ইটাচুনা রাজবাড়ী। গত কয়েকবছর ধরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি ভ্রমণকেন্দ্র। অবশ্যই একটু অন্য রকমের ভ্রমণ - কলকাতা থেকে প্রায় ৬৬ কিলোমিটার দূরে খন্যান স্টেশন থেকে টোটো করে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া আড়াইশো বছরের প্রাচীন বিশাল এক প্রাসাদে অনেকটা জমিদারী স্টাইলে থাকা। ইতিহাস বলছে, এই জমিদারবাড়ীর ( প্রচলিত ভাবে এটিকে রাজবাড়ী বলা হলেও আসলে এটি একটি বিশাল জমিদারবাড়ী ) পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন মারাঠা থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা আক্রমণকারী বা বর্গী হিসেবে। সেই সময়ে এঁদের পদবী ছিলো কুন্দন। কিন্তু পরে মারাঠা বর্গীর এই অংশটি যুদ্ধ ছেড়ে বাংলাকেই তাদের স্থায়ী নিবাস হিসেবে বেছে নেন, নিজেদের একাত্ম করে তোলেন এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি আর আচারের সঙ্গে, নিজেদের কুন্দন পদবীকে পরিবর্তিত করে নেন বাঙালীদের মধ্যে প্রচলিত কুন্ডু-তে। এখানে তাঁদের জমিদারী স্থাপিত হয়, আর সেই জমিদারীর সূত্রেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এখানকার এই বিশাল বাড়ী, ১৭৬৬ সালে সাফল্য নারায়ণ কুন্ডুর সময়ে যা অসাধারণ এক বহু মহলা প্রাসাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে, সেই বিশাল প্রাসাদটির একটি অংশ হোম স্টে হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে অতিথিরা অনেকটা সেই পুরোনো দিনের রাজকীয় স্টাইলেই থাকার সুযোগ পান। অনেকগুলি ঘর আছে এখানে, যেগুলি অভিনব ভাবে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে নামকরণ করা হয়েছে - ঠাকুমা, গিন্নি মা, বড়ো মা, মেজ মা, বড় পিসি, ছোট পিসি, বড় বৌদি, ছোট বৌদি - ইত্যাদি। আধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি বহু ঘরে আছে পুরোনো দিনের অ্যান্টিক আসবাব, যাতে ফেলে আসা দিনের রাজকীয় ভাবে থাকার আমেজটি বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করা যায়। এগুলি ছাড়াও গ্রামের মধ্যে অবস্থিত বলে, গ্রামের মাটির বাড়ীর স্বাদ দেওয়ার জন্যে রাজবাড়ীর বাগানে, কয়েকটি মাটির বাড়ীও আছে ইচ্ছুক অতিথিদের জন্যে। আগামী দু তিনটি পর্বে, আমরা ঘুরে দেখবো সেই রাজবাড়ীর বিভিন্ন মহল - যতটা সম্ভব।
এই প্রাসাদটি প্রায় কুড়ি বিঘা এলাকা নিয়ে অবস্থিত। তার মধ্যেই আছে, বাহির মহল বা কাছারি মহল, অন্দরমহল, ঠাকুরদালান, বাগান, খিড়কিমহল, ইত্যাদি।একদিকে যেমন বিশাল প্রাসাদের রাজকীয় আভিজাত্য, তেমনই বাইরে সুন্দর করে সাজানো বাগান, গ্রামের গন্ধ মাখা নানা ধরনের গাছ গাছালি, পুকুর, পোষা হাঁস, মুরগি, পায়রা, খরগোশের অবাধ বিচরণ। আবার অপূর্ব সুন্দর ঠাকুরদালানে আড়াইশো বছর ধরে চলে আসা শ্রীধর জীউয়ের পুজো। পুরনো দিনের সমস্ত সৌন্দর্য আর আভিজাত্যকে বাঁচিয়ে রেখে এযুগের মানুষের কাছে মেলে ধরার এক অসাধারণ প্রয়াস। বিস্মিত, বিহ্বল মনের ভরে যাওয়ার উপকরণ সর্বত্র । বাড়ীটি ও তার চারপাশ ঘুরে দেখতে,অনুভব করতে সময় লাগে, ঝড়ের বেগে তা হয় না। কারণ সময় এখানে থেমে আছে আড়াইশো বছর ধরে, পুরনো দিনের সেই জৌলুসকে, সেই সময়ের গন্ধকে অনুভব করতে আমাদেরও কিছুটা সময় দিতে হয় বৈ কি। আর সেইজন্যেই, একদিনের ভ্রমণে, যতটুকু দেখতে পেরেছি, সেটাই এখানে ধরে রাখতে চেয়েছি ক্যামেরার চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে, হাতে একটু সময় নিয়ে - একাধিক পর্বের মাধ্যমে। আজ প্রথম পর্বে আমরা দেখবো বাড়ীর মূল অংশ, পরেরদিন দেখা যাবে ঠাকুরদালান এবং বাগানের বিভিন্ন এলাকা, শেষ পর্বে দেখবো বাড়ীর বাইরের কিছু মন্দির আর এখানকার খাওয়াদাওয়া। গেট দিয়ে বাড়ীর চত্বরে ঢুকলেই সামনেই সেই বিরাট বাড়ি, ইংরেজি “u” অক্ষরের আদলে। সামনে ফুলের নকশা কাটা সুসজ্জিত একটি সাদা তোরণ, আর তার দুপাশে লাল রঙের বাহির মহল। তিনদিকেই একতলা আর দোতলায় টানা বারান্দা। ডানদিকের মহলে একতলায় বারান্দা দিয়ে ঢুকে একটি বিরাট হল ঘর, তার মধ্যে দুটি বিশাল বিছানা, পুরোনো দিনের ইজি চেয়ার, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল, সোফা, অনেকগুলি চেয়ার । মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়বাতি, আর পেছন দিকে সিলিং থেকে টাঙানো পুরোনো দিনের দুটি টানা পাখা। সঙ্গে ছেলেদের ও মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা টয়লেট। জানা গেল, অতীত কালে এটিই ছিল এদের মূল কাছারি অফিস, বর্তমানে কোনো বড় গ্রূপ সারাদিনের জন্য গেলে এটি তাদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পাশেই একটি ঘরে খাবার ব্যবস্থা, আর অন্যদিকে আরেকটি ঘরে কিছু হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা। খাবার ঘরের কথা বলেছি, খাওয়ার কথাও বলবো, কিন্তু তার আগে দেখে আসি বাড়ীর ওপরের অংশ।
আগেই বলেছি, বাড়ীর দোতলাতেও টানা বারান্দা, আর সেই বারান্দার পাশেই বিভিন্ন ঘর, রাতের অতিথিদের থাকার জন্যে। এখানে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাদের ওই বাড়ীর পক্ষ থেকেই সমস্ত বাড়ীটি ঘুরিয়ে দেখানো হয়, তাই সেই প্রদর্শকের সঙ্গেই চলতে হয়, নয়তো প্রথম প্রথম বাড়ীটি কিন্তু একেবারেই একটি গোলকধাঁধার মত লাগে, এত বড় বাড়ীতে প্রদর্শক ছাড়া সবটা নিজে নিজে ঘুরে দেখা সত্যিই বেশ কঠিন। তা ছাড়া, যাঁরা সারাদিনের জন্য যান, তাঁদের সব জায়গায় প্রবেশাধিকার থাকেনা, প্রদর্শক যতটুকু দেখান, সেটুকু দেখেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সেই তুলনায় কিন্তু যাঁরা রাত্রিবাস করেন, তাঁদের ঘুরে দেখার সুযোগ একটু বেশী।
দোতলার বারান্দা গুলিও খুব সুচারুভাবে সাজানো - পুরোনো দিনের আসবাব, দেওয়ালে পুরোনো দিনের ছবি, কোথাও বা দেওয়ালে টাঙানো কার্পেট। তবে বিশেষ আকর্ষণ হলো, একতলার মতোই দোতলার আর একটি বিরাট ঘর, পুরোনো দিনের আসবাবে ভরা। আছে পুরোনো সোফা, পাথরের সেন্টার টেবিল, রাজপুরুষকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার তাঞ্জাম, আগেকার দিনের টেলিফোন, হুঁকো স্ট্যান্ড ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আছে এই বংশের বংশতালিকা। এখানেও আছে মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়বাতি, পায়ের তলায় পার্সিয়ান কার্পেট।। তবে এই ঘরটির তফাৎ হলো, যে এটি নীচের ঘরের মতো কারোকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না, দর্শকদের ঘুরিয়ে দেখিয়ে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবার ছাত। তিনতলার ওপরে বাড়ীর বিশাল ছাত। সেই ছাতে উঠলে একদিকে যেমন বাড়ীর বার মহল আর ঠাকুরদালানকে ওপর থেকে দেখা যায়, তেমনি অন্য দিকে দেখা যায় - অন্দরমহলের একটি অংশ। ওপর থেকে দেখা সেই অংশটিকেও ভারী চমৎকার লাগে। তবে, যাঁরা day tourist বা শুধু দিনের বেলাতেই এখানে ভ্রমণের জন্য যান, তাঁদের কিন্তু এই অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার নেই। আর তাই ওপর থেকেই দেখে নিতে হয় রাজবাড়ীর এই অংশের সৌন্দর্যটুকু। দিনের বেলায় রাজবাড়ীর যা রূপ, সন্ধ্যেবেলায় তা কিন্তু অনেকটাই আলাদা । সমস্ত বারান্দা জুড়ে যখন আলো জ্বলে ওঠে, ঠাকুরদালান ঝলমলিয়ে ওঠে ঝাড়বাতি আর পুরনো দিনের লোহার কারুকাজ করা স্ট্যান্ডের আলোয়, তখন এই রাজবাড়ী হয়ে ওঠে আরও মোহময়, আরও মায়াবী - আড়াইশো বছরের বুক থেকে উঠে আসা এক ইতিহাসের মতো - রহস্যময়, কিন্তু যার আকর্ষণ অমোঘ । মোটামুটি এই হলো ইটাচুনা রাজবাড়ীর বারমহলের কথা। পরেরদিন আমরা দেখবো এঁদের বাগান, আর ঠাকুরদালান।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর মূল অংশ নিয়ে আগের দিন বলেছি। আজ বলবো, এখানকার ঠাকুরদালান আর বাড়ী সংলগ্ন বাগানের কথা।
ঠাকুরদালান - ইটাচুনা রাজবাড়ীর একটি অত্যন্ত সুন্দর অঙ্গ হচ্ছে এখানকার ঠাকুরদালানটি। বাইরের গেট দিয়ে মূল বাড়ীর চত্বরে প্রবেশ করার সময়েই দেখা যায়, তিনপাশের লাল বারান্দার মাঝখানে সাদা থাম আর তার সঙ্গে সাদা রঙের পঙ্খের সুন্দর কাজ করা তোরণ - সেটিই ঠাকুরদালানে যাওয়ার পথ। তোরণের একেবারে ওপরে ছাতের কাছে লেখা - “ শ্রী শ্রী শ্রীধর জিউ কৃপাহি কেবলম, তার একটু নীচে দোতলার বারান্দার ওপরে লেখা - “ ১৭৬৬ সালে সাফল্য রাম কুন্ডু মহাশয় কর্তৃক স্থাপিত “, তার আরো নীচে একতলার প্রবেশপথের ওপর - “ ১৮৯৪ সালে শ্রী নারায়ণ কুন্ডু মহাশয় কর্তৃক পুনস্থাপিত “ এবং তার নীচেই সুপরিচিত পিতৃমন্ত্র। লালের সঙ্গে সাদার মেলবন্ধনে এই দারুণ সুন্দর তোরণটি প্রথম থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর এই তোরণ দিয়েই প্রবেশ করা যায়, এখানকার এই ঠাকুরদালানে। তোরণে যা লেখা আছে, তাতেই বোঝা যায় এই মন্দির শ্রীধরজিউ-এর নামে উৎসর্গীকৃত। এই বংশের আদি মারাঠী পুরুষেরা শৈব হলেও, বাংলায় এসে তারা কিন্তু স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী বৈষ্ণবমতকেই প্রাধান্য দেন - যার ফলশ্রুতি এই ২৫২ বছরের পুরোনো মন্দির। অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিন খিলানের এই মন্দির, আর এখানেও লাল সাদার সুন্দর মিশ্রণ। বাইরের মূল দেওয়াল লাল রঙের, তার ওপরে সাদা রঙের দেবদেবীর মূর্তি। থাম আর থামের ওপরের কাজও সাদা রঙেরই। মন্দিরের তিনদিক ঘিরে লাল রঙের বাড়ী ও বারান্দা। ওপরের বারান্দায় চিক ঝোলানোর জায়গা, যে চিকের আড়াল থেকে বাড়ীর মহিলারা দেখতেন ঠাকুরদালানের বিভিন্ন উৎসব, বা এখানে সেই সময়ে হওয়া যাত্রা বা কবিগান। সামনের পুরো প্রাঙ্গণটি জুড়ে সুন্দর লোহার কাজ করা বাতিস্ট্যান্ড। জানা গেল, এই পরিবারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ওঠাপড়া হলেও, আড়াইশো বছর ধরে চলে আসা এই শ্রীধরদেবের পূজো কখনোই বন্ধ হয়নি। আজও ত্রিসন্ধ্যায় পূজো হয় এখানে, বিশেষ করে সূর্য ডোবার পর, আলোকমালায় সজ্জিত এই ঠাকুরদালানে সন্ধ্যার আরতি সত্যিই দেখার মতো। পুরোনো দিনের মতো আজও এখানে মহাসমারোহে পালিত হয় জন্মাষ্টমী আর দোলযাত্রা। বসন্তকালে সেই দোল উৎসবে শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরে তখন যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় - অতীতের বসন্ত এখনকার বসন্তের সঙ্গে তার রঙীন হাত মেলায়।।
বাগান - ঠাকুরদালান থেকে পাশেই একটি রাস্তা দিয়ে গিয়ে পড়া যায়, এখানকার বাগানে। বাড়ীর ভেতরে যেখানে রাজকীয় বৈভব, এখানে এই বাগানে, কিন্তু তখন শুধুই প্রকৃতির সঙ্গে মাখামাখি। প্রথমেই একটি ছাউনি, যেটাকে এঁরা বলেন “ চা-ঘর”। আগে যা ছিল এঁদের গোশালা, সেটিকেই এখন পরিবর্তিত করা হয়েছে, চারদিক খোলা এই চা ঘরে। সন্ধ্যের পর এখানে, এই বাগানে, অতিথিদের আড্ডা বসে। একপাশে আছে, জমিদারী আমলের বিরাট দাবার বোর্ড, যা আগে ছিল পাথরে বাঁধানো । এর ঘুঁটিগুলি সব কাঠের। বাগানে একটু ঘুরলেই চোখে পড়বে, আমলকি, হরীতকী, কর্পূর, ডালচিনি প্রভৃতি গাছের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক নাম না জানা ফলের আর ফুলের গাছ। চলার সময় নিজের মনেই সঙ্গ দেবে এদের পোষা হাঁস, মুরগী, পায়রা, খরগোশের দল। একটু দূরেই এক বিরাট পুকুর, সেই পুকুরে আগে খেলা করত বিশাল সব মাছেরা, পুকুরের ঘাটে এসে বসতেন অন্তঃপুরবাসিনী মহিলারা। এই বাগানের মধ্যেই ওই পুকুরের পাশে আছে চারটি মাটির বাড়ী, যার সঙ্গে ভেতরের রাজবাড়ীর জৌলুসের কোনো মিল নেই, বরং তাদের মধ্যে আছে গ্রামবাংলার নিজস্ব শৈলীর ছোঁয়া। আর এদের নামও বাংলার বিভিন্ন ফুলের নামে, ভেতর বাড়ীর মতো কোন মানুষের নামে নয়। । বাগানের আর এক কোণে খাঁচায় আছে বন মুরগী ও টার্কি, আবার তাদের সঙ্গেই আছে এখানকার এক প্রিয় কুকুর “গুণ্ডা”র কবর। এখানে, এই কটেজ গুলিতে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা রাজবাড়ীতে এসেও রাজকীয় বিলাসের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে খুঁজে পাবেন গ্রাম বাংলার একান্ত নিভৃত পরিবেশকে। বাড়ীর ভেতরে আর বাগানে - দু ধরণের থাকার জায়গার দুরকমের বৈশিষ্ট্য, একটির সঙ্গে আরেকটির হয়তো মিল নেই, কিন্তু এই দু ধরণের থাকার ব্যবস্থা নিয়েই এই ইটাচুনা রাজবাড়ী, এটাই এখানকার বিশেষত্ব ।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর ভেতরের ব্যবস্থা আমরা মোটামুটি দেখে নিয়েছি, ঘুরে দেখেছি প্রায় পুরো বাড়ীটিই - এর আগের দুটি পর্ব জুড়ে। এখন এই শেষ পর্বে আমরা দেখবো এঁদেরই একটি প্রায় পরিত্যক্ত শিব মন্দির, আর সেই সঙ্গে জেনে নেব এখানকার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা।
শিবমন্দির - ইটাচুনা রাজবাড়ীর চৌহদ্দির বাইরে, মেন গেট-এর ঠিক বিপরীতে, রাস্তার ওপরেই আছে এঁদেরই একটি শিবমন্দির - যা আজ প্রায় পরিত্যক্ত। সেই মন্দিরে আছে একটি অদ্ভূত দর্শনের শিবমূর্তি - জটাজুটধারী মনুষ্য আকৃতির সেই শিব বসে আছেন এক পা মুড়ে একটু বিচিত্র ভঙ্গীতে, মাথার জটা পৈতের মতো বুকের ওপর নেমে এসেছে, হাতে কবচকুণ্ডল, কাঁধের ওপরে ফণা তোলা সাপ। সব মিলিয়ে মূর্তিটি বেশ বিচিত্র আর বিরল। রাজবাড়ীর গাইডের মুখে জানা গেল, বহু বছর আগে এই বংশের কেউ একজন স্বপ্নাদেশে এই মূর্তির সন্ধান পেয়েছিলেন বিহারের গিরিডির এক জঙ্গলে। কিন্তু এখানে নিয়ে এসে এই মন্দিরে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার দিনেই সেই প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু ঘটে। তাই তখন থেকেই এই মূর্তির কোনো পূজা আর হয় না, এবং মন্দিরটিও পরিত্যক্ত হয়। এর আগে “ প্রায় পরিত্যক্ত” কথাটি ব্যবহার করেছি। তার কারণ, ওই মূর্তি আর ওই মন্দিরে পূজা বন্ধ হবার বহু পরে স্থানীয় মানুষেরা এই মন্দিরের সামনের বারান্দায় একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করে তাঁর পূজা শুরু করেন। এটিও কিছুটা অভিনব ব্যাপার, কারণ সব মন্দিরেই দেবতা থাকেন মন্দিরের গর্ভগৃহে, কিন্তু এখানে সেই পূজো হচ্ছে গর্ভগৃহের বাইরে, বারান্দার চলনপথে। অথচ, মন্দিরের ভেতরে, জঙ্গল থেকে পাওয়া এখানকার আদি মূর্তিটি বসে আছেন একাকী, ভাঙাচোরা অন্ধকার ঘরে, কোনোরকমের পূজা থেকে বরাবরের জন্য বঞ্চিত হয়ে।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর খাওয়াদাওয়া - সবশেষে বলি, এখানকার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ হয়ে রাত্তিরের নৈশভোজ বা ডিনার, এখানে সব খাবারই পরিবেশিত হয়, পুরোনো দিনের বাঙালী ঘরানায়, কাঁসার থালা, বাটী, গ্লাস ব্যবহার করে। সকালে লুচি, আলুরদম, দুপুর আর রাত্তিরে কাঁসার থালার মাঝখানে সরু চালের ভাত, তারপর সেই ভাতকে ঘিরে বিভিন্ন কাঁসার বাটিতে বিভিন্ন তরকারী, সঙ্গে ডাল, মাছ, মাংস। শেষ পাতে চাটনী, দই বা মিষ্টি। সব মিলিয়ে বেশ এলাহী ব্যাপার। খাবার বেশ সুস্বাদু, কিন্তু তার স্বাদ অনেক বেড়ে যায় ওই পরিবেশ আর পরিবেশনের জন্যে। আড়াইশো বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়ীতে, আগেকার দিনের মতো কাঁসার থালা বাটিতে খাওয়া, সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতার সামগ্রিক স্বাদ কিন্তু একেবারেই আলাদা।
মোটামুটি এই হল এই রাজবাড়ী ভ্রমণের গল্প। সব কিছু ভাল ভাবে ঘুরে দেখতে আর জানতে একটু সময় লাগে, আর তাই তিন পর্বে আলাদা আলাদা করে ঘুরে দেখালাম এই বাড়ীটি, আর সামনের শিবমন্দির। এ ছাড়া, বাড়ীর বাইরে ঠিক পাশেই - প্রবুদ্ধ ভারত সঙ্ঘ নামে রামকৃষ্ণদেবের একটি সাধারণ মন্দির আছে, আর তার বিপরীত দিকে মাঠের মধ্যে আছে একটি ফাঁকা দুর্গা দালান, যেখানে দুর্গা পুজোর সময় মূর্তি গড়িয়ে সর্বজনীন পুজোর আয়োজন করা হয়। আগ্রহী ব্যক্তিরা এক ফাঁকে ঘুরে নিতে পারেন এই রামকৃষ্ণ মন্দিরটিকেও ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |