ঘুরে এলাম অরুণাচল ।
এককথায় বলতে গেলে খুব সুন্দর জায়গা । অসাধারণ অভিজ্ঞতা । প্রথমেই গ্রুপের সকলকে অনুরোধ করব একবার যান আর ঘুরে আসুন - অবশ্যই যাদের এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি । এবার আশা যাক আসল কথায়, মানে ঘোরার কথায় । অরুণাচল ঘুরতে গেলে প্রথমেই যেটা দরকার বা যেটা না হলে আপনাকে অরুণাচলে ঢুকতেই দেবে না তা হলো ILP (Inner Line Permit) । আমরা সব মিলিয়ে ষোল জনের একটি দল ছিলাম । পাঁচটি পরিবার । ১০ থেকে ১৮ র মধ্যে পাঁচ জন । একজন ৭৩+ । বাকিরা সব মধ্যবয়সী । যা কিছু করার আমি আর আমার বন্ধু (বয়েসে যদিও আমার চেয়ে ছোট) মিলেই করলাম । বন্ধু এসে বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম । ফ্লাইটের টিকিট সকলের জন্য কেটে নেওয়া হলো জানুয়ারিতে । ভ্রমণ পরিকল্পনা বা রুট প্ল্যানটা এরকম ছিল : - ৩১/০৩/১৯ - কলকাতা থেকে গৌহাটি ফ্লাইটে । ওখানে থেকে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে নেওয়া হবে । যেটা গৌহাটি থেকে গৌহাটি বুকিং করা থাকবে । গৌহাটি থেকে প্রথমে ভালুকপোং যাবো এবং রাতে ওখানেই থাকব । - ০১/০৪/১৯ ভালুকপোং থেকে দিরাং এর উদ্দেশ্যে খুব সকালে রওনা দেব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । রাতে দিরাং এ থাকব । - ০২/০৪/১৯ দিরাং থেকে তাওয়াং এর উদ্দেশ্যে খুব সকালে রওনা দেব । এখানে ০৪/০৪/১৯ পর্যন্ত থাকব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । রাতে তাওয়াং এ থাকব । এখানে তিনরাত থাকা হবে । এখানে প্রথমদিন আশপাশের দর্শনীয় স্থান দেখে নেওয়া হবে । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাবার জন্য আলাদা পাশ বা পারমিট লাগে যেটা তাওয়াং থেকেই পাওয়া যাবে । রাস্তা ঠিকঠাক থাকলে তবেই সেনাবাহিনী পাশ দেয় । পাশ পেলে সেটাও নিয়ে নেব । পরদিন বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাব যদি পাশ পাওয়া যায় । - ০৫/০৪/১৯ তাওয়াং থেকে খুব সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে বোমডিলা পৌঁছে সেখানে রাত্রিবাস করব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । - ০৬/০৪/১৯ বোমডিলা থেকে খুব সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে গৌহাটি পৌঁছে সেখানে রাত্রিবাস করব । পথে যে দ্রষ্টব্যস্হান পড়বে তা দেখে নেব । এখানে আমরা রিজার্ভ করা গাড়িটাকে ছেড়ে দেব । - ০৭/০৪/১৯ সকালে কামাখ্যা মাকে দর্শন করে বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা ফিরব । ILP বা পারমিট অনলাইনেও করা যায়, ১০০ টাকা লাগে । আমরা সল্টলেকে অরুণাচল ভবনে গিয়ে করিয়েছিলাম । ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছিলাম । তিনটে ফর্ম কিনতে হয়েছিল ১৬ জনের জন্য । ১০ টাকার ফর্মে এক একটাতে ৬ জনের নাম দেওয়া যাবে । সঙ্গে দু কপি পাসপোর্ট সাইজের ফটো, আধার কার্ড আর ভোটার আইডি লাগে । অপ্রাপ্তবয়স্ক বা যাদের ভোটার আইডি নেই বা হয় নি তাদের বার্থ সার্টিফিকেট লাগে । অরুণাচল ভবন থেকে সবকিছু জেনে ওদের কথামতো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে ফর্ম, ফটো, আধার কার্ড ইত্যাদি জমা দিয়ে এলাম । প্রত্যেকের জন্য পঞ্চাশ টাকা করে জমা দিতে হলো ( অনলাইনে যেটা একশ টাকা লাগে) । এক সপ্তাহ লাগে পারমিট পেতে । আমাদের ফোন করে জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল যে পারমিট হয়ে গেছে । সপ্তাহখানেক পরে গিয়ে সেগুলোকে নিয়ে এলাম । এছাড়াও পারমিট গৌহাটি বা ভালুকপোং থেকেও করানো যায় । তবে আগে থেকে করিয়ে নিয়ে গেলে আপনার সময় নষ্ট হবে না । পারমিট চেক করবে ভালুকপোং এ ঢোকার সময় । টিকিট আর পারমিট তো হলো । এবার গাড়ি আর হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে । ১৬ জনের জন্য গাড়ি চাই, সঙ্গে মালপত্রও থাকবে । অরুণাচল ভবনেই প্রথমে খোঁজ করেছিলাম । একতলায় পারমিট হয় আর দোতলায় একজন ভদ্রলোক আছেন যার কাছ থেকে গাড়ি আর হোটেলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলাম । সরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই । তবে উনি দুটো ট্রাভেল এজেন্সির নাম, ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন । সে দুটো ট্রাভেল এজেন্সির ঠিকানা সল্টলেকেরই । ফলে আমরা ওখানে গিয়ে খোঁজখবর করলাম । ১৬ জনের জন্য ১৭/২১/২৬ সিটের সবধরনের গাড়ির কথাই হলো । ১৭ আর ২৬ সিটের গাড়ি সহজেই পাওয়া যাচ্ছিল । কিন্তু আমরা চাইছিলাম ২১ সিটের গাড়ি যেটা নাকি সংখ্যায় খুব কম চলে । অনেকের সাথেই কথা হলো । প্রতিদিনের ভাড়া কেউ বলল ৮০০০/-, কেউ বলল ৮৫০০/- আবার কেউ চাইল ৯০০০/- টাকা । আমি ফেসবুকের ট্রাভেল গ্রুপ থেকেও অনেকের নাম ও নাম্বার পেয়েছিলাম । তাদের কেউ কেউ ট্রাভেল এজেন্ট বলেই বোধ হয়েছিল । যাইহোক অবশেষে চেনা পরিচিত একজনের দ্বারা গাড়ি ও হোটেল ভাড়া করে নিলাম । গাড়ির ভাড়া প্রতিদিন ৭২০০/- । আমরা ৭ দিনের জন্য মানে ৩১শে মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ভাড়া করে নিলাম ।
কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা দরকার । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক যাবার জন্য আলাদা পাশ লাগে । তাই সঙ্গে দু কপি ফটো, দু কপি করে আধার কার্ড ও ভোটার আইডির জেরক্স রাখতে হবে । ভোটার আইডি না থাকলে বার্থ সার্টিফিকেটের জেরক্স দু কপি । এছাড়াও সব অরিজিনাল সঙ্গে রাখতে হবে । বুমলাপাশ ও মাধুরী লেক ঘুরতে গেলে তাওয়াং থেকে আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হবে । যে গাড়িতে করে আমরা গৌহাটি থেকে গিয়েছিলাম সেসব গাড়িকে বুমলাপাশ ও মাধুরী লেকে যেতে দেওয়া হয় না । ঐ জায়গা পুরোপুরি সেনাবাহিনীর অধীনে । অতএব আপনাকে আলাদা করে গাড়ি ভাড়া করতেই হবে ।
আরেকটি কথা । সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র তো রাখবেন । এছাড়াও কোকা-৩০ ও কর্পূর রাখবেন । সেলা পাশ ১৩৪০০ ফুট, টাওয়াং ১০০০০ ফুট আর বুমলা পাশ ১৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্হিত । উচ্চতাজনিত কোনো অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্য এটা বলা । অক্সিজেন কম থাকার জন্য সমস্যা হতে পারে । কোকা-৩০ ও কর্পূর এক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী । আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রিজার্ভ করা টেম্পো ট্রাভেলারেই ছিলাম । ফলে সকালের জলখাবার, দুপুরের খাবার, বিকেলের টিফিন সব রাস্তাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে করতে হয়েছিল । সব জায়গায় আপনার পছন্দ মতো খাবার পাবেন না । সেজন্য আমরা সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে ড্রাই ফুড রেখেছিলাম । এটা রাখলে দেখবেন অনেক সুবিধা হবে ।
৩১/০৩/১৯
তিনটে পরিবার আমরা এগারোটায় গৌহাটি পৌঁছে যাই । একই ফ্লাইটে টিকিট না পাওয়ার জন্য বাকি পরিবার দুটি পরের ফ্লাইটে একঘন্টা পরে বারোটায় এসে পৌঁছাল । আমাদের গাড়ি এগারোটা থেকে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল । বার তিনেক কথাও হয় ড্রাইভারের সাথে । এরই মধ্যে আকাশ কালো করেছে । মনে হচ্ছে যেন দুপুর নয়, এখন সন্ধ্যা । এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছ অবধি যেতে গিয়ে পুরোপুরি ভিজে স্নান করে নিলাম । আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে । দুপুর সাড়ে বারোটায় আমরা গৌহাটি এয়ারপোর্ট থেকে ভালুকপোং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । বাইরে তখন বৃষ্টি হয়েই চলেছে । শেষ মুহূর্তে আমাদের ২১ সিটারের বাসের পরিবর্তে ২৬ সিটারের টেম্পো ট্রাভেলার বাস দিয়েছে । আমরা একটু আপত্তি করেছিলাম । আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ২৬ সিটারের বাস সব জায়গায় যেতে পারবে কিনা । যদিও আমাদের বলা হয়েছিল কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না । আসলে ভোটের বাজারে অনেক গাড়ি নিয়ে নিয়েছে ভোটের জন্য । বড় বাস পাওয়ার জন্য বাসে প্রচুর জায়গা । সবার মালপত্র পেছনে খালি জায়গায় আর সিটে রাখা হলো । গাড়ি চলতে শুরু করেছে । আস্তে আস্তে মজুত ভান্ডার থেকে খাবারও বের হতে লাগলো । আমরা কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে বুকিং করেছিলাম কলকাতায় (৩৫০০০/-) গাড়ি ও হোটেলের জন্য । এখানে আবার গাড়ি যিনি দিয়ে ছিলেন তাকে ২৫০০০/- টাকা দিলাম । আগে ৫০০০/- দেওয়া ছিল । সব মিলিয়ে ৫০৪০০/- টাকা দিতে হবে । বৃষ্টি কমেছে, সবার মুখ চলছে, গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে । ক্ষেত্রি অঞ্চলের খালোইবারিতে বাড়ুই লাইন হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । ডিম, মাছ,মাংস সবকিছু রয়েছে । খাবারটাও ভালোই লাগলো । এখানে অন্য একটি হোটেল অন্নপূর্ণা রেস্টুরেন্টে প্রথম গিয়েছিলাম । ১৬ জন শুনেই বলে দিল যে খাবার হবে না । খাওয়া হলো । সুন্দর ঝকঝকে রাস্তায় গাড়ি আবার তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে । বৃষ্টি বন্ধ আছে । সোয়া পাঁচটায় একজায়গায় আবার দাঁড়ালাম চা খাবার জন্য । সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমরা ভালুকপোং এ পৌঁছে গেলাম । খাওয়ার সময় বাদ দিলে মোটামুটি সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে ভালুকপোং আসতে । ভালুকপোং ঢোকার মুখেই চেক পোস্টে আমাদের পারমিট চেক করল । যা করার তা আলি মানে আমাদের ড্রাইভারই করল । ও আমাদের পারমিটগুলো নিয়ে রেখেছে । পথে আরো কিছু জায়গায় চেক করবে বলল । ওর সঙ্গে একজন হেল্পার রমেন রয়েছে যে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে । চেক পোস্ট পেরিয়েই আমাদের হোটেল ঈগল নেস্ট । টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল একটু আগেই । হোটেলে চেক ইন করে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম । হোটেলটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন । রাস্তার ওপরেই । খাবারের দরদাম ঠিকঠাক । মোটামুটি ভালোই ঠান্ডা আছে তাই সোয়েটার পরে নিতে হলো সকলকেই । আমরা ছেলেরা ক'জন বেরোলাম ঐ টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই । আশপাশে আরও হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে । বৃষ্টি আর ঠান্ডার জন্য দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে দেখলাম । রাতের খাবার ভালো করেছিল । ঠিক হলো পরদিন সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হবো । পরদিন দিরাং যাবার কথা । মাঝে একটা জায়গায় রাস্তা বন্ধ থাকবে ন'টার পর থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা । তাই তার আগে ঐ জায়গাটা পেরিয়ে যেতে হবে । ০১/০৪/২০১৯ ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙে গেল । স্নান করে তৈরি হয়ে গেলাম । হোটেলের ছাদে উঠে গেলাম চারপাশটা দেখার জন্য । গতরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে । এখন একটু ধরেছে । তবে আকাশ এখনও এমন গোমড়া মুখে বসে যা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে ঘোরাঘুরি তো মাটি হবেই তাছাড়া পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়াও বেশ বিপজ্জনক । আজ একটু পরেই আমাদের দিরাং এর উদ্দেশ্যে রওনা দেবার কথা । পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ি রাস্তা । যাক, বেশি ভেবে কাজ নেই । এখন পাঁচটা দশ । চারপাশটা বৃষ্টিস্নাত । মেঘ থাকার জন্য আলো ভালো করে ফোঁটে নি । চারিদিকে ছোটবড় পাহাড় । দূরের পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা মেঘগুলো যেন তাদের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে । সারারাত অনেক পরিশ্রম করেছে কিনা তাই বোধহয় এখন ঘুমানোর চেষ্টা করছে ।
নেমে এলাম ছাদ থেকে । নীচে গিয়ে দু'পা হেঁটে আশপাশটা দেখে নিলাম । আমরা সবাই তৈরি হয়ে গেছি । আলি আর রমেনের আরও কিছুটা সময় লাগবে । তাই ওদের কথামতো কামেং নদী দর্শনে হাঁটা লাগালাম । আমরা হাঁটতে হাঁটতে কামেং নদীর কাছে পৌঁছে গেলাম । হোটেল থেকে তিন চার মিনিটের হাঁটা পথ । কামেং নদী দৈর্ঘ্যে ২৬৪ কিলোমিটার । আগে এর নাম ছিল ভরলী নদী । এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম একটি মুখ্য উপনদী যা তেজপুরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে । নদীটা বেশ চওড়া তবে এখন জল কম । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে । কি ভদ্র, কি শান্ত এখন এই নদী ! অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন এই নদীর আশপাশ । বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ছবিটবি তুলে চলে এলাম । সকাল সকাল মনটা ভরে গেল । নদীর পাড় থেকে আসতেই চাইছিল না মনটা । সংসারী লোকজনের মনকে কখনো কখনো শৃঙ্খলে বাঁধতে হয় । পদে পদে তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় সেটা । আমিও তাই করলাম ।
বাস ছেড়ে দিল দিরাং এর উদ্দেশ্যে । দুরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার । এখন রাস্তা বেশ ভালো । চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এলাম ছয় কিলোমিটার দূরের Tipi Orchidarium । এখন ঘড়িতে আটটা । শুনশান পরিবেশ । কোনো লোকজনকে দেখা গেল না । Tipi Orchidarium এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম Orchidarium । ১৯৭২ সালে প্রায় ১১৩ একর জমি নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় । ৫০০০০ বেশি অর্কিড রয়েছে । এটি একটি রিসার্চ সেন্টারও বটে । এটা রবিবার বন্ধ থাকে । আমরা ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে সব দেখতে লাগলাম । মনে চিন্তা দোলা দিচ্ছে, রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে না তো । আলি সেই ভয়ে তাড়া লাগাচ্ছে । ভয় এমন একটা সংক্রমক ব্যাধি যে একে একে সকলের মনেই এই ভয়টা ঢুকে পড়লো নিজের অজান্তেই । যদি রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তবে কি হবে ? কতোক্ষন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে । চটপট কিছু ছবি তুলে আমাদের গাড়িতে উঠে পড়লাম । প্রকৃতি প্রেমিক যারা বা যারা এটাকে আরও ভালো করে দেখতে চান তাদেরকে বলব অনেকটা সময় নিয়ে এখানে আসবেন। দারুণ সুন্দর জায়গা । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । বেশ যত্ন সহকারে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে । হতাশ হবেন না এটুকু বলতে পারি । গাড়ি আবার ছুটতে লাগলো ঝকঝকে সুন্দর রাস্তা দিয়ে । দু পাশে পাহাড় ও জঙ্গলকে পেছনে ফেলে কামেং নদীর সাথে । অপূর্ব সুন্দর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । সবকিছু ভুলিয়ে দেয় । মনে হয় এখানেই থেকে যাই বাকি জীবনটা । পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে । দিরাং এর উচ্চতা ১০০০০ ফুট । অতএব আমাদের এবার উঁচুতে ওঠার পালা । প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল । দেখলাম সামনে আরও কিছু ট্রাক আর সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । তবে কি রাস্তা বন্ধ ? আমাদের কি এখানেই থেকে যেতে হবে ? নেমে জানতে পারলাম যে landslide হবার জন্য রাস্তা বন্ধ । বড় গাড়ি যেতে পারবে না । ছোট প্রাইভেট কারগুলো আসা যাওয়া করছে । লোকজন আছে, কাজে ব্যস্ত - রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য । রমেন দেখে এসে বলল, 'বোম ফুটবে । ইয়া বড়ো পাথর পড়ে রাস্তা আটকে দিছে । ওটা বোম দিয়ে ফুটাবে তারপর রাস্তা পরিষ্কার হবে ।' বোঝা গেল কপালে দুঃখ আছে । যাক, অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই ।
পাহাড়ের কান্না শুনেছেন ? আমি শুনেছি । অন্তত আমার তেমনি মনে হলো । জীবনে এই প্রথম শুনলাম ।
আমরা পুরুষেরা দু-তিনজন এগিয়ে গেলাম যেখানে শ্রমিকরা কাজ করছিল । দেখলাম এক বিরাটাকৃতির প্রস্তরখন্ড অর্ধেক রাস্তা জুড়ে পড়ে আছে । ওটাকে বারুদের সাহায্যে টুকরো টুকরো করার কাজে ব্যস্ত সমস্ত শ্রমিকরা । গতরাতের বর্ষায় ঐ প্রস্তরখন্ডটি বিশাল পর্বতের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে এসে অনাদরে রাস্তায় শুয়ে আছে । যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঐ শ্রমিকরা রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত । পরবর্তী কয়েক দিন আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখেছি এইভাবেই শ্রমিকরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে । তাওয়াং থেকে গৌহাটি যাওয়া-আসার পথে আরো বেশ কয়েকবার আমাদের এভাবেই দাঁড়াতে হয়েছিল । তাই সকলের কাছে অনুরোধ বর্ষাকালে এদিকে আসবেন না । আমরা যখন এসেছি সেটা বর্ষাকাল না হলেও বৃষ্টির ফলে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ধস নেমেছে দেখেছি । তবে বিশেষ কোনো অসুবিধে হয় নি । সর্বত্র শ্রমিকরা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে । পুরুষ মহিলা সমভাবে কাজ করে চলেছে । মহিলারা অনেকেই পিঠে বাচ্চা নিয়ে এই কঠিন শ্রম দান করে চলেছে । এই রাস্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে । অনবরত মিলিটারির ভারী ট্রাক, জিপ ইত্যাদির যাতায়াত দেখতে পাবেন । তাই এ রাস্তা বন্ধ হলে তাদের জন্য মুশকিল । গত কয়েকদিনের বৃষ্টির ফলে বহু জায়গায় রাস্তা ভাঙ্গাচোরা পেলাম । হঠাৎ রমেন চিল্লিয়ে বলল, 'চলেন, চলেন । এবার বোম ফুটবে । আগুন দিছে । ' দেখলাম ঐ শ্রমিকরাও হাতের ইশারায় আমাদের পালাতে বলছে আর নিজেরাও ছুটে পালাচ্ছে । দৌঁড়ে চলে এলাম গাড়ির কাছে । সবাই গাড়ি থেকে নেমে আগেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল । সশব্দে বোমাটা ফাটল । আর ঠিক তার পরই আমি পাহাড়ের কান্নাটা শুনতে পেলাম । নিকটবর্তী পাহাড় তো বটেই অনেক দূরদূরান্তের পর্বতশৃঙ্গগুলিও একটানা অনেকক্ষণ গুমরে গুমরে কাঁদল । হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন । বোমার আওয়াজের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অনেকক্ষণ চলল । আমাদের দলেরই এক সদস্য এর ভিডিও করেছিলেন যাতে কান্না থুরি শব্দটা ভিডিওতে বন্দি করতে পারেন । পরে সকলকে তা শোনালেনও । এ যেন আত্মীয় বিয়োগের কান্না । বড় পাথরটাকে টুকরো টুকরো করে সৎকার করা হলো । সব মিলিয়ে চল্লিশ মিনিট সময় নষ্ট হলো । রাস্তা পরিষ্কার হতেই আবার আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল । অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের মাঝে আমরা । চলেছি দিরাং এর উদ্দেশ্যে । পথে ছোট বড়ো অসংখ্য ঝর্ণা । কোনোটা শুকনো, কোনোটায় অল্প জল - যেমন লুমুম ফলস । কোনাটিই বেশ বড় । তেমনি একটি সবল ও স্বাস্থ্যবান ফলসের সামনে এসে আলি গাড়ি দাঁড় করালো । আমরা সকলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম । সশব্দে পাহাড় থেকে নেমে আসছে । কেমন একটা don't care ভাব । এর রূপ আমরা মনের গভীরে স্হাপন করার সাথে সাথে ক্যামেরা বন্দিও করে নিলাম ।
গাড়ি চলতে লাগল আবার । মাঝে এক-দুটো জায়গায় চেকিংও হলো । এবার এসে পড়লাম Foot Suspension Bridge এর কাছে । এখানে থেকে LOC ৯৮ কিলোমিটার মাত্র । শরীরে মধ্যে কেমন একটা রোমাঞ্চ হতে লাগলো । এটা Jamiri H.Q আর Jamiri Point এর মধ্যে অবস্হিত । টেঙ্গা নদীর ওপর । বেশ সুন্দর এই ব্রীজ । কাঠের পাটাতনের দোদুল্যমান ঝুলন্ত ব্রীজ এটা । প্রথমে একটু ভয় ভয় করলেও নিশ্চিন্তে এই ব্রীজ পেরিয়ে যেতে পারবেন । সেনাবাহিনী যেখানে আমাদের গাড়িটাকে দাঁড় করিয়েছিল সেখানে সব গাড়ি থামিয়ে সব কিছু চেক করা হচ্ছিল । আমাদের বলা হলো যে আমরা যেন জামিরি ব্রীজটা ঘুরে আসি । পাহাড়ি টেঙ্গা নদী কুল কুলিয়ে বয়ে চলেছে । কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল । ওপারে গিয়ে ব্রীজ থেকে নেমে নদীর জলে হাত ডুবিয়ে তার শীতল স্নিগ্ধতাকে স্পর্শ করে নিলাম । এতো সুন্দর জায়গা যে অনায়াসেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো যায় । আমরা যদিও কিছুসময় ঘুরে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম ।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি । গ্রুপের বন্ধুরা অনেকেই জানতে চেয়েছেন খাওয়া-দাওয়ার জন্য কেমন খরচ হয়েছে বা খাবারের কেমন দাম । আমাদের সম্পূর্ণ ভ্রমণে মানে গৌহাটি থেকে তাওয়াং এ খাবার-দাবার মোটামুটি সস্তায় হয়েছে । মাছ ভাত ১০০ বা ১২০ বা ১৫০ টাকা করে পরেছে । চিকেন ১৫০ বা ১৮০ টাকা । নিরামিষ ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে । রুটি ১০ টাকা পিস সঙ্গে সব্জি অথবা ৮০ টাকা প্লেট যাতে পাঁচটা রুটি ও সব্জি । ওমলেট কুড়ি টাকা করে এক একটা । সেদ্ধ ডিম দশ টাকা পিস । ওপরে বর্ণিত সবগুলোই প্লেট সিস্টেম বা মিল সিস্টেম । ফলে সুবিধা হলো যে ভাত, ডাল, তরকারি আপনি যত খুশি নিতে পারবেন, তারজন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না । অতিরিক্ত রুটি নিলে আলাদা পয়সা দিতে হবে । মোটামুটি ভাবে ৩৫০-৪০০ টাকার মধ্যে আপনার সারাদিনের খাবার মানে সকালের জলখাবার থেকে রাতের ডিনার সব হয়ে যাবে । তবে সঙ্গে পর্যাপ্ত ড্রাই ফুড রাখা দরকার । বেশিরভাগ সময় আপনাকে গাড়িতে কাটাতে হবে আর পাহাড়ি পথে সব জায়গায় আপনি খাবার পাবেন না । একমাত্র যেখানে বসতি আছে সেসব জায়গায় দোকান পাবেন । আবার সব জায়গায় আপনি আপনার পছন্দের খাবার পাবেন না অথবা শুনতে হবে যে খাবার শেষ হয়ে গেছে । তবে আপনি যে গাড়িতে যাবেন সেই গাড়ির ড্রাইভারা সব জানে । তাই ওরা ঠিক জায়গা মতো নামাবে খাবার জন্যে । কিছু না পেলে ম্যাগী বা ডিম সেদ্ধ ভরসা । ড্রাই ফুডের মধ্যে আমরা সঙ্গে রেখেছিলাম - মুড়ি, চিরে ভাজা, চাল ভাজা, ছোলা, বাদাম, চানাচুর, বিস্কুট, কেক, টফি বা চকলেট ( এটা উচ্চতা জনিত সমস্যায় ভালো কাজ দেয় ) । এছাড়া চা, কফি ইত্যাদিও সঙ্গে রাখা হয়েছিল । আর জলের বোতল । আজ যেমন পছন্দ মতো খাবার না পেয়ে জলখাবার হিসেবে ডিম সেদ্ধ কেনা হলো । আর কোনো কিছু কিনে খাওয়া হয় নি বা পাই নি । তবে কেউ না খেয়ে থাকে নি । সকালে বাস ছাড়ার সাথে সাথেই সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথমে চাল ভাজা আর পরে চিরে ভাজা । মাঝে একবার চা হয়েছে যেটা ফ্লাক্সে করে আনা হয়েছিল । এ যেন আমরা পিকনিক করতে বেরিয়েছি । হইহই করে সব চলেছে । প্রায় সকলের চোখ জানালা দিয়ে বাইরে পরে আছে । কেউ কিছু মিস করতে চাইছে না । প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি এ ভুখন্ড । কি নেই ? পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, পাহাড়ি নদী আছে, ঝর্ণা আছে । ওপরে নীল আকাশও আছে । এখন আর বৃষ্টির নামগন্ধ নেই । রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ । দূরে পাহাড়ের চূড়ায় কখনো কখনো জমা মেঘও দেখা যাচ্ছে । কয়েকজন বন্ধু জানতে চেয়েছেন হোটেলের ফোন নাম্বার ও গাড়ির বুকিং সম্পর্কে । এব্যাপারে আমি বলি, আপনারা আমার পুরো লেখাটা পড়ুন । অনেক কিছু জেনে যাবেন । ভালো মন্দ মিলিয়ে আছে । তবে যাই করবেন একটু যাচাই করে নেবেন । নইলে ঠকতে হবে । যেহেতু প্রায় সব টাকা আপনাকে আগেই দিতে হবে অতএব আপনি চাইলেও তখন কিছু করতে পারবেন না । মাঝে মাঝেই ভাঙ্গাচোরা বিপজ্জনক রাস্তা । সেসব পেরিয়ে দুটোর সময় একটা হোটেলে সামনে গাড়ি দাঁড়াল । নিরামিষ ভাত আর সঙ্গে ওমলেট । সেও তৈরি করে দিল । কারণ এরা একসাথে বেশি খাবার করে রাখে না । Dawa Hotel, 5 Mile । পেট পূজো করে আবার যাত্রা শুরু হলো । চারটে নাগাদ আমরা দিরাং মনেষ্ট্রিতে এলাম । এর নাম Thupsung Dhargyeling Monastery । পাহাড়ের ওপর এই মনেস্ট্রি । আয়তনে বিশাল । এখান থেকে দিরাং ভ্যালীর সৌন্দর্যে আমরা অভিভূত । মনেস্ট্রির গেট দিয়ে ঢুকে পা চালিয়ে আরো ওপরের দিকে উঠতে হলো । পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, সুন্দর সাজানো গোছানো । মন ভরে গেল । এটা অবশ্যই দেখবেন । দেওয়ালের গায়ে অসম্ভব সুন্দর পেইন্টিং । সাজানো বাগান, গাছ, রং বেরঙের ফুলের টব । খুব যত্ন নেওয়া হয় দেখেই বোঝা যায় । দূরের পাহাড়ের মাথায় শেষ বিকেলের নরম রোদ্দুর আজকের মতো বিদায় জানানোর অপেক্ষায় । চারিদিকের এই অপরূপ সৌন্দর্য মনকে কোন অজানা দেশে নিয়ে চলে যায় । ভেতরে ভগবান বুদ্ধর সাথে দলাই লামার ছবিও রয়েছে । বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এখান থেকে চললাম Hot Water Spring দেখতে । এখানে যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না আলি ও রমেনের । আমরা জোর করাতে অনিচ্ছা সহকারে নিয়ে গেল । অনেকটা নামার পর এই হট ওয়াটারটা পাওয়া গেল । আমরা যখন ক'জন আরো নীচে নদীর ধারে চলে গেলাম । অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে ছিলাম । সেটা মালুম হলো ওঠার সময় । দিরাং এর উচ্চতা ৪৯১০ ফুট । এখানে ঠান্ডা বেশ আছে । হট ওয়াটার স্প্রিং দেখে সাড়ে পাঁচটায় আমাদের হোটেলে এসে পৌঁছালাম । হোটেলের নাম Hotel Snow Lion । চেক ইন করে আমরা রাতের খাবারের অর্ডারও দিয়ে দিলাম । এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে । এরা কখনোই অতিরিক্ত খাবার বানায় না । তাই অরুণাচলের সবজায়গায় দেখলাম খাবারের অর্ডার মোটামুটি সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটায় না দিলে আপনি খাবার নাও পেতে পারেন ।
০২/০৪/২০১৯
আজ তাওয়াং যাবার কথা । পথে সেলাপাস । সেলাপাসে সেলা লেক হলো মূল আকর্ষণ । সকাল দেখে বোঝার কি কোনো উপায় আছে দিনটা কেমন যাবে ? না বোধহয় । রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল । খুব ভোরে উঠে গিজারের গরম জলে শরীরটাকে তরতাজা করে তৈরি হয়ে নিলাম । বাকিরা সব তৈরি হচ্ছে । আমি সোজা ছাদে । রাতে তাপমাত্রা ৪/৫ ডিগ্রি থাকলেও এখন ৬/৭ এর মধ্যে আছে । মিষ্টি মধুর ঠান্ডায় সকালের নরম রোদ যেন শরীরের ওপর এক মোলায়েম চাদর জড়িয়ে দিয়েছে । হোটেলের চারপাশে অনেক প্রাইভেট বাড়ি । অনেক বাড়িতেই কমলালেবুর গাছে অসংখ্য কমলালেবু ঝুলছে । দেখলেই মনে হয় ছুটে গিয়ে কটা তুলে আনি । সেটা সম্ভব নয় । তাই মনের ইচ্ছেটাকে মনেই চেপে রাখতে হলো । দূরে গতকালের দেখা মনেস্ট্রিটাও পরিস্কার দৃশ্যমান । আশেপাশে মেঘ গায়ে জড়িয়ে পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা তো আছেই - যেন বলছে, এসো, দেখো, তোমাদের জন্যই তো আমরা অপেক্ষা করে থাকি । হোটেলের ছাদটা বেশ বড়ো । দলের অনেকেই তখন ছাদে এসে নানান পোঁজে ছবি তুলতে ব্যস্ত । সেলাপাসের উচ্চতা ১৩৪০০ ফুট । গুগলে দেখলাম সেখানে তাপমাত্রা -২ ডিগ্রি । ছটায় -৩ ডিগ্রি ছিল । এখন আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়বে । আলি বলল, বরফ দেখার আশা কম । গতকাল যারা ফিরেছে তাদের কাছ থেকে সে জেনেছে । কিছুটা হতাশ হলাম । সেলাপাসে না পেলেও বুমলাপাসে বরফ পাবো সেই আসায় মনকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে । বরফ না দেখতে পেলেও সেলা লেকটাকে তো দেখতে পাবো এই আশায় রইলাম । আটটা নাগাদ আমাদের যাত্রা শুরু হলো সেলাপাসের দিকে । দিরাং থেকে ৬৩ কিলোমিটার। সকালে বেরোনোর আগে একরাউন্ড জলখাবার সকলের হয়ে গেছে । নিজেদের আনা খাবার দিয়ে সেটা হয়েছে । আমাদের গাড়ি চলেছে দিরাং নদীর পাশ দিয়ে । ১৭ কিলোমিটার দূরে Nyukmadung War Memorial এ আমরা প্রথম থামলাম । সময় ৮:৪০ মিনিট । এখানেই একজন মহিলা আর্মি অফিসার তার ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন । ওনার কাছ থেকে এই war memorial সম্পর্কে বেশকিছু কথা জানলাম । বেশ উঁচু লম্বা এই অফিসার, কলকাতার মেয়ে । দশ বছরের ওপর উনি এখানে আছেন । ওনার সাথে আমাদের পরে আবার Jaswant Garh War Memorial এ দেখা হয় তখন উনি আমাদের ওটার ইতিহাসও বলছিলেন । সে কথায় পরে আসব । এই Nyukmadung War Memorial স্হানটিতে ১৮ নভেম্বর ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের মধ্যে এক সাংঘাতিক লড়াই হয়েছিল । প্রচুর হতাহত হয় । সেই সেনাদের স্মরণে এটি তৈরি । সুন্দর সাজানো গোছানো । নানান বৃক্ষ দ্বারা যত্ন করে সাজানো হয়েছে । মিনিট পঁচিশেক পরে আবার গাড়ি চলতে লাগল । পাহাড়ি রাস্তায় মনোরম শোভা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি সেলাপাসের দিকে । মনে মনে ভাবছি সেলা লেক কেমন দেখব । মাথার ওপর রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ বুকে কিছু সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে । অনেকটা শরতের আকাশ বলে ভ্রম হতে পারে । বহুদূরের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে বরফ জমে আছে দেখলাম । তবে সেটা কিছু কিছু জায়গায় । আলি বলল, ঐদিকেই আমরা যাবো । আধঘন্টা চলার পর একজায়গায় দাঁড়ালাম জলখাবার খাওয়ার জন্য । খাওয়া সেরে আবার চলতে লাগলাম । ধীরে ধীরে মাথায় বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো অনেক কাছে চলে আসছে । বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । মনে হচ্ছে ওরা যেন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে । আমরা ক্রমশ বরফের সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ছি । পাহাড়ে আবহাওয়া নিমেষেই চেঞ্জ হয় । রোদ আর নেই । অল্প অল্প স্নো ফল হচ্ছে । পাহাড়ের গায়ে বরফ তো রয়েইছে, এবার অনেক জায়গায় দেখলাম গাছের মাথায় অল্প স্বল্প বরফ । আরও বিষ্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল ভাবতে পারি নি । রাস্তার দুপাশে প্রস্তরখন্ড ও ঢিবির মাথায় বরফ জমে রয়েছে দেখলাম । সবাই উল্লসিত হলাম । সেনাবাহিনীর গাড়ি চলেছে আগে পিছে । অল্প অল্প স্নোফল হয়েই চলেছে । আলি ওয়াইপার চালিয়ে রেখেছে । আরও উঁচুতে চলে এসেছি । এখন আর রোদ্দুর নেই, বরং মেঘ জমেছে । ১১:৪০ মিনিটে সেলাপাস পৌঁছলাম । সবাই বাস থেকে নেমে পড়েছি ।
চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ । এক জায়গায় দেখলাম কিছুটা জায়গায় জল তবে সেটা লেকের অন্তর্গত নয় বলেই বোধ হলো । স্নোফলের তীব্রতা আগের চেয়ে বেড়েছে । দলের ছেলে-বুড়ো, মহিলা, ছোটোরা আনন্দে উত্তেজনায় লাফালাফি, দাপাদাপি করতে শুরু করে দিয়েছে । আমরা একদল কিছুক্ষণ নেচেও নিলাম । এভাবে স্নোফল চাক্ষুষ করব এতোটা আশা আমরা কেউই করি নি । রাস্তা থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে সেলা লেকের দিকে । কিন্তু কোথায় লেক । সমস্ত বরফে ঢাকা । লেকের চতুর্দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা । পায়ে চলার রাস্তা আছে বলে বোধ হলো । এখন যদিও কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । শুধু বরফ আর বরফ । আমাদের পুরো দলটাই আনন্দে উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে গেছে । কখনো সকলে মিলে ড্যান্স করছে, কখনো রাস্তার পাশে ঘন বরফের ওপর শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে । ছোটোরা মুঠো মুঠো বরফ নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে । প্রায় সকলের ক্যামেরাই সমানতালে ছবি তুলে চলেছে । ছবি তুলতে তুলতে হাত ঠান্ডায় জমে লালচে হয়ে অসাড় হয়ে যাচ্ছে । গ্লাভস বের করে পরে নিয়ে গরম করছি, পরক্ষণেই গ্লাভস খুলে ছবি তুলছি ।
এক মূহুর্তও মিস করা চলবে না । ধীরে ধীরে ওয়েদার আরও খারাপ হলো । আকাশ কালো হয়ে গেছে । তীব্র গতিতে স্নোফল হতে শুরু করেছে । আলি তাগাদা দিতে লাগল । আগে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে বিপদে পড়তে হবে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের সকলকেই গাড়িতে উঠে পড়তে হলো । ঘড়িতে তখন প্রায় একটা । গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে দিয়েছে । আলির হাত খুব ভালো । পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আছে । রাস্তায়ও বরফ পড়েছে । তাই অতি সন্তর্পণে তাকে চালাতে হচ্ছে, বিশেষ করে টার্নিংগুলোত । পাহাড়ের ঢালে ঘন বরফ জমেছে । পাহাড়ের গায়ে গাছের পাতাগুলোতে বরফ জমছে । একটু আগে দেখা সবুজ বনানী সফেদ রং এ ঢেকে যাচ্ছে । আমরা এগিয়ে চলেছি । এ এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যা সারা জীবন মনে থাকবে । মুষলধারে বৃষ্টি হলে যেমন চারিদিকে আবছা সাদাটে হয়ে যায়, দূরের জিনিসও অস্পষ্ট হয়ে যায় তেমনি হয়েছে । এখানে বৃষ্টির পরিবর্তে বরফ পড়ছে । শত সহস্র পেঁজা তুলো যেন আকাশ থেকে নেমে আসছে । যে যেভাবে পারছে গাড়িতে বসে বসেই ছবি তুলে চলেছে । সকলেই উত্তেজিত, আনন্দে টগবগ করছে । এমনভাবে সেলাপাসকে পাব তা কেউ ভাবতে পারে নি । আর কিছু না দেখে এখান থেকে ফিরে গেলেও কোনো লোকসান হবে না, পয়সা পুরো উসুল । মিনিট চল্লিশ চলার পর একটা ওয়াটার ফলস পেয়ে নেমে পড়লাম । অঝোরে স্নোফল হয়ে চলেছে । তার মধ্যেই সকলে নামলাম ।
জায়গাটার কি নাম জানি না । গাড়িটা যেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল সেখানেই একটা রেস্টুরেন্ট । উল্টো দিকে ঝর্ণা । প্রায় সকলেই পড়ি কি মরি করে ঝর্ণার দিকে এগিয়ে গেল । চারিদিকের পাহাড়, বৃক্ষরাজি মাথা নত করে বরফ বর্ষণের মোলায়েম আদর উপভোগ করছে । ঈশ্বর যেন অকৃপণ হাতে সমস্ত আশীর্বাদ নিঃশব্দে তাঁর নিজের হাতে গড়া প্রকৃতির বুকে উজার করে দিচ্ছে । কি সুশৃঙ্খল ! কি নীরব তার অভিব্যক্তি ! ঘন বরফের আস্তরণে ধীরে ধীরে সবকিছু ঢেকে যাচ্ছে । সেই বরফ বর্ষণের মধ্যেই আমরা ঝর্ণার কাছে গিয়ে তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । দারুণ সুন্দর অথচ দুরন্ত । উচ্ছল জলরাশি তীব্র গতিতে পর্বতশৃঙ্গের মাথা থেকে ঢাল বেয়ে সশব্দে এসে ভূমি স্পর্শ করে উন্মাদ গতিতে ছুটে চলেছে । যেন তার খুব তাড়া আছে । মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে অসংখ্য পরী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে দ্রুত গতিতে । যেমন তাদের রূপ তেমনি তাদের সৌন্দর্য । সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে কতোবার মনে মনে ভাবতাম এই ঢেউটাই শেষ ঢেউ নয়তো ! মনের ভয় মনে ঢাকা পরে যেত পরবর্তী ঢেউগুলোতে । তেমনি এখানেও ভয় হচ্ছে । মনে মনে প্রার্থনা করছি সেই অসীম শক্তিধরের উদ্দেশ্যে যেন এই রূপের বৈচিত্র্য আদি অনন্তকাল থাকে । এই রূপ সুধা পান করে সকলের জীবন ধন্য হোক ।
সেলাপাসে বরফে অতোসময় থাকার জন্য সকলের শরীর তখন গরম কিছু খেতে চাইছিল । কিন্তু গাড়ি যেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল সেই রেস্টুরেন্টে চা পেলাম না ।লাঞ্চের সময়ও হয়ে গিয়েছিল । সেটাও তাড়াতাড়ি তৈরি হবে না এতোজনের জন্যে । দু ঘন্টা সময় লাগবে লাঞ্চ তৈরি করে দিতে । অগত্যা আবার আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটতে লাগলো । বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা ১৪০০০ ফুট উচ্চতার JaswantGarh War Memorial এ পৌঁছে গেলাম । এটা ২১ কিলোমিটার সেলা পাস থেকে । এখন সময় বেলা দুটো । অবিরাম স্নোফল হয়েই চলেছে । এখন যেন তার ঘনত্ব ও তীব্রতা আরও বেড়েছে । কিন্তু তাতে কি । কেউ এই নিয়ে ভাবছেই না । গাড়ি দাঁড় করানো মাত্র সকলে লাফিয়ে নেমে পড়লো । এক সুবৃহৎ প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে পড়লাম সকলে । মাথা ও শরীরে কুচো বরফ জমছে । রাইফেলম্যান জশয়ন্ত সিং এর স্মৃতি রক্ষার্থে তারই নামে এই war memorial । মর্মর মূর্তি রাখা আছে । তার বিছানা রয়েছে, সেখানে তার ব্যবহৃত পোশাক, কম্বল সমস্ত কিছু আজও যত্ন সহকারে রাখা । এগুলো রেগুলার কাঁচা, ধোয়া হয় । এখানেই আবার আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল সেই মহিলা সেনা অফিসারের । তিনি এর ইতিহাস বর্ণনা করলেন । ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের মধ্যে যে যুদ্ধ এখানে হয়েছিল । সেই যুদ্ধে ৪র্থ গাড়োয়াল রাইফেলস এর সৈনিক জসওয়ন্ত সিং রাওয়াতের বীরত্বের কাহিনী । একা তিনি চিনা সেনাবাহিনীকে ৭২ ঘন্টা আটকে রেখেছিলেন । ৩০০ চিনা সৈনিক তার হাতে নিহত হয় । তিনি যে একা এখানে আছেন ও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তা যাতে বুঝতে না পারে তারজন্য তিনি ক্রমাগত এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে চলে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন । প্রথমে চিনা সৈনিকরা মনে করেছিল এখানে অনেক ভারতীয় সেনা আছে । সেই কারণে যুদ্ধটা ৭২ ঘন্টা স্হায়ী হয়েছিল । স্হানীয়দের কথা অনুযায়ী তাকে সেলা ও নুরা নামে দুজন পাহাড়ি গ্রাম্য মেয়ে খুব সাহায্য করেছিল । তারা তার খাদ্য, অস্ত্রসস্ত্র এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে নিয়ে যেতে সাহায্য করে । সেই দুই বোনের নামে সেলা পাস ও নুরানাং ভ্যালির নামকরণ হয় । পরে যখন চিনা সেনারা বুঝতে পেরেছিল যে জসয়ন্ত একা আছে তখন প্রচুর সেনা তাকে ঘিরে ফেলে । সেই দুই বোনও মারা যায় । জসওয়ন্তকে ধরে চিনা সেনারা তার শিরচ্ছেদ করে মুন্ডু চিনে নিয়ে যায় । শুনতে শুনতে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে । মাত্র ২১ বছর বয়সী এই সৈনিক আমাদের ভারতমাতার রক্ষার জন্য অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয় । আজও এখানে সকলের বিশ্বাস সে এখনও জীবিত । একদিন সে ফিরে আসবে । সে এখনও আমাদের ভারতমাতার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরায় ব্যস্ত আছে । তাওয়াং এলে এটা অবশ্যই দেখবেন । খুব ভালো লাগবে । সেই '৬২ সালের যুদ্ধে চিনা সেনারা ভারতীয় ভুখন্ডের এই স্হান পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল । পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেটা পুনরায় উদ্ধার করে । এরপর আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম বাঙ্কারের কাছে যাবো বলে । প্রথমে কয়েকটা সিঁড়ি । এরপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম । চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো অসংখ্য বাঙ্কার - ছোট, বড়ো, মাঝারি বিভিন্ন সাইজের । কয়েকটির মধ্যে আমরা ঢুকলাম । আজ আমরা ট্যুরিস্ট হিসাবে এখানে এসে ঢুকে দেখছি । বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে অসম সাহসী সেই বীর সৈনিকের বীর গাথা । অদম্য সাহস আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলে বলীয়ান ইনি আমাদের সকলের কাছে প্রণম্য । বেশ খানিকক্ষণ ঘুরেটুরে ফিরে এলাম । এখানেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত একটি ক্যান্টিন আছে যেখানে গরম চা আর গরম জল বিনা পয়সায় খাওয়া যায় । মাথায় আর শরীরের বরফ ঝেড়েঝুড়ে ঢুকে পড়লাম সেখানে । সকলেই গরম চা খেতে ব্যস্ত । শরীরটাকে তো গরম করতে হবে । পরে এখানেই আমরা ধোসা খেয়ে লাঞ্চ সারলাম । সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এই ক্যান্টিন । দাম সস্তা । ইডলি, ধোসা, প্যাটিস ইত্যাদি নানান খাবার পাওয়া যায় ।সেনাবাহিনীর লোকজনও এখানেই খাওয়া দাওয়া করছে দেখলাম । খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তিনটের সময়ে Jaswantgarh war memorial থেকে রওনা দিয়ে চারটে নাগাদ নুরানাং ফলসে পৌঁছে গেলাম । Jaswantgarh war memorial থেকে দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার । আমরা বেশ খানিকটা নীচে নেমে আসার ফলে এখানে স্নোফল নেই, পরিবর্তে টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়ে চলেছে । কেউ কেউ তাই ছাতা মাথায় নেমে পড়ল । এটা জাং শহরের সন্নিকটে অবস্হিত । গাড়ি যেখানে দাঁড় করিয়েছিল সেখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি পেড়িয়ে নীচে নামতে হলো । এই ফলস থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় । তার পাইপলাইন ইত্যাদি নজরে এলো । এটা জাং বা জং ফলস নামেও পরিচিত । এই ফলসের জলরাশি ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট উচ্চতা থেকে পড়ছে । এটি সেলাপাস থেকে তৈরি হওয়া নুরানাং নদীর জল যা এখানে ফলস হয়ে পড়ে তাওয়াং নদীতে গিয়ে মিশেছে ।
অপূর্ব এই জলপ্রপাত । চারিদিকে পাহাড় । বর্ষাস্নাত বনানী যেন আরও সবুজ রংয়ে সেজেছে । সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মাথা থেকে তীব্র গতিতে নীচে পাথরের উপরে পড়ার ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় চারপাশে একটা কুয়াশার মতো আস্তরণ তৈরি হয়েছে । সেই জলকনা এসে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে । তাতে কি ! সকলে বাঁধন ছেড়া উদ্দাম আনন্দে বিভোর । ঝর্ণা, তা থেকে উৎপন্ন পাহাড়ি নদী, বিশাল বিশাল পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে ছোট ও মাঝারি প্রস্তরখন্ডকে টপকে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে জলরাশি । স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল । মনে হলো এখানেই থেকে যাই । এই রূপ, রস ফেলে কোথায় যাব ! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা আপ্লুত । ছোটোদের আনন্দ দেখার মতো । বোঝার উপায় নেই কার আনন্দটা বেশি - ছোটোদের না বড়োদের । সকলের ক্যামেরাই ব্যস্ত । কিছু যেন মিস হয়ে না যায় । এই অপূর্ব সুন্দর জায়গাতেই 'কোয়লা' ছবি র শুটিং হয়েছিল । শাহরুখ ও মাধুরী অভিনীত তানহাই গানের শুটিং এখানে হয় । আমি বৃষ্টির থেকে বাঁচতে ছাতা নিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু ছাতা মাথায় নিয়ে ছবি তুলব কিভাবে ! তাই ছাতা একজায়গায় রেখে আশপাশের বিষ্ময়কর সৌন্দর্যকে ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । প্রায় ঘন্টাখানেক থেকে ওপরে উঠে এলাম । প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে । আরও ৩২ কিলোমিটার দূরে তাওয়াং । গাড়ি ছুটতে লাগলো ।
তাওয়াং এ যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে । টিপটিপ বৃষ্টি হয়েই চলেছে । অবাক বিস্ময়ে দেখলাম রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির মাথা, কাঁচ সব ঘন বরফের আচ্ছাদন । রাস্তার ধারে ধারে বরফ জমে আছে । টিনের চালার বাড়িগুলোর মাথায় বরফ জমে রয়েছে । ওয়েদার একেবারে ঠান্ডা ঠান্ডা, কুলকুল । হোটেলে চেক ইন করার পর শুনলাম এসময় এখানে বরফ পড়ে না । কিন্তু এবছর পড়েছে । কপালটা ভাল বলতে হবে । তখন কি জানতাম যে পরদিন খারাপ খবর শুনব । যাইহোক আমরা ছেলেরা চারজনে বেড়িয়ে ৫০০ মিটার দূরের এক বাঙ্গালি হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে এলাম । তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে । বিছানায় শুয়ে মনে হোল কেউ যেন বিছানায় জল ঢেলে রেখেছে । উলিকট, সোয়েটার সব চাপিয়ে দুটো মোটা কম্বল গায়ের দিয়ে শুয়ে পড়লাম । মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে তাপমাত্রা দেখলাম -৩ ডিগ্রি । ঠান্ডা কাকে বলে মালুম হচ্ছিল ।
ভ্রমণ - অরুণাচল (৩১শে মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিল, ২০১৯) - ৬ষ্ঠ পর্ব/১
আজ ৩রা এপ্রিল । সকালে উঠে ব্যালকনিতে এসে মন ভরে গেল । চারিদিক রোদে ঝলমল করছে । তবে গতকালের চেয়ে বরফের ঘনত্ব যেন একটু বেশি বলেই মনে হলো । তারমানে রাতে আরও স্নো-ফল হয়েছে । চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ধারে, টিনের চালায়, কাছে ও দূরের পাহাড়ে সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বরফ জমে আছে । বেলা বাড়লে নিশ্চয়ই সব গলে যাবে । এবার খোঁজ নিতে হবে রাস্তার অবস্থা কেমন । ঠান্ডাটা জবরদস্ত আছে । আজ ও কাল আমরা তাওয়াং এর সব কিছু দেখে নেব এমন একটা সাদামাটা পরিকল্পনা ছিল, সকলের যেমন থাকে আর কি । যেমন দেখার কথা লোকাল সাইট সিয়িং, তেমনি যাওয়া ও দেখার কথা বুমলাপাস, মাধুরী লেক, পি টি সো লেক । হোটেলের ম্যানেজার তাপসবাবু গতকাল রাতে বলেই দিয়েছিলেন যে বুমলাপাস ও মাধুরী লেক যাবার আশা নেই বললেই চলে । বুমলাপাস যেতে হলে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হয় । রাস্তা খোলা থাকলে তবেই সেনাবাহিনী পারমিশন দেবে । যদি অতিরিক্ত স্নোফলের জন্য রাস্তা বন্ধ থাকে তাই উনি প্ল্যান বি মোতাবেক অন্য একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন । আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার নিয়ে বুমলাপাস, মাধুরী লেক বা পি টি সো লেক যাওয়া যাবে না । নতুন করে লোকাল ছোট গাড়ি (টাটা সুমো, ইনোভা ইত্যাদি) নিতে হবে - এটা আমাদের জানাই ছিল । যেহেতু আমরা ষোলজন তাই দুটো গাড়ি ভাড়া করতে হবে । মাধুরী লেক পর্যন্ত যেতে দিলে এক একটা গাড়ি ৩৫০০/- টাকা নেবে । আর যদি যেতে না দেয় তবে পি টি সো লেক পর্যন্ত ৩০০০/- টাকা করে এক একটা গাড়ি নেবে । বুমলাপাস গেলে আরো বেশি (আনুমানিক ৫০০০/- টাকা) । আমরা তাপসবাবুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম । যেহেতু গত দুদিন খুব স্নোফল হয়েছে তাই রাস্তা বন্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি । বুমলাপাস তো নয়ই, মাধুরী লেক, পি টি সো লেকও যেতে দেয় নি সেনাবাহিনী । যদি আমরা শেষ পর্যন্ত বুমলাপাস যেতে নাই পারি তবে আগামীকাল আমরা Zemithang যাবো ভাবছিলাম । Zemithang (৮৫ কিলোমিটার) যেতে এক একটা গাড়ি ৬০০০/- টাকা করে নেবে বলল তাপসবাবু । এদিকে গতকাল রাতেও খুব স্নোফল হয়েছে বলেই জানতে পারলাম । আমাদের গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না । আলিরা চেষ্টা করে চলেছে । এতো ঠান্ডায় বেচারা গাড়ির কি দোষ । সেও জমে বরফ । যদিও এখন আমরা যাবো না । আমরা যখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে মাধুরী লেক কেন আমরা পি টি সো লেকও যেতে পারব না তখন আমরা ভাবছিলাম ফার্স্ট হাফটা কি করব । আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ন'টার সময় লোকাল গাড়িতে বেড়িয়ে পি টি সো লেক ইত্যাদি ঘুরে একটার মধ্যে ফিরে আসার কথা । লাঞ্চ করে আবার দুটো আড়াইটার মধ্যে বেড়িয়ে আশেপাশের দ্রষ্টব্য স্হানগুলো আমাদের টেম্পো ট্রাভেলারে ঘোরার কথা । এদিকে আমরা চাইছিলাম গাড়ির ভাড়া একটু যাচাই করে নিই । তাপসবাবু সঠিক ভাড়া বলছে কিনা জানা দরকার । একটি গাড়ির সাথে কথা বলে ভাড়াগুলো জেনে গেলাম । তাপসবাবু সবগুলোতেই ৫০০/- থেকে ১০০০/- টাকা বাড়িয়ে বলেছেন । হয়তো তার নিজের কমিশন । Zemithang এর ক্ষেত্রে ৫০০০/- টাকা চাইল এই গাড়ির ড্রাইভার যেখানে তাপসবাবু ৬০০০/- টাকা চাইছিলেন । সে বলল যে ওরা যে ভাড়া বলবে হোটেল সব সময় তার চেয়ে ৫০০-১০০০/- টাকা বাড়িয়ে বলে কমিশন খাবে । যাইহোক শেষ পর্যন্ত এই গাড়ির ড্রাইভারদের থেকে জেনে Hanging Bridge বা Chagzam bridge যাওয়া ঠিক করলাম । এখানেও তাপসবাবুর পাঠানো সুমো/ইনোভা গাড়ি এক একটা ৩০০০/- টাকা করে চাইল । কিন্তু অন্য গাড়ি বলল ২৫০০/- টাকা ভাড়া । এগুলো বলার একটাই কারণ যাতে আপনারা বুঝতে ও ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন গাড়ি বুক করার সময় । যাইহোক ২৫০০+২৫০০ মানে ৫০০০ টাকায় দুটো গাড়ি বুক করে ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী Hanging Bridge দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । মিনিট ৪৫ এর জার্নি । আজ ঠান্ডার জন্য আমি স্নান করি নি । গিন্নি অবশ্য স্নান করে নিয়েছে । গতকালের সেই হোটেল জয় গুরুতে সকালের জলখাবার খেয়ে সাড়ে নয়টায় বেরিয়ে দশটা পনেরো নাগাদ পৌঁছে গেলাম । প্রথম দলাই লামার একজন শিষ্য টাংটন গ্যালোপো যিনি ছিলেন একজন স্থপতি, দার্শনিক এবং আয়রন চেইন সেতু প্রস্তুতকারী তিনি এই ব্রীজটি তৈরি করে ছিলেন । তিনি হিমালয় অঞ্চলের 100 টিরও বেশি লৌহ সেতু নির্মাণের কাজ করেছিলেন বলে জানা যায় । ১৪২০-১৪৩০ সালের মধ্যে তাওয়ং-চু নদীর উপর এই সেতুটি তৈরি করেছিলেন । আজ থেকে এতো বছর আগে পঞ্চদশ শতকের এই অত্যাশ্চর্য ব্রীজটি আমাদের সকলকে অবাক করে দিল । রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে বেশকিছুটা নিচে নেমে যেতে হয় । সম্পূর্ণ লোহার এই ঝুলন্ত ব্রীজটি । ব্রীজের তলা দিয়ে তাওয়ং-চু নদী তন্বী মেয়ের মতো পাহাড়ি পথ বেয়ে নাচতে নাচতে চলেছে । কল কল করে বয়ে চলা জলরাশি ছোট, বড়, মাঝারি সমস্ত ধরণের প্রস্তরখন্ডকে অবলীলায় ডিঙিয়ে সদর্পে বয়ে চলেছে । চারিদিকে পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে তার পথ । পরিস্কার ঝকঝকে জল । লোহার ঝুলন্ত ব্রীজে উঠেই প্রথমে একটু ভয় ভয় করবে । ব্রীজটা দুলছে । ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি বলে কথা । দুরে দু একজনকে যেতে দেখে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে চললাম । বেশ মজাদার । ততক্ষণে ভয়ডর সব হাওয়া ।
ব্রীজের অপর প্রান্তে পৌঁছে গেলাম । কিন্তু ওদিকে নামা গেল না । গেট বন্ধ রয়েছে । পঞ্চদশ শতকের এই প্রাচীন লোহার ঝুলন্ত ব্রীজের পাশেই আধুনিক কালের একটি স্টিলের ব্রীজ রয়েছে । যাঁরা পুরনো ব্রীজে উঠতে ভয় পাবেন তাঁরা আধুনিক কালের ব্রীজে উঠতে পারবেন । তবে পঞ্চদশ শতকের ব্রীজে আমরা বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা প্রায় সকলেই উঠলাম । ভয়ের কোনো কারণ নেই । প্রায় ছ'শত বছর আগের তৈরি এই ব্রীজটি দেখে আমরা এককথায় বিস্মিত ও চমৎকৃত হলাম ।
ফিরে চললাম সেই হোটেল জয়গুরুতে । দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে এসেছিলাম । এই হোটেলটি বেশ ভালো । পুরনো মার্কেট এরিয়ায় অবস্হিত । দামও ঠিকঠাকই লেগেছে আমাদের । ফিরে এসে ফোন করে জানতে পারলাম আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার গাড়ি এখনো ঠিক হয় নি । স্টার্ট হচ্ছে না । সকাল থেকে চেষ্টা করে মিস্ত্রী যাকে পেয়েছে সে দুপুর একটা দেড়টার সময় আসবে । এবার কখন গাড়ি ঠিক হবে , আদৌও ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না । যার কাছে আমরা গাড়ি ও হোটেল বুক করেছিলাম তার সাথে যোগাযোগ করে অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলা হলো । তাপসদা মারফত আলিরা আমাদের জন্য দুটো টাটা সুমো বুক করে দিল । টাকা গাড়ির মালিক দেবে । আমরা লোকাল সাইট সিয়িং দেখতে বেরিয়ে পড়লাম । সকলের লাঞ্চ করা আগেই হয়ে গেছিল । প্রথমে আমরা বুদ্ধ পার্কে এলাম । গৌতম বুদ্ধের এক সুবিশাল স্ট্যাচু । দূরের পাহাড়ের গায়ে জমা বরফ মুক্তোর মালা মতো ঝুলছে । অপূর্ব সে দৃশ্য । কখনো কখনো এক টুকরো কালো মেঘ সুয্যি মামাকে ঢেকে দিচ্ছে । এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যস্হল তাওয়াং মনেস্ট্রির উদ্দেশ্যে । তাওয়াং মনেস্ট্রি, ভারতের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম (লাসার Potala Palace এর পর ) এই সুদৃ্শ্য মঠটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার বা ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্হিত । এটি Gaden Namgyal Lhatse নামেও পরিচিত । মূল প্রার্থনা গৃহে ঢুকে পড়লাম । বিশাল দরজা নিজেরাই খুলে নিয়েছি । বাঁদরের উপদ্রবের জন্য দরজাটি বন্ধ রাখা হয়েছিল । প্রায় ৮ মিটার উচ্চতার বিশাল বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে এই প্রার্থনা গৃহে । সর্বত্র এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজমান । বৌদ্ধ স্হাপত্যের ঐতিহ্যগত শৈলী, দেওয়াল জুড়ে সুন্দর সুন্দর স্কেচ ও রঙিন চিত্র ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে যা মন ভরিয়ে দেয় । মনেস্ট্রি থেকে হিমালয় পর্বতমালার তায়াংচু ভ্যালির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যাবে । এটার বয়েস প্রায় চারশত বছর । বিশাল এলাকা জুড়ে এটি অবস্হিত । প্রায় শ'তিনেক ভিক্ষুকের আবাসস্থল এটি । এখানে একটি লাইব্রেরী আছে যেখানে ঢুকতে গেলে কুড়ি টাকার টিকিট কাটতে হবে । সময়াভাবে আমরা আর সেটা দেখি নি । তাওয়াং এর অন্যতম মূল আকর্ষণ এই মনেস্ট্রি । এবার আমরা এলাম Ugyenling Monastery তে । এখানে ৬ষ্ঠ দলাই লামা Tsanyang Ghatso জন্মে ছিলেন । তাই এটি ৬ষ্ঠ দলাই লামা জন্মস্থান নামেও পরিচিত । এটি তৈরি করেছিলেন Ugyen Zangpo ১৪৮৭ খ্রীষ্টাব্দে । তাওয়াং শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্হিত, তাওয়াং ওয়ার মেমোরিয়ালের কাছাকাছি । সাধারণ ভাবে ট্যুরিস্টরা এটা দেখতে আসেন না । সবাই তাওয়াং মনেস্ট্রি দেখেই চলে যান । ১৭০০ শতকে এটা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে এটি ছোট আকারে পরিনত হয়েছে । গেট দিয়ে ঢুকতে ডানহাতে একটি গাছ আছে যা ৬ষ্ঠ দলাই লামা নিজের হাতে বসিয়ে ছিলেন বলে জানা যায় । এবার আমরা এসে পড়লাম Dorjee Khandu Memorial Mesume আর Jangchub Chorten । ৯ই এপ্রিল ২০১৭ সালে চতুর্দশ দলাই লামা এটির উদ্বোধন করেছিলেন । Dorjee Khandu ছিলেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী । ৩০শে এপ্রিল ২০১১, হেলিকপ্টারে তাওয়াং থেকে ইটানগর যাবার পথে দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল । তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এটি তৈরি করা হয়েছিল । মিউজিয়াম বন্ধ থাকার জন্য আমরা ঢুকতে পারি নি । তাতে অবশ্য খুব একটা মন খারাপ হলো না । কারণ সুন্দর সাজানো গোছানো ও পরিস্কার এই পার্কের মধ্যে Jangchub Chorten রয়েছে । কিভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল তা কেউ আমরা বুঝতেই পারলাম না । দূরের পাহাড়ের গায়ে পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ রোদ আর মেঘের খেলা বড়ই আনন্দদায়ক । এরপর চলে এলাম Thegtse Sang-ngag Choekhorling Monastery । এই মঠটি অনন্য । এটি তাওয়াং এ খিন-মী গ্রামে অবস্হিত । এটি বৌদ্ধধর্মের ভিন্ন একটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যা নিংমা সম্প্রদায় নামে পরিচিত । এই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা লম্বা চুল রাখতে পারে ও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে । এখানে একটি ছোট্ট চিড়িয়াখানা মতো আছে । সেখানে হরিণ, খরগোশ, রাজহাঁস ইত্যাদি আছে দেখতে পেলাম । অনেক বড়ো জায়গা নিয়ে এটি । মূল উপসনালয়টি একটু ভিন্ন প্রকৃতির যা অন্য মনেস্ট্রি থেকে আলাদা । খুব সুন্দর ও রঙিন চিত্রে ভরা সমস্ত দেওয়াল । দূরের পাহাড়ের গায়ে ধীরে ধীরে মেঘ জমছে । দেখে মনে হবে ওরা যেন খুব ব্যস্ত । নিজের পছন্দ মতো বন্ধু খুঁজে নিয়ে গল্প গুজবে মশগুল । তাই পাহাড়ের কোলে লেপ্টে পড়ে আছে । নীচে তাওয়াং চু ভ্যালির অপরূপ সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয় অনায়াসে । এমন সুন্দর জায়গায় বারে বারে এলেও মন ভরবে না । এরপর চলে এলাম তাওয়াং War Memorial এ । ১৯৬২ সালে ইন্দ-চিনের যুদ্ধে সকল শহীদদের (২৪২০ জন) স্মরণে এই ৪০ ফুটের রঙিন স্মৃতিসৌধটি নির্মিত ও উৎসর্গকৃত । এটি Namgyal Chorten নামেও পরিচিত । এর নকশাটি একটি বিশাল স্তুপ আকৃতির । ঢোকার মুখেই এক রঙিন সুবিশাল গেট পেলাম । এটি পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন । একজন সেনা অফিসার আমাদের সকলকে একত্রিত করে এর সম্পর্কে সবিস্তারে বললেন । আমরা সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তুলে নিলাম । এখানে দু-একটি ছাড়া সব জায়গায় ছবি তোলা যাবে । বোর্ফস কামান, বুদ্ধ মূর্তি, ইত্যাদি দিয়ে সাজানো জায়গাটা । একেবারে ঝকঝকে চকচকে । সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু জায়গায় সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ । এতোজন ভারতীয় বীর মৃত্যু বরণ করেছেন ৬২' যুদ্ধে ! স্যালুট জানাই তাদের সকলকে । এখানে দুটি হল আছে যার একটিতে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রসহ নানান সামগ্রী সংগৃহীত করে রাখা হয়েছে । অন্য হলঘরটিতে লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয় । লাইট এন্ড সাউন্ড শো যে হলটিতে হয় তার প্রবেশদ্বারটি পাশে রয়েছে আলাদা করে । আমরা যখন সেখানে পৌঁছোলাম তখন প্রথম শো'য়ের টিকিট না থাকার ফলে দ্বিতীয় শো (৬:৩০ মিনিট) এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় রইল না । প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বেশি সময় বাইরে থাকা মুশকিল । তবে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ব্যবহৃত ঘরে আমাদের সকলকে বসতে দিল । ঠিক সাড়ে ছ'টার একটু আগেই টিকিট দেওয়া শুরু হলো । দশ বছরের ওপর প্রত্যেকের জন্য তিরিশ টাকা করে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম । ১৯৬২ সালের সেই ইন্দ-চিনের যুদ্ধের উপর এটি দেখানো হলো । বেশ চমকপ্রদ অনুস্ঠান । অনেক অজানা কথা জানা হলো । তাওয়াং এর অন্যতম আকর্ষণ এই স্মৃতিসৌধটি এবং অবশ্যই লাইট এন্ড সাউন্ড প্রোগ্রামটি । আমাদের গাড়ির ড্রাইভারদ্বয় গাড়ি নিয়ে চলে গেছিল । ফোন করার সাথে সাথেই তারা আবার এসে আমাদের নিয়ে হোটেল জয় গুরুতে পৌঁছে দিল । রাতের খাবারের জন্য আগেই বলা ছিল । খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম । রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য বুমলা পাস, মাধুরী লেক ও পি টি সো লেক যাওয়া হবে না এ যাত্রায় । তাই আগামী কাল Zemithang যাওয়া ঠিক করলাম । সেই যে গাড়ি বলেছিল ৫০০০/- টাকা নেবে তাকেই বলে দেওয়া হয়েছে । সকাল ৬:৩০ মিনিটে বেরোতে হবে । যেতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে । যতক্ষন বাইরে আছি বা সোয়েটার, জ্যাকেট পরে আছি কোনো অসুবিধে নেই । কিন্তু ঘরে ঢুকে বিছানায় শোবার কথা চিন্তা করলেই ভয় হয় । সমস্ত কিছু মনে হচ্ছে বরফ জলে ভেজা । রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাও বাড়তে শুরু করেছে । তবে আজ আর রাস্তায় বরফ জমে থাকতে দেখি নি গতকালের মতো । টেম্পারেচার এক অথবা দুই হবে । কিন্তু মনে হচ্ছে তার চেয়েও কম । যাই হোক ঈশ্বরের নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম । কাল তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে যে ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |