বর্গভীমা মন্দির :--
আজ আপনাদেরকে বলতে চলেছি একান্নটি সতী পিঠের একটি পিঠ মা বর্গভীমা মন্দিরের কথা l যেটা মেদিনীপুরের তমলুকে অবস্থিত l এখানে সতীর বাম গোড়ালি পড়েছিল l মহাভারতে উল্লেখিত ময়ূর বংশীও তাম্রধজ রাজাই হলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা l পুরান মতে দক্ষ যজ্ঞে সতীর দেহ ত্যাগের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত হয়ে সতীর বাম পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এখানে l সেই থেকেই একান্ন পিঠের এক পিঠ হয়ে ওঠে এই বর্গভীমার মন্দির l পয়লা বৈশাখ, বিপত্তারিণী পূজা, দূর্গাপূজা ও কালীপূজায় এখানে জাকযমক দেখার মতো হয় l ভিতরে আছে পূজার ব্যবস্থা l মন্দিরে ঢুকেই চোখে পড়বে অজস্র দোকান l যেখানে পূজার সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে l ভিতরে আছে ভোগশালা, বহু দর্শনারথি এসে এখানে কুপনের বিনিময়ে ভোগ গ্রহণ করেন ll
মহিষাদল রাজবাড়ী:--
বর্গভীমা মন্দির থেকে মহিষাদল রাজবাড়ীর দূরত্ব এমন কিছু বেশি না l গাড়ি থামলো গেটের মুখে l এটাকে ফুলবাগ প্যালেস ও বলা হয়l গেট পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল এলাকা l তার একপাশে কাউন্টার, প্রবেশ মূল্য 10 টাকা l এবার বলি রাজবাড়ীর ইতিহাসটা..... এই রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জনার্দ্দন উপাধ্যায় l মোঘল সম্রাট আকবরের অধীনে সেনা বাহিনীতে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন তিনি l ষষ্ঠদশ শতকে বাণিজ্যিক কারণে উত্তরপ্রদেশ থেকে জনার্দ্দন উপাধ্যায় নদী পথে মহিষাদল উপকণ্ঠে অবস্থিত গেঁয়োখালিতে আসেন l কল্যাণ রায়চৌধুরী ছিলেন সেই সময়ের রাজা l তাঁর কাছ থেকে জমি কিনে জনার্দ্দন উপাধ্যায় নতুন রাজা হলেন l নবাব সরকারকে রাজস্ব না দিতে পারায় রাজার রাজত্ব নিলাম হয়ে যায় l আর ঠিক তখনি জনার্দ্দন উপাধ্যায় জমিটি কিনে নেন l রাজবাড়ীর দুটি তলা l উপর তলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ l আর নিচের তলায় রয়েছে, সে আমলের বিভিন্ন জিনিস যেগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে l ভিতরে আছে সে আমলের কাঠের আসবাপত্র, বাদ্যযন্ত্র, এবং একটি কক্ষ আছে যেখানে যুদ্ধের সমস্ত রকম অস্ত্রসস্ত্র সংরক্ষণ করা আছে l প্রসঙ্গত বলে রাখি রিতুপর্ণা অভিনীত বসুপরিবার সিনেমাটি এই রাজ বাড়িতেই শুটিং হয়ে ছিলো l এখানে গেলে সিনেমাতে দেখানো সেই শিকার ঘরটি ও দেখতে পাবেন l মৃত পশুগুলিকে সংরক্ষণ করে রাখা আছে l
0 Comments
লাদাখ, হিমালয়ের কুম্ভমেলা এবং তার পৌরাণিক ও ভূতাত্ত্বিক গুরুত্ব :-Muktagopal Bhattacharyya10/15/2020
কুম্ভমেলা কথাটার মধ্যেই আমাদের মধ্যে একটা কৌতুহল মিশে আছে। তার মধ্যে আছে কিছুটা ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং কিছুটা মিলনমেলা। কিন্তু শুধুমাত্র মিলনমেলা বা ধর্মীয় ভাবনার কথা বললে বোধহয় কুম্ভমেলার বিষয়ে অনেক কিছু বাকি থেকে যায়। বারো বছর অন্তর ভারতের চারটি জায়গায় অনুষ্ঠিত হওয়া পূর্ণকুম্ভ এবং সিংহস্থকুম্ভ মেলাকে শুধুমাত্র এটা ধর্মীয় মেলা ভাবলে বোধকরি ভুল হবে। এই সত্যটি কোনোমতেই অস্বীকার করা যায়না যে আজকের বানিজ্য ও বিপননের যুগেও যে কোটি কোটি ভারতবাসীর মনের মধ্যে যে একটা অন্তঃসলিলা ‘ভারতবর্ষ’ তপমগ্ন মহাতাপসের মতো আপন মনে বয়ে চলেছে। সেই তপমগ্ন মহাতাপসের স্পর্শ পাওয়ার জন্য এবং অহংবোধের খোলস কুম্ভমেলার সময় পবিত্র নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে নিজের মনের অন্তরের ক্ষুদ্রত্ব অনুভব করার জন্য বোধহয় নানান জীবিকার মানুষ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসে এই কুম্ভমেলায় মনের পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে। এই কারণেই বোধহয় কুম্ভমেলাগুলি নদী কেন্দ্রিক। প্রতিটি মেলার সঙ্গে এক বা একাধিক নদী জড়িয়ে আছে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে পুণ্যস্নানই হল কুম্ভমেলার প্রধান অংশ। স্থান নির্বাচিত হয় বৃহস্পতি ও সূর্যের অবস্থান অনুসারে। বৃহস্পতি ও সূর্য সিংহ রাশিতে অবস্থান করলে নাসিকের ত্র্যম্বকেশ্বরে; সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করলে হরিদ্বারে; বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে এবং সূর্য কুম্ভ রাশিতে অবস্থান করলে প্রয়াগে; এবং সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করলে উজ্জয়িনীতে মেলা আয়োজিত হয়। আবার সূর্য, চন্দ্র ও বৃহস্পতির রাশিগত অবস্থান অনুযায়ী মেলা আয়োজনের তিথি বা তারিখ নির্ধারিত হয়। আমাদের অর্থাৎ সমস্ত ভারতীয়দের কুম্ভমেলা নিয়ে ধ্যান ধারণা বা পৌরাণিক ভাবনা চিন্তা শুধুমাত্র এই চারটি জায়গায় অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলা নিয়ে। কোথাও অর্ধকুম্ভ, কোথাও পূর্ণকুম্ভ বা সিংহস্থ কুম্ভ আবার কোথাও মহাকুম্ভ। অবশ্য মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয় ১৪৪ বছর পর পর। অর্থাৎ এগারোটি পূর্ণকুম্ভের পর দ্বাদশতম পূর্ণকুম্ভোই হলো মহাকুম্ভ।
--২--- আমার এই প্রতিবেদনটি ভারতবর্ষের ওই চারস্থানের কুম্ভমেলাকে নিয়ে নয়। এটি হিমালয় পর্বতের ১২০০০ফুট উচ্চতার উপর লাদাখের হেমিস গুম্ফা এবং তার সংলগ্ন এলাকায় আয়োজিত আমার দেখা "হিমালয়ের কুম্ভমেলাকে" নিয়ে। যদিও লাদাখ পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত ওই কুম্ভমেলা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিলনা এবং আমার উদ্দেশ্য ছিল লাদাখ নামের ওই সাদা স্বর্গ দেখা, যে স্বর্গ বছরের প্রায় সাত মাস বরফের তলায় থাকে। কিন্তু ওই হিমালয়ের কুম্ভমেলা ও তার সংলগ্ন এলাকা দেখার পর, আমার মন ও চোখের সামনে ভেসে এসেছিল ভূবিজ্ঞান মিশ্রিত পূরাণ সম্পর্কিয় কিছু রহস্য যার সমাধান আমি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি।
--- ৩------
২০১৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় দিল্লি থেকে লাদাখগামী গোএয়ারের ফ্লাইট ধরেছিলাম লাদাখ যাবার উদ্দেশ্যে। লাদাখ যাবার সময় ফ্লাইটের জানলা দিয়ে হিমালয় পর্বতমালার তুষারাবৃত হিমাদ্রি শিখরগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম, আমরা সুবিশাল বরফে ঢাকা গিরিরাজ হিমালয়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি, যার সুদীর্ঘ এবং আগাগোড়া বরফে আচ্ছন্ন শৃঙ্গগুলো যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের ছোঁয়ার জন্যে তাকিয়ে রয়েছে। সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ ওই তুষার-ধবল আর্দ্র পর্বতশৃঙ্গগুলোতে হিল্লোলিত হয়ে নানান বর্ণের সমাবেশে প্রতি মূহুর্তে এক অপূর্ব সৌন্দর্য প্রতিফলিত করে চলেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম ওই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করা তো কোন ছাড়, পৃথিবীর কোনো চিত্রকরের তুলিতেই সেই অপূর্ব দৃশ্যের সামান্য প্রতিকৃতিও অঙ্কিত হতে পারে না। ওই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মনেহলো, বতর্মান জগতের আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত মানুষের ক্ষমতার গর্ব, এই বিরাট বিশাল নগ্ন সৌন্দর্যের কাছে এসে স্তম্ভিত হয়ে, প্রতি মুহূর্তে নূতন বর্ণে সুরঞ্জিত অভ্রভেদী শৃঙ্গগুলোর দিকে তাকিয়ে, নিজের ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে করতে, নতজানু হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে আমাদের বিমান হিমালয় পর্বতমালার শিবালিক, ধৌলাধর, গ্রেটার হিমালয় ও ঝনস্কার রেঞ্জ পার হয়ে লাদাখ রেঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে ভারতের সর্বোচ্চ এবং উচ্চতার নিরিখে পৃথিবীর বাইশতম উচ্চ, লেহ শহরের লাগোয়া কুশক বাকুলা রিমপোচি বিমান বন্দরে নেমে পড়েছিল। আমরাও ১০৬৮২ ফুট উচ্চতার কোনো বিমান বন্দরে প্রথম পদার্পণ করেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে লেহ শহরে যাবার পথে গাড়িতে বসেই দেখছিলাম বিশাল বিশাল পোস্টার, হিমালয়ের কুম্ভমেলার। প্রতি বারোবছর পর আয়োজিত কুম্ভমেলার শুরু হয়েছিল ১৬-০৯-২০১৬ থেকে। আমরা লাদাখ পৌঁছেছিলাম ১৩-০৯-২০১৬, অর্থাৎ তার তিন দিন পূর্বে। হিমালয়ের কুম্ভমেলার সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণাই ছিলনা। তাই হিমালয়ের কুম্ভমেলা দেখবার আশায় মনটা খূশীতে ভরে উঠেছিল। (ক্রমশ - পরবর্তী পর্ব ১৬/১০/২০২০ র পর)
দ্বিখন্ডিত দামোদরের মাঝে গড়ে ওঠা গ্রাম - ভাঙ্গামোরা। বর্গীদের সময়কালে এ অঞ্চল ছিল উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণদের বসবাস। গড়ে উঠেছিল বহু হিন্দু মন্দির। এমনই একটি মন্দির নিয়ে এই আধ-কাটার গল্প।
~~ ভাঙ্গামোড়া গ্রামের ছোট্ট একটি জায়গা আধ-কাটা। তৎকালীন সময়ে গড়ে ওঠা আনুমানিক প্রায় 300 বছরেরও বেশি প্রাচীন দুটি টেরাকোটা মন্দিরের অবস্থান এই আধ-কাটা অঞ্চলে। ~~ ইতিহাস জানা না গেলেও আটচালা বিশিষ্ট সুবিশাল মূল মন্দিরটি বিষ্ণু মন্দির ছিল বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরের গঠনশৈলী চমকপ্রদ। মন্দির গাত্রে রামায়ণের কাহিনী বর্ণিত সুনিপুণ টেরাকোটা। প্রায় 20/25 ইঞ্চি পুরু মন্দিরের দেওয়াল। মন্দিরের চূড়ার নিচে একটি ছোট কক্ষ আছে। ভেতরে সিঁড়ি রয়েছে ওই কক্ষে পৌঁছানোর জন্য। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে শেষপ্রান্তে নির্মিত ঢাকনায় তলা থেকে বল প্রয়োগ করে উপরদিকে খুলে কক্ষে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের নীচেও একটি গুপ্ত কক্ষ এবং একটি সুরঙ্গ পথ আছে। সম্ভবত এই সুরঙ্গ পথ দিয়ে গ্রামের বাইরে চলে যাওয়া যেত। বর্গী আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে এই সুরঙ্গপথ ও কক্ষগুলি ব্যবহার করা হতো বলে অনুমান করা হয়। কিংবদন্তি আছে - এক সন্ন্যাসী এই সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে আর বেরিয়ে আসেননি। ~~ স্থানীয় মানুষ মনে করে অসুরেরা রাতারাতি এই মন্দির তৈরী করে। সেই রাতেই মন্দিরের পাশে পুকুর কাটাও শুরু হয়। অর্ধেক পুকুর কাটার পর ভোরের আলো দেখা দিলে রাত শেষ হওয়ার ভয়ে অসুরেরা কোদাল-টোদাল ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। সেই অর্ধেক কাটা পুকুর থেকেই জায়গার নাম "আধকাটা"। ~~ তবে কিংবদন্তি আছে - মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা এক রাত্রির মধ্যে মন্দিরের পাশে একটি বিশাল পুকুর খনন করাবেন বলে পরিকল্পনা করেন। গ্রামবাসীর মনে একটি বিস্ময় ভাব গড়ে তোলা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। সকালে উঠে মানুষ দেখবে এবং বলবে কোন দৈববলে পুকুর তৈরি হয়েছে। খনন কার্য চলাকালীন মধ্যরাত্রে বর্গী আক্রমণের খবর আসে। আক্রমণের ভয়ে খননকারীরা অর্ধেক কাটা পুকুরের কাজ বন্ধ করে চলে যায়। খননকার্যে খুঁত বা বাধা হওয়ায় পুকুরটি পুনরায় খনন করা হয়নি। ~~ আরো একটি কিংবদন্তি শোনা যায়, পুকুর খনন কার্য চলাকালীন মাঝরাতে একটি কাক "কা-কা" করে ডেকে ওঠে। খননকারীরা ভোর হয়ে গেছে ভেবে কাজ বন্ধ করে চলে যায়। এইভাবে অর্ধেক কাটা পুকুর থেকে জায়গার নাম "আধকাটা"। ~~ পথদিশা - হাওড়া-তারকেশ্বর লোকাল ট্রেনে তারকেশ্বরে নেমে সেখান থেকে বাস ধরে দেউলপাড়া। দেউলপাড়া থেকে ডানদিকে বাঁধের রাস্তা ধরে ভাঙ্গামোড়া ৭ কিমি।| দেউলপাড়া থেকে ভাঙ্গামোড়া যাওয়ার জন্য মোটরভ্যান বা ট্রেকার পাওয়া যায় তবে তা সংখ্যায় কম। ~~ নিকটবর্তী দর্শনীয় - ভাঙ্গামোড়া, বৈকুন্ঠপুর, সৌলুক, দেউলপাড়া, তারকেশ্বর।
পৃথিবী এখন অসুস্থ, বিগত সাত মাস ব্যাপী এই লড়াই আমাদের দুর্বল করে দিলেও,মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। বাঙালীর পায়ের তলায় সর্ষে,মাঝে কিছুদিনের বিরতি থাকায় কিছুতেই শান্ত হতে পারছিলাম না।মাঝে মাঝে পাগলের মতো ভিড়, দমবন্ধ ইটকাঠ, পাথর আর কংক্রিটের শহর থেকে মন পাড়ি দেয় অন্য কোথাও।
সপ্তাহশেষে যৎসামান্য তল্পিতল্পা নিয়ে কোনওক্রমে পালিয়ে যাওয়ার বাসনায়,দ্বিচক্রযানটি নিয়ে মুখে মাস্ক এঁটে,বেরিয়ে পড়লাম গিন্নিকে নিয়ে,গন্তব্য এবার ইটাচুনা।প্রতি দিনের ছাপোষা জীবন আর তুচ্ছতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এক ছুট্টে চলে গেলাম ইতিহাস মোড়া ইটাচুনা রাজবাড়িতে। যান্ত্রিক আধুনিকতাকে সটান ছুড়ে ফেলে রাজকীয় দিনরাত কাটানোর বাসনাতেই পৌছে গেলাম ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা ইটাচুনা( আমার বাসস্থান হাওড়া থেকে ৬২ কিমি)।জনঅরণ্য থেকে খানিক দূরেই হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ি প্রস্তুত আভিজাত্যের চাদরের মোড়কে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে। 'খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো, বর্গী এল দেশে’ চৌথ আদায়ের জন্য বর্গীরা(মারাঠা সৈন্য) প্রায়ই হানা দিচ্ছে।সেইসময় প্রচুর ধনসম্পত্তি করে কুন্দ্রা রাজা বংগদেশে থেকে যান।এই কুন্দ্রা থেকেই পরবর্তী কালে কুন্ডু পদবী তে রুপান্তর হয়।সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর বংশধররা ১৭৬৬ সালে এই রাজবাড়ি তৈরি করেন। বর্গীদের বাড়ি বলে স্থানীয়। মানুষ একে বর্গীডাঙাও বলেন।শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গাছগাছালি মেঠো পথ, মাইলের পর মাইল সবুজে মোড়া চাষের জমি, কলোচ্ছ্বাসরত শিশুর দল চোখ জুড়িয়ে অদ্ভূত প্রশান্তি দেয় হৃদয়কে। পথ শেষ হয় রাজবাড়ির বিশাল ফটকে। গেট ছাড়িয়ে ভিতরে পা দিলে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ— কালের নিয়মে সেই অতীত জৌলুসের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। তাও পুরনো দেওয়ালের প্রাচীন গন্ধ, উঁচু কড়িবরগার ছাদ, আল্পনা দেওয়া বিরাট নাটমন্দির, প্রাঙ্গন জুড়ে বিরাট বিরাট বাতিস্তম্ভ, প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি দিয়ে সাজান ইতিহাসের গন্ধমাখা সুবিশাল বৈঠকখানা মুহূর্তে অন্য এক জগতের দরজা খুলে দেয় চোখের সামনে। কাছারি বাড়ি, হিসাবের ঘর, বাজার সরকারের ঘর পেরিয়ে তবে অন্দরমহলে পা।বাড়ির মেয়েরা যাতে অন্দরের জানলা খুলে বাইরেটা দেখতে পান, অথচ তাঁদের কেউ দেখতে না পায় সেই ব্যবস্থা করা ছিল অলিন্দে ছোট ছোট জানলা করে। বাড়ির সবই সাবেক প্রথার। বড়কর্তা মেজোকর্তার সারিবদ্ধ ঘর, বিবর্ণ বহু পুরনো আসবাবপত্র, বিরাট সিন্দুক,কারুকার্যমণ্ডিত পালঙ্ক সবই। বাড়ির লম্বা নিঃঝুম অলিন্দ, জানলা দিয়ে ডিঙি মেরে দেখা বাইরের সবুজের সমারোহ, খিড়কির পুকুরে নুয়ে পড়া গাছ— সবই বড় মায়াবী, মনকেমন করা। অতিথিদের জন্য মোট ১৭ টি ঘর আছে,সাবেক প্রথা মেনে যার ঘর তার নামেই ঘরের নামকরণ- বড় বৌদি,ছোট বৌদি,কাকাবাবু,ছোট পিসিমা ইত্যাদি।বর্তমানে ঠাকুমার ঘরটি সারিয়ে দেবপ্রভা নামকরণ করা হয়েছে(৬ জন ব্যক্তির এক সাথে থাকার ব্যাবস্থা আছে) এছাড়া রাজবাড়ির পিছনে কুটিরেও থাকা যায়। আমরা বড় বৌদির ঘরে ছিলাম,খাট,বিছানা থেকে আলমারী,দেরাজ,টেবিল ল্যাম্প কার্পেটে ইতিহাস মোড়া।মোট দুটি ঘর-একটি শয়ন কক্ষ অপরটি স্নান ঘর।ঘর সংলগ্ন বারান্দায় হাঁটলে নিজের নিঃশ্বাস ও বাতাসে ধ্বনিত হয়,মাঝে মাঝে শুধু কপোত- কপোতিরা ডানা ঝাপটে আপনায় চমকে দিতে পারে। প্রতিদিন বিকেল ৪.৩০ টায় গাউড আসেন অতিথিদের বাড়ী ঘুরিয়ে দেখান,ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করেন।পাকশালা,বাগান,পিছনের বাগান,রাজবাড়ীর জলাশয় এবং সবশেষে স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে ২০ বিঘা প্রাসাদের ছাদ।ছাদটি বড়ই মনোরম। প্রকাণ্ড ছাদে দিনের বেলা তুমুল হাওয়া আলোড়িত করে যায়। রাতের নিবিড় অন্ধকার ঠাণ্ডা শিরশিরে স্রোত বইয়ে দেয় বুকের ভিতর দিয়ে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় নক্ষত্রের রাত বুঝি একেই বলে। যেন নিকষ অন্ধকারে হিরের টুকরো ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। স্ট্রিট লাইট বিচ্ছুরিত শহুরে জীবনে এমন রাত তো আসে না!ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় সন্ধারতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে রাজবাড়ির ঠাকুরদালান থেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায় কুন্দ্রারা শিবের উপাসক ছিলেন,তাই রাজবাড়ীর বিপরীতে শিবলিংগ প্রতিষ্ঠিত আছেন। তার কিছুদূরেই দূর্গামন্দিরও আছে।পরবর্তীকালে এনারা শ্রীকৃষ্ণের পূজা চালু করেন এবং শ্রীধর জিউ(নারায়ণ) এর নিত্য পূজা চালু হয়,দিনে তিনবার ঠাকুরের আরতি হয়-সকাল ৬টা,সকাল ১০ টা আর সন্ধ্যা ৬টায়।আরতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে এক বাঁশুরিয়া পাশের গ্রাম থেকে রোজ বাঁশি বাজাতে আসেন রাজবাড়িতে। তাঁর নিমগ্ন বাঁশির মন খারাপ করা মেঠো সুর ভেসে যায় হাওয়ায়। খেলা করে নিস্তব্ধ বাড়ির আনাচ কানাচে।চা ঘরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বৈঠকখানার সেই প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি ইতিহাস কে আকড়ে টিকে আছে।
রাজবাড়ির খাওয়ার ব্যবস্থাও রাজকীয়। অথেনটিক বাঙালি রান্না বলতে যা বোঝায়, পাওয়া যায় এখানে। বনেদি জমিদার বাড়ির অন্দরসজ্জায় সজ্জিত ঝকঝকে কাঁসার থালাবাটিতে পরিবেশিত এই খাবারের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে বহু দিন।আধুনিকতায় মোড়া রুম সার্ভিস নয়,খাঁটি বাঙালি আদপে একসাথে বসে একতলায় পাকশালার পাশেই খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।ভাত,ডাল থেকে শুরু করে কোপ্তা,ছানার ডালনা হোক কি চিংড়ি,ভেটকি বা দেশী মুরগীর ঝোল।শুধু আগের দিন রাত্রে জানিয়ে দিতে হবে পছন্দের তালিকা।
নিবিড় সবুজ আর বিস্মৃত ঐতিহ্যের মখমলি গন্ধ বুকে ভরে রাত কাটিয়ে এ বার ঘরে ফেরার পালা।আবার ইতিহাসের পাতা থেকে বেড়িয়ে কংক্রিটের রাস্তায় রোজকার দিনযাপন... কীভাবে যাবেন গাড়িতে গেলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে যান। আজাদ হিন্দ ধাবা এবং হিন্দুস্থান হোটেলকে বাঁদিকে রেখে তার পরের বাঁ দিকের রাস্তা ধরুন। ব্রিজের তলা দিয়ে ডান দিকে গিয়ে পৌঁছে যান বোসিপুর। সেখান থেকে ১৯ কিলোমিটার আরও ড্রাইভ করে পৌঁছে যান হালুসাই। যেখান থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে ইটাচুনা রাজবাড়ি। ট্রেনে গেলে বর্ধমানগামী যে কোনও (ভায়া মেন লাইন) ট্রেন ধরুন। অথবা হাওড়া থেকে মেমারি-পাণ্ডুয়া লোকালও ধরতে পারেন। ট্রেনে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে যেতে। ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে আরও গোটাতিনেক স্টেশনের পর আসবে খন্যান। সেখানে নেমে ভ্যান/রিকশা/অটোয় মিনিট দশেকের পথ ইটাচুনা রাজবাড়ি। কোথায় থাকবেন থাকার ব্যবস্থা রাজবাড়ির অন্দরমহলেই। বিলাসবহুল ঘর থেকে মাটির কুঁড়েঘর— সব রকমের ব্যবস্থাই রয়েছে। বিলাসিতার মাপকাঠির নিরিখে ভাগ করা সবক’টা ঘর। সবচেয়ে দামি ঘর বিলাস মঞ্জরীতে যেমন থাকতে পারবেন পাঁচজন। শোয়ার ব্যবস্থা বিরাট পালঙ্কে! পাশাপাশি খড়ের ছাউনি দেওয়া কুটিরেও রাত কাটাতে পারেন ইচ্ছে হলে। ঘরের নামগুলো ভারী সুন্দর। গিন্নিমা, ছোট বৌদি, কনকলতা, ঝুমকোলতা ইত্যাদি। ঘর ভাড়া ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮৪০০ পর্যন্ত। এসি, নন এসি— দু’রকমের ঘরই পাবেন। তবে সপ্তাহান্তে ঘর ভাড়া বেশি। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসি ঘর পাওয়া যাবে না। আগে থেকে ঘর বুক করে রাখার জন্য ইটাচুনা রাজবাড়ির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট দেখতে পারেন। *গাড়ি পার্কিং রাজবাড়ীর মধ্যে করা যায়,তবে জায়গা না পাওয়া গেলে প্রাসাদের বাইরে নিজ দায়িত্বে রাখতে হয়।
প্ল্যান করেছিলাম রবিবার দিনই যাবো লঞ্চে গঙ্গা ভ্রমনে ...গিয়েছিলাম..কিন্তু সেদিন টিকিট না পাওয়ায় ফিরে এসেছিলাম....তাই আর রবিবারে যাওয়ার দুঃসাহসীকতা দেখাতে পারলাম না . . . বুধবারেই চলে গেলাম আর টিকিট পেয়েও গেলাম বিকেল 4টের রাইডের.... টিকিটের মুল্য ৩৯ টাকা ...মিলেনিয়াম পার্কে গিয়ে টিকিট কাটতে হয়... এখনো অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা হয়নি...
লঞ্চ টা মিলেনিয়াম পার্ক থেকে ছেড়ে প্রথমে হাওড়ার দিকে রওনা দেবে.. | নিমতলা ঘাট, বাগবাজার ঘাট, আর্মেনিয়ান ঘাট ছাড়িয়ে হাওড়া ব্রীজ ক্রস করে বেশ খানিকটা গিয়ে পুনরায় লঞ্চ U টার্ন নিয়ে ফিরে গিয়ে হাওড়া স্টেশন, মিলেনিয়াম পার্ক ছাড়িয়ে বাবুঘাট ,ইডেন গার্ডেন ছাড়িয়ে দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজের নীচ থেকে লঞ্চ ঘুরিয়ে পুনরায় মিলেনিয়াম পার্কে এসে থামবে... এই পুরো যাত্রা পথের সময় ছিল ৯০ মিনিট ... সেই সঙ্গে সুর্যাস্ত যাত্রা পথের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করে ... লঞ্চের পুরো সময় টাই রবীন্দ্র সংগীত চলেছিল... একদিকে রবীন্দ্রসংগীত আর এক দিকে সুর্যাস্ত - এই কম্বিনেশন কে শব্দে প্রকাশ করা যায়না .... এর সঙ্গে লঞ্চের মধ্যেই ছিল হালকা স্ন্যাকসের আয়োজন... এক কথায় ৯০ মিনিট ছিল অনবদ্য.... ভ্রমণের দিন . - 14/10/2020 ....
দুর্গাপুরের এতকাছে এতভাল একটা ইতিহাসের দলিল এতদিন পর কেন দেখলাম/ জানলাম এখন এটাই মনে হচ্ছে। আরও আগে আমাদের দেখে আসা উচিৎ ছিল। সে যাই হোক, গতকাল প্রসেনজিৎ দার পরিবারকে সঙ্গী করে আমরা রওনা দিলাম ৩০ কিমি দুরের কালিকাপুর রাজবাড়ি। অনেকদিন বন্দী থাকার পর গতকাল (১১/১০/২০২০) দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর আমরা আউসগ্রাম ব্লক২ এর গ্রাম কালিকাপুর গ্রামের উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। মলানদীঘি থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে ইলামবাজার রোডে উঠে একটু এগিয়ে এগারো মাইল স্টপেজ এ আাবার ডানদিকে বাঁক। গুসকরা রোড বরাবর একটু গিয়ে জঙ্গলের ভিতর প্রথম বাঁ দিকে যে রাস্তা টা গিয়েছে ওটাই কালিকাপুর গ্রাম পৌছে দিল।
এখানেই রাজবাড়ি। রাজ বাড়ি না জমিদার বাড়ি - এ নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে।এ প্রসঙ্গে কমল চৌধুরীর ‘বাংলার জমিদার ও রায়তের কথা’ বইটির একটি উদ্ধৃতি -“ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যাবস্থায় বঙ্গদেশে রাষ্ট্রবিপ্লবের আধিক্য দৃষ্ট হইয়াছিল।
সেই বিপ্লবসম্ভূত কারণ হইতে দেশে যে মহা অনর্থের সূচনা হয় ; রাজা প্রজা সকলেই তাহাতে শঙ্কিত হইয়াছিলেন ; সেই সময়ে বঙ্গদেশে রাষ্ট্রীয় ও রাজস্ব সম্বন্ধীয় নিয়মাবলীর আমূল পরিবর্তন হইয়া যায় ; সেই পরিবর্তনের কালে জমিদার সম্প্রদায়ের প্রথম পত্তন, এরূপ মনে করা নিতান্ত অসঙ্গত হয় না।
কিন্তু তৎকালে জমিদারদিগের স্বাধীন ক্ষমতা ছিল, এবং তাহারা জমিদার নামে অভিহিত না হইয়া অনেকেই রাজা নামে আখ্যাত হইয়াছিলেন। বোধ হয়, এই জন্যই অস্মদেশের প্রজা সাধারণ এখনও জমিদার কে রাজা বলিয়া সম্মোধন করিয়া থাকে।” তাই জমিদার বাড়ি কে আমরা সাধারন মানুষেরা রাজবাড়ি বলেই বেড়িয়ে মনের আনন্দ নি। এখানে কথা বলে যা জানা গেলো বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন পরমানন্দ রায়। তিনি পার্শ্ববর্তী মৌখিরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বর্ধমান রাজার কাছে এই এলাকার জমিদারির দায়ীত্ব পান। এই এস্টেট নাকি রানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চাষের থেকেও বেশি আয় ছিল বিস্তৃত বনাঞ্চল থেকে। মৌখিরা গ্রামে বন্যার প্রকোপ থাকায় তিনি কালিকাপুরে এসে বনভূমি পরিস্কার করে তাঁর সাত সন্তানের জন্য সাতটি মহল বানান। এজন্য এই রাজবাড়িটিকে সাতমহলা রাজবাড়ি বলা হয়। ১৭৬১ শকাব্দ বা ১৮১৮ খ্রীঃ নাগাদ এই সাতমহলা রাজবাড়িটি তৈরি হয়। ( তথ্য সূত্র --যোজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর বর্ধমানঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি / ৩য় খন্ড//// অমিতাভ গুপ্ত--photographer and travelogue writer)। এই রাজবাড়ি সংলগ্ন দুর্গাদালান, সামনে নাটমন্দির। গেট দিয়ে প্রথমেই আমরা দুর্গামন্দিরে প্রবেশ করলাম। মৃৎশিল্পী দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে চলছেন। মন্দিরের চতুর্পাশ প্রায় ভগ্নস্তূপ। মাঝখানের নাটমন্দিরে বিশালাকার স্তম্ভগুলি দাড়িয়ে আছে। এখানেই শুটিং হয়েছে মৃনাল সেনের খন্ডহর। রসগোল্লা সিনেমার টাপুরটুপুর গানের দৃশ্যটি চোখে ভেসে উঠবে। এছাড়াও এলার চার অধ্যায়, গয়নার বাক্স, মেঘনাদ বধ রহস্য, আরেকটি প্রেমের গল্পো, গুপ্তধনের সন্ধানে, ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে ইত্যাদি সিনেমার শুটিং ও এই রাজবাড়িতেই হয়েছে। এই শুটিংয়ে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকেই নাকি দুর্গামন্দির সংস্কার করা হয়েছে। রাজ পরিবারের বাকি সদস্য রা বিভিন্ন শহরে বসবাস করলেও দুর্গাপুজোতে সবাই আসেন। এখন একমাত্র রাজবাড়িতে বসবাসকারী বংশধর লাজপত রায়। ওনার সাথে কথা বলে কিছু ইতিহাস জানলাম। সাতমহলের ঐ একটি মহল ছাড়া সব গুলিই প্রায় ধ্বংসস্তূপ। ভিতরে প্রবেশ করবো তারও উপায় নেই। ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি পুরো এলাকা। রাজবাড়ির যে অংশে লাজপৎ বাবুরা বসবাস করেন তার বাইরে লেখা আছে-- এখানে আড্ডা মারিবেন না।। এরকমই অবস্থা আজ সাতমহলা রাজবাড়ির। আমরা দুর থেকেই রাজবাড়ির ফটোগুলি নিলাম কেননা প্রচুর ঝোপ জঙ্গল, কাছে যাওয়া গেলনা। দুর্গাদালানের বাইরে আছে জোড়া শিব মন্দির। টেরাকোটার কাজগুলিও অপূর্ব। রাজবাড়ির পিছন দিকে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম আরেকটা ভগ্ন মন্দির। পরমানন্দ রায়ের ছেলে কৈলাশ পতি রায় এই রাধাবল্লভ মন্দির টি তৈরি করছিলেন , কিন্তু তৈরি হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। কাজেই ওই মন্দিরটি অপূর্নঅবস্থাতেই ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে। গ্রামবাসীদের সাথে গল্প করতে করতে জানা গেলো এখানে গ্রামের বাইরে নীল কুঠিও আছে। কিন্তু যাওয়া যাবেনা, কিছুই দেখা যাবে না, জঙ্গলে ভর্তি -- এসব কথা। আমরা শুনে অতি আগ্রহে হাঁটা লাগালাম। পড়ন্ত বিকেল বেলায় গ্রাম্য পথে হাঁটতে ভালোই লাগলো, বেশি দুর নয়-- মাত্র ১/২ কিমি। একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি -- শুধু দেওয়াল গুলি মাথা উচিয়ে দাড়িয়ে আছে। তবে ভাল লাগলো ঘন ঝোপ সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পর এক বিশাল চৌকোনা পুকুরের সামনে এক সান বাধানো ঘাট। নিশ্চুপ এলাকা। পুকুরের মাঝখানে বড় বড় কয়েকটা পাখি। নীল চাষের জন্য নাকি অনেক চৌবাচ্চা আাছে যেগুলি এখন ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা। তবে এখানে এখনো অনেক নীল গাছ আগাছার মতো রয়ে গেছে। এখানকার এই ঝোপগুলি মুলত নীল গাছেরই। চাষ না হলেও দুই শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলেছে তারা। ( কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ গ্রামবাসীদের সাথে আলাপ চারিতা, লাজপৎ বাবুর সাথে অল্প সময়ের কথাবার্তা ও ইন্টারনেটে পাওয়া অমিতাভ গুপ্ত ও মন্দিরা ঘোষের লেখা আমাকে এই পোস্টটি লিখতে যথেষ্ট সাহায্য ও উৎসাহিত করেছে)
মিরিক শব্দটির উৎপত্তি লেপচা ভাষার শব্দ Mir-yok থেকে। যার অর্থ আগুনে ঝলসে যাওয়া স্থান। কিন্তু বাস্তবে হয়তো তারপরের চিত্রটাই ধরা পড়ে মিরিকের সৌন্দর্য এবং তার চারপাশের পরিবেশ থেকে। ঠিক যেভাবে কোন জঙ্গলে দাবানল লাগার পরে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু হয়। বৃষ্টির জলে ছোট ছোট নতুন গাছ জীবন্ত হয়ে ওঠে , সবুজের সমারোহে চারদিক ভরে যায়, মিরিকের চরিত্রটাও ঠিক সেইরকম।
মিরিক হলো পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার একটি মহকুমা।2017 সালের 30 মার্চ দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং মহকুমা এর অন্তর্গত পৌরসভা উন্নয়ন ব্লক নিয়ে এই মহাকুমা সম্পূর্ণভাবে গঠিত হয়। দার্জিলিং জেলার একটি মহকুমা হলেও মিরিকের স্বভাব দার্জিলিংয়ের শত ব্যস্ততার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে প্রায় ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় মিরিকের অবস্থান। পাহাড়, হ্রদ আর ধুপিগাছের ও পাইনগাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা রোমান্টিক জায়গা এই মিরিক। এক কিলোমিটারের বেশি লম্বা সুমেন্দু সরোবর মিরিকের প্রাণকেন্দ্র , যাকে আমরা মিরিক লেক বলেও জানি। শিলিগুড়ি এবং NJP দুই জায়গা থেকেই খুব সহজেই মিরিক যাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে মিরিক এর দূরত্ব প্রায় 52 কিলোমিটার। শিলিগুড়ির তেঞ্জিং নরগে সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড থেকে মিরিক যাওয়ার বাস ছাড়ে এবং সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা। এছাড়াও গাড়ি ভাড়া করে শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি চলে আসতে পারেন। প্লেনে আসতে চাইলে মিরিকের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর বাগডোগরার দূরত্ব প্রায় 55 কিলোমিটার। ট্রেনে করে আসলে নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে মিরিকের দূরত্ব সড়ক পথে প্রায় 56 কিলোমিটার। গাড়িতে করে আসতে সময় লাগবে প্রায় পৌনে দুইঘন্টা থেকে দু'ঘণ্টা। মিরিক আসার সবথেকে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে জানুয়ারি অথবা মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ। আমরা NJP দিয়ে গিয়েছিলাম এবং সময় টা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে। নিউ জলপাইগুড়ি তে নেমে স্টেশনের বাইরে বেরোতে না বের হতেই দেখি চারপাশে অজস্র ছোট-বড় গাড়ির ভিড়। সবাই যে যার মত প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছে। আপনি চাইলে এখান থেকে পুরো গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন অথবা শেয়ারে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। আমরা ছিলাম সব শুদ্ধ আটজন তাই আমরা একটা টাটা সুমো পুরোটাই ভাড়া নিলাম। মিরিক পর্যন্ত যেতে আপনার খরচ পড়বে কমবেশি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা তবে সব সময় দরদাম করে নেবেন। গাড়িতে করে হোটেলে পৌছাবার সময় রাস্তার মাঝামাঝি এক জায়গায় আমাদের ড্রাইভার লাঞ্চের জন্য গাড়ি থামালেন। হোটেলটা দুইতলা। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। আশপাশের পরিবেশটা খুবই নির্জন এবং গাছপালায় ভর্তি। তবে দেখলাম আমরা ছাড়াও এখানে বহু পর্যটক লাঞ্চের জন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে ভিড় করেছে।লাঞ্চ সেরে এবার আমরা হোটেল এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যেতে যেতে দু'পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দু চোখ ভরে উপভোগ করলাম।
মিরিকে আগে থেকেই আমাদের থাকার জন্য হোটেল বুক করা ছিল, হোটেলের নাম ব্লু লেগুন। হোটেলে পৌঁছে সবার আগে জামা কাপড় গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
এই হোটেলে খুব বেশি কর্মচারী নেই। মাত্র দুই থেকে তিন জন কর্মচারী। ওনাদের ব্যবহার এবং আপ্পায়ন খুবই ভালো। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অথচ নিস্তব্ধতার মধ্যে খুব সুন্দর এই হোটেল। আমাদের হোটেলের ঠিক সামনেই একেবারে মুখোমুখি কয়েক হাত দূরে লাঞ্চ এবং ডিনার করার জন্য একটি কাঠের তৈরী ঘর বানানো, এখানে সমস্ত গেস্ট কে লাঞ্চ এবং ডিনারের জন্য আপ্যায়ন করা হয়। তবে খুব দরকার থাকলে আপনি নিজের রুমেও লাঞ্চ এবং ডিনার করতে পারেন। খাবার জন্য যে ঘরটা বানানো হয়েছে সেটাও ছবির মত সুন্দর, শুধুমাত্র এই ঘরটাই নয়, আশেপাশে ছোট্ট ছোট্ট বেশ কয়েকটা লাঞ্চ বুথ বানানো রয়েছে, সেখানে বসেও আপনি নিশ্চিন্তে লাঞ্চ বা ডিনারের সারতে পারেন, তবে সেগুলি খুবই ছোট এবং তিন থেকে চার জনের জন্য উপযুক্ত। এগুলির পিছনে এদের ছোট একটা অর্গানিক বাগান রয়েছে, সেখানকার বহু সবজি প্রতিদিন রান্নায় ব্যবহার করা হয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই অন্যান্য আমিষ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন ডিম অথবা মাংস এরা দূরের বাজার থেকে সংগ্রহ করে আনেন। জন্মগতভাবেই এরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। তবে এখানে মাছ পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ফ্রেশ হতে না হতেই দশ মিনিটের মধ্যে ওনারা বিকেলের চা ও snacks ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা একটু আশেপাশের জায়গা ঘুরে দেখতে বের হলাম। আমাদের হোটেলের একেবারে সামনেই স্বচ্ছ টলটলে জলে ভরা মিরিকের প্রাণকেন্দ্র সুমেন্দু সরোবর অথবা মিরিক লেক। অনেকেই হয়তো মিরিক লেকের এই আসল নামটা কোনদিন শোনেননি। প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে কাঁচের মতন টলটলে স্বচ্ছ জল নিয়ে মিরিক লেক আর তার চারধারে লম্বা লম্বা আকাশছোঁয়া পাইন গাছ, ধুপিগাছ আর ফার্ণ এর জঙ্গল। ঘন সবুজ জঙ্গলের ছায়া পড়ে লেকের জলে মনে হবে সব সময় বাতাস খেলা করে চলেছে। যতটা পরিধি নিয়ে লেক আর তার চারপাশের জঙ্গল, ঠিক ততটাই রাস্তা বানানো রয়েছে লেকের চারদিকটা ঘুরে দেখবার জন্য। পুরো রাস্তাটা দৈর্ঘ্যে মোটামুটি সাড়ে তিন কিলোমিটার। এখানে মাঝে মাঝে বড় বড় গাছের নিচে ছোট ছোট বসার জায়গা করা আছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। সেখানে ছাড়াও হ্রদের পাশে সবুজ ঘাসের মাঠে বসেই অলস সময় কেটে যাবে। টুরিস্ট সিজনে ঘোড়ায় চেপে পুরো পথ ধরে ঘুরে আসা যায় , ঘোড়ার ভাড়া নির্ভর করে পর্যটক সমাগম এর উপর। এছাড়া হ্রদের জলেও বোটিং করারও ব্যবস্থা আছে। যদিও বর্ষার সময় লেকের জল অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার জন্য বোটিং বন্ধ থাকে। হ্রদের এপাশ থেকে ওপাশ যাওয়ার জন্য ইন্দ্রানী পুল বা রংধনু সেতু নামে একটি ছোট্ট ব্রিজ রয়েছে । ব্রীজের এক পাশে যদি একটানা পাইন গাছের জঙ্গল আছে তো ব্রিজের অন্য পাশে গিয়ে দেখা যাবে মোটামুটি বড় একটা ফাঁকা জায়গা, এবং সেটা মাটির বদলে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, সকাল এবং সন্ধ্যেবেলায় এটা মার্কেট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এখন চারপাশে ছোট ছোট দু চারটি দোকান, বেশকিছু আবাসিক হোটেল এবং ফুটপাতের কিছু খাবারের দোকান ছাড়া আর বেশি কিছু খোলা নেই। কয়েকটা ছোট ছোট গরম জামা কাপড়ের দোকানও আপনি এই জায়গায় পেয়ে যাবেন। এই জায়গায় এসে আমরা বেশ কিছুক্ষণ চারপাশের লাইন দিয়ে বাঁধানো বেঞ্চে বসে থাকলাম। সামনে দেখি বেশ কিছুটা দূরে জনাকয়েক লোকের জটলা। কাছে গিয়ে দেখলাম সেখানকারই কোনো লোকশিল্পী তাদের ভাষার অদ্ভুত সুন্দর গানে তালে তালে নেচে চলেছে, চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি ভুলে মগ্ন তালে তার সেই নাচ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
এখনো সেই লোকশিল্পী নিজের মনে নিজের তালে নাচে উন্মত্ত, আমাদের ছোট্ট হিয়াও দেখতে দেখতে সেই সুরের তালে নাচতে শুরু করলো। আর শুধু আমরাই নই, সেখানে উপস্থিত অন্যরাও আমাদের ছোট্ট হিয়ার নাচ দেখে খুব খুশি।
বসে থাকতে থাকতে চোখের সামনে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু এখানকার অসাধারণ সৌন্দর্য ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আমরা যেখানে বসে আছি তার ঠিক পিছনেই মিরিক লেক। কিছুটা গিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে লেক পর্যন্ত এবং সেখানে বেশ কিছু বোট বাধা রয়েছে টুরিস্ট নেওয়ার জন্য। আমরা শেষ পর্যন্ত আর লেকে বোটিং করিনি। আমরা সেখান থেকে আর কোথাও না গেলেও জানতে পারলাম এই লেকের পশ্চিম দিকের ঘাটে জঙ্গলের পরিবেশের মধ্যেই রয়েছে এক দুর্গা মন্দির, অনেকে আঞ্চলিকভাবে যেটাকে সিংহ দেবী মন্দির বলে জানেন। আরো কিছুক্ষণ সময় সেখানে কাটিয়ে, দু একটা দোকানে ওখানকার জিনিসপত্র দেখে প্রায় সন্ধের মুখে আমরা হোটেলে ফিরলাম। ঠিক করলাম পরদিন আশেপাশের জায়গা কোন একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে দেখা যাবে। জানতে পারলাম এখানে আশেপাশের জায়গা ঘুরে দেখার জন্য কোন ধরনের কন্ডাক্টেড টু্র এর ব্যবস্থা নেই। গাড়ি ভাড়া নেওয়ার জায়গা লেকের ঠিক পাশেই, সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছু টাটা সুমো এবং ল্যান্ড রোভার গাড়ি। সেখানে গিয়েই নিজেদের উদ্যোগে দাম দর করে গাড়ি ভাড়া করতে হবে। গাড়ি ভাড়া পড়বে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। যার মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন মিরিক গুম্ফা, বোকার লিঙ মনাস্টারি, ডন বস্কো চার্চ, সৌরিণী চা বাগান, থার্বো চা-বাগান টিংলিং ভিউ পয়েন্ট ইত্যাদি। আমাদের প্রথম গন্তব্য হল ডন বস্কো চার্চ। স্থানীয় ডন বসকো স্কুলের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা এই চার্জ দার্জিলিং জেলার অন্যতম বৃহৎ রোমান ক্যাথলিক চার্চ। চার্জের শ্বেতশুভ্র প্রাসাদটি মিরিকের প্রায় অনেকটা এরিয়া থেকেই দেখতে পাওয়া যায় এমন কি লেক থেকেও। ডন বসকো স্কুল থেকে একটু উঁচু ঢালের দিকে এগোতেই চার্চের স্টাফ কোয়াটার চোখে পড়বে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন স্কুল কোন কারণে বন্ধ ছিল এবং তার সংলগ্ন চার্চও। কয়েকবার ডাকাডাকি করতেই স্টাফ কোয়ার্টার থেকে চার্চের কেয়ারটেকার বেরিয়ে এলেন। তার কাছে জানতে পারলাম স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এখন দর্শনার্থীদের জন্য চার্চ খোলা যায় না। কিন্তু আমরা অনুরোধ করলে উনি শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র আমাদের জন্যই চার্চের গেট খুলে দেন। এখানে আমরা দেখতে পেলাম লাল রংয়ের রডোডেনড্রন ফুল। এই ফুল এখানে খুবই জনপ্রিয়। এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে এই ফুল দিয়ে অনেক ঔষধ তৈরি করা হয় সেই জন্য এই ফুলের এখানেও প্রচণ্ড চাহিদা। গেট দিয়ে কয়েক পা এগোতেই দুদিকে দুটো পেঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে চার্চের মধ্যে। চার্চের ভিতরে কাঠের প্যানেল এর সুন্দর কাজ আর বিশাল লম্বা লম্বা রঙিন কাচের জানালা পরিবেশ টাকে এক অসাধারন গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে। একতলায় এই কমপ্লেক্সের খুব সুন্দর করে মেন্টেন করা লন আর তার মধ্যে মাদার তেরেসার মর্ডান স্কাল্পচার এক নিস্তব্ধ এবং অসাধারণ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থলে লিঙ্ মনাস্টারি। এই মনাস্তেরিও মিরিক লেক থেকে দেখতে পাওয়া যায়। আর আপনি যদি এই মনাস্টারির ছাদ অব্দি পৌঁছে যান, তাহলে সেখান থেকেও মিরিক লেক এর অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবেন। এটি সমতল থেকে একটি ছোট্ট পাহাড়ের মতো টিলার উপর অবস্থিত। এখানে প্রায় 500 জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থাকেন এবং পড়াশোনা করেন। দার্জিলিং জেলার অন্যান্য মনাস্টারির মতন এটা ততটা পুরোনো নয়। শোনা যায় ১৯৮৪ সালে কাবজি বোকার রিপনচে নামক কোন ব্যক্তি এটির স্থাপনা করেন। অনেকটা চওড়া এবং ফাঁকা এরিয়া জুড়ে এই মনাস্টারি টি ছড়িয়ে রয়েছে। এর ছাদ এতটাই চওড়া যে এর ছাদে উঠে আপনি প্রায় পুরো মিরিকের প্যানোরামিক ভিউ উপভোগ করতে পারবেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট বড় তৈরি প্যাগোডা রয়েছে। যার মধ্যে অবস্থিত এখানকার দুটি অন্যতম আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে গোল্ডেন বুদ্ধা স্ট্যাচু এবং বিশাল বড় প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু প্রেয়ার হুইল, যেটাকে একসঙ্গে চার থেকে পাঁচ জন মানুষ ঘোরাতে পারবে। এখানে ঘুরতে আসার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে প্রার্থনার সময়। কোন প্রবেশমূল্য লাগবেনা। আমাদের এর পরের গন্তব্য স্থল মিরিকের বিখ্যাত চা বাগান। এখানকার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার জন্য মিরিকের পাহাড়ে কিছু বিশ্ব বিখ্যাত চায়ের বাগান আছে। সবথেকে বিখ্যাত হচ্ছে Tharbo plantation, যা ব্রিটিশ আমলের সময় থেকে চলে আসছে, এখন এটি Goodricke brand অধিগ্রহণ করেছে। এটি হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে পুরনো চা বাগান। এছাড়াও অন্যতম একটি বৃহত্তম চা বাগান হচ্ছে Okayti tea estate, স্থানীয় লোকজন এটিকে Rangdoo tea estate বলেও জানে। এটিও এখানে উনবিংশ শতক থেকেই রয়েছে। চা বাগানে গিয়ে আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম। চারিদিকে এত অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য যে এখান থেকে সহজে যেতে মন চাইছিলো না। যেদিকেই তাকানো যায়, যেন কোন শিল্পীর হাতে তুলি দিয়ে আঁকা উঁচু-নিচু সবুজের ঢাল আর তার মাঝে দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা পরিষ্কার পাথুরে রাস্তা। আমাদের কাছে আর খুব বেশি সময় ছিল না, তাই আমরা চা-বাগানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আস্তে আস্তে নিজেদের হোটেলের দিকে ফিরে চললাম। কিন্তু হাতে সময় থাকলে কেউ ঘুরে দেখে নিতে পারেন মিরিকের আরো দু'তিনটি অসাধারণ জায়গা। মিরিক লেক থেকে মাত্র 2 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত কমলালেবু, আর এলাচের অনেক বড় বড় ফার্ম। কম তাপমাত্রা এবং সুন্দর আবহাওয়ার জন্য এখানে খুব ভালো রকমারি প্রজাতির অর্কিডেরও চাষ হয়। মিরিকে আমাদের থাকার সময় এই টুকুই ছিল। অসাধারণ কিছু অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে নিয়ে মিরিক থেকে আমাদের ফেরার পালা।।
কলকাতা থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে লাল মাটির টানে সোজা বাঁকুড়ার মুকুটমনিপুর। সময়টা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। বাড়ি থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে সাঁতরাগাছি পৌছালাম সকাল 5 টা 50 মিনিটের মধ্যে। হাওড়ার সাঁতরাগাছি জংশন থেকে 12883 রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস সকাল 6 টা 25 মিনিটে ছেড়ে বাঁকুড়া পৌঁছনোর কথা সকাল দশটায়। ট্রেন কিছুটা লেট করে আমরা পৌঁছলাম 10 টা 35 মিনিটে। বাঁকুড়া থেকে মুকুটমনিপুর এর সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় 50 কিলোমিটার। প্রতি ঘণ্টায় বাঁকুড়া থেকে বাস ছাড়ছে অথবা আপনারা যদি কোন লজ বুকিং করে থাকেন তাদের সঙ্গে আগে থেকে চুক্তি করা থাকলে তারাও স্টেশনে গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়াও যাত্রী ভাড়া নেওয়ার জন্য অজস্র টাটা সুমো টাইপের গাড়ি স্টেশনের ঠিক বাইরে সব সময় ডাকাডাকি করছে।
আমরা উঠেছিলাম অহল্যা লজে। আগে থেকে বুকিং করা থাকায় লজের গাড়ি আমাদের জন্য স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল। বাঁকুড়া স্টেশন থেকে লজে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগলো দু'ঘণ্টার একটু বেশি। লজে গিয়ে সবাই বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে একটু আশেপাশের লালমাটির ছোট ছোট টিলা আর ছড়িয়ে থাকা দু-একটা টুকরো টুকরো বাজার দেখেই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু আপনি যেকোন বাজারে যান না কেন খুব সুন্দর সুন্দর ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের মাটির আর কাঠের মূর্তি এবং অলংকার দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না। এবং এগুলোর দাম খুবই সাধ্যের মধ্যে। তারপরও আপনি দাম-দর করার সুযোগ পাবেন। পরদিন সকালে একদম ভোর বেলায় বেরিয়ে পড়লাম আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু কংসাবতি ড্যাম এর উদ্দেশ্যে। বিষ্ণুপুর থেকে প্রায় 82 কিলোমিটার দূরত্বে বাঁকুড়া জেলার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমণিপুর। কংসাবতী নদীর উপর গড়ে ওঠা বাঁধ ও তার সংলগ্ন জলাশয় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই মূলত মুকুটমনিপুরের খ্যাতি। প্রায় 86 বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে 11.7 কিলোমিটার লম্বা এবং 38 মিটার উঁচু বাঁধ দিয়ে কংসাবতী নদীর জল কে ধরে রাখা হয়েছে।
এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক শোভা অতুলনীয়। জলাধার এর পাশে বসে বা জলাশয়ে নৌকা বিহার করে সময় কেটে যাবে।
বাঁধের একদিকে তীর সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চা ডিমটোস্ট এর দোকান। ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র মোরগের মুরগির দল। নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির । দোকান গুলির সামনে ছোট ছোট মাটির টিলা। আর মাটির টিলার সামনে আবার প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল পাতা। যেখানে খুশি বসে আপনি খেতে পারেন। এই বাঁধের জলাশয় এর জলে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত অতুলনীয়। মুকুটমণিপুর থেকে 6 কিলোমিটার দূরে কুমারী ও কংসাবতী নদীর সঙ্গমস্থল। নদী সঙ্গমে যাওয়ার জন্য ড্যাম টপ রোড ধরে প্রায় 6 কিলোমিটার যেতে হবে। তার ঠিক পাশেই দেখতে পাবেন পারস্নাথ পাহাড় যার মাথায় মহাদেব ও জৈন তীর্থঙ্কর পার্ষণাথ স্বামীর মন্দির রয়েছে। মুকুটমনিপুরের আরও একটা আকর্ষণীয় গন্তব্য কংসাবতী নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ঝিলিমিলির জঙ্গল। যা কিনা পিকনিক স্পট হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় । এছাড়াও অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে অম্বিকা মাতা মন্দির ভৈরব শিব মন্দিরের মূর্তি, রানিবাঁধ এবং নদীর মাঝে জলাধারের মধ্যে সবুজদীপ ডিয়ার পার্ক ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে রানিবাঁধ এর দূরত্ব মুকুটমণিপুর থেকে একটু বেশি। প্রায় ১৯ কিলোমিটার। বাকি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আপনি চাইলে একদিনের মধ্যেই ঘুরে দেখতে পারেন। কংসাবতী বাঁধ এর এক প্রান্ত থেকে নৌকায় করে সবুজদীপ যাওয়া যায় । সময় লাগে মোটামুটি আধঘন্টা। নৌকোর থেকে সবুজ দ্বীপে যেখানে আপনি নামবেন সেখানে পরিষ্কার স্বচ্ছ জলে দেখতে পাবেন বহু রকমের ছোট ছোট মাছের পোনা আর ব্যাঙাচির ঝাঁক। পুরো ডিয়ার পার্ক ঘুরে দেখতে আপনার ঘন্টাখানেক সময় লাগবে । চারিদিকে অজস্র ছোট-বড় চেনা-অচেনা গাছের সারি। ফ্যামিলি নিয়ে সময় কাটাতে খুবই সুন্দর লাগবে। রানিবাঁধ ছাড়া অন্যান্য স্পটগুলো গাড়িতে ঘুরে দেখতে মোটামুটি খরচ পড়বে আড়াই হাজার টাকা থেকে দুই হাজার 800 টাকা তবে দাম দর করে নেবেন। এবার ঘরে ফেরা। ফেরার জন্য আমরা বাঁকুড়া স্টেশন থেকে 12884 রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরলাম। সন্ধ্যে পাঁচটা পাঁচ মিনিটে ছেড়ে হাওড়ায় পৌঁছলো রাত সাড়ে নটায়। অল্পকিছু দূরত্বে ছুটি কাটানোর মত জায়গার মধ্যে মুকুটমনিপুর এর অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে অসাধারণ হয়ে থাকবে।।
বাঙালি অথচ শান্তিনিকেতনে যাননি এমন মানুষ খুবই কম দেখা যায় । তবে অনেকের কাছেই শান্তিনিকেতনে ভ্রমণ মানে শুধুমাত্রই বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা, সাথে উত্তরায়ন মিউজিয়াম আর বড়জোর খোয়াইয়ের হাট । কেউ কেউ দুদিনের ছুটিতে একযাত্রায় তারাপীঠ-শান্তিনিকেতন-বক্রেশ্বরের ঝোড়ো ট্রিপ করেন । ফলে শান্তিনিকেতনের অনেক কিছুই অদেখা থেকে যায় । আমার পরামর্শ, যাঁরা নিরিবিলিতে দুদিন এই শান্তির ঠিকানায় পাড়ি দিতে চান, তাঁরা এই ট্রিপের সঙ্গে অন্য কোনো জায়গা না জড়িয়ে শুধুই যদি শান্তিনিকেতনে কাটান তবে একটা স্বপ্নের ভ্রমণ হতে পারে ।
ছুটি থাকুক না থাকুক শান্তিনিকেতনে ভালো করে ঘোরার জন্য একটা শুক্রবার বাছুন যাত্রা দিন হিসাবে । ভোরের গণদেবতা এক্সপ্রেস ধরে সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসুন বোলপুর স্টেশনে । রিক্সা বা টোটো ধরে চলুন আপনার আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেল বা লজে । আর যদি আগে থেকে বুকিং করা না থাকে তবে ভুবনডাঙার মাঠের কাছ থেকে শুরু করে রতন পল্লী, শ্যামবাটি-গোয়ালপাড়া, সোনাঝুরি, প্রান্তিক স্টেশনের কাছাকাছি বিভিন্ন মানের হোটেল-লজ থেকে আপনার পছন্দমতো ঘর বেছে নিন । বোলপুর স্টেশনের কাছেও অনেক হোটেল আছে, সেগুলোর ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম, তবে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে দূরত্ব বেশি । হোটেলে লাগেজ রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ও ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ুন কবিতীর্থ দর্শনে । পারলে একজন গাইড নিয়ে নিন । অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন ওঁদের কাছ থেকে । অবশ্য গাইড না নিয়ে নিজেরাও ঘুরতে পারেন । একে একে দেখে নিন ছাতিমতলা, উপাসনাগৃহ, আম্রকুঞ্জ, তিনপাহাড়, শালবীথি, কালোবাড়ি, নতুন বাড়ি বা মৃণালিনী দেবী আনন্দ পাঠশালা, খড়ের তৈরি নতুন বাড়ি, গৌরপ্রাঙ্গন ও ঘন্টাতলা, সিংহসদন, ছোটো কালো বাড়ি বা চৈতি ইত্যাদি । বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা যেতে পারে সংগীত ভবন, কলাভবন, মালঞ্চ, নাট্যঘর, নন্দন । ছাতিমতলা বর্তমানে ঘেরা , সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই । এর দক্ষিণ দিকে বকুলবীথি-র অবস্থান । শান্তিনিকেতনের বাড়িটি বর্তমানে হেরিটেজ বিল্ডিং, এর সামনে রামকিংকর বেজের তৈরি শিল্পকীর্তি অনির্বাণ শিখা-র অবস্থান । আম্রকুঞ্জে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠিত হয় । কালো বাড়ি নন্দলাল বসুর স্মৃতিবিজড়িত । কলাভবনের বিখ্যাত মুর্তিগুলি অবশ্যই দেখে নেবেন । গান্ধীজী-র ডান্ডি অভিযান, সাঁওতাল রমণী আর কলের বাঁশি এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য । বিশ্বভারতীর মূল আকর্ষণ উত্তরায়ণ মিউজিয়াম । টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন এখানে । অনেকগুলি বাড়ি রয়েছে এই প্রাঙ্গনে—বিচিত্রা, উদয়ন, শ্যামলী, কোনার্ক, পুনশ্চ ও উদিচী । রবীন্দ্রভবন বিচিত্রায় দেখুন রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানান সামগ্রী, উপহার, সম্মান-স্মারক, নোবেলের রেপ্লিকা ইত্যাদি । আর রয়েছে কবিগুরুর ব্যবহৃত গাড়ি ও কয়েকটি বাড়ি । এখানে সবকিছু ভালোভাবে দেখতে দেখতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাবে । হোটেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে আবার বেরিয়ে পড়ুন । পায়ে পায়ে হেঁটে দেখে নিন বেণুকুঞ্জ, চীনা ভবন, হিন্দি ভবন, বইঘর “সুবর্ণরেখা”, শিল্পসামগ্রীর বিক্রয়ভান্ডার “আমার কুটীর” ইত্যাদি । সময় বা ইচ্ছা থাকলে অমর্ত্য সেনের বাড়ি “প্রতীচী”-ও দেখে নিন । ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটি বিশ্রাম নিন, চা-এর দোকান যত্রতত্র নেই , তবে যেখানে পাবেন একটু চা-পান করে নিন ।
পরেরদিন শনিবার সকালে প্রকৃতিভবন ঘুরে দশটার পরে চলে আসুন বল্লভপুর অভয়ারণ্য তথা ডিয়ারপার্কে । প্রায় একশোটি চিতল হরিণের পাশাপাশি ময়ূর, বেজি, সাপ, শিয়ালের বসবাস এই শাল-পিয়াশাল-মহুয়া-আকাশমণি-র জঙ্গলে । ওয়াচটাওয়ারে উঠে পাখির চোখে পুরো জঙ্গলটাই একনজরে দেখে নিতে পারেন ।
দুপুরে তিনটে-সাড়ে তিনটেয় বেরিয়ে পড়ুন কোপাই নদী দেখে খোয়াই-র উদ্দেশ্যে । শনিবারেই বসে খোয়াই-র হাট । স্থানীয়দের তৈরি শিল্পকর্মের পাশাপাশি সাঁওতালি নাচ, বাউল গানের আসর, পিঠে-পুলি-দই...কোথা দিয়ে যে সময় পেরিয়ে যাবে, টেরই পাবেন না । রবিবারের সকালটা রাখুন শ্রীনিকেতন আর কংকালীতলা দর্শনের জন্য । মনে রাখবেন : বুধবার শান্তিনিকেতনে সমস্ত কিছুই বন্ধ থাকে । তাই ভুলেও বুধবারটা কখনওই শান্তিনিকেতনে ঘোরার জন্য রাখবেন না । পৌষমেলা আর বসন্ত উৎসবের সময় অনেক আগে থেকেই সমস্ত হোটেল-লজ বুকড্ হয়ে থাকে । তাই এ সময়ে গেলে আগে থেকে বুকিং অবশ্যই করে রাখবেন । যাওয়া-আসা : এখন করোনা আবহে বেশিরভাগ ট্রেনই বন্ধ । স্বাভাবিক অবস্থায় বোলপুরে যাবার জন্য গণদেবতা (সকাল 6-05) ও শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস(সকাল 10-10), রাজগীর (সকাল 11-10), জয়নগর(সকাল 7-15), বিশ্বভারতী প্যাসেঞ্জার(বিকাল 4-40)আছে হাওড়া থেকে । ফেরার সময় এই ট্রেনগুলির মধ্যে গণদেবতা (বিকাল 6-25) ও শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস(দুপুর 1-10)ধরাই সবচেয়ে ভালো । তবে এখন শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থা করে যাওয়াই ভালো, তবে এস বি এস তি সি-র বাসেও বোলপুরে যেতে পারেন । কোথায় থাকবেন : অজস্র থাকার জায়গা রয়েছে শান্তিনিকেতনে ও আশেপাশে । বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিন আপনার রাত্রিযাপনের ঠিকানা ; WBTDC এর ট্যুরিস্ট লজ (033-22488271), পৌষালি (9434142454) রাঙামাটি ট্যুরিস্ট লজ (0-3463-252305), সারদা লজ (0-3463-252305), আজকাল স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের হলিডে হোম (033-30110852 / 9830189481) ইত্যাদি এর মধ্যে কয়েকটি ।
হরিহরের মিলন ক্ষেত্র, মহাতীর্থ গঙ্গাবাস, আমঘাটা, নদীয়া
বঙ্গদেশের ইতিহাসের অন্যতম নায়ক মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন একাধারে বিচক্ষণ, কর্মকুশল এবং প্রজাহিতৈষী। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। সমগ্র নদীয়া জেলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অজস্র কীর্তি আজও বিদ্যমান। কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার সিংহাসনে বসেছিলেন ১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে। রাজসিংহাসনে বসে তিনি সেই সময়কার প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে 'অগ্নিহোত্র বাজপেয়ী' নামক এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞ শেষে সেখানে উপস্থিত বঙ্গদেশের এবং বারাণসীর বিখ্যাত পন্ডিতগণ ও বিদ্বজ্জনেরা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে 'অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী' উপাধিতে ভূষিত করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রায় চল্লিশ বছর রাজ্যশাসন করে, পুত্র শিবচন্দ্রকে রাজ্যপাট বুঝিয়ে দিয়ে, বৃদ্ধ বয়সে তিনি বানপ্রস্থে যাবার জন্য মনস্থির করেন। বর্তমানে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ থানার অন্তর্গত, কৃষ্ণনগর শহর থেকে আন্দাজ দশ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত আমঘাটা নামক গ্রামের পাশ দিয়ে তখন প্রবাহিত হতো বর্তমানে বিলুপ্ত নদী 'অলকানন্দা', যা ছিল জলঙ্গী (খড়িয়া বা খড়ে) নদীর একটি শাখা। এই অলকানন্দা নদী কিছুটা দূরে গিয়ে মিশেছিল পুণ্যতোয়া ভাগীরথীর সঙ্গে, আর এভাবেই অলকানন্দা নিজেও হয়ে উঠেছিল পুণ্যসলিলা। ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই পুণ্যসলিলা অলকানন্দা নদীতীরের মনোরম পরিবেশে, গঙ্গাবাস নামের এক সুরম্য রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং পরে হরি ও হরের সংযুক্ত পাথরের বিগ্রহ সমন্বিত একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। হরিহরের যুগল মূর্তি অনুসারে মন্দিরের ওপরে দুটি চূড়া নির্মিত হয়। দক্ষিণমুখী মন্দিরটির পাদপীঠে একটি প্রতিষ্ঠা ফলক দেখা যায়, যাতে খোদিত রয়েছে: "গঙ্গাবাসে বিধিশ্রুত্যনুগতসুকৃতক্ষৌণিপালে শকেহস্মিন্ শ্রীযুক্তো বাজপেয়ী ভুবি বিদিত মহারাজরাজেন্দ্রদেবঃ ভেত্তুং ভ্রান্তিং মুরারিত্রিপুরহরভিদামজ্ঞাতাং পামরাণাং অদ্বৈতং ব্রহ্মরূপং হরিহরমুময়া স্থাপয়োল্লনয়া চ।।" অর্থাৎ, "যেসব অজ্ঞ পামর শিব ও বিষ্ণুকে পৃথক, ও উভয়ের মধ্যে ভেদ আছে মনে করে পরস্পরকে বিদ্বেষ করে, তাদের ভ্রান্তি দূর করবার জন্য ভুবনবিখ্যাত বাজপেয়ী মহারাজেন্দ্রদেব (কৃষ্ণচন্দ্র) ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাবাসে এই মন্দিরটি এবং হরিহরের ব্রহ্মরূপ অদ্বৈতমূর্তি, লক্ষ্মী ও উমার সঙ্গে স্থাপন করলেন।।"
মন্দিরের গর্ভগৃহে পাথরে নির্মিত হরিহরের চতুর্ভূজ বিগ্রহ রয়েছে। মূর্তিটির বাঁ দিকের অংশ হরির, হাতে রয়েছে শঙ্খ ও চক্র। ডান দিকের অংশ হরের, হাতে রয়েছে ত্রিশুল ও অভয়মুদ্রা। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এখানে আরও ছয়টি দেব-দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। অষ্টধাতু নির্মিত অন্নপূর্ণা ও মহালক্ষ্মী বিগ্রহ দুটি অতীতে এক সময়ে চুরি হয়ে যাওয়ায় এখন সেখানে মাটির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও গর্ভগৃহে শীতলক্ষ্যা, গণেশ ও জগন্নাথদেবের বিগ্রহ, একটি শিবলিঙ্গ ও শালগ্রাম শিলা দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের সকল বিগ্রহ আজও নিত্য পূজিত। হরিহরের মন্দিরের পূর্বদিকে একটি প্রাচীন মন্দিরের কিছু ভগ্নাবশেষ দেখা যায়, যা কালভৈরবের মন্দির নামে পরিচিত। বর্তমানে সেই ভগ্নস্তূপের ওপরে একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করে সেখানে চতুর্ভুজ কালভৈরব, গণেশ ও হনুমানের পাথরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কালভৈরব বিগ্রহের হাতে সাপ ও ত্রিশুল দেখা যায় এবং পিছনে রয়েছে একটি কুকুর। শোনা যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অনেক পরিশ্রমে চিত্রকূট পর্বত থেকে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পায়ের ছাপ সমন্বিত একটি পাথরের অংশ নিয়ে এসে এই গঙ্গাবাসে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের পূজার্চ্চনা পরিচালনা করবার জন্য পূজারী রাধাকান্ত তর্কবাগীশকে গঙ্গাবাসে ১০২ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন এবং এখানে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতদের এনে তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করে একটি জনপদ গড়ে তোলেন। সেই সময়ে এই হরিহরের মন্দিরকে কেন্দ্র করে গঙ্গাবাস একটি তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। পূজার্চ্চনায় কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে সর্বশ্রেণীর ধর্মপ্রাণ মানুষ ও সাধুসন্তেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গঙ্গাবাসে সমবেত হতেন। বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তি ও দশেরার সময় প্রচুর তীর্থযাত্রীর ভিড় হত। পবিত্র অলকানন্দা নদীতে স্নান করে হরিহরের পূজা দিতেন হাজার হাজার মানুষ। এই গঙ্গাবাসে বসবাসকালে ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে, ৭৩ বছর বয়সে অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমান মহারাজ রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর পূর্বে অলকানন্দা নদীতীরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যে সুরম্য রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, আজ তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। কেবলমাত্র ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু ইঁটের ঢিপি এবং কয়েকটি ভাঙ্গা পাথরের অংশবিশেষ সেই অধুনা লুপ্ত রাজপ্রাসাদের সাক্ষ্য বহন করছে। হরিহরের মন্দিরটি কালের প্রবাহে প্রায় বিধ্বস্ত হলেও ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ভক্তিবেদান্ত ট্রাস্ট মন্দিরটির সংস্কার সাধন করে এবং বর্তমানে মন্দিরটি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। পুণ্যসলিলা অলকানন্দারও আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। পলি জমে গতিপথ অবরুদ্ধ হয়ে সেই স্রোতস্বিনী নদী আজ জলা-জমিতে পরিনত হয়েছে। কালের প্রবল প্রকোপে একসময়ের হরিহরক্ষেত্র ও মহাবারাণসী বলে প্রসিদ্ধ মহাতীর্থ 'গঙ্গাবাস' আজ প্রায় বিলুপ্ত, বিস্মৃত। © 2020 Atanu Das / [email protected] |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |