যাটা দুশো বারোতে ঠেকেছে | ভারতের অংশে সেটা একশোর একটু বেশি | পৃথিবীর মধ্যে সুন্দরবন হলো সবচাইতে বড়ো ম্যানগ্রোভ অরণ্য | ইউনেস্কো থেকে হেরিটেজ তকমাপ্রাপ্ত সুন্দরবন অরণ্যতে ভারত বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০০৫ সালে শুরু হয়েছে ইকো ট্যুরিজম | তাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর যেমন জোর দেয়া হয়েছে তেমনি এই অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষজনকে বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ | এখন কাঠ কাটতে, জঙ্গলের ভিতরে মধু সংগ্রহ করতে কিংবা এই অঞ্চলে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বন বিভাগের আগাম অনুমতি নেয়া আবশ্যিক | বাংলায় একটা কথা আছে না, ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির | এই অঞ্চলে কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক | সুন্দরবন লাগোয়া দ্বীপগুলিতে এমন কোনো পরিবার নেই যাদের কোনো না কোনো সদস্য বাঘের বা কুমিরের মুখে পড়েনি | জোর দেয়া হয়েছে পর্যটন শিল্পেও | দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষজনদের জন্যে সমস্ত সুন্দরবন অঞ্চলটাকেই সাজিয়ে তোলা হচ্ছে ছবির মতো করে | বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন অতিথি নিবাস | চোরা গোপ্তা বেআইনি পশু শিকার বন্ধ করার জন্যে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যৌথ নজরদারির ব্যবস্থার | তবে আরো অনেক কিছু বাকি আছে | বিকাশ বাবুর কাছ থেকে আমরা এক মনে শুনছি | গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদী আর বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় এই সুন্দরবন অঞ্চল | পশ্চিম বঙ্গের হুগলি নদী থেকে বাংলাদেশের বালেশ্বর নদী অব্দি এর বিস্তার | রয়েছে অসংখ্য ছোট বড়ো নদী | ছোট ছোট অপ্রশস্ত খাঁড়ি বা খাল দিয়ে সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত |
এই মুহূর্তে আমরা এরকমই একটা খাঁড়িতে ঢুকেছি | চলেছি পাড়ের খুব কাছ দিয়ে | বিকাশ বাবু বলে চলেছেন | সুন্দরবনের বাঘের একটা বিশেষ গুণ যে তারা সাঁতার কাটতে পারে | ছোট নদী সাঁতরে পার হওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কাছে জলভাত | উনি নাকি একবার বাচ্ছা মুখে নিয়ে একটা বাঘিনীকে সাঁতরে নদী পার হতে দেখেছেন | ব্যাস হয়ে গেলো | যারা যারা একটু দূরে দূরে রেলিঙের ধার বরাবর বসেছিল তারা গুটিশুটি মেরে ভেতর দিকে বিকাশবাবুর কাছে ঘন হয়ে বসে পড়লো | পীযুষের মুখের হাসি তখন উধাও | তরুণ আর শম্ভু পিছনের দিকে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল | তারা ততক্ষণে উপরে উঠে এসেছে | প্রবীর এতক্ষণ মটকা মেরে শুয়ে ছিল | এক ঝটকায় উঠে আমার পাশে এসে বসলো | ধ্রুব ওর হাফ প্যান্টের দড়িটা তখন শক্ত করে বাঁধছে । যেন বাঘ মামাকে সাঁতরাতে দেখলেই রড বেয়ে কেবিনের ছাদে উঠে পড়বে ।শান্তনু একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়েছিলো | সেটাকে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে সিগারেটটা আবার প্যাকেটে ঢোকালো | ভাবখানা যেন যদি পাড় থেকে আগুন লক্ষ্য করে বাঘ বাবাজি লাফ দেয় | অপূর্বর কথা তখন থেমে গেছে | সদাহাস্যময় সংগীতকেও দেখলাম বেশ গম্ভীর হয়ে যেতে |
অবশেষে দুরু দুরু বুকে খাঁড়িটা পার হয়ে আমরা একটা চওড়া নদীতে এসে পড়লাম | দত্ত নদী | এর উল্টো পাড়েই সুধন্যখালি ন্যাশনাল পার্ক | আমরা একে একে সবাই নেমে বিকাশ বাবুর পিছন পিছন হাটছি | যাতায়াতের সমস্ত রাস্তাগুলোর দুদিকে প্রায় ষোলো ফিট উঁচু জাল লাগানো | রাস্তা গুলো ভীষণ সুন্দর | ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে জমির উপর রাখা আর চারদিক কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা একটা পুরোনো স্টিম ইঞ্জিন লাগানো ভেসেল | প্রায় তিরিশ বছর আগে পথ ভুল করে থাইল্যান্ড থেকে এটা নাকি সুন্দরবনে ঢুকে পড়েছিল | এখানেও একটা বিরাট কুমিরদের জলাশয় আছে | যদিও অনেক্ষন তাকিয়ে থেকেও কোনো কুমির চোখে পড়লো না | রাস্তার পাশে পাশে রয়েছে বেশ কিছু ওপরে সুন্দর ছাউনি লাগানো গোলাকৃতি সবুজ রঙের বসার জায়গা | একটা চারতলা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে | একেবারে ওপরের তলাটা চারদিক খোলা | ছাদ নেই | একসাথে প্রায় পচিশজন মানুষ সেখানে দাঁড়াতে পারে | টাওয়ারের খুব কাছেই একটা বিরাট মিষ্টি জলের পুকুর | চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু ম্যানগ্রোভের জঙ্গল | অন্যান্য গাছও আছে | তবে জঙ্গলের বুক চিরে মাঝে মাঝে অনেকটা চওড়া নেড়া জমি | এখান থেকেই নাকি সবচাইতে বেশি বন্য জন্তু জানোয়ার দেখা যায় | খুব ভোরের দিকে আসতে পারলে ওই মিষ্টি জলের লেকে জল খেতে আসা বাঘের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি | তবে ভাগ্য ভালো থাকলে অন্য সময়ও বাবাজীবনের সাক্ষাৎ হতে পারে | দেশি বিদেশী প্রচুর টুরিস্ট এসেছেন দেখলাম | আমরাও ভিড় কাটিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চোখে সামনের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে আছি | বলা তো যায়না কপাল খুললেও খুলতে পারে | জলাশয়ের কাছের নেড়া জমিটায় বেশ কিছু লম্বা ঠোঁট ওয়ালা কালো কালো পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে | হটাৎ ঘন ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকটা বুনো শুয়োর | সচরাচর আমরা যেরকম দেখি এগুলো ঠিক সেরকম না | এগুলো কালচে আর গায়ে অনেক লোম | আমরা বুনো শুয়োর গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখছি | মাঝে মাঝে শূকর গুলো আশেপাশের ঝোপে হারিয়ে যাচ্ছে | আর ঠিক তখুনি সেই ঘটনাটা ঘটলো | আমার ডানদিকে দাঁড়ানো অপূর্ব দাস | আর তার ঠিক পাশেই শান্তনু | হটাৎ ওই মিষ্টি জলের পুকুরের কাছে ঝোপের আড়ালে অনেক দূরে একটা বড়ো গাছের দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে শান্তনু চেঁচিয়ে উঠলো 'আরে ওই তো বাঘ'| অপূর্ব তখন মাথা উঁচু করে একটা বোতল থেকে জল খাচ্ছিলো | বাঘ শব্দটা শুনে মাথাটা নামাতে গিয়ে বিষম খেলো | তখন খানিকটা মেঘলা মতো আকাশ | তার উপর বুনো ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে আলো আঁধারিতে অত দূরের কিছু পরিষ্কার ভাবে ঠাহর করা যাচ্ছে না | কিন্তু আমারও মনে হলো কিছু একটা মেটে মতো বস্তু চার হাত পায়ে চুপি সাড়ে এগোচ্ছে | ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন ওইতো ওইতো করে চেঁচাতে আরম্ভ করেছে | ততক্ষণে ওয়াচ টাওয়ারের তিনতলা থেকে সবাই চারতলায় উঠে এসেছে | এক বিহারি ভদ্রমহিলা তার কোলের বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে জোরসে চেপে ধরে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছেন | অনেকে পায়ের চেটোর উপর ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জন্তুটাকে দেখার চেষ্টা করছে | এদিকে ওয়াচ টাওয়ারের নিচে এদিক ওদিক যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বাঘ কথাটা শুনে তারা সবাই তখন দুদ্দাড় করে অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারের উপরে ওঠার চেষ্টা করছে | আমাদের গাইড বিকাশ বাবুকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না | নারী কন্ঠে কেউ একজন ভ্যাক করে কেঁদে উঠলো | একজন দর্শকের হাতে একটা দূরবীন দেখলাম | কিন্তু উনি কিছুতেই লক্ষ্য বস্তুটা খুঁজে পাচ্ছেন না | ততক্ষনে অনেকে ব্যাগের ভিতর থেকে দামি ক্যামেরা বার করে ফেলেছে | আমার ঠিক ডান দিকে একজন তার ক্যামেরার সাথে টেলিস্কোপিক জুম লেন্স লাগাতে আরম্ভ করলেন | আমার কম দামি ক্যামেরা | আলাদা করে জুম লেন্স লাগানোর প্রয়োজন নেই | এবার আমি আমার ক্যামেরায় চোখ রেখে ম্যানুয়ালি জুম করে বাঘটাকে ধরার চেষ্টা করলাম | প্রথমে ওই নির্দিষ্ট গাছটাকে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না | অবশেষে পেলাম | এবার আস্তে আস্তে লেন্সের মুখটা নিচের দিকের নামিয়ে দেখতে পেলাম জানোয়ারটাকে | বাদামি লোমে ঢাকা বড়োসড়ো চতুস্পদ একটা কিছু | অল্প নড়াচড়া করছে | প্রথমে মুখটা পিছন দিকে ঘোরানো ছিল | এবার মাথাটা আমাদের দিকে ঘোরালো | শাটারটা আদ্ধেক টিপতেই ফোকাস পুরো ক্লিয়ার | ধুর, এটা তো একটা পূর্ণ বয়স্ক বেশ বড়ো সাইজের বাঁদর | আমি বাঁদর বলে চেঁচিয়ে উঠতেই একসঙ্গে অনেকগুলো দীর্ঘ নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেলাম | এতক্ষণ যে বিহারি ভদ্রমহিলা বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ইস্ট নাম জপ্ করছিলেন তিনি দুম করে বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বকাবকি আরম্ভ করলেন | বাচ্চাটা বোধহয় ওনার কোলে হিসি করে ফেলেছিলো | সবার প্রথমে শান্তনু বাঘ বলে চেঁচিয়েছিলো | আমরা ওর মুখের দিকে তাকালাম | ঠোঁটের কোনায় একটা স্মিত হাসি | সেটা অপ্রস্তুত হওয়ার না সবাইকে এপ্রিল ফুল করার ঠিক বুঝতে পারলাম না | কারন তারিখটা তো পয়লা এপ্রিল |
4:15 নাগাদ দরজায় ধাক্কা শুনে খুলে দেখি সৈকত। মুখটা বিরক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিকের নাসিকাগর্জন এর ঠেলায় ঘুমোতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে নাকি ওর পেটে দুটো লাথিও মেরেছে, কিন্তু সে নাকি পাথরের মূর্তি, নট নড়ন চড়ন। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কৌশিক ঘুম থেকে উঠলো। আমরাও সবাই 5:15 তে রেডি। কিন্তু বৃষ্টি থামেনা। অবশেষে 6:20 নাগাদ বৃষ্টিটা ইলসেগুড়ি মতো হওয়ায়, আমরা জিপিসির হুড লাগিয়েই রওনা হলাম। একটুখানি এগোতেই ডানদিকে ফাঁকা ঘাসজমিতে দেখি দুটো বাইসন (ইন্ডিয়ান গাউর) একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় বাচ্চাটাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। বাচ্চাটা আবার মাঝে মাঝে মায়ের দুধ খাচ্ছে। আর একটু এগোতেই মিনটাদা ডানদিকে একটা গাছের কোটরের দিকে আঙ্গুল দেখালো, তাকিয়ে দেখি একটা মনিটর লিজার্ড (Varanus togeanus)একটা পা আর মুখ বার করে উঁকি মেরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ওখানে অপেক্ষা করলাম, যদি সে একটু বাইরে বেরোয়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আবার সেই নালাটার কাছে আসতেই পচা গন্ধে প্রায় বমি হওয়ার উপক্রম। কালভার্ট টায় একটু দাঁড়ালাম, জিপসির স্টার্ট বন্ধ করে। যদি বাঘ মামার (বা মামী) একটু দেখা পাই। সে তো এলোনা, অতএব আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
বাঁশবাড়ি গেট অবধি আবার সেই প্রচুর পাখি, বার্কিং ডিয়ার, ময়ূর দেখলাম। বাইরের সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্টে টিফিন সারলাম রুটি, ঘুগনি আর ডিমের পোচ দিয়ে। তারপর বাঁশবাড়ি বাজার পেরিয়ে প্রায় 45 মিনিট পরে পৌঁছলাম ভুঁইয়াপাড়া ফিল্ড ডিরেক্টর অফিসে। এখান থেকে পারমিট করিয়ে গেট পেরিয়ে আবার অরণ্যে প্রবেশ করলাম।
এই দিকটায় পুরোটাই প্রায় গ্রাসল্যান্ড। মিনিট পাঁচেক যেতেই দেখি একটা হাতির পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। সামনে গিয়ে দেখি একটা ছানা হাতিও আছে। আমরা একটু কাছে যেতেই একটা বড় হাতি কান দুলিয়ে শুঁড় তুলে ভীষণ জোর ট্রাম্পেট দিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এলো। আর বাকি হাতিগুলো বাচ্চাটাকে পায়ের মধ্যে লুকিয়ে নিলো। হাতির তাড়া খেয়ে আমরাও পালালাম। এরপর কুরির বিল ওয়াচটাওয়ার এর দিকে এগোতে এগোতে 3-4 টে বেঙ্গল ফ্লোরিকান কে উড়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু এত দূর দিয়ে উড়ছিল যে ভালো ছবি পেলাম না। এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুরেও অনেক দূর থেকে 15-20 টা হাতির পাল আর গোটা পাঁচেক হগ ডিয়ার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। যদিও এদিকে গন্ডারের আনাগোনা বেশি, তবুও একটাকেও দেখতে পেলাম না। কিছুটা মনখারাপ নিয়েই ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় একটা ঈগল কে একটা ন্যাড়া গাছের মাথায় বসে থাকতে দেখলাম। যাই হোক, আবার সেই পুরোনো রাস্তায় মাথানগুড়ি ফিরে এলাম।
ফিরে এসে স্নান করে আবার ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এবার ভাত, ডাল, চিকেন কারি। মাথানগুড়ি সব পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে 4 টে নাগাদ বেরোলাম ভুটানের দিকে, উদ্দেশ্য হর্নবিল সাইটিং। এবার গাইড রবি গেল বন্দুক ছাড়া, বললো ভুটানে বন্দুক নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। একটা গোলাকার পাথরের ওপর ভারত-ভূটান সীমান্ত খোদাই করা রয়েছে। খানিকটা এগিয়ে একটা পাহাড়ি ঝোড়ার কাছে মিনটাদা গাড়ি রাখলো। উপরে একটা গাছ দেখিয়ে বললো, হর্নবিল গুলো ওখানেই আসে। আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম। যদিও দু একটা হর্নবিল দেখতে পেলাম, তারা সবাই নদী পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছিল। ওই গাছে কিছুই না দেখতে পেয়ে মিনটাদা অন্য একটা লোকেশনে নিয়ে গেল। মিনিট 15 অপেক্ষা করার পর দেখি একটা গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিল ওই গাছে এসে বসলো। আরো মিনিট 5-7 পর আরো একটা এসে আগেরটার গা ঘেঁষে বসলো। তারপর দেখি একজন আরেকজনের ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কৌশিক বললো “ ওরা ভালো বাসাবাসি করছে”। প্রায় আধঘন্টা অনেক হর্নবিল দেখলাম। প্রায় সন্ধে হয়ে যাওয়ায় ফিরে এলাম মাথানগুড়ি। এবার আমাদের ফেরার পালা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা হলাম বাঁশবাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষবারের মতো সেই নালাটার কাছে আরো একবার দাঁড়ালাম, এখন গন্ধটা সেরকম আসছে না। উনি বোধহয় পুরোটাই সাবাড় করে দিয়েছেন। নাহ, এবারেও দেখা পেলামনা। অন্ধকারে বনপথ পাড়ি দিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাঁশবাড়ি পৌঁছলাম। সেই রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে মিনটাদা কে বিদায় জানালাম। দেবা দত্ত ও আমাদের সি অফ করতে এসেছিল। একটা টাটা ম্যাজিক গাড়ি করে রওনা দিলাম নিউ বঙ্গাইগাঁও। আমাদের ফেরার ট্রেন রাত 12 টায়, গরিব রথ। আমরা বাঁশবাড়ি কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম, কিন্তু সবাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আবার ফিরে আসতেই হবে মানসী মানসে।
0 Comments
কয়েকজন বন্ধুর পোষ্টিং পড়ে মনে হলো এবার কাছাকাছি দেশের বাইরে নিজেরা একটা ভ্রমণসুচী তৈরী করলে কেমন হয়। তাই আমার সকল ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সফরের একটা প্রোগ্রাম করলে মন্দ হয় না।
প্রথমেই বিভিন্ন গ্রুপে সার্চ করে কয়েকটি পোষ্টিং পড়লাম এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করে একটা আইডিয়া পেলাম। প্রথমেই ফ্লাইট বুকিং সেরে ফেললাম Goibibo সাইট থেকে। আমরা স্পাইস জেটে এলাম চেন্নাই আবার ওখান থেকে ওই একই এয়ারলাইন্সে কলম্বো। শ্রীলঙ্কায় আমরা ছয় দিন থাকবো তারপর শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সে করে মালদ্বীপ যাব সেখানে উকুলহাস দ্বীপে দুই দিন আর মাফুসী দ্বীপে দুই দিন। শ্রীলঙ্কায় পরপর ছয়টি জায়গা যেমন ক্যান্ডি, নিউয়েরা এলিয়া, এলা, মিরিসা, আন এওয়াটুনা ও নেগোম্বো ছয় রাতের জন্য এবং মালদ্বীপে দুটো দ্বীপে Booking.com এর মাধ্যমে হোম ষ্টে/ গেষ্ট হাউজ/ হোটেল/ রিসর্ট বুকিং সেরে ফেললাম। আমরা পুরো শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের জন্য Trip advisor এর মারফত একটি ১৭ আসন বিশিষ্ট গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল “ক্যান্ডি”। প্রতিটি ছবির সাথে স্পটগুলির বর্ননা দেওয়া আছে। এরপরও যদি কারও কোন জিজ্ঞাসা থাকে নিশ্চয়ই করবেন হয়ত সবসময় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাবেন না কারণ সারাদিন ঘুরে যখন হোটেলে ফিরব তখন চেষ্টা করব সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে।
ক্যান্ডি:
ক্যান্ডি শ্রীলঙ্কার একটি বড় শহর। এটির চারপাশ সুন্দর পাহাড়ী ভ্যালি ঘেরা ,চা বাগান এবং বৈচিত্র্যপূর্ন রেনফরেস্টের আবাসস্থল। শহরটির হৃদয় হল সুন্দর ক্যান্ডি লেক (বোগাম্বারা লেক), যা হেঁটে বেড়ানোর জন্য জনপ্রিয়। ক্যান্ডি পবিত্র বৌদ্ধ ধর্মের জন্য বিখ্যাত। সোনালী ছাদে তৈরি মন্দির শ্রীলংকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ উপাসনালয় - বুদ্ধের একটি দাঁত। পূজার সময় কড়া প্রহরায় থাকা ঘরটি দর্শনার্থী ও ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা হয় তবে সত্যিকারের দাঁত দেখা যায় না। যাই হোক, এটি একটি দাগোবা (স্টুপ) মতো সোনার কাসকেটে রাখা হয়। নুওয়ারা এলিয়া: Nuwera elliya শ্রীলংকা কেন্দ্রীয় প্রদেশের পাহাড়ি দেশের একটি শহর। এর নাম মানে "সমতল (টেবিল ভূমি) শহর" অথবা "আলোর শহর"। একটি সুন্দর দৃশ্যমান এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ জলবায়ু। এটি 1,868 মিটার (6,128 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত এবং শ্রীলংকাতে চা উৎপাদনের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে মনে করা হয়। শ্রীলংকার সবচেয়ে লম্বা পর্বত পিদুরুতালগালা এই শহরকে পরিবেষ্টিত করে। Nuwera elliya শ্রীলংকার সবচেয়ে শীতল এলাকার জন্য পরিচিত।
সত্যিই নুওয়ারা এলিয়ার সৌন্দর্য ভুলতে পারবো না। তাই আজ ওই জায়গা ছাড়ার আগে আবার গেলাম সেই লেকের ধারে এবং সুন্দর লেকটি উপভোগ করার জন্য মোটর বোট রিসার্ভ করে আধঘন্টা ঘুরে নিলাম।
তারপর বাধ্য হয়ে সুন্দর এই শহর ছেড়ে রওনা দিলাম আরো একটি পাহাড়ি শহর "এলা" র উদ্যেশ্যে। পথে ছোটবেলার রামায়ণ পড়া বা প্রসিদ্ধ রামায়ণ সিরিয়াল দেখে জানা সেই "অশোক বাটিকা" দেখলাম। এই স্থানেই সীতা দেবীকে লংকার রাজা রাবন বন্দী করে রেখেছিলেন। এবার আমারা এলা শহরের দিকে এগোলাম। Ella সিংহলী ভাষায় "জল প্রপাত। এটি কলম্বোর প্রায় ২00 কিলোমিটার (120 মাইল) পূর্বে এবং সমুদ্রতল থেকে 1,041 মিটার (3,415 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এলাকায় প্রচুর সমৃদ্ধ জৈব-বৈচিত্র্য রয়েছে, যা প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ এবং প্রাণিসম্পদ দিয়ে ঘন। এলা পাহাড়ের বন এবং চা গাছের আচ্ছাদন সহ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। শহরটি তার উচ্চতার কারণে পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমির তুলনায় শীতল জলবায়ু রয়েছে। এখানে একটি দ্রষ্টব্য স্থান হল "Nine Arches Bridge". জনপ্রিয় গুজবগুলি ইঙ্গিত দেয় যে যখন সেতু নির্মাণ শুরু হয়, ইউরোপের সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং এই সাইটের জন্য বরাদ্দ করা ইস্পাত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটেনের যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতে পুনরায় বরাদ্দ করা হয়। ফলস্বরূপ, কাজটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে স্থানীয়রা পাথর ইট এবং সিমেন্ট দিয়ে সেতু নির্মাণ করে, কিন্তু ইস্পাত ছাড়া।
গড়বেতা গনগনি ভ্রমণ কথা
গনগনি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই । বাংলার একমাত্র গিরিখাত, কমবেশী সবাই জানে । আজ গনগনির সাথে গড়বেতার কিছু কথা বলি । পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা একসময় রাজনৈতিক ভাবে খবরের শিরোনামে ছিলো । কিন্তু কালের প্রভাবে পরিবর্তনের যুগে রাজনৈতিক গড়বেতার পটভূমিকা পরিবর্তন হয়েছে । আজ গড়বেতা বলতে প্রথমেই আমরা গনগনির কথা মনে করি । গনগনি ছাড়া গড়বেতার পরিচয়ে প্রথমেই আসি সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরের কথায় । ওড়িশার মন্দির রীতির মতো সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দির । পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় স্থানীয় ভাবে খুবই জাগ্রত ঠাকুর মা সর্বমঙ্গলা । গনগনি ভ্রমণে এলে প্রথমেই মা সর্বমঙ্গলা দর্শন করতে হবে । এরপর চলুন বারো শিবের মন্দির । দুদিকে ছয়টা করে মোট বারোটা শিবের মন্দির গড়বেতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্য । এরপর শ্যাম ভবনের কৃষ্ণ মন্দির । শ্যাম ভবন একটা ধর্মশালা । এখানে থাকার ব্যবস্থা আছে । পাশেই শ্যাম মন্দির । সুন্দর বিগ্রহ । এরপর গনগনি যাওয়ার পথে দ্রষ্টব্য নতুন হওয়া ভদ্রকালী এবং ভদ্রকেস্বর মন্দির । একসাথে মা কালী, শিব ঠাকুর এবং বজরংবলীর মন্দির । গিরিখাত শুরু হওয়ার আগে ফাঁকা জায়গায় ভদ্রকালী মন্দির খুবই ভালো লাগবে । এরপর গড়বেতা যেকারনে ঘুরতে আসা সেই গনগনির কথায় আসা যাক । নীল আকাশের নিচে একটু পায়ে পায়ে হেঁটে আকাশ, বাতাসের সঙ্গে আর শিলাবতী নদীকে সাক্ষী রেখে ফুরফুরে মেজাজে মনের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যায়। গনগনি হলো 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন', যার বাংলা অর্থ গিরি সংকট বা গিরিখাত। নদী উপত্যকা গভীর হলে তাকে গিরি খাত বলে। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা যুক্তিযুক্ত কিনা সেটা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে । তবে ভ্রমণ ট্যুরিজমে এই বিতর্ক উপেক্ষা করে শুধুমাত্র গনগনি গিরিখাত ই আমাদের প্রধান আকর্ষণ । এই রকম গিরিখাত অন্য কোথাও দেখতে পাওয়ার সুযোগ খুব কমই আছে। কম খরচে সচরাচর এমন জায়গা পাওয়া মুশকিল। ভৌগোলিক উপাদানে গঠিত এমন জায়গা প্রকৃতিপ্রেমিক যারা তারা ভালো বাসবেন। উদাস দুপুরে নদীর কুলু কুলু ধ্বনি শুনতে শুনতে মন চলে যাবে নিজেকে ছাড়িয়ে এক অজানা জগতে, এক অপার্থিব আশ্রয়ে। তবে গনগনি মূলত পিকনিক স্পট । শীতকালে ছুটির দিন কিম্বা স্পেশাল দিনগুলো মাইক সহযোগে পিকনিকের তান্ডবে গনগনিতে প্রকৃতিকে কতখানি একাকীত্ব করতে পারবেন সন্দেহ । তাই শীতকালে ছুটির দিন, পিকনিক দিন এড়িয়ে গনগনিতে আসুন । নির্জন, নিরিবিলিতে । আর অবশ্যই শিলাবতী নদীর ধারে আসুন একটু বসুন । ভালো লাগতে বাধ্য।
কলকাতা থেকে দিনের দিন গিয়ে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যাবেলা ট্রেন ধরে ফিরে আসা ট্রিপের মধ্যে গড়বেতা গনগনি অন্যতম । সকালে রূপসী বাংলা, রাজ্যরানী, বা লালমাটি এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা স্টেশনে নামুন । একটা টোটো রিজার্ভ করে সারাদিন গনগনি ঘুরে আবার বিকেলে এই ট্রেনগুলো (হাওড়াগামী) ধরে ফিরে আসা যায় । থাকার দরকার পড়ে না ।
তবে থাকতে চাইলে গড়বেতার শ্যাম ভবনে ধর্মশালা আছে । গড়বেতায় কিছু বেসিক হোটেল ও আছে । দুপুরের খাওয়া দাওয়া গড়বেতা কলেজের বিপরীতে হোটেল (রেস্টুরেন্ট) থেকে করুন । খাওয়ার মান খুবই ভালো । সারাদিনের টোটো ভাড়া ৩০০ টাকা মতো ।
ইটাচুনা রাজবাড়ী। গত কয়েকবছর ধরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি ভ্রমণকেন্দ্র। অবশ্যই একটু অন্য রকমের ভ্রমণ - কলকাতা থেকে প্রায় ৬৬ কিলোমিটার দূরে খন্যান স্টেশন থেকে টোটো করে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া আড়াইশো বছরের প্রাচীন বিশাল এক প্রাসাদে অনেকটা জমিদারী স্টাইলে থাকা। ইতিহাস বলছে, এই জমিদারবাড়ীর ( প্রচলিত ভাবে এটিকে রাজবাড়ী বলা হলেও আসলে এটি একটি বিশাল জমিদারবাড়ী ) পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন মারাঠা থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা আক্রমণকারী বা বর্গী হিসেবে। সেই সময়ে এঁদের পদবী ছিলো কুন্দন। কিন্তু পরে মারাঠা বর্গীর এই অংশটি যুদ্ধ ছেড়ে বাংলাকেই তাদের স্থায়ী নিবাস হিসেবে বেছে নেন, নিজেদের একাত্ম করে তোলেন এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি আর আচারের সঙ্গে, নিজেদের কুন্দন পদবীকে পরিবর্তিত করে নেন বাঙালীদের মধ্যে প্রচলিত কুন্ডু-তে। এখানে তাঁদের জমিদারী স্থাপিত হয়, আর সেই জমিদারীর সূত্রেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এখানকার এই বিশাল বাড়ী, ১৭৬৬ সালে সাফল্য নারায়ণ কুন্ডুর সময়ে যা অসাধারণ এক বহু মহলা প্রাসাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে, সেই বিশাল প্রাসাদটির একটি অংশ হোম স্টে হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে অতিথিরা অনেকটা সেই পুরোনো দিনের রাজকীয় স্টাইলেই থাকার সুযোগ পান। অনেকগুলি ঘর আছে এখানে, যেগুলি অভিনব ভাবে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে নামকরণ করা হয়েছে - ঠাকুমা, গিন্নি মা, বড়ো মা, মেজ মা, বড় পিসি, ছোট পিসি, বড় বৌদি, ছোট বৌদি - ইত্যাদি। আধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি বহু ঘরে আছে পুরোনো দিনের অ্যান্টিক আসবাব, যাতে ফেলে আসা দিনের রাজকীয় ভাবে থাকার আমেজটি বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করা যায়। এগুলি ছাড়াও গ্রামের মধ্যে অবস্থিত বলে, গ্রামের মাটির বাড়ীর স্বাদ দেওয়ার জন্যে রাজবাড়ীর বাগানে, কয়েকটি মাটির বাড়ীও আছে ইচ্ছুক অতিথিদের জন্যে। আগামী দু তিনটি পর্বে, আমরা ঘুরে দেখবো সেই রাজবাড়ীর বিভিন্ন মহল - যতটা সম্ভব।
এই প্রাসাদটি প্রায় কুড়ি বিঘা এলাকা নিয়ে অবস্থিত। তার মধ্যেই আছে, বাহির মহল বা কাছারি মহল, অন্দরমহল, ঠাকুরদালান, বাগান, খিড়কিমহল, ইত্যাদি।একদিকে যেমন বিশাল প্রাসাদের রাজকীয় আভিজাত্য, তেমনই বাইরে সুন্দর করে সাজানো বাগান, গ্রামের গন্ধ মাখা নানা ধরনের গাছ গাছালি, পুকুর, পোষা হাঁস, মুরগি, পায়রা, খরগোশের অবাধ বিচরণ। আবার অপূর্ব সুন্দর ঠাকুরদালানে আড়াইশো বছর ধরে চলে আসা শ্রীধর জীউয়ের পুজো। পুরনো দিনের সমস্ত সৌন্দর্য আর আভিজাত্যকে বাঁচিয়ে রেখে এযুগের মানুষের কাছে মেলে ধরার এক অসাধারণ প্রয়াস। বিস্মিত, বিহ্বল মনের ভরে যাওয়ার উপকরণ সর্বত্র । বাড়ীটি ও তার চারপাশ ঘুরে দেখতে,অনুভব করতে সময় লাগে, ঝড়ের বেগে তা হয় না। কারণ সময় এখানে থেমে আছে আড়াইশো বছর ধরে, পুরনো দিনের সেই জৌলুসকে, সেই সময়ের গন্ধকে অনুভব করতে আমাদেরও কিছুটা সময় দিতে হয় বৈ কি। আর সেইজন্যেই, একদিনের ভ্রমণে, যতটুকু দেখতে পেরেছি, সেটাই এখানে ধরে রাখতে চেয়েছি ক্যামেরার চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে, হাতে একটু সময় নিয়ে - একাধিক পর্বের মাধ্যমে। আজ প্রথম পর্বে আমরা দেখবো বাড়ীর মূল অংশ, পরেরদিন দেখা যাবে ঠাকুরদালান এবং বাগানের বিভিন্ন এলাকা, শেষ পর্বে দেখবো বাড়ীর বাইরের কিছু মন্দির আর এখানকার খাওয়াদাওয়া। গেট দিয়ে বাড়ীর চত্বরে ঢুকলেই সামনেই সেই বিরাট বাড়ি, ইংরেজি “u” অক্ষরের আদলে। সামনে ফুলের নকশা কাটা সুসজ্জিত একটি সাদা তোরণ, আর তার দুপাশে লাল রঙের বাহির মহল। তিনদিকেই একতলা আর দোতলায় টানা বারান্দা। ডানদিকের মহলে একতলায় বারান্দা দিয়ে ঢুকে একটি বিরাট হল ঘর, তার মধ্যে দুটি বিশাল বিছানা, পুরোনো দিনের ইজি চেয়ার, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল, সোফা, অনেকগুলি চেয়ার । মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়বাতি, আর পেছন দিকে সিলিং থেকে টাঙানো পুরোনো দিনের দুটি টানা পাখা। সঙ্গে ছেলেদের ও মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা টয়লেট। জানা গেল, অতীত কালে এটিই ছিল এদের মূল কাছারি অফিস, বর্তমানে কোনো বড় গ্রূপ সারাদিনের জন্য গেলে এটি তাদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পাশেই একটি ঘরে খাবার ব্যবস্থা, আর অন্যদিকে আরেকটি ঘরে কিছু হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা। খাবার ঘরের কথা বলেছি, খাওয়ার কথাও বলবো, কিন্তু তার আগে দেখে আসি বাড়ীর ওপরের অংশ।
আগেই বলেছি, বাড়ীর দোতলাতেও টানা বারান্দা, আর সেই বারান্দার পাশেই বিভিন্ন ঘর, রাতের অতিথিদের থাকার জন্যে। এখানে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাদের ওই বাড়ীর পক্ষ থেকেই সমস্ত বাড়ীটি ঘুরিয়ে দেখানো হয়, তাই সেই প্রদর্শকের সঙ্গেই চলতে হয়, নয়তো প্রথম প্রথম বাড়ীটি কিন্তু একেবারেই একটি গোলকধাঁধার মত লাগে, এত বড় বাড়ীতে প্রদর্শক ছাড়া সবটা নিজে নিজে ঘুরে দেখা সত্যিই বেশ কঠিন। তা ছাড়া, যাঁরা সারাদিনের জন্য যান, তাঁদের সব জায়গায় প্রবেশাধিকার থাকেনা, প্রদর্শক যতটুকু দেখান, সেটুকু দেখেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সেই তুলনায় কিন্তু যাঁরা রাত্রিবাস করেন, তাঁদের ঘুরে দেখার সুযোগ একটু বেশী।
দোতলার বারান্দা গুলিও খুব সুচারুভাবে সাজানো - পুরোনো দিনের আসবাব, দেওয়ালে পুরোনো দিনের ছবি, কোথাও বা দেওয়ালে টাঙানো কার্পেট। তবে বিশেষ আকর্ষণ হলো, একতলার মতোই দোতলার আর একটি বিরাট ঘর, পুরোনো দিনের আসবাবে ভরা। আছে পুরোনো সোফা, পাথরের সেন্টার টেবিল, রাজপুরুষকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার তাঞ্জাম, আগেকার দিনের টেলিফোন, হুঁকো স্ট্যান্ড ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আছে এই বংশের বংশতালিকা। এখানেও আছে মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়বাতি, পায়ের তলায় পার্সিয়ান কার্পেট।। তবে এই ঘরটির তফাৎ হলো, যে এটি নীচের ঘরের মতো কারোকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না, দর্শকদের ঘুরিয়ে দেখিয়ে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবার ছাত। তিনতলার ওপরে বাড়ীর বিশাল ছাত। সেই ছাতে উঠলে একদিকে যেমন বাড়ীর বার মহল আর ঠাকুরদালানকে ওপর থেকে দেখা যায়, তেমনি অন্য দিকে দেখা যায় - অন্দরমহলের একটি অংশ। ওপর থেকে দেখা সেই অংশটিকেও ভারী চমৎকার লাগে। তবে, যাঁরা day tourist বা শুধু দিনের বেলাতেই এখানে ভ্রমণের জন্য যান, তাঁদের কিন্তু এই অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার নেই। আর তাই ওপর থেকেই দেখে নিতে হয় রাজবাড়ীর এই অংশের সৌন্দর্যটুকু। দিনের বেলায় রাজবাড়ীর যা রূপ, সন্ধ্যেবেলায় তা কিন্তু অনেকটাই আলাদা । সমস্ত বারান্দা জুড়ে যখন আলো জ্বলে ওঠে, ঠাকুরদালান ঝলমলিয়ে ওঠে ঝাড়বাতি আর পুরনো দিনের লোহার কারুকাজ করা স্ট্যান্ডের আলোয়, তখন এই রাজবাড়ী হয়ে ওঠে আরও মোহময়, আরও মায়াবী - আড়াইশো বছরের বুক থেকে উঠে আসা এক ইতিহাসের মতো - রহস্যময়, কিন্তু যার আকর্ষণ অমোঘ । মোটামুটি এই হলো ইটাচুনা রাজবাড়ীর বারমহলের কথা। পরেরদিন আমরা দেখবো এঁদের বাগান, আর ঠাকুরদালান।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর মূল অংশ নিয়ে আগের দিন বলেছি। আজ বলবো, এখানকার ঠাকুরদালান আর বাড়ী সংলগ্ন বাগানের কথা।
ঠাকুরদালান - ইটাচুনা রাজবাড়ীর একটি অত্যন্ত সুন্দর অঙ্গ হচ্ছে এখানকার ঠাকুরদালানটি। বাইরের গেট দিয়ে মূল বাড়ীর চত্বরে প্রবেশ করার সময়েই দেখা যায়, তিনপাশের লাল বারান্দার মাঝখানে সাদা থাম আর তার সঙ্গে সাদা রঙের পঙ্খের সুন্দর কাজ করা তোরণ - সেটিই ঠাকুরদালানে যাওয়ার পথ। তোরণের একেবারে ওপরে ছাতের কাছে লেখা - “ শ্রী শ্রী শ্রীধর জিউ কৃপাহি কেবলম, তার একটু নীচে দোতলার বারান্দার ওপরে লেখা - “ ১৭৬৬ সালে সাফল্য রাম কুন্ডু মহাশয় কর্তৃক স্থাপিত “, তার আরো নীচে একতলার প্রবেশপথের ওপর - “ ১৮৯৪ সালে শ্রী নারায়ণ কুন্ডু মহাশয় কর্তৃক পুনস্থাপিত “ এবং তার নীচেই সুপরিচিত পিতৃমন্ত্র। লালের সঙ্গে সাদার মেলবন্ধনে এই দারুণ সুন্দর তোরণটি প্রথম থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর এই তোরণ দিয়েই প্রবেশ করা যায়, এখানকার এই ঠাকুরদালানে। তোরণে যা লেখা আছে, তাতেই বোঝা যায় এই মন্দির শ্রীধরজিউ-এর নামে উৎসর্গীকৃত। এই বংশের আদি মারাঠী পুরুষেরা শৈব হলেও, বাংলায় এসে তারা কিন্তু স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী বৈষ্ণবমতকেই প্রাধান্য দেন - যার ফলশ্রুতি এই ২৫২ বছরের পুরোনো মন্দির। অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিন খিলানের এই মন্দির, আর এখানেও লাল সাদার সুন্দর মিশ্রণ। বাইরের মূল দেওয়াল লাল রঙের, তার ওপরে সাদা রঙের দেবদেবীর মূর্তি। থাম আর থামের ওপরের কাজও সাদা রঙেরই। মন্দিরের তিনদিক ঘিরে লাল রঙের বাড়ী ও বারান্দা। ওপরের বারান্দায় চিক ঝোলানোর জায়গা, যে চিকের আড়াল থেকে বাড়ীর মহিলারা দেখতেন ঠাকুরদালানের বিভিন্ন উৎসব, বা এখানে সেই সময়ে হওয়া যাত্রা বা কবিগান। সামনের পুরো প্রাঙ্গণটি জুড়ে সুন্দর লোহার কাজ করা বাতিস্ট্যান্ড। জানা গেল, এই পরিবারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ওঠাপড়া হলেও, আড়াইশো বছর ধরে চলে আসা এই শ্রীধরদেবের পূজো কখনোই বন্ধ হয়নি। আজও ত্রিসন্ধ্যায় পূজো হয় এখানে, বিশেষ করে সূর্য ডোবার পর, আলোকমালায় সজ্জিত এই ঠাকুরদালানে সন্ধ্যার আরতি সত্যিই দেখার মতো। পুরোনো দিনের মতো আজও এখানে মহাসমারোহে পালিত হয় জন্মাষ্টমী আর দোলযাত্রা। বসন্তকালে সেই দোল উৎসবে শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরে তখন যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় - অতীতের বসন্ত এখনকার বসন্তের সঙ্গে তার রঙীন হাত মেলায়।।
বাগান - ঠাকুরদালান থেকে পাশেই একটি রাস্তা দিয়ে গিয়ে পড়া যায়, এখানকার বাগানে। বাড়ীর ভেতরে যেখানে রাজকীয় বৈভব, এখানে এই বাগানে, কিন্তু তখন শুধুই প্রকৃতির সঙ্গে মাখামাখি। প্রথমেই একটি ছাউনি, যেটাকে এঁরা বলেন “ চা-ঘর”। আগে যা ছিল এঁদের গোশালা, সেটিকেই এখন পরিবর্তিত করা হয়েছে, চারদিক খোলা এই চা ঘরে। সন্ধ্যের পর এখানে, এই বাগানে, অতিথিদের আড্ডা বসে। একপাশে আছে, জমিদারী আমলের বিরাট দাবার বোর্ড, যা আগে ছিল পাথরে বাঁধানো । এর ঘুঁটিগুলি সব কাঠের। বাগানে একটু ঘুরলেই চোখে পড়বে, আমলকি, হরীতকী, কর্পূর, ডালচিনি প্রভৃতি গাছের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক নাম না জানা ফলের আর ফুলের গাছ। চলার সময় নিজের মনেই সঙ্গ দেবে এদের পোষা হাঁস, মুরগী, পায়রা, খরগোশের দল। একটু দূরেই এক বিরাট পুকুর, সেই পুকুরে আগে খেলা করত বিশাল সব মাছেরা, পুকুরের ঘাটে এসে বসতেন অন্তঃপুরবাসিনী মহিলারা। এই বাগানের মধ্যেই ওই পুকুরের পাশে আছে চারটি মাটির বাড়ী, যার সঙ্গে ভেতরের রাজবাড়ীর জৌলুসের কোনো মিল নেই, বরং তাদের মধ্যে আছে গ্রামবাংলার নিজস্ব শৈলীর ছোঁয়া। আর এদের নামও বাংলার বিভিন্ন ফুলের নামে, ভেতর বাড়ীর মতো কোন মানুষের নামে নয়। । বাগানের আর এক কোণে খাঁচায় আছে বন মুরগী ও টার্কি, আবার তাদের সঙ্গেই আছে এখানকার এক প্রিয় কুকুর “গুণ্ডা”র কবর। এখানে, এই কটেজ গুলিতে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা রাজবাড়ীতে এসেও রাজকীয় বিলাসের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে খুঁজে পাবেন গ্রাম বাংলার একান্ত নিভৃত পরিবেশকে। বাড়ীর ভেতরে আর বাগানে - দু ধরণের থাকার জায়গার দুরকমের বৈশিষ্ট্য, একটির সঙ্গে আরেকটির হয়তো মিল নেই, কিন্তু এই দু ধরণের থাকার ব্যবস্থা নিয়েই এই ইটাচুনা রাজবাড়ী, এটাই এখানকার বিশেষত্ব ।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর ভেতরের ব্যবস্থা আমরা মোটামুটি দেখে নিয়েছি, ঘুরে দেখেছি প্রায় পুরো বাড়ীটিই - এর আগের দুটি পর্ব জুড়ে। এখন এই শেষ পর্বে আমরা দেখবো এঁদেরই একটি প্রায় পরিত্যক্ত শিব মন্দির, আর সেই সঙ্গে জেনে নেব এখানকার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা।
শিবমন্দির - ইটাচুনা রাজবাড়ীর চৌহদ্দির বাইরে, মেন গেট-এর ঠিক বিপরীতে, রাস্তার ওপরেই আছে এঁদেরই একটি শিবমন্দির - যা আজ প্রায় পরিত্যক্ত। সেই মন্দিরে আছে একটি অদ্ভূত দর্শনের শিবমূর্তি - জটাজুটধারী মনুষ্য আকৃতির সেই শিব বসে আছেন এক পা মুড়ে একটু বিচিত্র ভঙ্গীতে, মাথার জটা পৈতের মতো বুকের ওপর নেমে এসেছে, হাতে কবচকুণ্ডল, কাঁধের ওপরে ফণা তোলা সাপ। সব মিলিয়ে মূর্তিটি বেশ বিচিত্র আর বিরল। রাজবাড়ীর গাইডের মুখে জানা গেল, বহু বছর আগে এই বংশের কেউ একজন স্বপ্নাদেশে এই মূর্তির সন্ধান পেয়েছিলেন বিহারের গিরিডির এক জঙ্গলে। কিন্তু এখানে নিয়ে এসে এই মন্দিরে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার দিনেই সেই প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু ঘটে। তাই তখন থেকেই এই মূর্তির কোনো পূজা আর হয় না, এবং মন্দিরটিও পরিত্যক্ত হয়। এর আগে “ প্রায় পরিত্যক্ত” কথাটি ব্যবহার করেছি। তার কারণ, ওই মূর্তি আর ওই মন্দিরে পূজা বন্ধ হবার বহু পরে স্থানীয় মানুষেরা এই মন্দিরের সামনের বারান্দায় একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করে তাঁর পূজা শুরু করেন। এটিও কিছুটা অভিনব ব্যাপার, কারণ সব মন্দিরেই দেবতা থাকেন মন্দিরের গর্ভগৃহে, কিন্তু এখানে সেই পূজো হচ্ছে গর্ভগৃহের বাইরে, বারান্দার চলনপথে। অথচ, মন্দিরের ভেতরে, জঙ্গল থেকে পাওয়া এখানকার আদি মূর্তিটি বসে আছেন একাকী, ভাঙাচোরা অন্ধকার ঘরে, কোনোরকমের পূজা থেকে বরাবরের জন্য বঞ্চিত হয়ে।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর খাওয়াদাওয়া - সবশেষে বলি, এখানকার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ হয়ে রাত্তিরের নৈশভোজ বা ডিনার, এখানে সব খাবারই পরিবেশিত হয়, পুরোনো দিনের বাঙালী ঘরানায়, কাঁসার থালা, বাটী, গ্লাস ব্যবহার করে। সকালে লুচি, আলুরদম, দুপুর আর রাত্তিরে কাঁসার থালার মাঝখানে সরু চালের ভাত, তারপর সেই ভাতকে ঘিরে বিভিন্ন কাঁসার বাটিতে বিভিন্ন তরকারী, সঙ্গে ডাল, মাছ, মাংস। শেষ পাতে চাটনী, দই বা মিষ্টি। সব মিলিয়ে বেশ এলাহী ব্যাপার। খাবার বেশ সুস্বাদু, কিন্তু তার স্বাদ অনেক বেড়ে যায় ওই পরিবেশ আর পরিবেশনের জন্যে। আড়াইশো বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়ীতে, আগেকার দিনের মতো কাঁসার থালা বাটিতে খাওয়া, সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতার সামগ্রিক স্বাদ কিন্তু একেবারেই আলাদা।
মোটামুটি এই হল এই রাজবাড়ী ভ্রমণের গল্প। সব কিছু ভাল ভাবে ঘুরে দেখতে আর জানতে একটু সময় লাগে, আর তাই তিন পর্বে আলাদা আলাদা করে ঘুরে দেখালাম এই বাড়ীটি, আর সামনের শিবমন্দির। এ ছাড়া, বাড়ীর বাইরে ঠিক পাশেই - প্রবুদ্ধ ভারত সঙ্ঘ নামে রামকৃষ্ণদেবের একটি সাধারণ মন্দির আছে, আর তার বিপরীত দিকে মাঠের মধ্যে আছে একটি ফাঁকা দুর্গা দালান, যেখানে দুর্গা পুজোর সময় মূর্তি গড়িয়ে সর্বজনীন পুজোর আয়োজন করা হয়। আগ্রহী ব্যক্তিরা এক ফাঁকে ঘুরে নিতে পারেন এই রামকৃষ্ণ মন্দিরটিকেও ।
কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাটোয়ার বিখ্যাত ৫১ সতীপীঠের এক অন্যতম পীঠস্থান যোগাদ্যা দেবী মায়ের মন্দির থেকে। জনশ্রুতি এখানে দেবিমায়ের ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পড়েছিল।
এখানে সতী মাতা যোগাদ্যা রূপে পূজিতা হন। কিন্তু প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তি কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে বর্ধমান রাজ কীর্তিচন্দ্র এই ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা মায়ের নব মূর্তি স্বপ্নাদেশ পেয়ে নির্মাণ করেন, তার সাথে এই ক্ষীরগ্রামে দেবীর মন্দির ও নির্মাণ করে দেন। এখানে দেবী যোগাদ্যা দশভূজা মহিষমর্দিনী রূপে পূজিতা হন। এই মূর্তি সারা বছর পার্শ্ববর্তী ক্ষীরদীঘির জলে ডুবে থাকে, কেবলমাত্র বছরে ৪ দিন জল থেকে তুলে মন্দিরে এনে পুজো করা হয়। কিন্তু প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি পরবর্তী সময়ে দীঘি সংস্কার এর সময় ফের খুঁজে পাওয়ার ফলে দুটি মূর্তি সমান ভাবে পূজিত হয়, এবং সে কারণে বর্তমানে নব নির্মিত মন্দিরও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু মূর্তি জনসমক্ষে আনা হয় কেবলমাত্র পূর্বে উল্লিখিত ৪ দিন, এই দিনগুলি হলো ৩১ বৈশাখ, ৪ জৈষ্ঠ্য, ১৫ পৌষ, ও আষাঢ়ী নবমী, তবে সাধারণ ভক্ত বৃন্দের মাকে দেখার সৌভাগ্য মেলে কেবলমাত্র ৩১ বৈশাখ বা ১৫ মে। আমরা মাকে তাই দর্শন করতে পারিনি, তবে মূল মন্দির ও স্থান মাহাত্ব দর্শন করতে পেরেছি, তাই বা কম প্রাপ্তি কোথায়?
কীভাবে যাবেন :-
কাটোয়া-বর্ধমান রেলপথে কাটোয়া থেকে ১৭ কিমি, বর্ধমান থেকে ৩৬ কিমি দূরে কৈচোর স্টেশন। স্টেশন থেকে বাস , রিক্সা বা টোটো তে ৪ কিমি যেতে ক্ষীরগ্রাম এর পশ্চিমে দেবী যোগাদ্যা উমার মূল মন্দির ও সেখান থেকে মিনিট ১০ হাঁটা পথে দেবীর নব নির্মিত মন্দির দেখে নিতে পারেন। তার পাশেই অবস্থিত ক্ষীরদীঘির বুকে জলমন্দির, যেখানে বছর এর বাকি সময় দেবী মায়ের অধিষ্ঠান। সকালে বেরিয়ে সারাদিন ঘোরার পক্ষে এক আদর্শ ভ্রমণ হয়ে উঠতে পারে কাটোয়ার অন্তর্গত মা_যোগাদ্যা_দেবীর_মন্দির। মন চাইলে জয় মা বলে বেড়িয়ে পড়ুন, আশা করি ভালই লাগবে। সকলের সুবিদার্থে আমার তোলা কিছু ছবি গ্রুপে শেয়ার করলাম।আশা করি আপনাদের মন্দির সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবে। এছাড়া ভোগ পেতে চাইলে ১২ টার মধ্যে মন্দির গেলে ভোগ গ্রহণ করতে পারেন। নিরামিষ ভোগ, কিন্তু অসাধারণ তার স্বাদ। কুপন মূল্য ₹৫০। জয় মা বলে একবার ঘুরেই আসুন না।।।
পাহাড়ে ঘোরার জায়গা গুলোর ২ রকমের রূপ । শীতে বরফ আর শরৎ এ নীল আকাশ এর সাথে রং এর খেলা । সেই রূপ এর টানেই আবার ও আমার ছুটে চলা সিকিম । ৬ মাস আগে দূর্গা পুজোর সময়ে একবার ঘুরে এসেছি সিল্ক রুট এ । দোল এর chute তে আবার ও প্ল্যান । কয়েকটা সঙ্গী পেয়ে গেলাম যে । দোটানা ছিল পয়সা নষ্ট করে এক জায়গা দুবার যাওয়ার মানে আছে কিনা কিন্তু যা দেখে এলাম তা সত্যি ই ভাবতে পারিনি ।
ট্রেন এ টিকেট পাইনি তাই অগত্যা বাস এর টিকেট । NBSTC এর বাস এর টিকেট কাটলাম কিন্তু যা শিক্ষা হলো আর কোনওদিন নাম ও মুখে আনব না । টিকেট ক্যানসেল এর টাকা আজ ও ফেরত পেলাম না ১৮ দিন পরেও । যাক প্রথম দিন শিলিগুড়ি থেকে চলে এলাম আরিতার । দুপুরে খাওয়া শেষ হতেই বেরিয়ে পড়লাম মানখিম ভিউ পয়েন্ট এর উদ্দেশে । বিকেল টা ওখানে সময় কাটিয়ে আরিতার মনাস্ট্রি দেখে সেদিন এর মতো ঘোরা শেষ ।
পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে আরিতার লেক ঘুরে রঙলি এলাম । এখানে পার্মিট পাওয়া গেলো জুলুক এর ওপর অবধি । প্রবল তুষারপাত এর জন্য কুপুপ অবধি যাওয়া যাবে না । খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই । কুইখোলা ফলস হয়ে এসে পৌছালাম ফাদমচেন এ ।
তৃতীয় দিন টা ভীষণ ই উত্তেজনা র । বরফ দেখবো বলে কথা । জুলুক হয়ে রাস্তা শুরু হতেই দুপাশে বরফ শুরু । জিগজ্যাগ ভিউ পয়েন্ট এ এ কিছুক্ষন ছবি তুলে আবার ওপরের দিকে এগোলাম । কিন্তু একটু গিয়েই গাড়ি আর রাজি নয় যেতে । কোনো গাড়ি যাচ্ছে না । যদিও বরফ ও অনেক এখানে । কিছুক্ষন পর কয়েকটা গাড়ি একসাথে থামবি এর দিকে ওঠা শুরু করলো । আমরাও পিছু নিলাম । থামবি পৌঁছে প্রচুর বরফ পেলাম আর দেখলাম বেলচা দিয়ে রাস্তা থেকে বরফ তোলার কাজ চলছে । কাজেই গাড়ি আর কিছু তাই যাবে না । সাহস করে এবার হাঁটা শুরু করলাম । প্রায় ২ কিলোমিটার মতো রাস্তা নিজেরা এলাম আর সাথে কেউ ই ছিল না । শুধু ৬ জন এ আর যাওয়া টা ঠিক হবে না ভেবে আবার থামবি ফিরে এলাম । যা বরফ দেখলাম এই টুকু সময়ে সারাজীবন মনে থাকবে । ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম এই রাস্তা তাই ৬ মাস আগে কুপুপ অবধি ঘুরে এসেছি পুরো পরিষ্কার আর আজকে পুরো বরফ ঢাকা । থামবি তে গরম কফি খেয়ে ফিরে এলাম ফদমচেন । আর কি বেড়ানো শেষ । বাড়ি ফেরার পালা । আবার সেই বাস এর পুশব্যাক সিট্ এ গা এলিয়ে কলকাতা ফেরত ।
।।ছোট্ট ছুটির ফাঁকে।।
বসন্তের আগমনে বাতাস যখন হাওয়া বদলানো শুরু করলো ঠিক তখনই আমার চঞ্চল হৃদয় বড়ই ব্যাকুল হয়ে উঠলো নিজেকে হাওয়া বদলানোর তাড়নায়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ভেবে পাচ্ছিলাম না কোথায় যাওয়া যায়। সামনে দোল উৎসবের উদ্দীপনায় ভ্রমণ পীপাষু বাঙালি পর্যটকের দল মাস দুয়েক আগে থেকেই সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র গুলো দখল নিয়ে বসে আছে। না পাচ্ছি হোটেল না পাচ্ছি ট্রেনের টিকিট। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ পেলাম শিলিগুড়ি থেকে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। ভাবলাম এ সুযোগ ছাড়া যাবে না একদিকে রথও দেখা হবে অন্য দিকে কলা ও বেচা যাবে। তাই আপাতকালীন টিকিট কেটে ১১মার্চ কাজিরাঙা এক্সপ্রেস ধরে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যথা সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বিবাহ অনুষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল আলিপুরদুয়া্র ও শিলিগুড়ি এই দুই শহরকে কেন্দ্র করে। তাই তিন দিন ওখানে নানা অনুষ্ঠান ও যাতায়াতের মধ্যে দিয়ে সময় কেটে গেল। চার দিন পর অর্থাৎ ১৬ই মার্চ বেড়িয়ে পড়ি জঙ্গল সাফারি করতে। শিলিগুড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে শালুগাড়ার অন্তর্গত সেবকের পাদদেশে নতুন করে গড়ে ওঠা বেঙ্গল সাফারি পার্কের উদ্দেশ্যে। পার্কটি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাধারণ প্রবেশমূল্য ৩০টাকা, গাড়ি সাফারির মূল্য ২০০টাকা এবং হাতি সাফারির মূল্য ৩০০টাকা। পার্কটিতে হরিণ,বানর, কচ্ছপ, বনমুরগি, ময়ূর, ভাল্লুক, লেপার্ড, কুমীর এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়।
এই জায়গায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল সেবক কালিবাড়ি। এটিও নতুন করে সেজে উঠেছে কয়েক বছর পূর্বে। আঞ্চলিক ভাবে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া এখানে বাঘপুল (Corrination Bridge) একটি দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে পরিচিত আছে। এই জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বেশ উপভোগ্য। প্রতিদিন শত শত সিকিম ও কালিম্পং গামী পর্যটকের দল এর পাশদিয়ে চলে যায় কিন্তু এগুলো দেখেন না, কেন জানি না। হয়তো খানিকটা উদাসীনতা, নয়তো বা অজানার অভাব এদের এগুলোকে বঞ্চিত করে। আমি অনুরোধ জানাচ্ছি ঘন্টা তিনেক সময় নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে অথবা যাতায়াতের পথে এগুলি দেখে নিতে। আশা করি হতাশ হবেন না।
১৭ই মার্চ শিলিগুড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি কুচবিহারের উদ্দেশ্যে। ১৬০কিমি. প্রায় ঘন্টা তিনেকের জার্নি। ট্রেন বা বাস দুভাবেই এখানে আসা যায়।আমি অবশ্য বাসেই গেছিলাম। এখানে পৌঁছে প্রথমেই চলে আসি কুচবিহার রাজপ্রাসাদে। এরপর ২৫টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি রাজপ্রাসাদের ভেতরে। প্রাসাদটি বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে অবস্থিত। সামনে বিশাল বড় উদ্যান তার মধ্যে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা রং বেরঙের ফুল ও গাছের সমারোহ। সমস্ত ফাঁকা জায়গা গুলো ঘন সবুজ ঘাসে ভরা তারই মধ্যে বিরাজ করছে জলে ভরা কয়েকটি পরিখা এবং দুই দিক দিয়ে যাতায়াতের জন্য বাঁধানো রাজপথ। ওপর প্রান্তে বিরাজ করছে সুন্দর কারুকার্যে ভরা সুদৃশ্য রাজপ্রাসাদটি। যাহা সকলকে একবাক্যে বিশ্বয় এনে দেয়।
প্রাসাদটির নির্মানশৈলী ইটালিয়ান স্থাপত্যের অনুকরণে গঠিত। ভিতরে সাজানো রয়েছে রাজব্্শের পূর্বপুরুষের ছবি এবং ব্্শানুক্রমিক পরিচিতির বিবরণ। এছাড়া তৎকালীন সময়ে ব্যবহিত মূদ্রা, অস্ত্র, পোশাক ও পরিধেয় অল্্কার সামগ্রী মিউজিয়ামের মাধ্যমে সং ক্ষণ করে রাখা আছে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পরেও এই রাজাদের রাজত্ব বর্তমান ছিল। কুচবিহারের সেই সময়ে নাম ছিল কামতাপুররাজ্য এবং এর বিস্তৃতি ছিল অধুনা আসাম পর্যন্ত। পরে ভারত সরকার এটি অধিকার করে কামতাপুররাজ্যকে কুচবিহার ও আসামে বিভক্ত করে। এ ভাবেই সমাপ্ত হয়ে যায় কামতাপুরী রাজবাড়ীর ইতিহাস।
কুচবিহারের আরো একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল মদনমোহন মন্দির। এটি কুচবিহার রাজপ্রাসাদ থেকে ১কিমি. দূরত্বে অবস্থিত। জনমুখে শোনা যায় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জাগ্রত মন্দির। বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু লোক এখানে আসেন তাদের মনষ্ককামনা পূর্ণ করতে। রাসের সময় এখানে মেলা বসে এবং বহু লোকের সমাগম হয়। এভাবেই ১৭তারিখের সফর সূচী সমাপ্ত করে রাতে ফিরে আসি শিলিগুড়িতে। ১৮ই মার্চে রাতে ট্রেন ধরে ১৯ মার্চ সকালে কলকাতা ফিরে আবার নতুন উদ্দীপনায় পূর্ব কর্ম জীবনে ফিরে যাই। *** সমাপ্ত ***
চাঁদনী চকের পরাঠেওয়ালী গলি।
দিল্লীর চাঁদনী চকের কথা হলেই প্রথমেই মনে আসে লালকেল্লা, মসজিদ,মন্দির ইত্যাদি ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যগুলোর কথা। কিন্তু আজ আমি এগুলির কথা নয়, বলব এক গলির কথা, যার নাম 'পরাঠেওয়ালী গলি'। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে বিষয়টা খাবার সম্পর্কিত। আমার কাছে ভ্রমণ এবং খাদ্য কিন্তু একে অপরের সাথে জড়িত। নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সাথে স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করাও আমার কাছে সমান আকর্ষনীয়। সেই কারণে এবারে বেড়িয়ে পড়েছিলাম দিল্লীর চাঁদনী চকের উদ্দেশ্যে।
চাঁদনী চকের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। চাঁদনী চককে দেখে আমাদের বড় বাজারের কথা মনে হয়। হৈ হুল্লোড়, লোকজন, মুটে,রিক্সা রাস্তার দুধারে দোকানের সারি! বেশ খানিকটা যাবার পর একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়লাম। গুগল ম্যাপ সেই গলিতেই ঢুকতে বলছিল। কিন্তু বেশ কিছুদূর চলার পরও কোনও পরোটার দোকান দেখতে পেলাম না, দুদিকে কেবল জামা কাপড়ের দোকান। অবশেষে বাঁ হাতে ঘুরতেই দেখতে পেলাম সেই বিখ্যাত পরাঠেওয়ালী গলির! পরপর বেশ কিছু পরোটা, লস্যি,মিষ্টির দোকান। আমরা গেলাম 'পন্ডিত গয়া প্রসাদ শিব চরণ পরাঠেওয়ালার দোকানে। জানতে পারলাম প্রায় ছয় জেনারেশন ধরে শর্মারা এই দোকান চালাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭২ এ। আমরা টেবিলে বসতেই খোপওয়ালা থালাতে আলু মটরের তরকারী,পুদিনা চাটনী, কুমড়োর একটা মিষ্টি তরকারী, তেঁতুলের চাটনী যার মধ্যে ছোট দুটো কলার টুকরো পরিবেশিত হল। টেবিলের একপাশে সবজীর আচার রাখা ছিল বড় বাটীতে। এরপর আমাদের অর্ডার অনুযায়ী চারটে পরোটা এল - পনীর, কাজু,ফুলকপি, মিক্সড ভেজ পরোটা। পরোটাগুলো বেশী বড় নয়, বাইরেটা মুচমুচে, ভেতরটা নরম। আমার সব থেকে ভালো লাগল কাজু পরোটা। খাদ্য তালিকাতে দেখলাম বহুরকমের পরোটা আছে - আলু, কপি, মূলো,ডাল এইসব পরিচিত পরোটা যেমন আছে, তেমন আছে করোলা,ভেন্ডি,কলা,খোয়া,টমেটো,পাপড় ইত্যাদি পরোটা। দাম কিছুর ৬০ এবং কিছুর ৭০। দেখলাম খোপওয়ালা অনেক গুলো বাক্সে পুর রাখা আছে। চাহিদা অনুযায়ী লেচীতে পুর ভরে বেলে ডুবন্ত ঘি তে ভাজা হচ্ছে।
শুনলাম যেহেতু এই দোকান গুলো ব্রাহ্মন পরিবার দ্বারা পরিচালিত, সেই কারণে এখানে পেঁয়াজ রসুনের ব্যবহার নেই। দোকানের মালিক বলছিলেন একসময় অনেক বিখ্যাত লোকজন এখানে পরোটা খেতে আসতেন, কিন্তু এখন আর সেই স্বর্ণযুগ নেই। এখন বেশীর ভাগই স্থানীয় লোকজন যা আসেন। যাইহোক আমরা ১২০ বছরের পরাঠেওয়ালী গলির পরোটার স্বাদ নিয়ে ফিরে চল্লাম।
বেশ কয়েক বছর ধরে ই অন্তর্জাল দুনিয়ায়, পলাশ রাঙ্গা পুরুলিয়ার ছবি ভেসে উঠছিল। সামনে থেকে চাক্ষুষ করার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছিল না। ভাই, বোন সবাই মিলে, কোথাও যাবার পরিকল্পনা হতেই, পুরুলিয়া হলো, প্রথম পছন্দের। সবার সহমতে, তৈরি হলো, 'বাসন্তিয়া পুরুলিয়ার' রূপ পরিদর্শন এর পরিকল্পনা।
ছোট, বড় মিলে সদস্য সংখ্যা 21 জন। সেই মতোন, টিকিট, ও ঘরের ব্যবস্থা করা হল। অবশেষে যাত্রা র দিন এলো। হাওড়া থেকে রাত এগারো টায় ট্রেন। চক্রধরপুর লোকাল। প্রায় প্রতিটি স্টেশন ই দাঁড়িয়ে, ধীরে, ধীরে এগোতে লাগলো ট্রেন টি। ভোর বেলা জানলা দিয়ে সূর্যের রক্তিম আলো ঢুকতে লাগলো। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতে ই, বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ট্রেন থেকে যতদূর চোখ প্রসারিত হচ্ছে, শুধু লাল পলাশের মেলা।লাল পলাশের উপর, সূর্যের প্রথম কিরণ পরে তা আরও অপরূপ হয়ে উঠেছে। সেই সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে, সেই সৌন্দর্য উপলদ্ধি করলাম।বেশ কিছুক্ষণ পরে, সেই সৌন্দর্য উপলদ্ধি করার চেষ্টা করলাম মাত্র।বারাভূম স্টেশনে ঢুকতে, প্রায় সাত টা বেজে গেল এই স্টেশন টি বেশ চমৎকার।পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন, বাইরে , ছৌ নাচের মূর্তি সাজানো আছে।ভাড়া করা গাড়িতে, রওনা হলাম গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে, জ্যোতি গেস্ট হাউস। এখানেও পথ প্রসারিত হয়েছে, পলাশ আবৃত, দুধারে জঙ্গলে র মধ্যে দিয়ে। গেস্ট হাউসে পৌঁছে, একটু বিশ্রাম ও জল খাবার খেয়ে, ভাড়া করা গাড়িতে, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্যে বেড়িয়ে পরলাম। প্রথমেই গেলাম পাখি পাহাড়। এই অঞ্চল টা, শাল,সেগুন, আর পলাশ গাছে পরিব্যক্ত।সারা পাহাড় জুড়ে কোনো শিল্পী দল উড়ন্ত পাখির চিত্র খোদাই করে চলেছেন।পাখি পাহাড়ের ঠিক সামনেই, দুটি কুসুম গাছ, যেন এখানে, আগত অতিথি দের রক্তিম অভ্যুর্থনা জানাচ্ছে। আসে,পাশে,কিছু পলাশ গাছ, ও রক্তিম সাজে সজ্জিত। কিছুটা সময় কাটিয়ে, পরবর্তী গন্তব্যে র জন্য, বেড়িয়ে পরলাম। পথে পলাশের শোভা, মন কে ভীষন ভাবে উৎফুল্ল করে তুলেছে। যা দেখতে আসা, তা সার্থক। চোখ, মন ভরে গেছে, পলাশের সৌন্দর্য এ।আরেকটু সামনে থেকে, স্মৃতির খাতায়, কিছু রূপ, কিছু মুহূর্ত কে ক্যামেরা বন্দী করতে, একটা পলাশ বনের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হলো। পাহাড়ের প্রান্ত দিয়ে, একদল গো পালক দল, তাঁদের পোষ্য নিয়ে পথ চলেছেন।প্রতিটি পলাশের ডাল কে অক্ষত রেখে, শুধুমাত্র পলাশের রূপ কে, কিছুটা ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করলাম মাত্র। কিছুটা সময় কাটিয়ে, পরবর্তী গন্তব্যে র জন্য রওনা হলাম। পরবর্তী গন্তব্য পারডি ড্যাম। যখন এখানে এসে নামলাম, তখন হঠাৎ ই একরাশ মেঘ এসে সূর্য কে ঢেকে দিয়ে গেল। মেঘলা আকাশ, ফাগুন হাওয়া ও পারডি ড্যাম, সব অবসাদ, ক্লান্তি, এক নিমেষেই ভুলিয়ে দিল। কিছু স্থানীয় মানুষের জীবন প্রণালী ও লক্ষ্য করলাম। সময়ের স্বল্পতার জন্য, ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না, এখানে। পরবর্তী গন্তব্য খয়রাবেড়া ড্যাম। খয়রাবেড়া ড্যাম অঞ্চল টির ব্যাপ্তি, অনেক টা অঞ্চল জুড়ে। এখানে ও প্রথমে ই অভ্যর্থনা জানাচ্ছে বড় একটা শিমুল গাছ, তার লাল ফুলের ডালি নিয়ে। জলাধারে জল অনেকটা ই কমে এসেছে। কিছু পাখির দেখা মিলল।চারদিকের শোভা অতি মনোরম। দেখতে, দেখতে অনেকটা বেলা হয়ে গেল। পথে পড়ল চারিদা গ্রাম। যা মুখোস তৈরি গ্রাম নামে পরিচিত। রাস্তার উপরেই বিভিন্ন দোকানে, শিল্পীরা ছৌ নাচের ও অন্যান্য মুখোশ তৈরি করে চলেছেন। কিছুটা সময় কাটিয়ে, গেস্ট হাউস এ ফিরে যাবার পালা। গেস্ট হাউসে এ ফিরে খাবার খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে, বিকালে, পায়ে, পায়ে হেঁটে আসে, পাশ টা একটু ঘুরে বেড়ালাম।পাহাড়ের কোলে একদল ছেলে মাঠে খেলা করছে। রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকা, পলাশ গাছের ফুল, কালো পিচ রাস্তার উপর যেন কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ গাছ টার ঠিক পিছনের মাঠেই হঠাৎ করে সূর্য ডুবে গেল। পূর্ণিমা একদম কাছে। তাই উজ্জ্বল চাঁদের জোৎস্নাধারায়, গেস্ট হাউসের ছাদটি, একবারে আলোকিত হয়ে গেল। ছাদেই চললো আড্ডা, আর গল্প। ঠিক কত রাতে আড্ডা টি ভেঙ্গেছিল, ঠিক মনে নেই।
গেস্ট হাউসের অন্যতম সদস্যা, আমার বেশ বন্ধু হয়ে গেল।ঠিক হলো, সে আমাকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল টা ঘুরে দেখাবে। সেই মতন অনুমতি ও পাস হয়ে গেল। পরের দিন সকালে, আমরা বেড়ানোর সময়ে, আমার দুই দিদি ও আমাদের সঙ্গী হলো। চারজন মিলে বেরোলাম পার্শ্ববর্তী অঞ্চল টা ঘুরে বেড়ানোর জন্য। সকলের স্নিগ্ধ হওয়ায়, শান্ত পরিবেশে, কেমন যেন একটা স্বাধীনতার অনুভূতি। কিছুক্ষনের জন্য সব পিছুটান ভুলে গেলাম। পাহাড়ের প্রান্ত দেশে, পলাশের বিশাল ব্যাপ্তি। গাড় সবুজের মধ্যে, রক্তিম পলাশের শোভা বর্ণনাতীত। এখানে বেশ কিছু চন্দন গাছ ও বেশ কিছু মহুয়া গাছ দেখতে পেলাম। একটা তীব্র গন্ধের অনুভূতি, মহুয়া গাছের উপস্থিতি কে জানান দিচ্ছে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে, গেস্ট হাউস এর দিকে ফিরে গেলাম। জলখাবার খেয়ে তৈরি হলাম, অযোধ্যা পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্য।
দেখলাম টুর্গা ড্যাম, অপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম। বেশ কিছু মুহূর্ত, ক্যামেরা বন্দি করে, তারপরই গেলাম রাম মন্দির। এখানকার পরিবেশ ও খুব স্নিগ্ধ, মনোরম। যা মন কে একটু শান্তি প্রদান করলো। রাম মন্দিরের ভিতরে কিছু লেখা, এখানকার আর্থ সামাজিক দিকের অপর চিত্র তুলে ধরলো। দেওয়ালে স্পষ্ট লেখা আছে, " এখানকার বাচ্ছাদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে, এদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।" এরপরই গেলাম বহু প্রতীক্ষিত মুরগুমা ড্যাম এ। এখানে যাওয়ার রাস্তাটি ভারী সুন্দর।যা কোন ভাবেই ব্যক্ত করার ক্ষমতা আমার নেই। পাহাড়, জঙ্গলে ভরা দুই দিকের রাস্তা। র তারই মধ্যে লাল পলাশের হাতছানি। মুরগুমা যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা অনেক। এখানেও জলাধারে জল খুব ই কম হয়ে গেছে। অঞ্চল টির ব্যাপ্তি অনেকটা। দূরে পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ গাছ, এই অঞ্চলের শোভা কিছু বাড়িয়েছে। জলাশয়ের জলে কোথাও স্থানীয় মানুষ, ও কোথাও গবাদিপশু তপ্ত দ্বিপ্রহরিক সান্দ্রতা নিতে ব্যাস্ত। কিছুটা সময় কাটিয়ে, রওনা হলাম, পরবর্তী গন্তব্যে র জন্য। মুরগুমা থেকে পরবর্তী গন্তব্য, বামনি ফলস। এখানে বেশ অনেকটা কষ্ট করে নীচে নেমে, তবে এখানের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পাহাড়ি জল ধারা , অনেকটা উঁচু থেকে নিচে নেমে আসছে। ছোট রাও বেশ সছন্দে নীচে নেমে, এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পিছু পা হয় নি। এখানেও কিছুটা সময় কাটিয়ে, কষ্ট করে উপরে উঠে, পরবর্তী গন্তব্যে র জন্য গাড়িতে উঠে বসা। এরপর গন্তব্য, মার্বেল লেক, যা blue lake নামে ও পরিচিত। চারধারে পাহাড় আবৃত শান্ত জলাশয়, এক কথায় অনবদ্য । জলাশয়ের শীতল জলের , অনুভূতি, মনকে প্রশান্তি প্রদান করল। এখানে পুরুলিয়ার অন্যতম জীবন চিত্র প্রদর্শিত হলো। দেখলাম, বেশ কিছু রমনী, অনেক দূর থেকে,অনেক টা কষ্ট করে পানীয় জল সংগ্রহ করে আনছেন। জানলাম, অন্তত 1 km দূর থেকে এই জল বহন করে নিয়ে আসা। তাই এখানে এতটুকু পানীয় জল অপচয়, খুবই পীড়াদায়ক। যাই হোক, তখন ঘড়িতে, দুপুর গড়িয়ে, বিকাল হওয়ার মুখে। তাই গেস্ট হাউসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।
( ছৌ নৃত্য দেখা, যা জীবনের অপর সঞ্চয়)
গেস্ট হাউসে খাবার সেরে, একটু বিশ্রাম নিয়ে, আবার বাইরে টা একটু পায়ে পায়ে ঘুরে দেখা। জঙ্গলে, গাছের ফাঁক দিয়ে ফাগুনী পূর্নিমা র চাঁদের আলো, চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা করলাম মুহূর্ত টি। এবার গেস্ট হাউসে ফেরার পালা। আজ গেস্ট হাউসের অলিন্দে, বাংলার ঐতিহ্য মন্ডিত, লোকনৃত্য 'ছৌ' এর আয়োজন করা হয়েছে। ফাগুনী পূর্ণিমার জোৎস্না ধারায়, পাহাড়ের প্রান্ত দেশে, জঙ্গল আবৃত মাঠে, পরিবেশিত হবে ছৌ নৃত্য। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান টির ব্যবস্থাপনায়, ধরমবীর প্রামানিক স্যার। সন্ধ্যের একটু পরেই প্রায়, কুড়ি, বাইশ জনের একটি দলের, মিলিত প্রচেষ্টায় সম্প্রচারিত হল ছৌ নৃত্য। এর আগে, কখনও সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয় নি, এই নৃত্য শিল্পের, তাই মন আজ উত্তেজনায় ভরপুর। আমাদের দর্শকদের বসার ঠিক সামনে ই বাজনদার দের বসার ব্যবস্থা হলো। মাঠের অপর প্রান্তে, আছেন ছৌ নৃত্য শিল্পীগণ। ছোট শিল্পী রাও এই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করবে। আর আছেন দুইজন মহিলা নৃত্য কুশলী। মাঠের এই প্রান্তে আছেন, ছৌ নৃত্য সঞ্চালক ব্যক্তি। অনুষ্ঠান শুরু হলো, বাজনদার দের বাজনার মধ্যে দিয়ে। ছৌ মুখোশ, ও পোশাক পরে, একের পর এক, কখনো একসাথে চার , পাঁচ জন অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করলেন। চোখ, প্রাণ জুড়িয়ে গেলো, সার্থক পুরুলিয়া সফর। আসে পাস থেকে, অন্যান্য গেস্ট হাউস থেকে ও অনেক দর্শক সমবেত হলেন, এই নৃত্য শিল্প দেখার জন্য। দুটি পর্বে অনুষ্ঠিত হলো, এই নৃত্য শিল্প। একটি, মহিষাসুর মর্দিনী, অপরটি রামায়ণ কথা কেন্দ্রিক। প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে চললো এই নৃত্য পরিবেশন। অনুষ্ঠান শেষে, মাঠে নেমে, শিল্পী দের কাছে, গিয়ে যা দেখলাম, তা একরকম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এত ভারী মুখোশ, পোশাক পরে, কিভাবে এরকম নৃত্য পরিবেশন করা যায়, সত্যিই বুঝে পেলাম না। অসুরের মুখোশ ও পোশাক ই মনে হলো সর্বাধিক ভারী। যে শিল্পী এই মুখোশ, ও পোশাক পরে নৃত্য পরিবেশন করেছেন, আমাদের আনন্দ প্রদান করেছেন, তাঁর নাকের উপরে অনেকটা ছাল উঠে গেছে, মুখোশের ভারে। সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কি বলবো, কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না। যাই হোক অনুষ্ঠান শেষে সব শিল্পী, কলা কুশলী চলে গেলেন। এই পরিবেশে ছৌ নৃত্য দেখার সুযোগ, জীবনের অপর সঞ্চয় হয়ে রইলো। সেই দিন ই আমাদের পুরুলিয়া সফরের শেষ রাত। পরের দিন সকালে, জল খাবার খেয়ে, বেড়াবো এমন সময় আবিরের রঙে ভরে গেলাম। আবিরের রং সাথে করেই ঘরে ফেরার পালা। আবার বারাভূম স্টেশন, এবং সেখান থেকে রাঁচি ইন্টারসিটি তে হাওড়া অবশেষে ঘরে ফেরা। পুরুলিয়া সফর এই ভাবেই শেষ হলো। |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |