সাত সকলে পাটনি টপের ঠান্ডায় গরম গরম ফুলকো লুচি সহযোগে আলুর তরকারি দিয়ে সকালের খাওয়া সেরে আমরা রেডি হয়ে নিলাম পরবর্তী গন্তব্যস্থল পহেলগাঁও যাবার জন্য। এতো সুন্দর একটা হোটেল আর ততোধিক সুন্দর একটা জায়গা ছেড়ে আসতে মন না চাইলেও যেতে হবেই, তাই মনোকষ্ট নিয়েই উঠে পড়া বাসে। প্রায় ঘণ্টা আটেকের একটা লম্বা জার্নি কিন্তু আশপাশের সৌন্দর্যের কারনে সেটা আমরা সবাই বেশ উপভোগ করছিলাম। রাস্তায় পড়লো কুখ্যাত অনন্তনাগ, গাইড বলছিলেন এই সময় আমরা যেন একটু সাবধানে থাকি আর বাস থেকে যেন ছবি না তুলি। দেখছিলাম যে শহরটা কিন্তু খুব সুন্দর আর বর্ধিষ্ণু। চওড়া রাস্তা, বাড়ি ঘরগুলো ভীষণ সুন্দর আর প্রতিটাই আলাদা আলাদা রকমের, তবে দোতলা তিনতলার বেশী উঁচু কোনো বাড়ি বিশেষ চোখে পড়লো না। কোনো গন্ডগোলের চিহ্নও দেখতে পেলাম না, সেটা আমাদের জন্য ভালোই হোলো। এবার রাস্তার ধারে পড়তে লাগল মাথায় বরফের সাদা টুপি পড়া নাম না জানা সব পর্বতশৃঙ্গ, বাসের মধ্যে তখন কে কিভাবে সেই সব দৃশ্য ক্যমেরাবন্দি করতে পারে তার উত্তেজনা। যত গাড়ি এগোচ্ছে তত পাহাড়গুলো কাছে চলে আসছে। এবার রাস্তার অন্য পাশে দেখা দিলো লিডার নদী, সূর্য্যের আলোয় চিক চিক করছে তার জলধারা আর সে চলেছে তার নিজের ছন্দে লাফাতে লাফাতে। ছবি কি পারে এ দৃশ্য ধরে রাখতে, তবে চেষ্টা করতে তো আর কোনো দোষ নেই। এদিকে বাসের মধ্যে আমরা ব্যতিব্যস্ত সবার সেই চেষ্টার চোটে। এক দিকে পাহাড় আর অন্য দিকে নদী দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম পহেলগাও। এই হোটেলটা আগেরটার মতন ভালো না হলেও একদম লিডার নদীর ধারে আর সামনেই বিরাট পাহাড়, জানলার পর্দা সরালেই অপূর্ব দৃশ্য। রাস্তায় নামার আগেই আমরা ঘেরাও হয়ে গেলাম শালবালা আর আখরোটবালাদের ভীড়ে এরা আমাদের জন্য হোটেলের নিচে অপেক্ষা করছিল আমরা বাস থেকে নামা ইস্তক। এতো সস্তায় এতো ভালো মাল যে আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয় সেটা আমাদের বুঝিযেই ছাড়বে। তবে সামনেই আছে অনেক দোকান, সবার নামের শেষে "শাল ফেক্ত্রী"। মেয়েদের আর রাখে কে, শুরু হয়ে গেলো কেনাকাটা। অতএব রাস্তায় নামা, কিন্তু সামনের চৌমাথায় পৌছানোর আগেই দেখি আকাশের মুখ ভার। কালো মেঘ জমছে সাদা পাহাড় চূড়ার আশেপাশে। নেমে গেলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমরা কোনোরকমে দৌড়ে হোটেলে ফিরলাম। রাস্তা ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলো, ঠান্ডাও পড়তে লাগল জাঁকিয়ে। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলার পর্দা সরাতেই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। সামনের পাহাড়টার পুরো মাথাটা ঢেকে রয়েছে বরফে, অবিস্ম্ণরণীয দৃশ্য। আজ আকাশ পরিস্কার, আস্তে আস্তে আলো ফুটতে শুরু করলো, বরফের উপর সেই আলো পড়তে মনে হলো যেন পাহাড় গুলোর মাথায় আগুন ধরে গেছে। এ জিনিস আগে কখনও দেখি নি। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা আলাদা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ঘুরতে প্রথমে আরু ভ্যালী - সবুজ মখমলের মতন ঘাসে ঢাকা বিরাট এক প্রান্তর, একদিক ঘেরা চীনার গাছে আর অন্য দিকে দাঁড়িয়ে বিরাট পাহাড় যার মাথা ঢাকা সাদা বরফে, শুনতে পেলাম এখানে শুটিং হয়েছে প্রচুর জনপ্রিয় হিন্দী ফিল্মের। ছবি তোলা সাঙ্গ করে সেখান থেকে বেরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম বেতব ভ্যালি। এখনেই শুটিং হয় বেতাব সিনেমার। জায়গাটা কিন্তু অপূর্ব, সবুজ ভ্যালির মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে লিডার নদী। দূরে দেখা যাচ্ছে বরফে মোড়া পাহাড়শ্রেণী, সিনেমার শুটিং হয়েছিল বা এখনো হয় বলে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটা কাঠের বাড়ি। সেগুলো দেখতেও যত সুন্দর আবার নদীর ধারে সবুজ ঘাসের উপর সেগুলো হয়ে উঠেছে আরো মনমুগ্ধকর। ঘুরে বেরিয়ে 100/- টাকা টিকিটের পুরটাই উসুল। তাই ফেরার রাস্তাতেও গাড়ির মধ্যে থেকেও চললো ছবি তোলার পর্ব। এরপরের গন্তব্যস্থল চন্দন বাড়ি। অমরনাথ যাত্রার হাঁটা পথের শুরু এখান থেকে। পাথুরে রাস্তায় একটু এগিয়েই চোখে পড়লো বরফ। এই ট্যুরে আমাদের এই প্রথম বরফ দর্শন, যদিও ধুলোয তাতে ছোপ পড়েছে কিন্তু তাতে কি বরফতো। চললো দৌড়া দৌরি আর একটু উঠেই নামার সময় সব পড়তে লাগলো ধপাধপ। গুঁড়ো বরফ দারুন পিছল হলেও আছাড় খেয়েও উৎসাহের কোনো কমতি নেই কারো। এখান থেকে আমাদের ফেরা হোটেলে আর তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বের হলাম বাজার করতে। শুনতে পেলাম যে এখানে জিনিষ পত্রের দাম শ্রীনগরের তুলনায় কিছুটা সস্তা। ফলে জা হওয়ার তাই হোলো, সব দোকান বন্ধ হবার পর সবাই ফিরল হোটেলে। আগেরবার যেখানে ছিলাম সেটা খুঁজে না পেলেও স্মৃতি কিছুটা সাথ দিচ্ছিলো মনে পড়ে যাচ্ছিলো অনেক কিছু। তবে পহেলগাঁও এক কথায় অসাধারণ। রাতটা এখানে কাটিয়ে এবার যেতে হবে শ্রীনগর॥ সেটা জানাব এর পরের তৃতীয় পর্বে ....
পহেলগাঁও থেকে প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের বাস জার্নি করে পৌছলাম শ্রীনগরে। রাস্তায় পড়লো সদ্য চালু হওয়া চোদ্দ কিলোমিটার লম্বা সেই সুড়ঙ্গ পথ যেটা উদ্বোধন করেন আমাদের PM। এতে আমাদের চলার রাস্তা কমে গেলো বেশ খানিকটা। রাস্তা অপূর্ব পাহাড় আর নদীতে মেলানো। হু হু করে গাড়ি চলেছে মখমলের মতো সমান রাস্তা দিয়ে। প্রচন্ড রোদ কিন্তু এখানের নিয়মে বাসের জানলায় পর্দা দেওয়া যাবে না তাই বাসের জানলায় সঙ্গের শাল টাঙ্গিয়ে কোনো রকমে সামাল দেওয়া গেলো ওই কড়া রোদের। বাসথেকেই দেখতে পেলাম এক জায়গায় প্রচুর লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট ব্যাট বিক্রি করছে, গাড়ি দেখতে পেলেই এগিয়ে আসছে জানলার কাছে, জানলাম এখানেই এগুলো তৈরি হয়। সারা রাস্তায় প্রচুর মিলিটারি পাহারা দিচ্ছেন কিন্তু কেউ আমাদের অহেতুক বাস থামিয়ে বিরক্ত করলেন না, একবারে গিয়ে বাস দাঁড়ালো পামপুরের একটা বড় দোকানের সামনে। শুনেছিলাম এইখানেই চাষ হয় কেশরের, দোকানে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের ড্রাই ফ্রুট সঙ্গে কেশর আর শীলাজীত। ওরা জানালেন যে কেশরের ফুল ফোটে oct - nov মাসে। অতএব কেনা হোলো ডিবেতে প্যাক করা কেশর, দাম প্রতি গ্রাম 250/-।
শ্রীনগরের হোটেলটা একেবারে ডাল লেকের পাশেই কিন্তু ঘরের জানালা দিয়ে ডাল লেক দেখা যায়না। আমরা অক্লান্ত তাই এতটা জার্নির পরেও মাল পত্র রুমে রেখেই ওই দুপুর রোদে আমরা সোজা ডাল লেকের সামনে। ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম প্রায় 40বছর আগে দেখা স্মৃতির ডাল লেক। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে প্রচন্ড রোদের মধ্যেই আমরা দর দস্তুর করে উঠে পরলাম একটা শিকরাতে। শিকরায রাজোর মতন বসে ভেসে চললাম ডালের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে চললো পুরনো স্মৃতি রোমন্থন। আশে পাশে চলে আসছে লোকাল শিকারায ভেসে বেড়ানো দোকান, তাতে পাওয়া যাচ্ছে তাজা ফুল, ঠান্ডা আইসক্রিম, পোড়ানো ভুট্টা, কেশর প্রভৃতি। আমরা কিনব না আর বিক্রেতারাও নাছোড়, চলেছে আমাদের পাশাপাশি। আমাদের আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল কারুর সঙ্গে কড়া কথা না বলার জন্য, তাই আমরা হাঁসি হাঁসি মুখেই ওদের প্রত্যাখ্যান করছিলাম। আমাদের শীকারার মাঝিও ততক্ষণে আমাদের ব্যপারটা বুঝে গিয়ে ছিল তখন সেও তার লোকাল ভাষায় এই প্রত্যাখ্যানে আমাদের সাহায্য করছিলো। হটাৎ সে বোট দাঁড়করালো লেকের মাঝে একটা বড় বোটের গায়ে, কিনলো চায়ের মতো কি একটা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওটা কাশ্মিরী চা ''কাবা", শুনে আমার গিন্নীও নিলেন এক কাপ। আমাদের সামনেই জাফরান, বাদাম ও কিছু মশলা মিলিয়ে তৈরী হোলো কাবা আর সেটাতে চুমুক দিয়ে বৌ -মেয়ে দুজনই ফিদা। আমরা যেখান থেকে শীকারায উঠলাম সেটা ডাল ক্যানাল আর তার পরের বিরাট অংশটা হচ্ছে ডাল লেক। জলে কিন্তু একটা পঁচা দূর্গন্ধ আর জলের তলায় প্রচুর শ্যেওলা। তবে শুনতে পেলাম যে সরকার দুটো বিরাট বিরাট মেশিন চালিয়ে লেকের শ্যাওলা পরিষ্কার করছেন। কাজ শেষ হলে লেকটি বেশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। লেকের ধারে ও মাঝে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের হাউস -বোট আমরা চললাম সেগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে। কিছু কিছু জায়গায় জলে নোংরা এতো বেশী যে তোর ওপর চাষ আবাদ হচ্ছে, তাকে নাম দেওয়া হয়েছে hanging garden। রয়েছে মিনা বাজার, যেখানে বড় বড় হাউস বোটের উপর তৈরি হয়েছে দোকান আর সেখানে বিক্রি হচ্ছে কাশ্মিরী কাজের নানা জিনিষ পত্র, দাম কিন্তু একটু বেশীই। সব ঘুরে ফিরতে ফিরতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তখন ডালের আরেক রূপ। নিকষ কালো লেকের জলে তখন ঝলমল করছে হাউস বোটের আলো তৈরি করেছে এক অপার্থিব আলো ছায়া। এই সব কিছু ধরে রাখলাম মনের মিণিকোঠায় আর চেষ্টা করলাম তার কিছু ধরে রাখতে ছবির মাধ্যমে॥ পরের পর্ব আবার পরে
আজ 02-06-2018 শ্রীনগর বন্ধ, কিন্তু আমরা আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী বাসে উঠে চললাম শোনমার্গ। গন্ডগোলের কথা মাথায় রেখে একটু সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম, রাস্তা ঘাট একদম ফাকা ফলে গাড়ি ছুটলো সাঁই সাঁই করে। প্রায় ঘণ্টা চারেকের জার্নি, মাঝে দু-এক বার গাড়ি থামলেও কিছু টহল দেওয়া মিলিটারী ছাড়া কিছুই চোখে পরে নি। বেলা বারোটা নাগাদ পৌছালাম শোনমার্গ। চারিদিক সবুজে সবুজ এমনকি বাড়িগুলোর মাথাও সবুজ, পাহাড়ী ঢালে বাড়ি গুলাকে লাগছে খুব সুন্দর। মাথার উপর কটকটে রোদ, শুনলাম বরফ পেতে গেলে যেতে হবে '0' পয়েন্ট। সেটার জন্য ভারা নিলাম লোকাল জীপ। জীপ উঠতে লাগল পাহাড়ের উপরে, একদিকে সবুজ পাহাড়ী ঢাল আর তারপরেই বরফে ঢাকা পাহাড়। রাস্তায় যে বরফ ঢাকা পিক গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে সেগুলো চলে এলো একেবারে হাতের মুঠোয়। আর তারপর রাস্তার দুধারে শুরু হোলো বরফের আস্তরণ। জমে থাকা বরফে পড়েছে ধুলোর প্রলেপ ফলে আমরা ব্যপারটা বুঝতেই পড়ছিলাম না। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতেই হাতের মুঠোয় ওই বরফ তুলে আমাদের হাতে দিতেই আমাদের হইচই শুরু। তখন কারুর যেন আর তর সইছে না গাড়ি থেকে নামার জন্য। তবে আর একটু এগিয়েই জীপ এসে দাঁড়ালো পাহাড়ের নিচের একটা ফাঁকা প্রান্তরে, সামনে সাদা বরফের রাজ্য। গায়ে গরমের জামা চাপিয়ে পায়ে গামবুট পরে সবাই নেমে পড়লাম বরফে। কি মজা, এর জন্যেই তো এতো দূর আসা। পায়ের তলায় ঠান্ডা বরফ আর মাথার উপর গনগনে রোদ, সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ঘেমে ভিজে যাচ্ছি কিন্তু গরম জামা রাখতে যেতে হবে সেই জিপের কাছে। অতটা সময় নষ্ট করতে মন চাইছে না, তাই অত গরমেও গায়েই রইল সব কিছু। ঘণ্টা খানেক বরফে কাটিয়ে ড্রাইভারের ডাকে আসতে মন না চাইলেও ফিরে আসতে হোলো জিপে। তারপর আবার শ্যোনমার্গএ ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা ধরলাম ফেরার রাস্তা। আজ কিন্তু বরফ দেখে মন ভরে গেছে। ফেরার পথে বাসের ড্রাইভারকে অনেক জপিযে ঘুরে নিলাম হজরত বাল মসজিদ, এখানে রাখা আছে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের একটা চুল যেটা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। আমরা যখন ওখানে পৌঁছেছি তখন ওখানে চলেছে নামাজ পাঠ, তাই আমাদেরকেও ঢুকতে হোলো রুমাল দিয়ে মাথা ঢেকে। ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেল, তখন পড়ন্ত বিকাল। যাওয়া ও আসার দুই বারই বাস গিয়েছিল ডাল লেকের গায়ের রাস্তা ধরে তাই প্রাণ ভরে দেখে নিলাম ডালের রূপ। কালকের ঘটনার জেরে আজ শ্রীনগর বন্ধ কিন্তু কাপড় জামার বাজার বসেছে ডাল লেকের গায়ের রাস্তা বরাবর, যদিও নেটও বাজার দুটোই বন্ধ রয়েছে। কাল শ্রীনগরে আমাদের শেষ দিন, বাকি আছে মোঘল গার্ডেনগুলো ঘুরে দেখা আর বাজার করা। এগুলো জনাবো পরের পর্বে
কাশ্মীর ভ্রমণের শেষ অংশটা আর সময় মতো লেখা হোলো না কেবল মাত্র নিজের অলসতায়। যাইহোক সেই ব্যাপারে এখন জানাচ্ছি। শ্রীনগরের শেষ দিনের সকালের জল খাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মোঘল গার্ডেন গুলো ঘুরতে। ডাল লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে চলার শুরু। তবে কিছুটা গিয়েই বাস ডানদিকের একটা রাস্তা ধরে পৌঁছালো চশ্মেশাহীর সামনে। এখন সব মোঘলগার্ডেনে ঢোকার জন্য টিকিট লাগে, তাই টিকিট কেটেই লম্বা সিঁড়ি দিয়ে উঠে লাল পাথরের গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম বাগানে। সুন্দর ফুলে ঘেরা সাজান বাগান, দেখে মন জুড়িয়ে যায়। কত যে সিনেমার শুটিং হয়েছে এই সব বাগানে তার আর ইয়ত্তা নেই। এখানে একটা জলের উৎস আছে যাতে সেরে যায় অনেক পেটের অষুখ, আমরা অবশ্য সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করিনি। মাথার উপর তখন গনগনে সূর্য্য, অনেকেই ঘুরছেন ছাতা মাথায়। তাতেও পুরো বাগানটা ঘোরা প্রায় অসম্ভব তাই কিছুটা ঘুরে বেরিয়েই নেমে এসে বাসে বসে বিশ্রাম নিলাম। দেখলাম বয়স্ক যাত্রীদের অনেকেই একই পথের পথিক। এর পর নিষাদ বাগ, শালিমার বাগ ঘুরে হেঁটে হেঁটে আর সিঁড়িতে ওঠা নামা করে করে আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। সব বাগান গুলোই বিরাট বিরাট আর ফুলের গাছ দিয়ে সুন্দর করে সাজান আর সব বাগানের মাঝ বরাবর আছে একটা জলের ধারা আর তাতে রয়েছে অগুন্তি ফোয়ারা। এগুলো এমন ভাবেই তৈরি যে সবসময় জল বয়েই চলেছে। বিকালটা রাখা ছিল কেনাকাটার জন্য। ডাল গেটের বাজারটাও অবশ্য আমাদের হোটেলের কাছে, আর হোটেলের পাশেই রাস্তার ধারে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বসে যায় জমজমাট বাজার পাওয়া যায় কাশ্মিরী কাজ করা শাল, কাজ করা গরম কাপড়ের সালোয়ার পিস, সোয়েটার, জ্যাকেট প্রভৃতি। চলে দর দস্তুর, মেয়েদের আবার তাতেই আনন্দ। ফলে সহজেই যোগ হয়ে গেলো আর একটা বাড়তি লাগেজ। দলের কয়েকজন ওখান থেকেই প্লেনে ফিরে গেলেন কলকাতা কিন্তু আমরা যাব কাটরা হয়ে, voishna devi দর্শন করে। পরের দিন সকালে ঘণ্টা আটেকের বাস জার্নির শেষে আমরা পৌছালাম কাটরা, এবার চিন্তা পাহাড়ে উঠে দেবী দর্শনের। দেখেছিলাম ওখানে হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে আর তার টিকিট পাওয়া যায় অনলাইনে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেটা ম্যানেজ করতে না পেরে চিন্তা ছিলো আমার গিন্নীকে নিয়ে কেননা ওর হার্টের অপারেশান হয়ে গিয়েছে আর আমাদের কারুরই অতটা হাঁটার অভ্যাস নেই। যদিও অনলাইনে দেবী যাত্রার ছবি দেখে দেখে হেঁটে ওঠার জন্য কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেছিলাম। তবুও মনে ভয় একটা ছিলই। কাটরার হোটেলটি খুব আরামদায়ক, ac গুলোও ভালো কাজ করছে কিন্তু আমরাতো রাত্রে হাঁটবো তাই ওদিকে আর তাকাচ্ছিলাম না। আমি কলকাতার থেকে অনলাইনে আমাদের সবার যাত্রা পরচি নিয়েছিলাম কিন্তু সেটা কোনো কাজে আসলো না, তাই আমাদের সবাইকে হেঁটে গিয়ে ছবি তুলিয়ে নতুন পরচি নিতে হোলো। একটু কম খেয়ে রাত নটা নাগাদ হোটেল থেকে অটো নিয়ে পৌছালাম বানগঙ্গা চেকপোস্টে, অত রাতেও প্রচুর লোক চলেছেন দেবী দর্শনে। পরচিতে ছাপ মাড়িয়ে আমরা হেঁটে উঠতে লাগলাম দেবী দর্শনে, আর ঘোড়াবালারা দর হাঁকচে ঘোড়া প্রতি দুহাজার করে কেবল যেতে। ওরা এতই বদমাইশ যে বলার কথা নয়, আমাদের সঙ্গে এঁটে আছে এটুলির মত। কিছুক্ষন চলার পর রাস্তার দুদিকে শুরু হোলো বিভিন্ন জিনিষের দোকান, পাওয়া যাচ্ছে খাবার দাবার, লাঠি ইত্যাদি। আমরাও সবাই একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম, চলতে চলতে সেই লাঠিতে ভর দিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। বেশ চলছিল এই ভাবেই। হটাৎ একটা বাচ্চা মেয়েকে পিঠে নিয়ে একটা ঘোড়া খেপে গিয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ধাক্কা মারল গিন্নিকে, আর সে পপাত ধরণীতলে। এতো জোর লেগেছিলো যে আমরা দৌড়ে গিয়ে ধরা সত্তেও উঠে বসতে পারছিল না। আশেপাশের দোকানদাররাও ছুটে এলেন ওর সাহায্যের জন্য। ধরাধরি করে কোনরকমে ওকে বসান হোলো ওই দোকানের একটা বেঞ্চে, ভাবলাম যে আমাদের যাত্রা বোধহয় এখনেই শেষ। কিন্তু দেবী চাইলে কি না হয়, কিছুক্ষণ বসার পর গিন্নী আস্তে আস্তে সুস্থ্য হতে লাগলেন আর হাত ও পায়ের ওই রকমের যন্ত্রণা সহ্য করেও আস্তে আস্তে আবার উঠে দাঁড়ালেন। এবার আর রিস্ক নেওয়া গেলো না, দর দস্তুর করে প্রত্যেকে উঠে পড়লাম আলাদা আলাদা ঘোড়ায়। অর্ধকুমারী পর্যন্ত নিয়ে যাবে বলে কথা থাকলেও নামিয়ে দিলো তার অনেকটা নিচের একটা আস্তাবলে। এর পরের রাস্তা বেশ খাড়াই হলেও আমরা তখন নিরুপায়। কষ্ট হলেও উঠছি আস্তে আস্তে, লঠিতে ভর করে। ডানদিকে পড়লো একটা ছোট্ট হাসপতালের ঘর, রাত্রি বলে তার সামনের ফাঁকা জায়গায় সপরিবারে শুয়ে আছেন অনেক ভক্ত। তাদের মাঝখান দিয়েই সাবধানে কাটিয়ে কুটিযে ভেতরে ঢুকেই দেখা পেলাম এক ডাক্তারবাবুর, সব শুনে একটা কাগজে একটু ব্যাথা কমার মলম লাগাতে দিলেন আর দিলেন একটা খাবার বড়ি। তিনি অভয় দিলেন এতেই হেঁটে হেঁটে দেবী দর্শনে যাওয়া যাবে। ওষুধ খেয়ে, লাগিয়ে আর ডাক্তারের অভয় পেয়ে গিন্নী তখন একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। অর্ধকুমারীর কাউন্টারে আমাদের সময় দেওয়া হোলো যে দর্শন হবে চার দিনের পর যেটা সম্ভব নয়। তাই দূর থেকেই অর্ধকুমারীর মন্দিরের মা কে প্রণাম জানিয়ে পায়ে পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম মূল মন্দিরের দিকে। এবার রাস্তা কিন্তু বেশ ভালো, পরিষ্কার আর ঘোড়ার উৎপাত বিহীন। জানতে পারলাম যে ঘোড়া চলে অন্য রাস্তায়, তবে এই রাস্তায় আছে পালকি আর বাচ্চাসহ প্রম। দিনের বেলায় এই রাস্তায় অটো চলে, কিন্তু রাতে সে সব বন্ধ। কি আর করা যায়, আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে, রাতের অন্ধকারে দূরে দেখা যাচ্ছে ভবনের আলো। পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে গেছি বলে একটু ঠান্ডার আমেজও পাওয়া যাচ্ছে । আমরা একটু চলছি, বসছি রাস্তার পাশের চেয়ারে। কখনো বিশ্রাম নিচ্ছি দাঁড়িয়ে, লাঠিতে বা রাস্তার ধারের লোহার বিমের উপর ভর দিয়ে। কত মানুষ, কাচ্চা বাচ্চা, বুড়ো বুড়ি সবাই চলেছে "মা" এর দর্শনে। রাস্তা যেন আর শেষ হয় না, দেখতে পাচ্ছি সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলেছে রাস্তা, রাস্তা ভর ঠাকুরের নাম গান হয়ে চলেছে মাইকে চলেছে নানা রকমের ঘোষণাও। হটাৎ দেখি রাস্তার ধারের ডানদিকে রয়েছে জুতো রাখার লোহার তাক, তবে তার কাছে যাওয়া যাচ্ছেনা কারন সেখানে জনগণ ঘুমাচ্ছে পরম নিশ্চিন্তে। যাইহোক মন্দিরে ঢোকার ঠিক আগে একটা তাকে জুতো রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম দেবী দর্শনের লাইনের দিকে, কেননা আমরা মোবাইল, ক্যমেরা, দেশলাই প্রভৃতি সব কিছুই রেখে এসেছিলাম হোটেলে। নাহলে ওসব জমা রাখতেই চলে যেতো আরো এক-দেড় ঘণ্টা। মন্দিরে ঢোকার পর লাইনটা চলেছে উঠে নেমে আর মাঝেই মাঝেই মিলিটারিরা চেকিং চালাচ্ছে দর্শনার্থীদের। আমার হাতে একটা জলের বোতল ছিলো, ফেলে দিতে হোলো সেটাও আর তার আগেই ফেলে দিতে হয়েছিলো আমাদের সাহায্যকারী সেই লাঠিটাকে। লাইন দিয়ে চলতে চলতে দেখি মন্দিরের মাথার থেকে ঝোলানো অনেক পিতলের ঘণ্টা আর লাইনের লোকজন তা বাজানোর জন্য লাফা লাফি শুরু করে দিয়েছেন। না বুঝেই সেই ঘণ্টা বাজালাম আমরাও আর তারপর পৌছালাম একটা ফাঁকা জায়গায়, সামনেই পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা আর লাইনটা ঢুকে গেছে সেই গুহার ভেতরে। কিছুটা এগিয়েই ডানদিকে আলোয় ঝলমলে রঙ্গীন দেবী মূর্তি আর বাঁদিকে সোনার সিংহাসনে উপবিষ্ট আসল দেবীরা। তেনাদের সামনেই বসে এক পুরোহিত, যদিও এখানে পূজা দেওরার কোনো উপায় নেই তাই দেবী দর্শনেই মুক্তি। এখানে একই সঙ্গে অবস্থান করছেন দেবী দূর্গা, লক্মী আর সরস্বতী। দর্শন শেষে লাইনের ভিড়টা একটু হাল্কা হোলো, আমরা বেরিয়ে এলাম সেই ফাঁকা জায়গায়। নামার সময় ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে ঘোড়াতেই নামব পুরোটা, তাই প্রথমেই ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়লাম। ঘোড়া নামতে লাগলো ঘুরে ঘুরে voiro ঘাঁটি হয়ে। হাতি মাথা ঘুরে এই রাস্তাটা খুব চড়াই (ওঠার সময়) .যদিও আমাদের নামতে হচ্ছে নিচের দিকে। রাস্তাটা এতটাই ঢালু যে নামতে গেলে পায়ে ব্যাথা হওয়া অবসম্ভআবি। ঘোড়াতে করেও নামতে আমাদের লাগলো প্রায় পাঁচ ঘণ্টা, কোমরে ব্যাথা হয়ে গেছে আর হেঁটে নামলে যে কি হতো বুঝতে পারছি না। নিচে নেমে অটো ধরে হোটেলে পৌছে বুঝলাম, ac রুমের উপকারিতা। ঠান্ডা সরবৎ আর সকালের বানানো কচুরী খেয়ে সেই যে ঘুম দিলাম সে আর ভাঙ্গতেই চায় না। অনেক ডাকাডাকির পর উঠে কোনরকমে একটু নাকে মুখে গুঁজে আবার আমরা বিছানায়। আমাদের ফেরার ট্রেন ছিলো রাত্রি নটা নাগাদ কাটরা স্টেশান থেকে । অপূর্ব স্টেশনটা, গোটাটাই মাটির নিচে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঠিক যেন বিদেশী ছবিতে দেখা রেল স্টেশান। ঘোরা শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা ... ...
Post By-Debasis Singha
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |