কোতুলপুর - বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সাব ডিভিশনে একটি অল্পখ্যাত গ্রাম। মাঝে মাঝেই যেমন একটু বেরিয়ে পড়ি - জানা অজানা কোনো স্থান বা মন্দিরের খোঁজে, তেমন ভাবেই জানুয়ারির এক রবিবারে কলকাতা থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম বিষ্ণুপুর থেকে মোটামুটি তিরিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটিতে। যাঁরা ভ্রমণে বেরোন - তাঁদের অনেকেরই পছন্দের জায়গা ওই বিষ্ণুপুর, যা বিখ্যাত তার অসাধারণ টেরাকোটা মন্দিরগুলির জন্যে। আমাদের এবারের ভ্রমণে কিন্তু আমরা বাদ দিয়েছিলাম সেই বিষ্ণুপুরকেই - কারণ বিষ্ণুপুর আছে আর থাকবে তার মহিমা নিয়ে, সেখানে গেলে আমাকে থাকতে হবে অন্তত তিনটে দিন - সব কিছু মোটামুটি ভাবে দেখতে ও জানতে গেলে। কিন্তু এবারের যাত্রা মাত্র একদিনের, কলকাতা থেকে সকালে বেরিয়ে রাতেই ফিরে আসা - তাই বিষ্ণুপুরের পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয়েছিল অল্পখ্যাত এই কোতুলপুর, সেই সঙ্গে কাছের গোকুলনগর আর জয়পুরকেও। লিখতে বসে আজ প্রথমেই তাই বলবো এই কোতুলপুরের কথাই।
বাংলার অনেক ছোট গ্রামেই হঠাৎ করে এমন কিছু মন্দির বা স্থাপত্য চোখে পড়ে, যে প্রথম দর্শনেই একটু চমকে যেতে হয়। কোতুলপুরে এমনই একটি বিশাল তোরণের সামনে যখন নামলাম - তখন মনে হলো যেন কোনো বিশাল প্রাসাদ বা দুর্গের তোরণদ্বার। দুদিকে তিনটি করে মোট ছটি থামের ওপর দাঁড়িয়ে এই অর্ধচন্দ্রাকৃতি তোরণ - তার দুদিকে বিস্তৃত wings বা তোরণটির বর্ধিত অংশ - যেগুলিকে আসলে দোতলা বাড়ীই বলা যায়। তোরণের অবস্থা জীর্ণ, অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে, তবু সহজেই অনুমান করা যায় - একসমযে কি বৈভবের নিদর্শন ছিল এই তোরণ। তোরণটি সেই সময়ে ছিল এখানকার তদানীন্তন জমিদার নিরঞ্জন ভদ্রের খাস তালুকে প্রবেশের ঠিকানা, এখনও সেটির মাথার ওপরে একটি ভগ্ন ফলকে “ ভদ্র” লেখাটি পড়া যায়, বাকি অংশ বিলুপ্ত। তোরণের বাইরে একটু দূরে প্রাচীন একটি ঠাকুরদালান, আর সামনেই দুদিকে দুটি করে চারটি অপেক্ষাকৃত নতুন শিবমন্দির - যেগুলি কিন্তু এই প্রাচীন তোরণের মহিমার সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যহীন।
তোরণ দিয়ে এবার ভেতরে প্রবেশের পালা। না , কোনো বাড়ীর মধ্যে নয় - সেটির ভেতর দিয়ে রাস্তা গেছে গ্রামের আরো ভেতরে। তোরণ দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে একটু দূরে একটি সুন্দর সাদা রাসমঞ্চ, সামনে একটি দুর্গাদালান, আর ডানদিকে পরপর দুটি স্থাপত্য - প্রথমে পাথরের তৈরি একটি গিরি গোবর্ধন মন্দির, আর তার পাশেই একটি ছোট নবরত্ন দোলমঞ্চ। আবার সেই দোলমঞ্চের পরেই একটি বড় পঞ্চরত্ন মন্দিরের চূড়ো। দুর্গাদালানের এক কোণে একটি ফলক, যা থেকে জানা যায় ১৮৮০ সালের দুর্গা সপ্তমীর দিন শ্রী রামকৃষ্ণের এই গ্রামে পদার্পণের কথা। ডান দিকে পাথরের গিরিগোবর্ধন মন্দিরে বেশ কিছু মূর্তি - আছে দুদিকে দুজন দ্বারপাল, ওপরে যশোদা-কৃষ্ণ, গরুড় বাহন বিষ্ণু, দুপাশের প্যানেলে দশাবতার এই ধরণের অনেক টেরাকোটা মূর্তি। এই দুটি মন্দির ছাড়িয়ে পরে যে বড় পঞ্চরত্ন মন্দির - সেটিই এখানকার মূল মন্দির, ভদ্রদের কুলদেবতা শ্রীধর জীউ মন্দির। বাইরের রাস্তা থেকে কিছু বোঝা না গেলেও, ভেতরে ঢুকে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের কাজ গুলি। একটি ছোট প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু বেদীর ওপর তিন খিলানের তিরিশ ফুট উঁচু এই পঞ্চরত্ন শ্রীধর মন্দির - তার সামনের অংশে টেরাকোটার অজস্র কাজ।নীচের দিকে ফুলের অলংকরণ, ওপরের প্যানেলের বাঁদিক থেকে যথাক্রমে রাম রাবণের যুদ্ধ, কৃষ্ণের মথুরা পরিত্যাগ, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ - এমন অনেক ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরের দালানে কিছু ফ্রেসকোর কাজ - সেগুলোও আকর্ষণীয়। এছাড়া আছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলক - তার পাঠোদ্ধার বর্তমানে একটু কষ্টকর হলেও শতাব্দ ১৭৫৪, ১৭৫৫ আর বঙ্গাব্দ ১২৩৯ আর ১২৪০ কিন্তু এখনো পড়া যায় ।
নিরঞ্জন ভদ্রের পারিবারিক এই মন্দির ছাড়িয়ে এবার পাশেই ভদ্র পরিবারের আর এক শরিক সুধাকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ী। তবে তার আগে, শ্রীধর মন্দির থেকে বেরিয়েই বিপরীত দিকে একটা বিশাল প্রাসাদের আভাস। শুধু পড়ে আছে একটা ভাঙা দেওয়াল আর খোলা আকাশের নীচে একটা সিঁড়ি বয়ে একটা ভাঙা ছাতের ওপরে উঠে যাওয়া - বোঝা যায় এককালে এখানে একটি বিশাল বাড়ী ছিলো - যা আজ সম্পূর্ণই নিশ্চিহ্ন। সুধাকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ীর প্রবেশদ্বারের বাইরেও চারটি শিবমন্দির - প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। বাড়ীর ভেতরে আবার একটি রাসমঞ্চ, ঠাকুর দালান আর চারটি শিবমন্দির। কিন্তু এই বাড়ির এলাকার সবচাইতে দর্শনীয় হলো একটি দোতলা বাড়ী। আসলে বাড়ীর মত দেখতে হলেও এটি কিন্তু আদতে একটি দোতলা মন্দির - কোনো বাসস্থান নয়। মন্দিরের ছাদ থেকে শুরু করে নীচ অবধি পাশে, মাঝখানে, বারান্দায় - ছোট ছোট টেরাকোটার কাজ । হয়তো খুব উন্নত নয় , কিন্তু অলংকরণ এমন ভাবে করা যাতে সেই বাড়ী বা মন্দিরের দোতলা চরিত্র নষ্ট না হয়। ছোট ছোট টেরাকোটার কাজ, দেবদেবীর মূর্তি, তার মধ্যেই আবার অনেক মূর্তিতে সাহেবী মুখ আর পোশাকের আদল। সব মিলিয়ে বেশ নতুনত্ব। বাড়ীর বাইরেই একটি বড় পুকুর, সেই পুকুরের ওপর দিক থেকে এখানকার চারটি শিবমন্দিরের অবস্থান বোঝা যায়। কোতুলপুর নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকটা বড় হয়ে গেল। আসলে আমাদের বাংলার একটি গ্রামের প্রায় অখ্যাত আর অবহেলিত কিছু মন্দির - তারাই যে উঠে আসতে চাইলো আমার লেখার মধ্যে দিয়ে। পেরিয়ে গেলাম প্রায় আড়াইশো বছর - যখন এ গ্রাম ছিল হয়তো অনেক বর্ধিষ্ণু, কোলাহল আর রাজকীয় মহিমায় ভরপুর। আজ সে সবই ইতিহাস - অপেক্ষায় থাকে হয়তো আমাদেরই মতো কোনো অনুসন্ধিৎসু পথিকের। ভ্রমণ পরিচালনা ও তথ্য সহায়তা - ইতিহাসসন্ধানী ব্লগার অমিতাভ গুপ্ত।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |