গোকুলনগর। বাংলার আর একটি অল্পখ্যাত গ্রাম, কিন্তু এবারে এটি বাঁকুড়ায়। আর এখানেই আছে এই জেলার সবচাইতে বড় পাথরের মন্দির - গোকুলচাঁদ মন্দির। চারপাশের ধূ ধূ মাঠের মধ্যে একেবারে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাটেরাইট পাথরের এই বিশাল মন্দিরটি - তার দুর্গের মত প্রাকারের মধ্যে বন্দী হয়ে। চারপাশে উঁচু পাথরের প্রাচীর - তার ভেতরে এক পাশে এই মন্দির আর অন্যদিকে তেমনই বিশাল নাটমন্দির। প্রাচীরের বাইরেই আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ড জানিয়ে দিচ্ছে - এই মন্দিরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা - যেটি তৈরি হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ প্রথম রঘুনাথ সিংহের আমলে। প্রাচীরের গায়ে ভিতরে যাওয়ার জন্য খিলানাকৃতি প্রবেশ পথ, তার পাশেই প্রাচীরের সেই গায়েই স্তম্ভের আভাস। ভেতরে ঢুকলে ডানদিকে একটি উঁচু বেদী বা প্লাটফর্মের ওপর সেই মন্দির, বা দিকে নাটমন্দির। প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফিট উঁচু মন্দিরটি পঞ্চরত্ন, মাঝখানের সবচাইতে উঁচু শিখরটি অষ্টভুজাকৃতি, চার কোণের চারটি ছোট শিখর কিন্তু আবার চতুষ্কোণ আকৃতির। মন্দিরটি চওড়া বেদীর মাঝখানে, তার চারপাশেই পরিক্রমার রাস্তা সেই বেদীর ওপর দিয়েই।মন্দিরের সামনে আর দুই পাশে তিন খিলানের বারান্দা। পাথরের মন্দিরের গায়ে অনেক ছোট ছোট মুর্তির কাজ, তবে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ছাপ তাদের ওপর স্পষ্ট। তবু তার মধ্যেই চেনা যায় দশাবতারের মূর্তিকে, কিন্তু পড়া যায়না ওপরের প্রতিষ্ঠা ফলকটিকে। মন্দিরের মধ্যে কোনো মূর্তি নেই, শোনা যায় মূল মূর্তি নাকি বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে। বিপরীত দিকের নাটমন্দিরের মাথার মাঝখানের চাল অনেকদিন আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, তবু একটি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাওয়া যায় ছাতের প্রান্তের অংশে। আর সেখানে উঠলে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যায় সমস্ত এলাকাটি। নাটমন্দির আর মন্দিরের মাঝখানে আর একটি অনেকখানি খোলা উঁচু বেদী, তারপর পাথরের একটি তুলসী মঞ্চ - সেই বেদী আর মন্দিরের মাঝখানে। নাটমন্দিরের দুদিকে তিনটি করে খিলান, দুপাশে ভেতরে যাওয়ার বিশাল প্রবেশপথ। নাটমন্দির এমনভাবে তৈরি যে মন্দিরের দিকের মাঝখানের খিলানের ভেতর থেকেই পুরো মন্দিরটি দেখা যায়। আর নাটমন্দিরের ছাদে উঠলে দেখা যায় মন্দির প্রাচীরের বাইরে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত। মাঠ আর সবুজের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে একাকী এই মন্দির।
শোনা যায়, গোকুলনগর গ্রামে আরো বহু মন্দির ছিল একসময়, যা নাকি ধ্বংস হয়েছিল কালাপাহাড়ের আক্রমণে, শুধু এই মন্দিরটিই কোনোভাবে টিঁকে গেছে। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকতো বিভিন্ন সব মূর্তি, পরে সেগুলির স্থান হয় বিভিন্ন মিউজিয়ামে। এখনো খোলা আকাশের তলায় কিছু শিবলিঙ্গ এখানে ওখানে দেখতে পাওয়া যায়। এমনই একটি আধভাঙা বরাহ মূর্তি আছে এই গোকুলনাথ মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরে - কিছুটা জঙ্গলের মধ্যে। মুর্তির কোমরের নীচের অংশটি মাটিতে প্রোথিত, ওপরের হাতগুলি ভাঙা। তবে মুখ আর মাথার শিরস্ত্রাণ অক্ষত। চারপাশে ভাঙা পাথরের চিন্হ দেখে মনে হয়, এখানেও হয়তো একটি মন্দির ছিল আগে, যা এখন ধূলিসাৎ। কোন রকমে একটি সাময়িক ছাউনি গ্রামের লোকেরা করে দিয়েছেন মাটিতে প্রোথিত সেই সুপ্রাচীন বরাহ মুর্তির ওপরে। আবার একটু দূরে আছে আর একটি মন্দির, সেটি নতুন ভাবে করা, কিন্তু তার মূর্তিগুলি প্রাচীন। ভেতরে দুটি মূর্তি - তার মধ্যে একটি বরাহ মূর্তি। কিন্তু তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে সেটি স্ত্রী বরাহ মূর্তি - যা কিন্তু খুব বেশী দেখা যায় না। বাংলার অনেক অঞ্চলেই এই ভাবে অনেক সম্পদ, অনেক মণি মাণিক্য ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে খোঁজ পাই, হঠাৎ করে পৌঁছে যাই এক বর্ণময় অতীতে - এই সব চিহ্নের পথ ধরে। অতীত কথা বলে ওঠে বর্তমানের কানে, বর্তমান ঘুরে বেড়ায় অতীতে। তবু এক সময়ে সেখান থেকে আবার ফিরে আসতে হয় সেই আলো ঝলমল বর্তমানেই, অতীত পড়ে থাকে তার নিজস্ব আলো হারানো অন্ধকারে। ভ্রমণ সঙ্গী ও তথ্য সূত্র - ইতিহাস সন্ধানী ও ব্লগার - অমিতাভ গুপ্ত। অন্যান্য সূত্র - সোমেন সেনগুপ্ত - দি টেলিগ্রাফ
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |