লাদাখের রিং পোঁচে বিমানবন্দরে যখন উড়োজাহাজের চাকা ছুলো তখন ঘড়িতে ঠিক সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিট । দিল্লি থেকে লেহ শহরে আসতে সময় নিয়েছে প্রায় ১ ঘণ্টা। বিমানের ভেতর বসে শুনতে পেলাম বলছে বাইরের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী, তাই গায়ের টি শার্টের উপর চাপিয়ে নিলাম নরম জ্যাকেটটা আর বিমানের বাইরে আসতেই দূর ধূসর পাহাড়ের শীতল রুক্ষ হাওয়ায় কেঁপে গেল শরীর । যেদিকে চোখ যায় শুধু খয়েরী রুক্ষ ধূসর পাহাড়ের সারি যার মধ্যে সূর্যের প্রথম আলো মিশে তৈরি করেছে এক বিচিত্র পাহাড়ি নেশা। কনকনে হাড় হিমকরা শীতল রুক্ষ বাতাস, দিগন্তবিস্তৃত ধূসর পাহাড়ের সারি, মাথার উপর অসীম নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা আর তার ছায়া এসে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে, ভারতের সবচেয়ে উঁচু বিমানবন্দরে তথা লেহ শহরে আপনাকে স্বাগত ।
ব্যাগপত্র নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখি সারি সারি গাড়ী, তারমধ্যেই বেশ টিকালো নাক অনেকটা ওয়াসিম আক্রমের মত দেখতে গাড়িচালকের গাড়ীতে চললাম লেহ শহরের ভিতরে। আমার মত বোহেমিয়ানরা আগে থেকে কিছুই ঠিক করে রাখেনা এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি এদিক ওদিক ঘুরে ঠাই হল ইরফান গেস্ট হাউসে। এখানে থাকার দুটো কারন পাশেই অনেক রেস্তোরাঁ তাতে অনেক বিদেশী খাবার পাওয়া যায় আর ঘরের ভাড়াও খুব সস্তা আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু গেস্ট হাউসের ভিতরের একটা আপেল গাছ তাতে ছেয়ে আছে লাল টুকটুকে আপেল। ফ্রুট জুস, দই চিজ লেতুশপাতা দিয়ে তৈরি salad চিকেন কিমা দিয়ে বানানো sandwich সাথে পাঁঠার কলিজার ডিপ frayed কিমা, ডিমের পোঁচ, সাথে হট চকলেট। ইস্রায়েলি এই ডিশ শেষ করতে অনেকসময় লেগে গেল। যেহেতু দিল্লি থেকে লেহ মাত্র ২ ঘণ্টায় এসেছি এতটা উচ্চতায় তাই আজ বিশ্রাম পাহাড়ি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে acclimatization. দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং বহু পাহাড়ে ট্রেক করে এইটা জেনেছি পাহাড়ে গিয়ে আপনাকে আগে তার পরিবেশ তার উচ্ছতার সাথে নিজের শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে তারপর অন্য কাজ। আজ তাই লেহ শহরে একটু হাঁটাহাঁটি, দুপুরে লেহ প্রাসাদ এক্সপ্লোর আর বিকেলের দিকে শহরের মাঝে অবস্থিত মনাস্ত্রিতে নিজেকে মিশিয়ে দেবো পাহাড়ি আধ্যাত্মিকতার সাথে। কারন পরশু থেকে শুরু হবে মারখা ভ্যালি ট্রেক তার আগে কাল ইতিহাস প্রসিদ্ধ লেহ শহরের বিখ্যাত গুম্ফা গুলোকে আবিস্কার করার পালা। পরেরদিন সকালে জাসুং গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে বলল-today is your day man, Lets explore leh the city of castles.যাত্রা শুরু করার আগে সামনের বুদ্ধ মূর্তির দিকে তাকিয়ে নিজের মনকে একাগ্র করার চেষ্টা করছিলাম, সামনে দুজন বিদেশি ধ্যানে সম্মোহিত হয়ে হারিয়ে ফেলেছে কালের সিমা। মনে মনে বলছিলাম- অহংকার নয়,হিংসা নয়,ego নয়, মানুষকে ভালোবাসো প্রান খুলে পৃথিবীর উষ্ণতা নয় মনের উষ্ণতা বাড়ুক।
দাখকে বলা হয় city of gumphas বুদ্ধের দেশ,তাই লক্ষ্য ছিল ৩ টে অতি প্রাচীন শাশ্বত গরিবান্বিত হেমিস,থিক্সে আর সে গুম্ফা। প্রথমেই আমাদের গাড়ি ছুটল হেমিস monastryr পথে,পাশে দেখা হল সিন্ধু নদের সাথে। এগারো দশকের আগে স্থাপিত এই হেমিসের ইতিহাস আজও আমাদের স্তব্ধ করে দেয়, শোনা যায় প্রভু যীশুও এখানে এসে বৌদ্ধ ধর্মের শান্তির পবিত্রতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। গুম্ফার ভিতরের মিউজিয়াম টা দেখতেই হবে, এছাড়াও প্রভু রিং পচেকে সম্মান করে সারা পৃথিবী খ্যাত হেমিস উৎসব অসাধারণ। লামাদের নৃত্য ও তাদের গভীর মন্ত্রোচ্চারণ আপনাকে পাহাড়ের বুকে প্রশান্তির বানী শুনাবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি লাল বস্ত্র পরা সব লামারা ব্যাস্ত নিজেদের কাজে, যেহেতু নভেম্বরের শেষের দিক তাই বেশ টাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, হটাত শরীরে স্পর্শ করল স্নেহের পরশ। এক সৌম্যদর্শন বৌদ্ধ লামা আমাকে পরিয়ে দিল মোটা পশমের চাদর। শুনছিলাম প্রাচীন এই মনাস্ত্রি ১৬৭২ সালে রাজা সেন গে নেমেগাল নতুন করে এই গুম্ফা সংস্কার করেছিলেন। বিদায়ের পথে খয়েরী পাথরের বুকে সাদা হেমিস মনাস্ত্রি হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।
Hemis monastery থেকে আমাদের গাড়ী ছোটা শুরু করলাম ২৫ কিলোমিটার দুরের থিক্সে মনাস্ত্রির পথে। লেহ শহরের গর্ব এই থিক্সে গুম্ফা প্রায়১১৯০০ ফুট উঁচুতে সিন্ধু নদের উপত্যকার গায়ে অসংখ্য স্তুপ, থাংকা,দেওয়ালে আকা প্রতিকৃতি নিয়ে তৈরি। ১৫ শতাব্দীর শেষের দিকে সংপা বলে একজন ধর্মগুরু তার এক অনুগামী সেরাব জাংপকে একটি আমিত্যর মূর্তি ও নিজের রক্ত দিয়ে সেই মূর্তিকে স্থাপন করতে বলেন, পরবর্তী কালে জাংপ সেই মূর্তি লাদাখের রাজাকে দান করলে রাজা খুশী হয়ে জমি দান করেন এবং সেখানেই এই থিক্সে গুম্ফার কাজ শুরু হয়। এই গুম্ফার প্রধান আকর্ষণ মৈত্রেয় বুদ্ধ। ৪৯ ফুটের এই বিশাল বুদ্ধ মূর্তি লাদাখের অন্যতম।
থিক্সে গুম্ফার ইতিহাস গায়ে মেখে আমরা ছুটলাম সে গুম্ফার পথে,লেহ শহরের দক্ষিণে ১৫ কিমি দূরে এই গুম্ফার স্থাপনকাল প্রায় ১৬৫৫ সাল। মানালি থেকে লেহ আসার পথে সড়কপথে এই গুম্ফা পরে। shey ছিল লাদাখের প্রাচীন রাজধানী কেউ কেউ বলে এই গুম্ফার বয়েস নাকি হেমিস গুম্ফার থেকেও বেশী। থিক্সে গুম্ফা থেকে ধুলোমাখা শীতল মরুভুমি আর তার মাঝে শ্বেতশুভ্র chorten পেরিয়ে অনেকে আসে সে গুম্ফাতে। লেহ শহরের প্রাচীন ইতিহাস বহন করে এই তিন গুম্ফা, ইতিহাসে বুঁদ হয়ে আমরা চললাম শান্তি স্তূপের পথে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে। হোমাগ্নি ঘোষ ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |