বাংলায় একটা কথা আছে না যে উঠলো বাই তো কটক যাই | আমাদেরও অবস্থাটা দাঁড়ালো ঠিক সেরকমই | কয়েকদিনের প্ল্যানেই আমরা দশজন সহকর্মী বন্ধু ঠিক করে ফেললাম বাড়ির থেকে খানিকটা দূরে কোথাও দুটো রাত্রি কাটিয়ে আসবো | মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা | ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি | ঠিক হলো এবার আর পরিবারের কেউ নয়, শুধু নিজেরাই যাবো | কয়েকজন মৃদু আপত্তি করলেও সেটা ধোপে টিকলো না | আসলে সবাই একটা ঝঞ্ঝাটহীন নির্ভেজাল আনন্দ করতে চাইছিলাম | এইবার জায়গা নির্বাচন | আসলে মার্চ মাসের একেবারে শেষ দিক | চারদিকে একটা ভ্যাপসা গরম | বেড়াতে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ সময় না | যাই হোক খুব বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হলো না | চলো সুন্দরবন | যাওয়ার দিন ঠিক হলো ৩১শে মার্চ, রবিবার সকালে | এবার আরেকটা সমস্যা | দশজন থাকি দশটা জায়গায় | তবে মোটামুটি বেশিরভাগই কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর অল্প কয়েকজন একটু দূরে | একটা চোদ্দো সিটারের টাটা সুইঙ্গার বুক করা হলো | ভাড়া নেবে কিলোমিটার প্রতি ২৫ টাকা | রুটটা ঠিক হলো তারাতলা বজবজ রোডের জিঞ্জিরাবাজার থেকে ঠিক সকাল ৮টায় গাড়িটা প্রথম দুজনকে তুলে তারাতলা টালিগঞ্জ ফাঁড়ি হয়ে আনোয়ার শাহ রোড ধরে যাদবপুর থানা থেকে রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক রোড বরাবর পথে যাদের বাড়ি পড়বে তাদের তুলতে তুলতে গড়িয়ার দিকে আসবে | সেখান থেকে পাটুলি কানেক্টর দিয়ে ই এম বাইপাস ধরে সোজা বারুইপুর | দুজন সেখান থেকে উঠবে | সেখান থেকে সোজা আমাদের গন্তব্যে |
শুধু সমস্যা ছিল আমাদের দলের একজন সদস্য অপূর্ব কুমার দাস কে নিয়ে | কারণ তার বাড়ি কোন্নগর | অতো সকালে তাকে কোথায় দাঁড়াতে বলবো বুঝতে পারছিলাম না | তবুও তাকে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে হাওড়া এসে কোনো টালিগঞ্জগামী বাস ধরে সকাল ঠিক সোয়া আটটার সময় আনোয়ার শাহ রোডের মুখে দাঁড়াতে বলা হলো | আমরা অনেকেই মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলাম যে অপূর্ব ওই সময়ে জায়গামতো পৌঁছাতে পারবে না | একে তো খানিকটা ঢিমেতালে চলার স্বভাব আবার তার উপর কলকাতার রাস্তাঘাটে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় | অবশেষে ৩১শে মার্চের সকাল এসে গেলো | পুরুষ মানুষের একা কোথাও যাওয়ার একটা ভারী সুবিধা হলো খুব বেশি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না | আর মাত্র দু রাত্রির তো ব্যাপার | একটা ছোট ব্যাগে তাড়াতাড়ি একটা পাজামা, একটা হাফ প্যান্ট , দাড়ি কাটার সরঞ্জাম , টুথব্রাশ পেস্ট, টাওয়েল আর সামান্য কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে আর কতই বা সময় লাগে | তাছাড়া আমি বলেই দিয়েছিলাম যে আনোয়ার শাহ রোডের থেকে অপূর্ব দাসকে পিক আপ করে যেন আমাকে ফোন করে জানায় | আর আমি নিশ্চিত ছিলাম অপূর্ব ঠিক সোয়া আটটায় ওখানে আসতে পড়বে না | দেরি হবেই | তাই একটু ঢিমে তালেই সব করছি | হটাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো | খবর পেলাম একদিন আগেই মানে মার্চ মাসের শেষ দিনে সবাইকে এপ্রিল ফুল করে অপূর্ব ঠিক সময়ই গাড়িতে উঠে পড়েছে | সর্বনাশ | ওখান থেকে আমার রামগড়ের বাড়িতে পৌঁছাতে গাড়িটার বড়জোর কুড়ি মিনিট লাগবে | চট করে স্নানটা কোনোরকমে সেরে সবে ব্রেকফাস্ট করতে বসবো, বাড়ির নিচে গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো | কোনোরকমে একটা রুটি মুখে গুঁজে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্যান্টের বেল্ট আটকাতে আটকাতে আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলাম | গাড়িতে তখন সঞ্জিত, সংগীত, শান্তনু, অপূর্ব আর আমাকে নিয়ে পাঁচজন | এরপর গড়িয়া কলেজের সামনে থেকে প্রবীরকে তোলা হলো | এবার ই এম বাইপাসের উপর ঢালাই ব্রিজের কাছ থেকে ধ্রুব আর পীযুষ | গাড়ি কামালগাজি ফ্লাইওভার পেরিয়ে বাইপাস ধরে সোজা বারুইপুর | বাইপাসটা হয়ে খুব সুবিধা হয়েছে | নাহলে এন এস বোস রোড ধরে মেন রাস্তা দিয়ে বারুইপুর পৌঁছাতে গেলে অনেকখানি সময় বেশি লাগতো | যাই হোক আমাদের গাড়ি বারুইপুর ফ্লাইওভারের মাঝ বরাবর দাঁড় করানো হলো | খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের শেষ দুই সদস্য তরুণ আর শিবু গাড়িতে উঠে এলো |
আগে বারুইপুর রেলগেট পার হওয়া ছিল একটা বিভীষিকা | ভয়ঙ্কর জ্যাম হতো | কয়েক বছর আগে এই নতুন ফ্লাইওভারের কল্যানে এখন সেই পথ অনেক মসৃন | আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে | ক্যানিং রোড | চারদিকে সবুজ বনানী | দুপাশে ছবির মতো গ্রাম বাংলার চেনা দৃশ্য | গাড়িতে এ সি চললেও গরম লাগছে | খুব জল তেষ্টা পেয়েছে | আমি দ্বিতীয় সিটের বাঁ দিকে জানলার পাশে বসেছি | সামনের সিটে বসা শান্তনু পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে একটা জলের বোতল দিলো | এক চুমুকে অনেকটা খেয়ে ফেললাম | খানিকক্ষণ বাদেই ভুলটা বুঝতে পারলাম | মাথাটা ঝিমঝিম করছে | জলটা খাওয়ার সময়ই স্বাদটা একটু সন্দেহজনক লাগছিলো | কি আর করা যাবে | দ্বিতীয়বার এপ্রিল ফুল হয়েছি | ইতিমধ্যে ক্যানিং এসে গেছে | মাতলা নদীর ব্রিজে ওঠার আগে ডানদিকে একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হলো | চা খাওয়ার বিরতি | ফ্রিজ থেকে একটা ট্রে বার করে চামচ দিয়ে মাখনের মতো একটা কি যেন চায়ের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে | ওটা নাকি মালাই | ক্যানিংয়ের বিখ্যাত মালাই চা | আমাদের কয়েকজন চায়ের খুব তারিফ করছে | অবশ্য যে কজন গাড়িতে ওই রহস্যময় জল পান করেছিলাম তাদের মালাই চায়ের স্বাদটা ঠিকমতো অনুভূত হলো না | ঘড়িতে তখন প্রায় দুপুর বারোটা | নদীতে জল খুব কম | অনেক জায়গায় চরা পড়ে গিয়েছে | নদীর মাঝবরাবর কয়েকটা নৌকা চলছে |
এইবার মাতলা নদী পেরিয়ে গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে | মিনিট চল্লিশ বাদে এলো বাসন্তী | আরো আধ ঘন্টা বাদে গদখালী | এখানে আমরা গাড়িটা ছেড়ে দিলাম | কারন এরপর আর গাড়ি যাবে না | গাড়িটা বেকার দুদিন বসে থাকবে | তার চাইতে গাড়িটা ফিরে যাক | ড্রাইভারকে বলা হলো পরের পরদিন মানে দোসরা এপ্রিল বেলা বারোটা নাগাদ আবার এখানে এসে আমাদের তুলে নিতে | মাইল মিটারে দেখলাম জিঞ্জিরাবাজার থেকে গদখালির দূরত্ব প্রায় ১০৪ কিলোমিটার | এবার জেটি ঘাট | গদখালী নদী পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে হবে গোসাবা | জেটিঘাট থেকে একটা বড়ো ভুটভুটি নৌকায় আমরা গদখালী নদী পেরোলাম | এবার আমরা সুন্দরবনের মূল অঞ্চলে | পেপারে তো মাঝে মাঝেই দেখি গোসাবার গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়েছে | এবার দুটো অটো রিক্সায় প্রায় ১০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে পৌছালাম গোমর নদীর ধারে ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম পাখিরালয়ে | নামটা লোকমুখে পাখিরালা | একসময় নাকি এখানে নানা ধরনের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসতো | তার থেকেই এই নাম | ভাবতেই পারিনি গোসাবার এই শেষ প্রান্তে পাখিরালয় গ্রামে এতো বড়ো বড়ো হোটেল আর রিসর্ট থাকতে পারে | সবটাই যেন ক্যানভাসে আঁকা | গায়ে লাগানো গোমর নদীর ওপারে সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে | পুরো জঙ্গলটাকে ১৮ ফিট উঁচু নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে | এই সব দেখতে দেখতে দেখতে আমরা আপনজন বলে একটা বড়ো তিনতলা হোটেলে পৌঁছালাম | তখন বেলা আড়াইটে | এদের নিজস্ব রিসর্টও আছে | এটাই এখানকার সবচাইতে বড়ো হোটেল | প্রচুর পর্যটক এসেছেন | বেশ কিছু বিদেশী টুরিস্ট দেখতে পাচ্ছি | একতলায় বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে সুন্দর করে সাজানো বিশাল ডাইনিং হল | ভাগ্যক্রমে পাঁচটা এ সি ডাবল বেডরুম পাওয়া গেলো | ঘর প্রতি একদিনের ভাড়া ১৭০০ টাকা | নিজস্ব জেনেরেটরও আছে | এবার দুপুরের খাওয়া | খাবারের কোয়ালিটি খুব ভালো | এবার খানিকটা বিশ্রাম | বিকালে সবাই মিলে হাটতে হাটতে গোমর নদীর ধারে জেটি ঘাটের কাছে পৌঁছে চারদিক দেখছি | বিরাট চওড়া নদী | অনেক ছোট বড়ো লঞ্চ, অনেক রকম নৌকা, ছোট ডিঙি দেখতে পাচ্ছি | ঠিক উল্টো দিকে ঘন জঙ্গলে ভরা কয়েকটা দ্বীপ | আসলে আমরা নিজেরাও একটা দ্বীপের মধ্যেই আছি | খানিকক্ষণ বাদে অন্ধকার হওয়ার মুখে নদীর ধারে একটা চায়ের দোকানে বসলাম | মালিকের নাম বাবুরাম | দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা | মাত্র দশজনের দল হলে কি হবে, চা হবে চার রকম | চিনি দেয়া আর চিনি ছাড়া লাল চা | আবার কারো চিনি দেয়া তো কারো আবার চিনি ছাড়া দুধ চা | বাবুরাম বাবু প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও সবার জন্যে ফরমায়েশ মতো চা বানিয়ে দিলেন | ওনার কাছ থেকে জানলাম যে এই গ্রামে পানীয় জল পাওয়া যায়না | অনেক দূর থেকে খাওয়ার জল আনতে হয় | আসলে বঙ্গোপসাগরের খুব কাছে বলে সব জল এখানে নোনতা | পর্যটকদের জন্যে এখানে পর্যাপ্ত পরিমানে মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হয় | মাঝে মাঝে এখানে বাঘ হানা দেয় শুনে আমাদের কয়েকজন তাড়াতাড়ি হোটেলের দিকে রওনা দিলো | ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে | দোকান পাট বন্ধ হচ্ছে | আমরাও হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম | এইবার হোটেলের ম্যানেজারের সাথে দেখা হলো | এই হোটেলের সুন্দরবন পর্যটনের জন্যে নিজস্ব তিনটে লঞ্চ আছে | যদিও প্রত্যেকটাতে চল্লিশ জন মানুষের বসার ব্যবস্থা আছে, আমরা একটা গোটা লঞ্চই বুক করে নিলাম | লঞ্চের ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা | সকাল ঠিক আটটায় ছেড়ে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ফিরিয়ে আনবে | দেখিয়ে আনবে বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থান | দুপুরের খাওয়া লঞ্চেই | চা-ও পাওয়া যাবে | সজনেখালি থেকে পারমিশন করাতে হবে | সুন্দরবন অভয়ারণ্যে ঘোরার জন্যে লঞ্চের পারমিট ফি ৫০০ টাকা | আর জনপ্রতি ১০০ টাকা করে এন্ট্রি ফি | যাই হোক সব কিছু ঠিক করে আমরা এবার প্রস্তুতি নিলাম সান্ধ্য আসরের | দোতালায় একটা বড়ো হলঘর খুলে দেয়া হলো | অর্ডার দেয়া হলো চিকেন পাকোড়ার | অবশ্য সেটা উড়ে গেলো নিমেষেই | রাস্তায় অনেকটা আঙ্গুর কেনা হয়েছিল | কিছু কাজু বাদামও ছিল | সব মিলিয়ে সান্ধ্য আসর বেশ ভালোই জমে উঠলো | দুএকজন কয়েক কলি গানও গেয়ে ফেললো | কখন যে বেশ রাত হয়ে গেছে মালুম পাইনি কেউ | পরদিন আবার বেশ ভোরে উঠে রেডি হতে হবে | এবার সবাই ডাইনিং হলে | দেশি মুরগির ঝোলটা দারুন বানিয়েছিলো |
আজ পয়লা এপ্রিল | হোটেলের ক্যান্টিনে আগের দিন রাত্রেই বলা ছিল যেন খুব ভোরে ঘরে চা বিস্কুট পাঠিয়ে দেয় | ঘুমটা ভাঙলো দরজায় নক করার আওয়াজে | ছিটকিনি খুলে দেখি বিরাট একটা ফ্লাস্ক হাতে একজন ক্যান্টিন বয় দাঁড়ানো | কাগজের কাপে এক কাপ লাল চা আর দুটো বিস্কুট পেলাম | ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সকাল সাড়ে ছটা | সাড়ে সাতটায় সকালের টিফিন দেয়ার কথা | চা খেয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ছুটলাম | দাড়ি কেটে জামা প্যান্ট পড়ে নিচে যখন নেমে এলাম তখনও সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি | তার মানে নদীর ধারে বাবুরাম বাবুর দোকানে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে | দোকানে পৌঁছে দেখি বেশ ভিড় | আমাদের কয়েকজন আগেই ওখানে হাজির | চা খাচ্ছে | সামনের বেঞ্চ দুটো ভর্তি | গাঁয়ের লোকজনও রয়েছে | চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে দেখি সামনের ছোট জেটিটার সামনে ‘আপনজন’ লেখা আমাদের লঞ্চটা দাঁড়ানো | খাবার দাবার তোলা হচ্ছে | অনেক ট্যুরিস্টরাও দেখলাম এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে | এরমধ্যেই একজন খবর দিলো যে সকালের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা আরম্ভ হয়েছে | আমরাও হোটেলের নিচতলার ডাইনিং হলে ফিরে এলাম | একটা থালায় বেশ কয়েকটা লুচি আর বাটিতে আলুর তরকারি | সাথে একটা ডিম্ সেদ্ধ | পিছনের টেবিলে একজন বিদেশী ভদ্রমহিলা তার স্বামী ও শিশু কন্যাকে নিয়ে বসে খাচ্ছেন | তাদের খাবার মেনু অবশ্য আলাদা | সামনের একটা প্লেটে অনেক গুলো কমলা লেবু রাখা আর প্রত্যেকের সামনে অনেকটা পাস্তার মতো দেখতে কিছু একটা খাবার | সেই টেবিলে কয়েকজন বাঙালি মাঝবয়েসী ভদ্রলোকও লুচি তরকারি খাচ্ছিলেন | তাদের মধ্যে বেশি উৎসাহী একজন প্রানপনে ওই বিদেশি ভদ্রমহিলাকে সুন্দরবন সম্বন্ধে বিচিত্র ইংরেজিতে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন | ভদ্রমহিলা খুব সম্ভবত আমেরিকান | মাঝে মাঝে উনি কিছু প্রশ্ন করছেন | কিন্তু না তো ওই বাঙালি ভদ্রলোক কিছু বুঝতে পারছেন না বোঝাতে পারছেন | একটা বিচিত্র পরিস্থিতি | সোয়া আটটা বাজে | এবার আমরা হেটে গিয়ে জেটি থেকে লঞ্চে উঠলাম | দোতালা লঞ্চ | একতলায় বিশ্রাম করার জন্যে কয়েকটা বিছানা পাতা | পেছনদিকে রান্নার জায়গা | সুন্দর একটা কমোড বসানো টয়লেটও আছে | আমরা সবাই দোতালায় উঠে এলাম | সামনের দিকে সারেংয়ের কেবিনের সামনে চারকোনা গদি পাতা একটা বসার জায়গা | আমি ওখানেই ক্যামেরা হাতে বসলাম | আমার পাশে শান্তনু | বাকিরা পেছনে ডেকের উপর প্লাস্টিকের চেয়ারে | সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি | আমরা তো সাকুল্যে মাত্র দশ জন | ঠিক সাড়ে আটটায় লঞ্চ স্টার্ট করলো | সকাল আটটার জায়গায় সবে সাড়ে আটটা | বাঙালি হিসাবে যথেষ্ট ভালো টাইমিং আমাদের | ভাগ্যিস আমরা সবাই একা এসেছি | পরিবার সাথে থাকলে নির্ঘাত দশটা বাজতো | লঞ্চে তারস্বরে স্পিকারে গান বাজছে | অনেক বলে আওয়াজটাকে কমানো গেলো | যেমন গানের বাণী, তেমন গলার আওয়াজ | ছেলের না মেয়ের গলা সেটা বোঝাই যাচ্ছে না | একটা গানের প্রথম দুটো লাইন শুনুন | 'চাঁদের আলোয় ভাঙা ঘরে টোকা দিলো কে ? ওরে মাইয়া উইঠা পইরা দরজা খুইলা দে ‘ | শুনে হাসবো না কাঁদবো সেটাই বুঝতে পারছি না | প্রথমেই যাবো সামান্য দূরে গোমর নদীর উল্টো পাড়ে সজনেখালিতে | তবে শুনে আস্বস্ত হলাম যে সজনেখালির পৌঁছনোর কিছু আগেই গান বন্ধ হবে |
সজনেখালি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি | এখানকার বনবিভাগের অফিস থেকেই লঞ্চে করে সুন্দরবন ঘোরার পারমিট নিতে হবে | লঞ্চের জন্যে ৫০০ টাকা আর জনপ্রতি ১০০ টাকা ধরে দশ জনের জন্যে ১০০০ টাকা জমা করতে হলো | এছাড়াও একজন স্বীকৃত গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক | তার জন্যে আরো ৫০০ টাকা | সাকুল্যে সাত হাজার টাকা | আমাদের গাইডের নাম শ্রী বিকাশ মিস্ত্রি | উনি লঞ্চে পুরো ট্যুরটাতেই আমাদের সাথে থাকবেন | বুকে বন দফতর থেকে দেওয়া সচিত্র পরিচয় পত্র ঝোলানো | উনি এবার আমাদের সবাইকে সজনেখালি দ্বীপের দ্রষ্টব্য জিনিসগুলো দেখাতে আরম্ভ করলেন | এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩২ স্কোয়ার কিলোমিটার | প্রথমে ঢুকেই একটা বিরাট চৌবাচ্চা | চারদিকে সাড়ে চার ফিট পাঁচিলের উপর সম্পূর্ণটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা | ভেতরে জলের মধ্যে নাকি বড়ো বড়ো কচ্ছপ আছে | অনেক টুরিস্ট এসেছেন | অনেকে পা উঁচু করে জালের মধ্যে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কচ্ছপ দেখার চেষ্টা করছে | অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকেও আমি কিছু দেখতে পেলাম না | অবশ্য কেউই পায়নি | ডানদিকে ছড়ানো ছেটানো বেশ কয়েকটা খুব সুন্দর সিমেন্টের ছাউনি দেয়া গোল বসার জায়গা রয়েছে | এবার বিকাশ বাবুর তত্ত্বাবধানে আমরা ওনার পিছু পিছু এগোচ্ছি | যাতায়াত করার সব রাস্তার দুপাশে প্রায় আঠেরো ফিট উঁচু লোহার জাল লাগানো | আসল বাঘ না দেখতে পেলেও ভিতরে প্রমান সাইজের দুটো কংক্রিটের বাঘ দাঁড় করানো | কৃত্রিম হরিণও আছে | ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের সবুজ রঙের তিনতলা নতুন পাকা গেস্ট হাউস দেখলাম | আগাম অনুমতি নিয়ে এখানে ঘর বুক করা যায় | এর আগে ২০০১ সালে আমি পাড়ার বন্ধুদের সাথে সুন্দরবন ঘুরতে এসেছিলাম | তখন সজনেখালিতে এই নতুন গেস্ট হাউস তৈরি হয়নি | তখন ছিল অনেকগুলো উঁচু কাঠের খুঁটির উপর সম্পূর্ণ কাঠের একটা গেস্ট হাউস | সেটা এখনো আছে | সেটায় বোধহয় এখন আর কেউ থাকে না | বিভিন্ন ধরনের প্রচুর গাছ রয়েছে | প্রত্যেকটা গাছের গায়ে নাম লেখা | সুন্দরী গাছ দেখলাম | একদম খাড়া | হাটতে হাটতে বাঁ দিকে জালের ঠিক গায় একটা বিরাট গুইঁ সাপ শুয়ে আছে দেখছি | চলতি নাম গোসাপ | একটা যেন ছোট খাটো কুমির | একটা মিউজিয়াম আছে | আমরা আর ভিতরে ঢুকিনি | মিউজিয়ামের সামনে বিরাট একটা ম্যাপ | তাতে সুন্দরবন অঞ্চলের সমস্ত খুঁটিনাটি রয়েছে | বিকাশ বাবু আমাদের সব বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন |
নতুন গেস্ট হাউসের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা বিরাট জলাশয় | চারদিক ঘিরে জাল দিয়ে ঘেরা বাঁধানো সুন্দর রাস্তা | ওখানে নাকি অনেক কুমির আছে | অনেকক্ষন ধরে আমরা কুমির দেখার চেষ্টা করছি | অনেকই দাঁড়িয়ে আছে | অনেক পরে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে পাড়ের কাছে কি একটা যেন মাথাটা উঁচু করেই ভুস করে আবার ডুবে গেলো | মনে হয় ওটা কুমিরেরই মাথা ছিল | আমি অবশ্য খেয়াল করতে পারিনি | সম্পূর্ণ দ্বীপটাই খুব সুন্দর | পরিচ্ছন্ন | এক কোনায় গিয়ে আমাদের মধ্যে একজন একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতেই বিকাশ বাবু ছুটে গিয়ে বাধা দিলেন | সুন্দরবনে যে কোনো দ্বীপেই ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ | একটা চারতলা বিরাট ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে | আমরা সবাই চার তলায় উঠে এলাম | এখন থেকে সম্পূর্ণ সজনেখালি দেখা যায় | যতদূর চোখ যায় চারদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল | তবে মাঝখানে মাঝখানে বেশ কিছু জায়গা সম্পূর্ণ নেড়া | দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে কাদা মাটিতে ভরা | আর সেগুলোর মধ্যেই রয়েছে কিছু মিষ্টি জলের ছোট পুকুর | গাইড বিকাশ বাবুর কাছ থেকে জানলাম যে বাঘ আর অন্য অনেক জন্তু জানোয়ার খুব সকালে আর সন্ধ্যায় এখানে জল খেতে আসে | নরম মাটির উপর অনেক রকম পায়ের ছাপ স্পষ্ট | সব মিলিয়ে দুর্দান্ত লাগছে | এবার আবার আমরা একসাথে পিছনের একটা গেট দিয়ে সজনেখালি ছেড়ে বেরিয়ে অন্য একটা জেটিতে এলাম | কি আশ্চর্য ! আমাদের লঞ্চটাও দেখি এই জেটিতে চলে এসেছে |
আমরা সবাই লঞ্চে উঠে পড়েছি | এবার আমরা যাবো সুধন্যখালি দ্বীপে | প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা | অনেক আগে সুধন্য বলে একজন কাঠুরেকে বাঘে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো বলে নাকি জায়গাটার এই নাম | লঞ্চে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি | ডানদিকের ধারে চেয়ার পেতে অপূর্ব আর তার ঠিক পেছনে সংগীত বসেছে | কাল গাড়িতে ওঠার পর থেকেই দেখছি ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করে চলেছে | ফেরি পার হওয়ার সময়ও একই জিনিস | রুমটাও দুজনে একসাথে শেয়ার করলো | আজ ভোরে ঘুম থেকেও উঠে দেখেছি দুজনে সামনে সামনি দুটো চেয়ারে বসে কথা বলছে | আসলে দুজনেই বাল্য বন্ধু | কোন্নগরে একই স্কুলে পড়তো | এতদিন বাদে একসাথে | কত গল্প যে জমা হয়ে আছে | তবে অপূর্বই একনাগাড়ে বলে চলেছে | গল্পে অপূর্ব কখনো নৈনিতালের লেকে আবার পরমুহূর্তেই হুগলির কোনো গন্ডগ্রামে | গল্প কন্যাকুমারিকার বিবেকানন্দ রক থেকে উঠে আসছে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে | সংগীত এমনিতেই শান্তশিষ্ট মানুষ | মুখে একটা সুন্দর হাসি লেগেই থাকে | অপূর্বর কথার খেই হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়লেও রক্ষা নেই | অপূর্ব হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আবার বলতে শুরু করবে | চা দেয়া হবে শুনে আমি আর শান্তনু সামনের দিকের জায়গাটা ছেড়ে পিছনে চলে এসেছি | প্রবীর সারেংয়ের কেবিনের সামনের সেই চারকোনা গদি পাতা জায়গাটায় শুয়ে পড়েছে | কাল হোটেলে ঢোকার পর থেকেই ধ্রুব সারাক্ষণ একটা হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুরছে | লঞ্চেও একই পোশাক | ডানদিকে রেলিং বরাবর পীযুষের পিছনের চেয়ারে বসা | সবসময়ই কারো না কারো পিছনে লাগে | যেমন এখন পড়েছে পীযুষকে নিয়ে | পীযুষের শরীরটা একটু নাদুসনুদুস বলে বাঘ নাকি ওকেই প্রথমে ধরবে | পীযুষ কিন্তু সবসময় হাসি মুখে থাকে | তরুনের চেহারা এতোটাই ছোটোখাটো যে মাঝে মাঝে খুঁজেই পাওয়া যায়না | শম্ভু আর ওর বাড়ি এক জায়গায় বলে একটু বেশি ঘনিষ্ট | লঞ্চের পেছনের দিকে দুটো চেয়ারে বসে গল্প করছে | সঞ্জিত আমাদের গাইড বিকাশ বাবুর সামনে বসে কথা শুনছে | ইতিমধ্যে কাগজের কাপে সবাইকে লাল চা দেয়া হলো | বিকাশ বাবু মাঝবয়সী শিক্ষিত মানুষ | ওনার মুখ থেকেই জানলাম যে ওনার মতো চল্লিশজন সুন্দরবন বন বিভাগের স্বীকৃত গাইড আছেন | এমনিতে ওনাদের কোনো নির্দিষ্ট মাইনে নেই | সজনেখালি থেকে লঞ্চ পিছু একজন করে গাইড বুক করা বাধ্যতামূলক | তবে সিজন ছাড়া রোজ সবাই কাজ পায়না | তবে যে কজন কাজ পাবে তাদের টাকাটা একজায়গায় করে সবার মধ্যে সমান ভাগ করে দেয়া হয় | তাতে হয়তো সারাদিন খেটে বিকাশ বাবুর ভাগ্যে জুটবে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা | তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত মাত্র চল্লিশ জনে কুলায় না | তখন আরো অতিরিক্ত চল্লিশজনকে বনবিভাগ গাইড হিসাবে নিযুক্ত করে |
দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি জায়গা জুড়ে সুন্দরবন অঞ্চল | এর মধ্যে ৬০ শতাংশের মতো বাংলা দেশের সীমানার মধ্যে আর ভারতের মধ্যে বাকি ৪০ শতাংশ | ভারতের অংশের মধ্যে ছোট বড়ো মিলিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একশো দুটো দ্বীপ আছে যার অর্ধেকের বেশি জায়গায় কোনো মানুষ থাকে না | যে কয়েকটা দ্বীপে মানুষ বসবাস করে তার অধিকাংশ জায়গাতেই বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি | বন দফতরের অফিসগুলো জেনারেটরে চলে | ২০০২ সালের গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে পাঁচশোর বেশি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল | ২০১৮ সালের ব্যাঘ্রশুমারিতে সেই সংখ্যাটা দুশো বারোতে ঠেকেছে | ভারতের অংশে সেটা একশোর একটু বেশি | পৃথিবীর মধ্যে সুন্দরবন হলো সবচাইতে বড়ো ম্যানগ্রোভ অরণ্য | ইউনেস্কো থেকে হেরিটেজ তকমাপ্রাপ্ত সুন্দরবন অরণ্যতে ভারত বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০০৫ সালে শুরু হয়েছে ইকো ট্যুরিজম | তাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর যেমন জোর দেয়া হয়েছে তেমনি এই অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষজনকে বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ | এখন কাঠ কাটতে, জঙ্গলের ভিতরে মধু সংগ্রহ করতে কিংবা এই অঞ্চলে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বন বিভাগের আগাম অনুমতি নেয়া আবশ্যিক | বাংলায় একটা কথা আছে না, ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির | এই অঞ্চলে কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক | সুন্দরবন লাগোয়া দ্বীপগুলিতে এমন কোনো পরিবার নেই যাদের কোনো না কোনো সদস্য বাঘের বা কুমিরের মুখে পড়েনি | জোর দেয়া হয়েছে পর্যটন শিল্পেও | দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষজনদের জন্যে সমস্ত সুন্দরবন অঞ্চলটাকেই সাজিয়ে তোলা হচ্ছে ছবির মতো করে | বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন অতিথি নিবাস | চোরা গোপ্তা বেআইনি পশু শিকার বন্ধ করার জন্যে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যৌথ নজরদারির ব্যবস্থার | তবে আরো অনেক কিছু বাকি আছে | বিকাশ বাবুর কাছ থেকে আমরা এক মনে শুনছি | গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদী আর বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় এই সুন্দরবন অঞ্চল | পশ্চিম বঙ্গের হুগলি নদী থেকে বাংলাদেশের বালেশ্বর নদী অব্দি এর বিস্তার | রয়েছে অসংখ্য ছোট বড়ো নদী | ছোট ছোট অপ্রশস্ত খাঁড়ি বা খাল দিয়ে সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত |
এই মুহূর্তে আমরা এরকমই একটা খাঁড়িতে ঢুকেছি | চলেছি পাড়ের খুব কাছ দিয়ে | বিকাশ বাবু বলে চলেছেন | সুন্দরবনের বাঘের একটা বিশেষ গুণ যে তারা সাঁতার কাটতে পারে | ছোট নদী সাঁতরে পার হওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কাছে জলভাত | উনি নাকি একবার বাচ্ছা মুখে নিয়ে একটা বাঘিনীকে সাঁতরে নদী পার হতে দেখেছেন | ব্যাস হয়ে গেলো | যারা যারা একটু দূরে দূরে রেলিঙের ধার বরাবর বসেছিল তারা গুটিশুটি মেরে ভেতর দিকে বিকাশবাবুর কাছে ঘন হয়ে বসে পড়লো | পীযুষের মুখের হাসি তখন উধাও | তরুণ আর শম্ভু পিছনের দিকে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল | তারা ততক্ষণে উপরে উঠে এসেছে | প্রবীর এতক্ষণ মটকা মেরে শুয়ে ছিল | এক ঝটকায় উঠে আমার পাশে এসে বসলো | ধ্রুব ওর হাফ প্যান্টের দড়িটা তখন শক্ত করে বাঁধছে । যেন বাঘ মামাকে সাঁতরাতে দেখলেই রড বেয়ে কেবিনের ছাদে উঠে পড়বে ।শান্তনু একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়েছিলো | সেটাকে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে সিগারেটটা আবার প্যাকেটে ঢোকালো | ভাবখানা যেন যদি পাড় থেকে আগুন লক্ষ্য করে বাঘ বাবাজি লাফ দেয় | অপূর্বর কথা তখন থেমে গেছে | সদাহাস্যময় সংগীতকেও দেখলাম বেশ গম্ভীর হয়ে যেতে |
অবশেষে দুরু দুরু বুকে খাঁড়িটা পার হয়ে আমরা একটা চওড়া নদীতে এসে পড়লাম | দত্ত নদী | এর উল্টো পাড়েই সুধন্যখালি ন্যাশনাল পার্ক | আমরা একে একে সবাই নেমে বিকাশ বাবুর পিছন পিছন হাটছি | যাতায়াতের সমস্ত রাস্তাগুলোর দুদিকে প্রায় ষোলো ফিট উঁচু জাল লাগানো | রাস্তা গুলো ভীষণ সুন্দর | ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে জমির উপর রাখা আর চারদিক কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা একটা পুরোনো স্টিম ইঞ্জিন লাগানো ভেসেল | প্রায় তিরিশ বছর আগে পথ ভুল করে থাইল্যান্ড থেকে এটা নাকি সুন্দরবনে ঢুকে পড়েছিল | এখানেও একটা বিরাট কুমিরদের জলাশয় আছে | যদিও অনেক্ষন তাকিয়ে থেকেও কোনো কুমির চোখে পড়লো না | রাস্তার পাশে পাশে রয়েছে বেশ কিছু ওপরে সুন্দর ছাউনি লাগানো গোলাকৃতি সবুজ রঙের বসার জায়গা | একটা চারতলা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে | একেবারে ওপরের তলাটা চারদিক খোলা | ছাদ নেই | একসাথে প্রায় পচিশজন মানুষ সেখানে দাঁড়াতে পারে | টাওয়ারের খুব কাছেই একটা বিরাট মিষ্টি জলের পুকুর | চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু ম্যানগ্রোভের জঙ্গল | অন্যান্য গাছও আছে | তবে জঙ্গলের বুক চিরে মাঝে মাঝে অনেকটা চওড়া নেড়া জমি | এখান থেকেই নাকি সবচাইতে বেশি বন্য জন্তু জানোয়ার দেখা যায় | খুব ভোরের দিকে আসতে পারলে ওই মিষ্টি জলের লেকে জল খেতে আসা বাঘের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি | তবে ভাগ্য ভালো থাকলে অন্য সময়ও বাবাজীবনের সাক্ষাৎ হতে পারে | দেশি বিদেশী প্রচুর টুরিস্ট এসেছেন দেখলাম | আমরাও ভিড় কাটিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চোখে সামনের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে আছি | বলা তো যায়না কপাল খুললেও খুলতে পারে | জলাশয়ের কাছের নেড়া জমিটায় বেশ কিছু লম্বা ঠোঁট ওয়ালা কালো কালো পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে | হটাৎ ঘন ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকটা বুনো শুয়োর | সচরাচর আমরা যেরকম দেখি এগুলো ঠিক সেরকম না | এগুলো কালচে আর গায়ে অনেক লোম | আমরা বুনো শুয়োর গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখছি | মাঝে মাঝে শূকর গুলো আশেপাশের ঝোপে হারিয়ে যাচ্ছে | আর ঠিক তখুনি সেই ঘটনাটা ঘটলো | আমার ডানদিকে দাঁড়ানো অপূর্ব দাস | আর তার ঠিক পাশেই শান্তনু | হটাৎ ওই মিষ্টি জলের পুকুরের কাছে ঝোপের আড়ালে অনেক দূরে একটা বড়ো গাছের দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে শান্তনু চেঁচিয়ে উঠলো 'আরে ওই তো বাঘ'| অপূর্ব তখন মাথা উঁচু করে একটা বোতল থেকে জল খাচ্ছিলো | বাঘ শব্দটা শুনে মাথাটা নামাতে গিয়ে বিষম খেলো | তখন খানিকটা মেঘলা মতো আকাশ | তার উপর বুনো ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে আলো আঁধারিতে অত দূরের কিছু পরিষ্কার ভাবে ঠাহর করা যাচ্ছে না | কিন্তু আমারও মনে হলো কিছু একটা মেটে মতো বস্তু চার হাত পায়ে চুপি সাড়ে এগোচ্ছে | ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন ওইতো ওইতো করে চেঁচাতে আরম্ভ করেছে | ততক্ষণে ওয়াচ টাওয়ারের তিনতলা থেকে সবাই চারতলায় উঠে এসেছে | এক বিহারি ভদ্রমহিলা তার কোলের বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে জোরসে চেপে ধরে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছেন | অনেকে পায়ের চেটোর উপর ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জন্তুটাকে দেখার চেষ্টা করছে | এদিকে ওয়াচ টাওয়ারের নিচে এদিক ওদিক যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বাঘ কথাটা শুনে তারা সবাই তখন দুদ্দাড় করে অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারের উপরে ওঠার চেষ্টা করছে | আমাদের গাইড বিকাশ বাবুকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না | নারী কন্ঠে কেউ একজন ভ্যাক করে কেঁদে উঠলো | একজন দর্শকের হাতে একটা দূরবীন দেখলাম | কিন্তু উনি কিছুতেই লক্ষ্য বস্তুটা খুঁজে পাচ্ছেন না | ততক্ষনে অনেকে ব্যাগের ভিতর থেকে দামি ক্যামেরা বার করে ফেলেছে | আমার ঠিক ডান দিকে একজন তার ক্যামেরার সাথে টেলিস্কোপিক জুম লেন্স লাগাতে আরম্ভ করলেন | আমার কম দামি ক্যামেরা | আলাদা করে জুম লেন্স লাগানোর প্রয়োজন নেই | এবার আমি আমার ক্যামেরায় চোখ রেখে ম্যানুয়ালি জুম করে বাঘটাকে ধরার চেষ্টা করলাম | প্রথমে ওই নির্দিষ্ট গাছটাকে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না | অবশেষে পেলাম | এবার আস্তে আস্তে লেন্সের মুখটা নিচের দিকের নামিয়ে দেখতে পেলাম জানোয়ারটাকে | বাদামি লোমে ঢাকা বড়োসড়ো চতুস্পদ একটা কিছু | অল্প নড়াচড়া করছে | প্রথমে মুখটা পিছন দিকে ঘোরানো ছিল | এবার মাথাটা আমাদের দিকে ঘোরালো | শাটারটা আদ্ধেক টিপতেই ফোকাস পুরো ক্লিয়ার | ধুর, এটা তো একটা পূর্ণ বয়স্ক বেশ বড়ো সাইজের বাঁদর | আমি বাঁদর বলে চেঁচিয়ে উঠতেই একসঙ্গে অনেকগুলো দীর্ঘ নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেলাম | এতক্ষণ যে বিহারি ভদ্রমহিলা বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ইস্ট নাম জপ্ করছিলেন তিনি দুম করে বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বকাবকি আরম্ভ করলেন | বাচ্চাটা বোধহয় ওনার কোলে হিসি করে ফেলেছিলো | সবার প্রথমে শান্তনু বাঘ বলে চেঁচিয়েছিলো | আমরা ওর মুখের দিকে তাকালাম | ঠোঁটের কোনায় একটা স্মিত হাসি | সেটা অপ্রস্তুত হওয়ার না সবাইকে এপ্রিল ফুল করার ঠিক বুঝতে পারলাম না | কারন তারিখটা তো পয়লা এপ্রিল |
4:15 নাগাদ দরজায় ধাক্কা শুনে খুলে দেখি সৈকত। মুখটা বিরক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিকের নাসিকাগর্জন এর ঠেলায় ঘুমোতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে নাকি ওর পেটে দুটো লাথিও মেরেছে, কিন্তু সে নাকি পাথরের মূর্তি, নট নড়ন চড়ন। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কৌশিক ঘুম থেকে উঠলো। আমরাও সবাই 5:15 তে রেডি। কিন্তু বৃষ্টি থামেনা। অবশেষে 6:20 নাগাদ বৃষ্টিটা ইলসেগুড়ি মতো হওয়ায়, আমরা জিপিসির হুড লাগিয়েই রওনা হলাম। একটুখানি এগোতেই ডানদিকে ফাঁকা ঘাসজমিতে দেখি দুটো বাইসন (ইন্ডিয়ান গাউর) একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় বাচ্চাটাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। বাচ্চাটা আবার মাঝে মাঝে মায়ের দুধ খাচ্ছে। আর একটু এগোতেই মিনটাদা ডানদিকে একটা গাছের কোটরের দিকে আঙ্গুল দেখালো, তাকিয়ে দেখি একটা মনিটর লিজার্ড (Varanus togeanus)একটা পা আর মুখ বার করে উঁকি মেরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ওখানে অপেক্ষা করলাম, যদি সে একটু বাইরে বেরোয়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আবার সেই নালাটার কাছে আসতেই পচা গন্ধে প্রায় বমি হওয়ার উপক্রম। কালভার্ট টায় একটু দাঁড়ালাম, জিপসির স্টার্ট বন্ধ করে। যদি বাঘ মামার (বা মামী) একটু দেখা পাই। সে তো এলোনা, অতএব আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
বাঁশবাড়ি গেট অবধি আবার সেই প্রচুর পাখি, বার্কিং ডিয়ার, ময়ূর দেখলাম। বাইরের সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্টে টিফিন সারলাম রুটি, ঘুগনি আর ডিমের পোচ দিয়ে। তারপর বাঁশবাড়ি বাজার পেরিয়ে প্রায় 45 মিনিট পরে পৌঁছলাম ভুঁইয়াপাড়া ফিল্ড ডিরেক্টর অফিসে। এখান থেকে পারমিট করিয়ে গেট পেরিয়ে আবার অরণ্যে প্রবেশ করলাম।
এই দিকটায় পুরোটাই প্রায় গ্রাসল্যান্ড। মিনিট পাঁচেক যেতেই দেখি একটা হাতির পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। সামনে গিয়ে দেখি একটা ছানা হাতিও আছে। আমরা একটু কাছে যেতেই একটা বড় হাতি কান দুলিয়ে শুঁড় তুলে ভীষণ জোর ট্রাম্পেট দিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এলো। আর বাকি হাতিগুলো বাচ্চাটাকে পায়ের মধ্যে লুকিয়ে নিলো। হাতির তাড়া খেয়ে আমরাও পালালাম। এরপর কুরির বিল ওয়াচটাওয়ার এর দিকে এগোতে এগোতে 3-4 টে বেঙ্গল ফ্লোরিকান কে উড়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু এত দূর দিয়ে উড়ছিল যে ভালো ছবি পেলাম না। এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুরেও অনেক দূর থেকে 15-20 টা হাতির পাল আর গোটা পাঁচেক হগ ডিয়ার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। যদিও এদিকে গন্ডারের আনাগোনা বেশি, তবুও একটাকেও দেখতে পেলাম না। কিছুটা মনখারাপ নিয়েই ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় একটা ঈগল কে একটা ন্যাড়া গাছের মাথায় বসে থাকতে দেখলাম। যাই হোক, আবার সেই পুরোনো রাস্তায় মাথানগুড়ি ফিরে এলাম।
ফিরে এসে স্নান করে আবার ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এবার ভাত, ডাল, চিকেন কারি। মাথানগুড়ি সব পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে 4 টে নাগাদ বেরোলাম ভুটানের দিকে, উদ্দেশ্য হর্নবিল সাইটিং। এবার গাইড রবি গেল বন্দুক ছাড়া, বললো ভুটানে বন্দুক নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। একটা গোলাকার পাথরের ওপর ভারত-ভূটান সীমান্ত খোদাই করা রয়েছে। খানিকটা এগিয়ে একটা পাহাড়ি ঝোড়ার কাছে মিনটাদা গাড়ি রাখলো। উপরে একটা গাছ দেখিয়ে বললো, হর্নবিল গুলো ওখানেই আসে। আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম। যদিও দু একটা হর্নবিল দেখতে পেলাম, তারা সবাই নদী পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছিল। ওই গাছে কিছুই না দেখতে পেয়ে মিনটাদা অন্য একটা লোকেশনে নিয়ে গেল। মিনিট 15 অপেক্ষা করার পর দেখি একটা গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিল ওই গাছে এসে বসলো। আরো মিনিট 5-7 পর আরো একটা এসে আগেরটার গা ঘেঁষে বসলো। তারপর দেখি একজন আরেকজনের ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কৌশিক বললো “ ওরা ভালো বাসাবাসি করছে”। প্রায় আধঘন্টা অনেক হর্নবিল দেখলাম। প্রায় সন্ধে হয়ে যাওয়ায় ফিরে এলাম মাথানগুড়ি। এবার আমাদের ফেরার পালা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা হলাম বাঁশবাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষবারের মতো সেই নালাটার কাছে আরো একবার দাঁড়ালাম, এখন গন্ধটা সেরকম আসছে না। উনি বোধহয় পুরোটাই সাবাড় করে দিয়েছেন। নাহ, এবারেও দেখা পেলামনা। অন্ধকারে বনপথ পাড়ি দিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাঁশবাড়ি পৌঁছলাম। সেই রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে মিনটাদা কে বিদায় জানালাম। দেবা দত্ত ও আমাদের সি অফ করতে এসেছিল। একটা টাটা ম্যাজিক গাড়ি করে রওনা দিলাম নিউ বঙ্গাইগাঁও। আমাদের ফেরার ট্রেন রাত 12 টায়, গরিব রথ। আমরা বাঁশবাড়ি কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম, কিন্তু সবাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আবার ফিরে আসতেই হবে মানসী মানসে।
0 Comments
"প্রকৃতির টানে ডুয়ার্সের প্রানে"
*************************** চলুন আজ আমি আপনাদের নিয়ে যাব এমন এক জায়গায় যেখানে উন্মুক্ত প্রকৃতি সর্বদা পাহাড়, নদী, জঙ্গল ও বিশুদ্ধ অক্সিজেনের উষ্ণ স্পর্শে আপনাদের আলিঙ্গনের মাধ্যমে প্রতিটি মূহুর্ত জানিয়ে দেবে তার অস্তিত্বের অনুভূতি। আপনাদের হৃদয় কখন যে তার অনুভূতির ছোঁয়ায় বিহ্বল হয়ে যাবে তা আপনারা বুঝতেই পারবেন না। চলুন তাহলে যাওয়া যাক ? না কি? কলকাতর শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ২০-৩০মি.এ ১৩১৪৯ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে চলে আসুন নিউ ম্যাল জ্্শান। সকাল ৯-৩৩মি. এ পৌঁছে যাবেন আপনাদের গন্তব্য স্থল নিউ ম্যাল স্টেশনে। এখান থেকে ৮০০- ১০০০ টাকায় একটি গাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসুন গরুমারা অভয় অরণ্যের টিকিট কাউন্টারের সামনে। এখানেই নেমে ID Proof দেখিয়ে বিকালের শেষ ট্রিপের "যাত্রাপ্রসাদ" ওয়াজ টাওয়ারের টিকিট কেটে নিন। এরপর কাউন্টারের ঠিক উল্টো দিকে "টাস্কের ডেন" রিসোর্টে সোজা গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ুন। প্রসঙ্গত বলে রাখি আগে থেকে বুকিং করে রাখাটা ভালো। তাহলে পিক আপ কার ও দুপুরের খাবার বলে রাখলে অনেকটা সময় বাঁচাতে পারবেন। নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকেও এখানে সরাসরি আসতে পারেন তবে, সেক্ষেত্রে খরচটা একটু বেশি হবে। চলুন এবার বাঙালি জাতির মধ্যাহ্নে কব্জি ডুবিয়ে ডান হাতের কাজটি সেরে বেলা ৩টে নাগাদ চলে আসুন কাউন্টারের সামনে জঙ্গল সাফারি করার জন্য। সঙ্গে পানীয় জল ও গরমের পোশাক অবশ্যই রাখবেন কারন হুটখোলা গাড়িতে ঠাণ্ডা লাগবে। এবার আপনাদের চালক কাম গাইড পারমিশন করিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকবে। কাঁচা রাস্তা ধরে পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর দিয়ে মজ্ মজ্ শব্দ করে গাড়ির চাকা গড়াতে থাকবে। চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু খাড়া ঘন গাছের নিচ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলবে। কখনো কখনো পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো ঘন গাছের ভিতর দিয়ে উঁকি মারবে আবার কখনো ভেদ না করতে পেরে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় আগের পথে ফিরে যাবে। এই রোমাঞ্চকর অনুভূতির স্বাদ উপভোগ করতেই লোকেরা জঙ্গল সাফারিতে আসে। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এরই মধ্যে দর্শন মিলতে পারে ময়ূর,বানর,বনমুরগি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বাইসনের। গাড়ি যখন "যাত্রাপ্রসাদ" ওয়াজ টাওয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তখনই দেখা মিলতে পারে গন্ডার,হরিন,হাতি অথবা বুনো সুয়োরের। এখানে আধঘন্টা সময় দেওয়া হবে ভালো করে পর্যবেক্ষণ ও ফটো সেশন করার জন্য। এভাবে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সমাপ্ত হবে জঙ্গল সাফারি। এবার দেখবেন প্রতিটি গাড়ি একটা ছোট্ট অডিটোরিয়ামের সামনে নামিয়ে দেবে। এখানে আপনাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে আদিবাসী নৃত্য পরিবেশনের। শীতের রাতে মাদলের তালে তালে আদিবাসী নারীদের নৃত্য আশাকরি সবাইকে জঙলি মাদকতার মায়া জালে আবদ্ধ করবে। মন চাইলে আপনাদের সঙ্গে থাকা মহিলারাও নাচে অংশ গ্রহণ করে মনের আশা পূরণ করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন কেবল শেষ ট্রিপের জন্য রাখা হয়। এর পর রিসোর্টে ফিরে একটু গল্প ও খুনসুটি করে আজকের দিনটা এ ভাবেই সমাপ্ত করুন। পরদিন একটি গাড়ি ভাড়া করে (২৫০০-৩০০০ টাকা) সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ুন সুন্দরী ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রথমে চলে আসুন জন প্রসিদ্ধ মূর্তি নদীর তীরে। এখানে নদীটি হীম শীতল স্বচ্ছ জল ধারা নিয়ে প্রতিটি মূহুর্তে কুলু কুলু শব্দ উৎপন্ন করে ছোট বড় পাথরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীটির অপর তীরে অবস্থান করছে সুদূর প্রসারীত ঘন সবুজে ঘেরা অরণ্যের সীমারেখা। এরই অন্তস্থলে সূর্যের কিরণে ঝিকিমিকি করছে সোনালী রঙের বালুকাময় তটরাশি যেখানে সর্বদা চরে বেড়ায় বক বা পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। এক কথায় এই রোমান্টিক দৃশ্য আপনাদের হৃদয়কে সিক্ত করবেই। এরপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে কিছুক্ষণ চলার পর পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলে আসুন ঝালঙ পয়েন্ট। চলার পথে অবশ্যই দেখে নেবেন চা বাগান,কফি বাগান ও রবার plantation Garden. ঝালঙ জায়গাটি মূলত একটি ভূটিয়া জনপদ। জলঢাকা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। নদীর অপর প্রান্তে অবস্থান করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটানের সীমান্তরেখা। এখান থেকেই চরিতার্থ করতে পারেন বিদেশ সফরের হালকা অনুভূতি। এখানের পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য ও অতি মনোরম। পরবর্তী দ্রষ্টব্য স্থান পারেন ও বিন্দু। এগুলি মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল। এখানে নদীর জল অপেক্ষাকৃত বড় বড় পাথরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখান থেকে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এগুলি ওখানকার উল্লেখযোগ্য পিকনিক স্পট হিসেবে পরিচিত। এবার আপনাদের যাত্রা পথ বহু আকাঙ্খিত সেই সানথালেখোলার উদ্দেশ্যে। প্রকৃতি এখানে নিজেকে এক অদ্ভুত মায়াবী রুপে আবির্ভূত হয়েছে। চারিদিকে ঘিরে থাকা বিশাল বিশাল গাছের সমাবেশে সূর্যের আলোর প্রবেশ পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত অঞ্চলটা এক অদ্ভুত আলো আঁধারের মধ্যে দিয়ে নিস্তব্ধতার মায়াজাল বুনে চলেছে। এরই মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এক পাহাড়ি ঝর্ণার জলের শব্দ এবং ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নিস্তব্ধতার মায়াজালকে বারে বারে ছিন্ন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ আপনাদের মতো কোলাহলমূখর জীবন যাত্রার মানুষদের একটু স্তম্ভিত করে দিতে পারে। এখানে আপনারা কিছু খাবার খেয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলুন রকি আইল্যান্ডের অভিমুখে। বিশাল বিশাল পাথরের ভিতর দিয়ে প্রচন্ড বেগে প্রবাহিত হওয়া নদীর জল শব্দ ও ফেনা উৎপন্ন করে ঝর্নার ন্যায় বয়ে চলেছে ক্রমশঃ নীচের দিকে। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে ও ফটো সেশন করে রহনা হয়ে যান সামসিঙ-এর পথে। সামসিঙ সাধারণত বিশেষ ভাবে পরিচিত চা বাগানের জন্য। একর কে একর জুড়ে বিরাজ করছে চোখ ধাঁধানো মন জুড়ানো চায়ের বাগান। এরই ভিতর পাহাড়ি রমনীদের গান গেয়ে চা পাতা তোলার বিরল দৃশ্য আপনাদের শহুরে মানুষদের মন মুগ্ধ করবেই। আপনারাও চাইলে কয়েকটি মূহুর্ত ওনাদের সাথে যুক্ত হয়ে চা পাতা তোলার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন যা সারা জীবন স্মৃতিতে থেকে যাবে। দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিম আকাশের গায়ে কমলা রঙের আলোয় আলোকিত করে দিনের বিদায় জানিয়ে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হবে। গোধূলির এই রাঙা আলোয় চা বাগানের বুক চীরে আঁকা বাঁকা পথে ধূলো উড়িয়ে আপনারাও চলে আসুন আজকের সফর শেষ করে আপনার রিসোর্টের আঙিনায়। এরপর বিছানায় শুয়ে স্মৃতি চালনার মধ্যে দিয়ে উপভোগ করতে থাকুন সুন্দরী ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ রস। আশাকরি আপনাদের সকলের কাছে এটা একটি অন্যতম রোমাঞ্চকর সফর হিসেবে জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রকৃতির মাঝে নিবিড়ভাবে দুটো দিন কাটিয়ে তৃতীয় দিন নিউ ম্যাল স্টেশন বা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কলকাতায় ফিরে আসতে পারেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি হাতে সময় থাকলে এখান থেকে লাভা ও রিশপ ঘুরে আসা যায়। তাহলে জঙ্গল, নদী ও পাহাড় এক যাত্রায় দর্শন হয়ে যায়। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ভ্রমণ সূচী কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করতে পারেন। কি বন্ধুরা ভালো লাগলো? তবে আর দেরি কেন? টিকিট কেটে বেরিয়ে পড়ুন বসন্তের আগে। সকল বন্ধুদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে আজ এখানেই লেখা শেষ করছি। ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করে মতামত জানান। ধন্যবাদ। ****** সমাপ্ত ******
দুই সুন্দরী মুর্তি ও জলঢাকা-
ডুয়ার্সের এই দুই খরস্রোতা নদী অসংখ্য নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে অবিরাম ঠান্ডা কনকনে জল নিয়ে। সামসিং এই দেখা যাবে মুর্তিকে ,কাছেই rocky islandএ নদীর স্রোতের ওপর বড় বড় প্রস্তরখন্ড এই জায়গার এক অন্য রূপদান করেছে,এটি একটি সুন্দর সময় কাটানোর জায়গা। আর জলঢাকা কে পাওয়া যাবে ঝালং, বিন্দুতে,জলঢাকা ই হলো ভারত ও ভুটানের সীমা ,ঝালং এ এই নদীতেই গড়ে উঠেছে জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এখানে পৌঁছতে গেলে সামসিং থেকে গাড়িতে যেতে হবে,সামসিং থেকে ঝালং এর রাস্তা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ও রোমাঞ্চকর। অরণ্যে ঘেরা রাস্তায় চলতে চলতে দেখতে পাওয়া যাবে চা বাগান,কমলা লেবুর গাছ,রাবার গাছ ও সর্পগন্ধা চাষ ইত্যাদি। বিন্দুতে নদীর ওপর আছে 5টি lockgate সহ বিন্দু বাঁধ।এখানে নদীর স্রোত ও প্রাকৃতিক শোভা দেখবার মতো,নদীর ঠিক ওপারেই ভুটান, ভুটান থেকে আসা অনেক সামগ্রী তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়,প্রকৃতির বুকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কাটিয়ে দেওয়া যায় এখানে যা মনের মধ্যে স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে আজীবন। লেখার একেবারেই অভ্যেস নেই..তাও খানিকটা চেষ্টা করলাম...ভুল ভ্রান্তি হলে ক্ষমা করে দেবেন.. চাকরিসূত্রে উত্তরবঙ্গে রয়েছি আর সেই সুযোগের সদব্যবহার করবনা সেটা কি করে সম্ভব!!..তাই যখনই মন চায় উইকেন্ডগুলোতে এদিক ওদিক বেরিয়ে পরি কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই। তেমনিভাবেই গত সপ্তাহে চারজন বন্ধু মিলে রওনা দিলাম সামসিং, লালিগুরাস এর উদ্দেশ্যে। বর্ষায় ডুয়ার্সকে যে এতো অপরূপ সুন্দর লাগে তা আগে জানা ছিলোনা...!! চারিপাশে কেবল সবুজের সমাবেশ এবং বিশুদ্ধ বাতাস, যেটা শহরবাসীদের কাছে আজকাল ভীষণ অপরিচিত..!! রাস্তার দুপাশের চা বাগানগুলো এখানকার পরিবেশে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে..!! এছাড়াও যেটি মূল আকর্ষণ ছিল সেটি হলো বর্ষায় চনমনে হয়ে ওঠা মূর্তি নদী আর সেখানে স্নান না করাটা অনেকটা বোকামিই হবে আমার মতে। তাই সবশেষে এই ট্যুর টাকে পাহাড়, নদী, জঙ্গল, চা বাগান এসবের একটি কম্বো প্যাক বললে খুব একটা ভুল হবেনা..!!! Post By:- Abhijit Mondal
ডুয়ার্স-এ 'বিন্দু'র সংসারের পথে.... পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট গ্রাম, তার নাম বিন্দু। গ্রামটি ভারত-ভুটান সীমান্তের গায়ে প্রায় 2000 ফুট উচ্চতায় নিজের সংসার পেতেছে। একটি অতিপ্রাচীন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিন্দুর সংসারকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছে, যাতে পর্যটকদের কাছে বিন্দু আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বাঁধের গায়ে "দুধ খোলা" , "বিন্দু খোলা" আর "জলঢাকা" নদী একে অন্যের সাথে একাত্ম হয়েছে। পাহাড়ী ভাষায় "খোলা" মানে নদী। প্রকৃতি জলঢাকা নদীকে মাধ্যম করে ভারত আর ভুটানের সীমানা গড়েছে। এমন অকল্পণীয় সৌন্দর্যে গা ভাসাতে অপেক্ষা না করেই পরিবারের সাথে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। ফালাকাটায় থাকার কারণে গাড়িতে বীরপাড়া, বীনাগুড়ি হয়ে প্রথমে মূর্তি পৌঁছালাম। সেখান থেকে খুনিয়া মোড় থেকে আমরা ডানদিকের রাস্তা ধরে বিন্দু পৌঁছালাম। পাহাড়ের গা বেয়ে যখন সর্পিল রাস্তা এঁকে বেঁকে উঠে যায়, তখন এক মন উদাস করা আবেগ, ভাবনার সাগরে ডুবস্নান দেয়। নাম না জানা অপরিচিত বন্য ঝর্ণার কুলুকুলু রব এক লহমায় নিছকই অপরিচিত থেকে পরিচিত হবার নেশায় মেতে ওঠে। দু'একটা নাম না জানা পাহাড়ি ফুল গন্ধতে কাউকে পরাজিত করতে না পারলেও রূপে হৃদয় ভোলায়। আমরা যতই পাহাড়ের উপর উঠে যাচ্ছিলাম, ততই শীতের আধিপত্য অনুভূত হচ্ছিল। গাড়ির কাঁচে ঝাপসা হয়ে যাওয়া দূরের পাহাড়টা ধীরে ধীরে কাছে আসছিল। কিছু পাইন আর রাবারের সারির মাঝে অচেনা পাখি নিজেদের ভাষায় অজানা সুরে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। একটা নদী যখন পাহাড়ের বুক চিরে পাহাড়টাকে দ্বিখণ্ডিত করে, ঠিক তখনই বিজ্ঞান সেখানে সেতু বানিয়ে পর্যটকদের এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে যাবার সুযোগ করে দেয়। লোহার সেতুর গায়ে পতাকার আকারে বিন্যস্ত নেপালিদের স্তোত্রগাঁথা তাদের সংস্কৃতিকে অন্যভাবে চেনার সুযোগ করে দেয়। গাড়ি থামিয়ে সেই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে কিছু মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করলাম। রাস্তা যেন শেষ হচ্ছিলই না, হঠাৎ স্রোতের শব্দ যখন শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে দিলো, তখনই বুঝলাম বিন্দু পৌঁছে গেছি। শব্দটা আর কিছুই না, ওটা তিনটে নদীর মিলিত হবার অস্তিত্বকে জানান দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমেই শীতের প্রকোপটা অনুভব করলাম। সামনেই কতগুলো ছোট ছোট দোকান ছিল। সেখানে গরম গরম চাওমিন সেদ্ধ আর মোমো খেয়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে যে যার নিজের মতো করে প্রকৃতিকে অন্নেষণ করতে লাগলাম। আমার আট মাসের ছোট্ট মেয়েটাও প্রকৃতি অনুভব করার আনন্দকে হাত পা নেড়ে হাসিমুখে স্বাগত জানালো। যতটা সম্ভব সব মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে আমরা আবার বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। মনের মধ্যে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে আমরা বিন্দুর সংসার থেকে নিজের সংসারে পাড়ি দিলাম। Post By:- Arunima Konar Nayak
|
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |