“মায়াবী মানালি”
জঙ্গলে গিয়ে বাঘ পেলাম কিনা আর পাহাড়ে গিয়ে বরফ পেয়েছি কিনা, বেড়িয়ে এসে এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন দুটোর সম্মুখীন হতে খুব খারাপ লাগে। বাঘ ছাড়াও শুধু জঙ্গল টাও যে উপভোগ করা যায় তা এবার ফেব্রুয়ারী মাসে নর্থ বেঙ্গল ঘুরে এসে বেশ বুঝেছি। বাঘ দেখতে পাওয়া অবশ্যই উপরি পাওনা। যাই হোক , এবারে আমাদের গন্তব্য শুধুই ‘মানালি’ আর তাকে ঘিরে কাছাকাছি দু একটা জায়গা।হ্যাঁ, বরফের লোভে মার্চ মাসটাকে ই বেছে নিয়ে ছিলাম। কোলকাতা থেকে অমৃতসর এয়ার পোর্টে পৌঁছলাম প্রায় দেড় টা নাগাদ। ওখান থেকে গাড়ী তে মানালি প্রায় বারো ঘন্টা। অহেতুক strain এড়াতে আমরা ‘মান্ডি’ তে night stay রেখেছিলাম।২৯০ কিমি পৌঁছতে প্রায় সন্ধে পেরিয়েই গেল।এই মান্ডি জায়গাটা নিয়ে দু এক কথা বলতেই হয়। পরদিন সকালে সত্যিই অবাকই হলাম। খুব ছোট্ট শহর এই ‘মান্ডি’ কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।দূরের পাহাড় গুলো সব বরফ দিয়ে ঢাকা। শান্ত, স্নিগ্ধ ছোট্ট একটা হিল স্টেশন।শুধু মান্ডি তে এসে অনায়াসে দু একদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।পরদিন খুব বেশীক্ষণ আর ‘মান্ডি’র সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল না। নটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হল মানালির উদ্দেশ্যে।জায়গাটা ছেডে আসার সময় একটু হলেও মন কেমন করছিল বৈকি। রাস্তা সব জায়গায় খুব ভাল না থাকায় ১১০ কিমি দূরে মানালি পৌঁছতে প্রায় ছ ঘন্টা লেগেই গেল। তবু দিনের বেলায় পাহাড়ী রাস্তায় চলতে বেশ ভালই লাগে।প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যেন নতুন নতুন সৌন্দর্য , নতুন কিছুর আবিষ্কার। নতুন কোন অজানা অচেনা ফুল দেখতে পেয়ে তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে হঠাৎ নেমে গিয়ে তার বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলা, দল বেঁধে যাওয়া কিছু স্কুল student দের সরল হাসির সাথে হাত নাড়া, এ সব কিছুর মধ্যেই এক অদ্ভুত ভাললাগা যাত্রার একঘেয়েমি কাটিয়ে দেয়।আর আছে পাশ দিয়ে সাথে সাথে চলতে থাকা ‘বিয়াস’ নদী। এক এক কোণ থেকে এক এক রকম রূপ তার।সে রূপ ক্যামেরা বন্দী করতে কার না মন চায়! কার ছবি টা বেশী ভাল সে নিয়ে তর্ক চলতেই থাকে।যত মানালির দিকে এগোচ্ছি , বরফে ঢাকা পাহাড় গুলো তত যেন হাতের কাছে চলে আসছে । অবশেষে প্রায় তিনটে নাগাদ মানালি পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে ব্যালকনির দরজা টা খুলতেই যে অপরূপ দৃশ্য সামনে এল তাতে যাত্রার সব ক্লান্তি এক নিমেষে কেটে গেল।দুধ সাদা বরফে ঢাকা বিশালকায় পর্বত শৃঙ্গ গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। পাঁচজনের মনের কথা তখন একই। লান্চ তো রোজই সময় মত করি, আজ না হয় এই দৃশ্যটাই আরেকটু ক্ষণ চেটেপুটে খাই। সেদিন সন্ধে টা ম্যালের মার্কেট টাই ঘুরে কাটালাম।
পরদিনের গন্তব্য ‘সোলাং ভ্যালি’।রোটাং পাসের রাস্তা বন্ধ থাকায় এখন এটাই আকর্ষণ।সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম । যত এগোচ্ছি তত বিস্মিত আর মুগ্ধ হচ্ছি । দুপাশে বরফ ঢাকা পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মাঝে এক জায়গায় নেমে একটা দোকানে waterproof dress আর গামবুট পরে নিতে হল।নিজেকে কেমন যেন তুষার মানবের মত লাগছিল।কিছুদূর পরেই গাড়ী ছেড়ে নেমে পড়তে হল আমাদের।আমরা পাঁচজন বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি খুবই সতর্ক হয়ে। একটু দাঁডিয়ে চারপাশ টা একবার চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি, আবার হাঁটছি। কারো মুখে কথা নেই। প্রতিটি মুহুর্ত প্রাণ ভরে উপভোগ করতে করতে চলেছি। আমার ছোট্ট বন্ধুর সরল প্রশ্ন, “আচ্ছা , সুইজারল্যান্ড কি এর থেকেও সুন্দর ?” উত্তর দিতে পারিনি।অবশেষে চারিদিক বরফে ঢাকা একটা সমতল ভূমি তে এসে পড়লাম। বিভিন্ন ধরনের sports event চলছে সেখানে। paragliding এ সাহস পেলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ observe করার পর মনে হল ski টা চেষ্টা করাই যেতে পারে।প্রথমে adjust করতে একটু সময় লাগলো বটে, তারপর কিন্তু ব্যাপার টা বেশ মজার।তবে সমতল ভূমি বলেই এটা সম্ভব হোলো, ঢালু থাকলে risk নিতাম না। আমার ছোট্ট বন্ধু ও অনায়াসে এটা করে ফেলল।এরপর ropeway করে সবাই আরো এক ধাপ ওপরে চলে এলাম।এখানে এসে তো রীতিমতো চমৎকৃত হবার পালা।এ কোথায় এলাম! চারপাশে গাছগুলো সব সাদা, মাঝে মাঝে দু একটা সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে । চতুর্দিকে শুধু গুঁড়ো বরফ, পা ঢুকে যাচ্ছে । সবাই একসাথে বসে পড়লাম ।আরো বেশ কিছু ট্যুরিস্ট ওখানে আগেই চলে এসেছিল। এ কোন বরফের রাজ্যে চলে এলাম। এতো বরফ একসাথে কখনো দেখেছি বলে মনেই করতে পারছিনা।আট থেকে আশি সবাই তখন একদল শিশু তে পরিণত হয়েছে।কেউ বরফের তাল নিয়ে আরেকজন কে ছুঁড়ে মারছে, কেউ বা বরফের গোলা পাকিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারছে, আবার কাউকে দেখছি গ্লাভস্ সহ হাত দুটো বরফের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছে, কেউ বা বেমালুম চুপ করে শুয়ে পড়েছে । সে এক অদ্ভুত ভাললাগায় আমরা তখন আচ্ছন্ন। আমার এক বন্ধুর বাড়ীর পরিচারক একবার আমায় বলেছিল,” কি যে এতো বরফ বরফ করেন দাদা বুঝিনা বাপু, ফ্রীজ খুললেই তো কত বরফ দেখা যায়।” তাকে কি করে বোঝাই দুই বরফের তফাত ।কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছিল না ওই জায়গা ছেড়ে । কতক্ষণ যে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ ই শুরু হোল snowfall আর মুহুর্তে পরিবেশ গেল পাল্টে। সবাই চিৎকার করছে আনন্দে। সবার মাথায়, মুখে, গায়ে বরফের গুঁড়ো তুলোর মত উড়তে উড়তে এসে পড়ছে । প্রকৃতির হঠাৎ এই পরিবর্তন কে তখন অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করছি আর ভাবছি আজও এ জিনিস দেখার ভাগ্য আমার ছিল। শেষ দেখেছিলাম ছাংগু লেকে, বেশ কয়েক বছর আগে।তার ও আগে ১৯৭৯ সালে অমরনাথ যাবার সময় মহাগুনাস্টপ এ।যাইহোক কতক্ষণ যে ওখানে ছিলাম জানিনা। রোপওয়ে করে নেমে এসে বাকী পথ টা হেঁটে আবার এসে গাডীতে।হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে ।
পরদিন মানালির local sightseeing. হিডিম্বা মন্দির, club house, বনবিতান সবই দেখলাম বটে কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে মনের মধ্যে তখন একটাই নাম ‘সোলাং ভ্যালি’।
পরের দিন চললাম ‘পালামপুর’। মানালি থেকে চার ঘন্টার রাস্তা। বেশ জমজমাট একটা হিল স্টেশন। ওখানকার ‘হোলি উৎসব’ সম্বন্ধে কিছুটা আগে থেকেই জানা ছিল। সেদিন পৌঁছে ওখানে ‘চামুন্ডা মন্দির’ আর ‘ধৌলাধার’ নেচার পার্ক দেখে নিলাম।আর পরদিন ওখানে হোলি উৎসব টা ওদের মত করেই উপভোগ করলাম। বিশাল একটা মাঠ। সেখানে সবাই সবার মত করে আবির খেলছে। একধারে বিরাট মেলা, সেখানে live function চলছে বিশাল এক মন্চে। পান্জাবী ভাষায় গান, নাচ সবই। কোন রং এর ব্যাপার নেই, শুধুই আবির। এ ওকে আবির মাখিয়ে রঙীন করে দিচ্ছে আর নিজেও রঙীন হচ্ছে ততোধিক।কোন বিশৃঙ্খলা নেই, কোন জোর জবরদস্তি নেই, কোন মাত্রা ছাড়া ব্যাপার নেই।সবটাই আন্তরিকতা আর ভালবাসায় মাখানো। জায়গায় জায়গায় লঙ্গরখানা, কোথাও হালুয়া, কোথাও লস্যি , কোথাও খিচুড়ি বিতরণ চলছে।ওদের এই কালচার কে খুব সম্মান করতে ইচ্ছে হল। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে অবশেষে হোটেলে ফেরা।
পরদিন ওখান থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে সোজা চন্ডীগড় । প্রায় বিকেল হয়ে গেল পৌঁছতে । ওখানে ‘রক গার্ডেন’ টা দেখলাম। বেশ নতুনত্ব লাগলো পুরো পরিকল্পনা টাতে।চন্ডীগড়ে থাকা টা শুধু মাত্র পরদিন সকালের ফ্লাইট টা ধরবো বলে। পরদিন যথাসময়ে উড়ান ধরে সোজা কোলকাতা । দু থেকে আড়াই ঘন্টার journey, conveyer belt এ luggage এর জন্য অপেক্ষা করা, গাড়ী করে জ্যাম পেরিয়ে বাড়ী ফেরা, কোন কিছুই আর মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী করছে না একেবারেই কারণ তখন মনের সবটা যে দখল করে ফেলেছে একটাই ছবি ‘সোলাং ভ্যালি’। হ্যাঁ এবার ফিরে গিয়ে কোন প্রশ্ন কেই আর অস্বস্তিকর মনে হবে না। পরিশেষে, অভিজ্ঞতা থেকে দু একটা জরুরী উপদেশ। ১) মানালির পক্ষে মার্চ মাস টাই বোধহয় উপযুক্ত সময়। ২)অনলাইনে গাড়ী fix না করে গাড়ী টা দেখে নিয়ে বুক করাই ভাল, বিশেষ করে টায়ার এর condition , চলতি ভাষায় যাকে বলে গুটি। ৩)ড্রাইভার খুব অল্প বয়সী ছেলে ছোকরা না হওয়াই বান্ছনীয়। ৪)সিমলা, কুলু, মানালি র তথাকথিত tour plan থাকলে আলাদা কথা, অন্যথায় হোলি উৎসব না থাকলে পালামপুরের থেকে ‘মান্ডি’ দু একদিন কাটানোর পক্ষে আদর্শ জায়গা। ৫)পাহাড়ে রাতের journey খুব boring. সময় বেশী লাগলেও দিনের বেলার journey সবসময় exciting. ৬)সোলাং ভ্যালি তে যাবার সময় waterproof পোশাক আর গামবুট একটু ভাল standard এর দোকান থেকেই নেওয়া উচিত কারণ তা না হলে ভেতরের পোশাক পুরো ভিজে যেতে পারে। ৭)পাহাড়ে খাওয়া দাওয়া টা একটু simple রাখাই ভাল।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |