পলাশ পার্বণ
প্রদীপ হাজরা অদ্ভুত একটা পালাই পালাই ভাব গ্রাস করে প্রতিবছর এই সময়টা এলেই । চারপাশে প্রকৃতির হোলি খেলা শুরু হয়ে যায় ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকেই । প্রকৃতির একান্ত নিজস্ব এই রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠা দেখতে হলে ব্যাগ গুছিয়ে পালাতেই হবে বাঁকুড়া-বীরভূম-পুরুলিয়া কিম্বা ঝাড়খণ্ড ওড়িশার ছোটোনাগপুর ঘেঁষা এলাকাগুলোতে । আমার বরাবরই পুরুলিয়ার প্রতি একটা আলাদা প্রেম , আলাদা ভালোলাগা রয়েছে । রুখুসুখু এই জেলার ভাণ্ডারে বিবিধ রতনের খোঁজ যারা একবার পাবেন , তাঁরা বারেবারেই ছুটে যাবেন পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে । আমার সহপাঠী ডাক্তার পার্থসারথি নাগের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল পুরুলিয়ারই একজন বিশিষ্ট সরকারি আধিকারিক তাপস মাহাতো-বাবুর । এমন একজন নিপাট পরোপকারী ভালোমানুষের সান্নিধ্য কিম্বা সহযোগিতা পেলে যেকোনো গন্তব্যই হয়ে ওঠে রেশম মসৃণ । আমাদের হঠাৎ আবদারে সাড়া দিয়ে বাগমুণ্ডির টাটা হোটেলে থাকার সুবন্দোবস্ত করে দিলেন উনি । ব্যাস আর কি , দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাতের আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে । বরাভুম স্টেশন পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরেই দুপাশে শুরু হলো রঙের খেলা । ট্রেনে আসার পথে দুপাশে প্রচুর পলাশ দেখেছি ঠিকই , কিন্তু কাছে গিয়ে তার রঙ রূপ সৌন্দর্য অনুভব করার মধ্যে একটা আলাদা মাদকতা আছে । কিছুদুর গিয়েই তাই গাড়ি থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল... পলাশ বনে ক্ষণিক হারিয়ে যাওয়া । দুপাশে চোখ মেলে তাকালেই লাল আবিরের আলিঙ্গন ! পলাশের সঙ্গী কুসুমও । এসময় কুসুম গাছে নতুন পাতা আসে... টুকটুকে লাল পাতা...দূর থেকে দেখে কৃষ্ণচূড়া বা পলাশ বলে ভ্রম হয় । এই এলাকায় কুসুমও অঢেল । ২০১৭ সালের পুজোর পরেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়েছিলাম । তাই এবার আর ট্যুরে অযোধ্যাকে রাখিনি ইচ্ছে করেই । আমাদের প্ল্যানই ছিলো গতবারে সময়ের অভাবে মিস হয়ে যাওয়া খয়রাবেড়া ড্যাম দর্শন আর বাগমুণ্ডির আশপাশের এলাকায় পলাশবনে ঘুরে বেড়ানো এবং নিখাদ ছুটি কাটানো । টাটা হোটেলের ঘরগুলো বেশ ছোটো ছোটো ,সদ্য চালু হওয়ায় অনেক পরিকাঠামোগত ভুলচুক আছে , কিন্তু হোটেলের মালিকের মন বেশ বড় আর উদার...সবসময় একটা মৃদু হাসি ঠোঁটে লেগেই আছে । আপনার যেকোনো সমস্যার কথা একবার জানালেই হল ! সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উদ্যোগী হবেন তার সমাধানে । আর খাওয়াদাওয়াও বেশ সস্তা এবং গুণগত মান খুবই ভালো । আমরা সন্ধ্যার দিকটা স্রেফ সময় কাটানোর জন্য পরপর দুদিন চিকেন আর মাটন রান্না করলাম নিজেরাই, এককথায় ভদ্রলোক অনুমতি দিয়ে দিলেন ! উনি সবই ব্যবস্থা করে দিলেন রুমের বাইরের করিডোরে ... গ্যাস , ওভেন , মশলাপাতি সবই । আর একজন স্টাফ সব ব্যাবস্থাপনা করে দিলেন আমাদের হাতে হাতে । বাগমুণ্ডির এই এলাকাটাতে পলাশ আর কুসুমের ছড়াছড়ি । হোটেলের সামনের উঠোনে , পাশের ফাঁকা মাঠে আর রাস্তার ওপারে অনেকগুলো পলাশগাছ দিগন্ত লাল করে রেখেছে সবসময় । গ্রামের শুরুতেই এই হোটেলের অবস্থান । সকাল হতেই একদল কচিকাঁচা আপনার দরজায় কড়া নাড়বে সদ্য ঝরা টাটকা একগাদা পলাশ নিয়ে সুপ্রভাত জানাতে । সামান্য দু- দশটাকা ওদের হাতে সেগুলোর বিনিময়ে তুলে দিয়ে দেখুন, একটা স্বর্গীয় হাসি উপহার পাবেন । হোটেলের রেস্টুরেন্টের পাশের ফাঁকা জমিটা ছাড়ালেই প্রথম বাড়িটাই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যের । আমরা প্রথমদিনে বেড়াতে বেরিয়েই সাদর অভ্যর্থনা পেলাম । সদ্য পাকা কুলের ভারে ন্যুব্জ একটা কুলগাছ বাড়ির উঠানেই রয়েছে । আমাদের সঙ্গীসাথীরা একবার নাম কা ওয়াস্তে অনুমতি নিয়েই একগাদা কুল প্যাকেটবন্দি করে ফেললো । গ্রামের ভিতরের দিকে যতো এগোবেন পলাশের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে । গ্রামের বাড়িগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে ৫০ মিটার এগোলেই একটা বিশাল পলাশবন । চরাই উতরাই পেরিয়ে একটা উঁচু জায়গা আছে বনের মধ্যেই । সেখান থেকে দূর পাহাড়ের সীমা পর্যন্ত শুধুই পলাশ আর পলাশ গাছ । বেশিরভাগ গাছে সদ্য ফুল ফুটতে শুরু করেছে , কিছু গাছে এখনও কুঁড়ি আসেনি । সব মিলিয়ে মনে হবে কোনও স্বপনপুরিতে এসে উপস্থিত হয়েছেন । দুদিনে আমরা ঘুরে দেখলাম খয়রাবেড়া ড্যাম , পাখি পাহাড় , মাঠা পাহাড় , দুয়ারসিনি জঙ্গল , ছৌ নাচের গ্রাম চড়িদা এবং আদিবাসি অধ্যুষিত গ্রাম নিশ্চিন্তপুর । খুব বেশি দৌড়নোর ইচ্ছে নিয়ে আমাদের এই ট্যুরের পরিকল্পনা কড়া হয়নি , তাই একটু ধীরেসুস্থে সময় নিয়েই আমরা ছোটো এলাকার মধ্যে আমাদের ঘোরাঘুরি সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলাম । তবে হাতে সময় থাকলে আর ইচ্ছে থাকলে অযোধ্যা পাহাড়ের পুরো এলাকা ঘুরে নিতে পারেন একটা গোটা দিন বরাদ্দ করে । আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পলাশ দর্শন... সেই উদ্দেশ্য আমাদের ২০০% পুরণ হয়েছে । থাকা ও খাওয়াঃ টাটা হোটেল ও শান্তি ট্যুরিসট লজ (৮৯৭২৫৩০৯৪৮ /৯৭৩৫৮৮০৫৪১ / ৯০৬৪৩০৩০২২) মা মঙ্গলা ট্যুরিসট লজ ( ৯৮০০৯৩৮৯৫৯ / ৯৫৭২৯৭০৮৮৪ ) এছাড়া বাগমুণ্ডি , চড়িদা , মাঠা পাহাড়ের আশে পাশে অনেকগুলো ছোটোখাটো হোটেল রিসোর্ট গরে উঠেছে । যাওয়া-আসাঃ রাতের আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে বরাভুম স্টেশনে নেমে ৫০০-৬০০ টাকায় গাড়ি নিয়ে ২৫ কিমি দুরের বাগমুণ্ডি ।। প্রদীপ হাজরা
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |