লেপচা জগত থেকে সুখিয়া পোখরি … (হোমাগ্নি ঘোষ)
ঘুম স্টেশনে গাড়ী থেকে নামতেই জাপটে ধরল কুয়াশা, বাপরে বাপ কি কুয়াশা মশাই ।। এক ফুট দুরত্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না, তার মধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি, লালমোহন বাবু থাকলে বলতেন হাইলি suspicious। সকালে তো আকাশ পরিষ্কার ছিল নীচে আর দুপুরের মধ্যেই এই ওয়েদার,এই জন্যেই বলে পাহাড়ের মেজাজ নারী চরিত্রের থেকেও বেশী জটিল। ঘুম স্টেশনের পাশে গুটিকয়েক স্থানীয় লোক আর আমরা, বাকি সমস্ত রাস্তা জনমানবহীন এদিকে টিপটিপ বৃষ্টি জমাট কুয়াশা বেশ একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সোমেশ্বর বলল – গাড়ী কোথায় পাব? বললাম দাড়া খিদের জ্বালায় চোখে অন্ধকার দেখছি আগে পেটপুজা। স্যাক থেকে জ্যাকেটটা বের করতে করতে দেখি স্টেশনের পাশে পরিত্যাক্ত একটা কোনে ময়লা শতচ্ছিন্ন একটা জ্যাকেট পরে বসে এক বুড়ো ভিখারি একটা পাউরুটি খাচ্ছে ,বেশ লোভ হোল ওর খাওয়াটা দেখে। আরে চল বৃষ্টি পরছে তো। সোমেশ্বরের কথায় সম্বিৎ ফিরলে বললাম- এই জন্যেই তো আসা রে ,একটু ভেজ, এই কুয়াশা মেঘ বৃষ্টি এই তিনটের কম্বিনেশান অনেকটা তোর ব্ল্যাক কফির সাথে আগাথা ক্রিস্টি। সোমেশ্বর হেসে বলল- পারো বটে এরকম পাহাড় প্রেমিক পাগলাটে দুটো দেখিনি। বৃষ্টি মাথায় একটু এগোতেই সামনের ৪,৫ টা দোকানের মধ্যে একটা খোলা। ঢুকতেই দেখি বেশ ভিড়। বাইরের ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সবাই এখানে এসে সেধিয়েছে। কোন কথা নেই দু প্লেট মোমও(১০ টা করে) সাথে আদার সুপ। মন্ত্রের মত কাজ হল,আহা কি স্বাদ। শেষে গরম দু কাপ লিকার চা। এই ভিজে ভিজে ওয়েদারে গরম ধোয়া ওঠা মোমও গরম সুপ আর দার্জিলিঙের চা পেলে জমে যায় মশাই কি বলেন? ঘুম থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে দার্জিলিং এর দিকে আর বাদিকের রাস্তা বেঁকে গেছে সুখিয়া পোখরি, লেপচা জগত ,মানেভঞ্জন এর দিকে। এই মানেভঞ্জন থেকেই সুরু হয় সান্দাকফু ট্রেক। আমরা গেছিলাম দোলের পরেরদিন এখানে হোলি তাই গাড়ী একটাও নেই,অনেক কষ্টে একজন নিয়ে যেতে রাজি ৬০০ টাকার বিনিময়ে । ঘুম থেকে লেপচা জগত মাত্র ১১ কিলোমিটার। বহুবার সান্দাকফু ট্রেক করেছি তাই আই রাস্তা আমার খুব চেনা , প্রতিবারই আমার ভাল লাগে এই মেঘ কুয়াশার কাটাকুটি খেলা,রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল পাইন গাছের মেঘের চাদরে মুখ লুকিয়ে রাখা। ভিজে পাইনের গা বেয়ে ঝরে পড়া বৃষ্টির জলের কখনো স্বাদ নিয়েছেন , আমি নিয়েছি। আপনারাও নেবেন। একটা কেমন বুনো ফুলের পাহাড়ি আবেশ আপনার শরীরকে আঁকড়ে ধরবে আর আপনি হারিয়ে যাবেন অপার্থিব এক ভালবাসায়। গাড়ীর কাচ দিয়ে হু হু করে কুয়াশা ঢুকছে ,হটাত করে ব্রেক কষে খাদের ধারে দাঁড়াল গাড়ীটা, কিছু বুঝে ওটার আগেই খাদের নীচের ছোট একটা বাড়ি থেকে উঠে এলো এক পাহাড়ি কিশোরী । হাতের ব্যাগ ভর্তি খুস্মুশ( যাকে আমরা বলি স্কোয়াশ) আর পাহাড়ি মুলো। ও যাবে লেপচা জগত তাই লিফট চাইছে। পথের আলাপে জানতে পারলাম সেই মেঘবালিকার নাম মুশু,ওর বাবা মারা গেছে বছর ৩ আগে । ও পরিবারের বড় মেয়ে ওর মা আর দুই ভাই এক বোনের দায়িত্ব ওর উপর। খুবই গরীব ,ক্ষেতের সব্জি বেচে সংসার চলছে একটাই স্বপ্ন সেই মেঘবালিকার ওর সব ভাইবোনরা যেন পড়াশুনা করতে পারে। মনে মনে কুর্নিশ জানালাম মেঘবালিকা তোমায়, কে বলে মেয়েরা পিছিয়ে , দায়িত্ব নিতে পারেনা যারা বলে তারা বাইরে এসে একবার দেখো বুঝতে পারবে এই ছোট ছোট মানুষগুলোর লড়াইয়ে ভরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তোমার আমার সবার জীবনের অনুপ্রেরণা । লেপচা জগতে অনেক home stay আছে আমাদের কোন ঠিক ছিল না কারন অজানা জায়গায় হটাত করে চলে আসার মধ্যে একটু হলেও আদিমতা থাকে একটু হলেও adventure থাকে, এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ওটাই তো adrenalin. কুয়াশায় মুড়ে আছে লেপচা জগত সেখান থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে সুখিয়া পোখরি ,সেখানে পাওয়া যায় রক্সি , লাল rhododendroner পাপড়ি থেকে বানানো country liquor , আগে সিকিম নেওরা ভ্যালি সান্দাকফু ট্রেকিং করার সময় বহুবার পান করেছি। এদিকে একটাও গাড়ী নেই কুছ পরোয়া নেহি রেনকোট পড়ে আমি আর সোমেশ্বর বেড়িয়ে পড়লাম বৃষ্টি ভেজা কুয়াশা মাখানো রাস্তায় সুখিয়া পোখরির উদ্দেশে। এত কুয়াশা যে সামনের গাড়ীর হেডলাইট কে মনে হচ্ছে ছানি পরা চোখের মত, দুধারে পাইনের মাথায় মেঘ ঘর বেধেছে নিজেদের সখীদের সাথে, সেই মেঘ গলা জল এসে চুম্বন করছে আমাদের শরীর। এই দুর্যোগের দুপুরে এই নির্জন পাহাড়ি রাস্তা আরও নির্জন। দুপাশের জঙ্গল কেমন যেন স্থির ও স্থবির কোন মহীয়ান ঋষির মত মৌন, দৃঢ় ,একাকী । সুখিয়া পোখরি পউছালাম টানা ২ ঘণ্টা হাঁটার পর , ফেরার সময় কপাল ভাল একটা গাড়ি পেয়ে গেলাম , তখন বেশ রাত , মেঘ আস্তে আস্তে কাটছে,জানিনা ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাব কিনা ? পরেরদিন ভোরবেলা চোখ খুলতেই ম্যাজিক সারা পাহাড় জুড়ে ঝলমল করছে রোদ , রঙ বেরঙ্গের পাখীর দল এসে বসেছে লাল গোলাপি rhododendron গাছের ডালে , আর তার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে গিরিরাজ হিমালয় সূর্যের আলো পড়ে স্পষ্ট হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাখ্রিন home stay এর লাখপা শেরপার সাথে আমরা চললাম ভিউ পয়েন্টে। যেতে যেতে উনি বলছিলেন এই লেপচাদের কথা তাদের জীবিকা ,তাদের বেচে থাকার গল্প, এও যেন এক আলাদা পৃথিবী। প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে গেলাম আর তারপর মাথাপিছু ২০ টাকা দিয়ে ভিড় বাসে করে সোজা দার্জিলিং এসে সকালের ব্রেকফাস্ট করতে ছুটলাম caventers . এই caventers এর গল্প আরেকদিন হবে। হোমাগ্নি ঘোষ। সৌজন্যে- https://www.facebook.com/homagni.ghosh
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |