পৃথিবী এখন অসুস্থ, বিগত সাত মাস ব্যাপী এই লড়াই আমাদের দুর্বল করে দিলেও,মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। বাঙালীর পায়ের তলায় সর্ষে,মাঝে কিছুদিনের বিরতি থাকায় কিছুতেই শান্ত হতে পারছিলাম না।মাঝে মাঝে পাগলের মতো ভিড়, দমবন্ধ ইটকাঠ, পাথর আর কংক্রিটের শহর থেকে মন পাড়ি দেয় অন্য কোথাও।
সপ্তাহশেষে যৎসামান্য তল্পিতল্পা নিয়ে কোনওক্রমে পালিয়ে যাওয়ার বাসনায়,দ্বিচক্রযানটি নিয়ে মুখে মাস্ক এঁটে,বেরিয়ে পড়লাম গিন্নিকে নিয়ে,গন্তব্য এবার ইটাচুনা।প্রতি দিনের ছাপোষা জীবন আর তুচ্ছতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এক ছুট্টে চলে গেলাম ইতিহাস মোড়া ইটাচুনা রাজবাড়িতে। যান্ত্রিক আধুনিকতাকে সটান ছুড়ে ফেলে রাজকীয় দিনরাত কাটানোর বাসনাতেই পৌছে গেলাম ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা ইটাচুনা( আমার বাসস্থান হাওড়া থেকে ৬২ কিমি)।জনঅরণ্য থেকে খানিক দূরেই হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ি প্রস্তুত আভিজাত্যের চাদরের মোড়কে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে। 'খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো, বর্গী এল দেশে’ চৌথ আদায়ের জন্য বর্গীরা(মারাঠা সৈন্য) প্রায়ই হানা দিচ্ছে।সেইসময় প্রচুর ধনসম্পত্তি করে কুন্দ্রা রাজা বংগদেশে থেকে যান।এই কুন্দ্রা থেকেই পরবর্তী কালে কুন্ডু পদবী তে রুপান্তর হয়।সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর বংশধররা ১৭৬৬ সালে এই রাজবাড়ি তৈরি করেন। বর্গীদের বাড়ি বলে স্থানীয়। মানুষ একে বর্গীডাঙাও বলেন।শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গাছগাছালি মেঠো পথ, মাইলের পর মাইল সবুজে মোড়া চাষের জমি, কলোচ্ছ্বাসরত শিশুর দল চোখ জুড়িয়ে অদ্ভূত প্রশান্তি দেয় হৃদয়কে। পথ শেষ হয় রাজবাড়ির বিশাল ফটকে। গেট ছাড়িয়ে ভিতরে পা দিলে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ— কালের নিয়মে সেই অতীত জৌলুসের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। তাও পুরনো দেওয়ালের প্রাচীন গন্ধ, উঁচু কড়িবরগার ছাদ, আল্পনা দেওয়া বিরাট নাটমন্দির, প্রাঙ্গন জুড়ে বিরাট বিরাট বাতিস্তম্ভ, প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি দিয়ে সাজান ইতিহাসের গন্ধমাখা সুবিশাল বৈঠকখানা মুহূর্তে অন্য এক জগতের দরজা খুলে দেয় চোখের সামনে। কাছারি বাড়ি, হিসাবের ঘর, বাজার সরকারের ঘর পেরিয়ে তবে অন্দরমহলে পা।বাড়ির মেয়েরা যাতে অন্দরের জানলা খুলে বাইরেটা দেখতে পান, অথচ তাঁদের কেউ দেখতে না পায় সেই ব্যবস্থা করা ছিল অলিন্দে ছোট ছোট জানলা করে। বাড়ির সবই সাবেক প্রথার। বড়কর্তা মেজোকর্তার সারিবদ্ধ ঘর, বিবর্ণ বহু পুরনো আসবাবপত্র, বিরাট সিন্দুক,কারুকার্যমণ্ডিত পালঙ্ক সবই। বাড়ির লম্বা নিঃঝুম অলিন্দ, জানলা দিয়ে ডিঙি মেরে দেখা বাইরের সবুজের সমারোহ, খিড়কির পুকুরে নুয়ে পড়া গাছ— সবই বড় মায়াবী, মনকেমন করা। অতিথিদের জন্য মোট ১৭ টি ঘর আছে,সাবেক প্রথা মেনে যার ঘর তার নামেই ঘরের নামকরণ- বড় বৌদি,ছোট বৌদি,কাকাবাবু,ছোট পিসিমা ইত্যাদি।বর্তমানে ঠাকুমার ঘরটি সারিয়ে দেবপ্রভা নামকরণ করা হয়েছে(৬ জন ব্যক্তির এক সাথে থাকার ব্যাবস্থা আছে) এছাড়া রাজবাড়ির পিছনে কুটিরেও থাকা যায়। আমরা বড় বৌদির ঘরে ছিলাম,খাট,বিছানা থেকে আলমারী,দেরাজ,টেবিল ল্যাম্প কার্পেটে ইতিহাস মোড়া।মোট দুটি ঘর-একটি শয়ন কক্ষ অপরটি স্নান ঘর।ঘর সংলগ্ন বারান্দায় হাঁটলে নিজের নিঃশ্বাস ও বাতাসে ধ্বনিত হয়,মাঝে মাঝে শুধু কপোত- কপোতিরা ডানা ঝাপটে আপনায় চমকে দিতে পারে। প্রতিদিন বিকেল ৪.৩০ টায় গাউড আসেন অতিথিদের বাড়ী ঘুরিয়ে দেখান,ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করেন।পাকশালা,বাগান,পিছনের বাগান,রাজবাড়ীর জলাশয় এবং সবশেষে স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে ২০ বিঘা প্রাসাদের ছাদ।ছাদটি বড়ই মনোরম। প্রকাণ্ড ছাদে দিনের বেলা তুমুল হাওয়া আলোড়িত করে যায়। রাতের নিবিড় অন্ধকার ঠাণ্ডা শিরশিরে স্রোত বইয়ে দেয় বুকের ভিতর দিয়ে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় নক্ষত্রের রাত বুঝি একেই বলে। যেন নিকষ অন্ধকারে হিরের টুকরো ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। স্ট্রিট লাইট বিচ্ছুরিত শহুরে জীবনে এমন রাত তো আসে না!ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় সন্ধারতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে রাজবাড়ির ঠাকুরদালান থেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায় কুন্দ্রারা শিবের উপাসক ছিলেন,তাই রাজবাড়ীর বিপরীতে শিবলিংগ প্রতিষ্ঠিত আছেন। তার কিছুদূরেই দূর্গামন্দিরও আছে।পরবর্তীকালে এনারা শ্রীকৃষ্ণের পূজা চালু করেন এবং শ্রীধর জিউ(নারায়ণ) এর নিত্য পূজা চালু হয়,দিনে তিনবার ঠাকুরের আরতি হয়-সকাল ৬টা,সকাল ১০ টা আর সন্ধ্যা ৬টায়।আরতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে এক বাঁশুরিয়া পাশের গ্রাম থেকে রোজ বাঁশি বাজাতে আসেন রাজবাড়িতে। তাঁর নিমগ্ন বাঁশির মন খারাপ করা মেঠো সুর ভেসে যায় হাওয়ায়। খেলা করে নিস্তব্ধ বাড়ির আনাচ কানাচে।চা ঘরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বৈঠকখানার সেই প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি ইতিহাস কে আকড়ে টিকে আছে।
রাজবাড়ির খাওয়ার ব্যবস্থাও রাজকীয়। অথেনটিক বাঙালি রান্না বলতে যা বোঝায়, পাওয়া যায় এখানে। বনেদি জমিদার বাড়ির অন্দরসজ্জায় সজ্জিত ঝকঝকে কাঁসার থালাবাটিতে পরিবেশিত এই খাবারের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে বহু দিন।আধুনিকতায় মোড়া রুম সার্ভিস নয়,খাঁটি বাঙালি আদপে একসাথে বসে একতলায় পাকশালার পাশেই খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।ভাত,ডাল থেকে শুরু করে কোপ্তা,ছানার ডালনা হোক কি চিংড়ি,ভেটকি বা দেশী মুরগীর ঝোল।শুধু আগের দিন রাত্রে জানিয়ে দিতে হবে পছন্দের তালিকা।
নিবিড় সবুজ আর বিস্মৃত ঐতিহ্যের মখমলি গন্ধ বুকে ভরে রাত কাটিয়ে এ বার ঘরে ফেরার পালা।আবার ইতিহাসের পাতা থেকে বেড়িয়ে কংক্রিটের রাস্তায় রোজকার দিনযাপন... কীভাবে যাবেন গাড়িতে গেলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে যান। আজাদ হিন্দ ধাবা এবং হিন্দুস্থান হোটেলকে বাঁদিকে রেখে তার পরের বাঁ দিকের রাস্তা ধরুন। ব্রিজের তলা দিয়ে ডান দিকে গিয়ে পৌঁছে যান বোসিপুর। সেখান থেকে ১৯ কিলোমিটার আরও ড্রাইভ করে পৌঁছে যান হালুসাই। যেখান থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে ইটাচুনা রাজবাড়ি। ট্রেনে গেলে বর্ধমানগামী যে কোনও (ভায়া মেন লাইন) ট্রেন ধরুন। অথবা হাওড়া থেকে মেমারি-পাণ্ডুয়া লোকালও ধরতে পারেন। ট্রেনে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে যেতে। ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে আরও গোটাতিনেক স্টেশনের পর আসবে খন্যান। সেখানে নেমে ভ্যান/রিকশা/অটোয় মিনিট দশেকের পথ ইটাচুনা রাজবাড়ি। কোথায় থাকবেন থাকার ব্যবস্থা রাজবাড়ির অন্দরমহলেই। বিলাসবহুল ঘর থেকে মাটির কুঁড়েঘর— সব রকমের ব্যবস্থাই রয়েছে। বিলাসিতার মাপকাঠির নিরিখে ভাগ করা সবক’টা ঘর। সবচেয়ে দামি ঘর বিলাস মঞ্জরীতে যেমন থাকতে পারবেন পাঁচজন। শোয়ার ব্যবস্থা বিরাট পালঙ্কে! পাশাপাশি খড়ের ছাউনি দেওয়া কুটিরেও রাত কাটাতে পারেন ইচ্ছে হলে। ঘরের নামগুলো ভারী সুন্দর। গিন্নিমা, ছোট বৌদি, কনকলতা, ঝুমকোলতা ইত্যাদি। ঘর ভাড়া ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮৪০০ পর্যন্ত। এসি, নন এসি— দু’রকমের ঘরই পাবেন। তবে সপ্তাহান্তে ঘর ভাড়া বেশি। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসি ঘর পাওয়া যাবে না। আগে থেকে ঘর বুক করে রাখার জন্য ইটাচুনা রাজবাড়ির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট দেখতে পারেন। *গাড়ি পার্কিং রাজবাড়ীর মধ্যে করা যায়,তবে জায়গা না পাওয়া গেলে প্রাসাদের বাইরে নিজ দায়িত্বে রাখতে হয়।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |