২০১৮ সালের মার্চের শেষ আর এপ্রিল এর শুরু, মহাবীর জয়ন্তী, গুড ফ্রাই ডে ইত্যাদির ধর্মীয় পরিবেশে উপরি পাওয়া ছুটি তে প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করেই গেছিলাম নবাব দের শহর লখনৌ, যেখানে পুরানো নবাবি আর ব্রিটিশ ইতিহাস আর স্থাপত্তের সাথে রয়েছে জিভে জল আনা মুখ রোচক সব খাবার। ফিরে আসার পর স্মৃতির পাতা হাতড়ে লেখা দুই পর্বের এই জার্নাল। আশা করি ভাল লাগবে। ২৮শে মার্চ, ২০১৮, রাত সাড়ে দশ টা, হাওড়া স্টেশন এখন এই রাত সাড়ে দশ টায় হাওড়া স্টেশনের অফিস যাত্রী দের ভিড় অনেক টাই পাতলা। শুধু দূর পাল্লার ট্রেনের যাত্রী রাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে হয়ত অনেকেই আমাদের ট্রেনের যাত্রী। আমাদের ট্রেন অমৃতসর মেল। যাব লখনৌ। নবাব দের শহর লখনৌ। পুরানো মসজিদ, ইমারত, রাস্তা, নবাবি খানা এসবের মাঝে কদিন নবাবি করব সেই কবেকার ইচ্ছে। তাই অবশেষে চললাম লখনৌ। কিন্তু শুরু থেকেই গণ্ডগোল। তাহলে গোড়া থেকেই বলি। গুড ফ্রাইডের ছুটি তে কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে গিয়ে অরিন্দম বলেছিল লখনৌ যাওয়ার কথা। আমারো অনেক দিনের সাধ, তাই ঠিক হয়ে গেল এবার লখনৌ। জয় দাও সঙ্গে জুটে গেল। ট্রেনের বুকিং, হোটেল ঠিক সব সারা। ২৮ শে মার্চ যাত্রা আর ২ রা এপ্রিল ফিরে আসা। ছোট্ট ট্রিপ। কিন্তু ২৬ শের রাতে অরিন্দম হঠাৎ বেঁকে বসল। ওর পৌষ্টিক তন্ত্রে গুরুতর সমস্যা। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও কিছুতেই যেতে রাজি হল না। অগত্যা আমি আর জয় দা। চলে এল ২৮ তারিখ। সন্ধ্যে ৭ টায় ট্রেন। ব্যাগ গোছানো শেষ। লাঞ্চ সেরে সবে জামা কাপড় পরবো, এমনি সময় মোবাইল বেজে উঠল। এস এম এস। রেল কোম্পানি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছে যে আমাদের ট্রেন আজ রাত সাড়ে ১২ টায় ছাড়বে। কি বিপদ। কি আর করা যাবে। জয় দা কে জানালাম। কাল বিকাল বিকাল আর পৌছানো হল না। অবশেষে রাত ১০ টা নাগাত আমরা স্টেশনে উপস্থিত হয়েছি। এবার প্রতিক্ষা ট্রেন আসার। ২৯ শে মার্চ, দুপুর দেড় টা, মুঘল সরাই স্টেশন রাতে ট্রেন ঠিক সময়েই এসে গেছিল প্ল্যাটফর্মে। আমরাও চড়ে বসে ছিলাম আমাদের এস ৫ এর মুখোমুখি লোয়ার বার্থে। যথা সময়ে ট্রেন ছেড়েও দিয়েছে। তারপর একে একে পেরিয়ে গেছে বালি, ডানকুনি, বর্ধমান। ঘুম আসছিল না, তাই জানলার ধারে বসে বসে বাইরে নিঝুম রাতের পৃথিবী দেখছিলাম। চারিদিকে অন্ধকার, শুধু গুরু পূর্ণিমার চাঁদ টা একটা হাল্কা ম্যাটম্যাটে আলো ছড়িয়ে রেখেছে দু পাশের ধান ক্ষেতে। সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস আর ট্রেনের এক টানা হয়ে চলা আওয়াজ টা। জয় দা গেছে টয়লেটের ধারে মোবাইলে চার্জ দিতে। কারন যদিও এখন কিছু কিছু স্লিপার ক্লাস বগি তে রেল কোম্পানি দয়া করে চারজিং পয়েন্ট দিচ্ছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের বগি টা সেই কৃপা লাভে বঞ্চিত। রাত দু টো পার হয়ে গেছে। না, এবার শুয়ে পড়া যাক। এইভেবে শুয়ে পড়েছি। যদিও আমাদের কিউবিকল টায় আর কোনো প্যাসেঞ্জার ছিল না, তবুও রাতে উতপাতের ভয়ে আগে ভাগেই মিডল বার্থ টাঙ্গিয়ে দিয়েছি। তারপর কিছুক্ষন এপাস ওপাস তারপর ঘুম। রাতে অবশ্য প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগায় ঘুম ভেঙ্গেছিল। জানলা গুলো আটো সাটো করে বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জড়সড় হয়ে। ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল সাত টায়। তখনো বাইরের বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। মন চাইছে গায়ে একটা কিছু চাপা দিতে, কিন্তু ব্যাগের ওজন কমাতে সেরম কিছু আনা হয়নি। অবশেষে আরও কিছুক্ষন পরে উঠে বসলাম। রাতে টুক টাক লোক উঠেছিল, কিন্তু এখান কার বার্থের কোনো ন্যায্য দাবিদার আসেনি। বোধহয় ট্রেন লেট বলে টিকিট ক্যান্সেল করেছে। ট্রেন চলেছে বিহারের মধ্যে দিয়ে। তাই রীতি মেনে এক গুচ্ছ লোক উঠে বসে আছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে। আমরা আমাদের জায়গায় বসলাম। মুখ ধোওয়া, ব্রেড অমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্ট সারাও হল। এখন বসে আছি চুপচাপ আর হিসেব কষছি, ট্রেন টা কখন পৌছতে পারে লখনৌ। আমাদের উল্টো দিকের আপার বার্থে এক বয়স্ক বিহারি ভদ্রলোক ছিলেন, সঙ্গে অনেক বাক্স প্যাঁটরা। বাড়ি চলেছেন। সঙ্গে আবার একটা তুলসী গাছ, বাড়ির জন্যে। তার কাছেই শুনলাম এদিক কার ট্রেনের হাল হকিকত। আমাদের ট্রেন চলেছে পাটনা লাইনে। এ পথে সময় অনেক বেশী লাগে আর লেটও হয় বেশী। তুলনা মুলক ভাবে গয়া লাইনে সময় অনেক কম লাগে। সকাল ১০ টা নাগাত পাটনা জাংসন পেরিয়ে গেল। ট্রেন টা আর খুব বেশি লেট করেনি। বখতিয়ারপুর, আরা পেরিয়ে গেছে। বক্সারে ওই ভদ্রলোক নেমে গেছেন। আমাদের দুপুরের আণ্ডা মিল খাওয়া হয়ে গেছে। অবশেষে দুপুর দেড় টা নাগাত মুঘল সরাই পৌছেছে। ২৯ শে মার্চ, রাত ১০ টা, রায় বরেলী ট্রেন টা মুঘল সরাই অবধি ঠিক ঠাক চলার পর ছন্দ পতন হয়। হওয়ারই ছিল, কারন রেল কোম্পানির পরিভাষায় আমাদের ট্রেন এখন লেট ট্রেন। তাই টাইমে চলা ট্রেন দের পথ ছেড়ে দিতে দিতেই তাকে চলতে হবে। তাই মুঘল সরাই তে এসে যেই মেইন লাইনে জুড়ল অমনি পহলে আপ এর বদান্যতা শুরু হয়ে গেল। মুঘল সরাই থেকে ছেড়ে ৪ বার দাঁড়িয়ে যখন ট্রেন বারানসী তে পৌছাল, তখন বাজে সাড়ে চার টে। এর ফাঁকে বলে রাখা ভাল যে মুঘল সরাই তে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে কেত মেরে সেলফি তোলার সময় এক বুড়ো সরদার জি আমায় খৈনীর দোকানের সুলুক জিজ্ঞেস করেন। আমাকে দেখে কি করে ওর খৈনী খোর মনে হল সেটা আর জিজ্ঞাসা করা হয় নি। বারানসী তে অনির্দিষ্ট কাল দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রেন ছাড়ে। তারপর মৃদুমন্দ গতি তে এগতে থাকে। মাঝে মাঝে পৌছাবার সম্ভাব্য সময় হিসাব করার চেষ্টা করছিলাম আর সেই মত হোটেলে ফোন করে জানাচ্ছিলাম। কিন্তু ট্রেনের রকম সকম দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে এক পরিবার এসে আমাদের সীটের ফাঁকা জায়গা গুলি দখল করেছে। মিয়া বিবি বাচ্চা সমেত লখনৌ চলেছেন। তাদের মাঝে আমরা গুটি সুটি মেরে বসে আছি। একটা সময় মনে হচ্ছিল যে ১০ টা নাগাত পৌঁছে যাব, কিন্তু তা এখন অলীক কল্পনা। ট্রেন আমেথি পেরিয়েছে, এখন রায় বরেলি ঢুকছে, দুটোই কংগ্রেসের নাম করা লোক সভা কেন্দ্র। আমাদের খাবার দিয়ে গেছে। ডিনার সেরে নিই বরং। স্টেশনে নেমে ডিনার করার আসা অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। ৩০ শে মার্চ, রাত আড়াই টা, লক্ষ্মী গেস্ট হাউস ট্রেন টা যত রকম ভাবে সম্ভব লেট করিয়ে রাত এক টায় লখনৌ স্টেশনে ঢুকিয়েছে। প্রথমেই যেটা করলাম তা হল ষ্টেশনের নামের সাথে সেলফি। শুরু থেকেই সেলফি তোলা আর ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করা চলছে। এরপর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটা অটো। ভাড়া চাইল দুশ টাকা। কি আর করা যাবে এই রাতে। উঠে পড়লাম। নির্জন রাতের শহর দেখতে দেখতে এগলাম। এখানে মেট্রোর কাজ চলছে, তাই অনেক রাস্তায় ডাইভারসন। অটো এম জি রোড এর রাজভবন বিধান সভা পেরিয়ে এসে পড়ল হজরত গঞ্জের শাহ নজফ রোডে যেখানে আমাদের হোটেল। হজরত গঞ্জ লখনৌর বড় মার্কেট এরিয়া, কিন্তু এই মাঝ রাতে সবই সুনসান নিস্তব্ধ। তানিস্ক জুয়েলারির বড় শো রুম টার পাশে হোটেলের সাইন বোর্ড টা জয় দার চোখে পরেছিল ভাগ্যিস। অতঃপর হোটেলের সামনে এসে ফোন, ঘুম ঘুম চোখে দরজা খোলা, খাতায় নাম এন্ট্রি, তারপর তিন তলার রুমে প্রবেশ। বেশ ঘর। এ সি, এল ই ডি টি ভি, সোফা দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো। আমরা হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চেপে বসলাম। মোবাইলের ব্যাটারি টিম টিম করছে। তাই আশু কর্তব্য মোবাইলে চার্জ দেওয়া। তারপর ঘুমের দেশে। কাল সকালে উঠতে দেরী হবে। ৩০ শে মার্চ, দুপুর ৩ টে, পুরানা শহর আমরা এখন পুরানো শহরের পাথরে বাঁধান রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। গন্তব্য লখনৌ শহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ বড়া ইমামবাড়া আর ভুলভুলাইয়া। আজ দিন শুরু হয়েছে সকাল ৯ টায়। তারপর তাড়াহুড়ো করে রেডি হওয়া আর ১০ টায় হোটেল থেকে নিস্ক্রমন। হোটেলের পুরো টাকা আজই মিটিয়ে দিলাম। রিসেপ্সনের লোক টি শহর সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিল। বলল ওলা করে ঘোরাই সুবিধা জনক। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। ওলা এর ড্রাইভার আমাদের শহর চেনাতে চেনাতে নিয়ে এসে ফেলল বড়া ইমামবাড়ার সামনে। কিন্তু আবার গণ্ডগোল। আজ শুক্রবার। জুম্মাবার। ইমামবাড়ার ভেতরে নমাজ চলছে। ভেতরে ঢোকা নিষেধ। খুলবে সেই বিকেল তিন্ টে। আবার আমাদের প্ল্যান সব ঘেঁটে গেল। ঠিক আছে কোই বাত নেহি। আমরা একটা টোটো তে চেপে বসলাম। এই যানবাহন টি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। টোটো চালক বড়ই অমায়িক। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পুরানো শহরের নিদর্শন গুলো চেনাতে চেনাতে টোটো এগোল। প্রথমেই পড়ল রুমি দরওয়াজা। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ১৭৮৪ নাগাত তৈরী হয় এই রুমি দরওয়াজা আর তার পাশের ওই বড়া ইমামবাড়া। তৈরী করে ছিলেন নবাব আসাফা উদ দৌলা। লোক মুখে কথিত ওই সময়ে ভুমিকম্পের কারনে অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে সহায় সম্বল হীন হয়ে পরেছিল, কিন্তু তাদের আত্ম সম্মান ছিল মজবুত। তাই ভিক্ষা তারা নেবে না। মুলত তাদের সাহায্য করার জন্যই এই ইমামবাড়া আর এই রুমি দরওয়াজার অবতারনা। যারা কাজ জানত সারাদিন ধরে তারা গড়ত। আর যারা কাজ জানত না তারা রাতের বেলায় ভাঙত। সেলাম নবাব। ধন্য তোমার দান। আসাফা উদ দৌলার এই দান এখানে কিংবদন্তি হয়ে আছে। রুমি দরওয়াজার আর্কিটেকচার টা বেশ অদ্ভুত। যদি বড়া ইমামবাড়ার দিক থেকে আসা যায় তবে মনে হবে একটা তিন তলা স্ট্রাকচার। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে একটা খিলানের আকার। শুনলাম ওই খিলানএর ডিজাইন নাকি এসেছে নবাবের কুর্তার গলার ডিজাইন থেকে। আর চারদিকের সরু গদার মত বেরিয়ে থাকা আকার গুলো নাকি এসেছে লবঙ্গের আকার থেকে। বোঝো ব্যাপার। এখান থেকে আমাদের টোটো আমাদের নিয়ে হাজির করল চক বাজারের এক চিকন এর দোকানে। লখনৌর বিখ্যাত এমব্রয়ডারি শিল্প চিকন। সেই দোকানেই কাটল ঘণ্টা দুয়েক। শপিং এর ডিটেল দিয়ে লেখা বাড়াতে চাই না তবে চিকনের কুর্তার লোভ সামলাতে পারিনি আমরা দুজনেই তাই বেরবার সময় আমাদের সম্মিলিত বিল হল প্রায় নয় হাজার ছুঁই ছুঁই। টোটো বাবাজিরও ভালই কমিসন জুটবে নিশ্চয়ই। টোটো এগিয়ে চলল। এবার ক্লক টাওয়ার বা ঘণ্টা ঘর। ১৮৮১ সালে নির্মিত। তখন ক্ষমতা ইংরেজ দের হাতে। এখনও নির্ভুল সময় দিয়ে চলেছে। এর পাশেই রয়েছে এক বড় সড় পুকুর সেই আমলে বানান। চারদিক থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচ পর্যন্ত। পুকুরে জল প্রায় নেই বললেই চলে। পুকুরের মাঝে একটা ফোয়ারা, বোধহয় অকেজো। একটা বাচ্চা ছেলে নোংরা জামা কাপড় পরে ঘোরা ফেরা করছিল। হঠাৎই আমার কাছে জুতো চেয়ে বসল। আমি একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। জুতো? কিন্তু প্রায় ১২ ঘণ্টা হয়ে গেছে লখনৌ এসেছি। নবাবি মেজাজ টা আস্তে আস্তে মাথায় চরছে। ফস করে ৫০ টাকার একটা নোট তাকে দিয়ে দিলাম। কি করবে কে জানে। এখান থেকে গেলাম ছোটা ইমামবাড়া। এখানেই টোটোর যাত্রা শেষ। আমরা ঢুকলাম ইমামবাড়ার ভেতরে। ১৮৩৮ সালে নবাব মহম্মদ আলি শাহ এর আমলে বানানো হয় এই ইমামবাড়া। ৫০ টাকার টিকিট কেটে নিলাম। এতে এই চত্তরের সবকিছু দেখা যাবে। একটা সুন্দর বাধানো পুকুর মত। তার ওপারে ধবধবে সাদা রঙের ইমামবাড়া। পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তা। হেঁটে গেলাম সেখানে। জুতো খুলে উঠলাম ইমামবাড়ার চাতালে। ছুটির দিনে বেশ ভালই ভিড় হয়েছে। পুকুরের ধারে একটা ভ্যান্টেজ পয়েন্ট থেকে ছবি তোলার চেষ্টায় ছিলাম কিন্তু দুটো মেয়ে বারবার এসে সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। সরি, টু মিনিটস। কোনও মেয়ের মুখে শুনলে কোন ছেলে না অপেক্ষা করবে। আমরাও করলাম। তারা ছবি তুলে একটা স্মাইল দিয়ে চলে গেল। ইমামবাড়ার ভেতরে পুরানো জিনিষ সাজানো। একটা মাতব্বর গোছের লোক সবাই কে হেই হেই করে ভাগাচ্ছিল। ১০০ টাকা দিতে সেই আমাদের জামাই আদরে সব ঘুরে দেখাল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চীন, জাপান, বার্মা থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহার। সোনা, রুপোর ঝাড় লণ্ঠন, ঘড়ি, হাতির দাঁতের মডেল মসজিদ। ফ্রেমে বাঁধানো কোরানের ভার্স। মহরমের তাজিয়া ইত্যাদি। ওই চত্তরেই রয়েছে মহম্মদ আলি শাহ আর তার মা এর সমাধি। আর তার পিছনে শাহি হামাম। হামামে ঢুকে নবাবি চান ঘরের ব্যাপার স্যাপার দেখলাম। অতিকায় বাথ টাব। আমাদের গোটা বাড়ি টা নবাবের চান ঘরে ঢুকে যাবে। এরপর বেরলাম সেখান থেকে। পরবর্তী গন্তব্য পিকচার গ্যালারী। পথে পড়ল সাতখাণ্ডা। নবাবের বেগম চাঁদ দেখবে বলে সাত তলা এই মিনার বানান শুরু হয়েছিল। তাই নাম সাতখাণ্ডা। যদিও চারতলা শেষ হতে না হতেই বেগম ইহলোক ত্যাগ করেন, ফলেই কাজ আর এগয়নি। এর পাশেই পিকচার গ্যালারী। এক বড় হল ঘরে বিশাল বড় বড় সব অয়েল পেইন্টিং নবাবদের। প্রথমেই অওয়ধের প্রথম নবাব সাদাত খান। খাঁটি পাঠান। রাজকীয় ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবি একেবারে পাকা হাতে আঁকা। কোনো এক ইংরেজ শিল্পী। আলো ছায়ার কাজ অসাধারন। কি জিনিষ দিয়ে আঁকা জানি না। কিন্তু এত বছর পরেও ছবি একদম জ্বলজ্বল করছে। এরপর মনসুর খান সফদর জং। যার নামে দিল্লির সফদর জং। তারপর সুজা উদ দৌলা। ইনিই ইংরেজ দের সাথে বক্সার এর যুদ্ধে হেরেছিলেন। পলাশি আর বক্সার এই দুই যুদ্ধে জিতে তখন ইংরেজ রা বিশাল ক্ষমতা শালী। তাদের সাথে বন্ধুত্ত পাতান ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না নবাবের। তার পর থেকে নবাব দের সাথে ইংরেজ দের দহরম মহরম এর শুরু। সুজা উদ দৌলা র বড় ছেলে আসাফা উদ দৌলা তারপর ছোট ছেলে সাদাত আলির সময়েও এই বন্ধুত্ত চলতে থাকে। এরপর ১৯১৪ সালে গাজি উদ্দিন হায়দার দিল্লি কে অগ্রায্য করে ইংরেজ দের মদতে নিজেকে রাজা বাদশা বলে ঘোষনা করে। তারপর নাজির উদ্দিন হায়দার, মহম্মদ আলি শাহ, আমজাদ আলি শাহ হয়ে ওয়াজেদ আলি শাহ। এমনি ভাগ্যের পরিহাস যে ১৮৫৬ সালে বন্ধু ইংরেজ রাই এর রাজ পাট কেড়ে নিয়ে কলকাতায় মেটিয়াবুরুজে নির্বাসনে পাঠায়। ওয়াজেদ আলি নেহাতই অলস, আমোদ প্রিয় নবাব হলেও ওনার বেগম হজরত মহল ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইনি ইংরেজ দের অনেক বেগ দিয়েছিলেন। যাই হোক নবাব দের স্মৃতি চারন এখানেই শেষ করা যাক। এটা ভাবার কোনো কারন নেই যে এত গল্প আমাদের ওই পিকচার গ্যালারীর গাইড বলেছে। সে মক্কেল তো নবাব দের ছবির জুতোর অ্যাঙ্গেল কি করে ঘুরে যাচ্ছে সেই বোঝাতেই ব্যস্ত ছিল। যেটা কিনা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। সে যাই হোক ছবি দেখা শেষ হতে ৩ টে বাজল। আর আমরাও ধীরে ধীরে এগলাম বড়া ইমামবাড়ার দিকে। ৩০ শে মার্চ, সন্ধ্যে ৭ টা, কাইজারবাগ এখন আমরা নাজিরাবাদ রোড ধরে কাইজারবাগের দিকে হাঁটছি। এই ফাঁকে গত চার ঘণ্টার গল্প বলে নেওয়া যাক। প্রথমেই ঢুকে ছিলাম বড়া ইমামাবাড়া চত্তরে। সারাদিন ধরে শপিং এর ব্যাগ বইছি। ওখানে ক্লোক রুমে জমা রাখলাম ব্যাগ গুলো। তারপর এগলাম। প্রথমে ঢুকেই সামনে বড়া ইমামবাড়া যার দোতলায় রয়েছে সেই ভুলভুলাইয়া। বাদশাহী আংটি তে পড়া ইস্তক এটা দেখার সাধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কবে থেকে। আজ তা পুরন হবে। আমাদের ডান দিকে আসাফা উদ দৌলার সমাধি মসজিদ। আর বাঁ দিকে শাহি বাউলি। বাউলি হল কুয়ো। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। সেখানে গাইডের পিছন পিছন ঘুরে দেখলাম এদিক ওদিক সুড়ঙ্গ। অনেক নিচে বাউলির জলে ছায়া পড়েছে ঢোকার গেটের। শত্রু এলেই জলে তার ছায়া পড়বে এমনি ব্যবস্থা। দুঃখের বিষয় এই বাউলি তে আর জল নেই। একটা পাইপে করে বাইরে থেকে জল এনে ফেলা হচ্ছে বাউলি তে গেটের ছায়া দেখানোর জন্য। ওখান থেকে বেরিয়ে অবশেষে আমরা ভুলভুলাইয়ার এন্ট্রি পয়েন্ট এ। ইমামবাড়ার বাঁ দিকের কোনে একটা সরু দরজা দিয়ে ঢুকতে হল। গাইড চার্জ ১০০ টাকা দেওয়ার পর আমাদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। কিন্তু যাব কোন দিকে। আমাদের এক কমলা রঙ এর সালোয়ার কে ফলো করার নির্দেশ দেওয়া হল। তিনিও বোধহয় কোনো নীল বা সবুজ রঙের শার্ট কে ফলো করছেন। সরু সিঁড়ি তে জম্পেশ ভিড়। ছুটির দিনের বিকেল বেলায় গোটা লখনৌ চলে এসেছে এখানে। একদল উঠছে আর একদল নামছে। ভিড়ের চাপে পদপৃষ্ঠ না হয়ে যাই। ইতিমধ্যে আমাদের গাইড এসে হাজির হয়েছেন। আর তার পিছন পিছন তার গলার আওয়াজ অনুসরন করে অন্ধকার গলি পথে এ ওর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা চলেছি। এই দলে যেমন আমাদের মত লোক রয়েছে, তেমনি বয়স্ক বৃদ্ধ বৃদ্ধা আবার সুন্দরি রমনী রাও রয়েছে। গাইড বলে চলেছে এখান থেকে সুড়ঙ্গ কোথায় কোথায় চলে গেছে। একবার কলকাতার নাম শুনলাম যেন। ট্রাই করে দেখব নাকি। ট্রেন এর ভরসা করে লাভ নেই। না থাক। এখনও তো কাবাব খাওয়া হল না। গাইড এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে আমাদের নিয়ে ফেলল ভেতরের একটা ব্যালকনি তে। ও হরি, এতো ইমামবাড়ার ভেতরের হল ঘর টা। তার মানে আমরা এতক্ষন ইমামবাড়ার ফাঁপা দেওয়ালের মধ্যে ঘুরে বেরাচ্ছিলাম। গাইড এবার আমাদের ফাঁপা দেওয়ালের অ্যাকাউস্টিকস শোনাল। কি করে একটা দেশলাই এর শব্দ ইমামবাড়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে শোনা যায়। কি ভাবে দেওয়ালে ফিসফিস করে কথা বলে অনেক দূরে কান পেতে শোনা যায়। মাঝে মাঝেই আমরা এসে পরছি চৌমাথায়। যেখানে চারদিকে চার টে সুড়ঙ্গ চলে যাচ্ছে। গাইডের দেখানো পথে আমরা এগচ্ছি, যদিও গাইড না থাকলেও অসুবিধা নেই কারন আসল পথে লাল কার্পেট পাতা আছে তাই ভুল হওয়ার যো নেই। গাইডের কথায় জানলাম ইমামবাড়া তৈরীর কাহিনী যা কিনা রুমি দরওয়াজার সাথেই তৈরী হয়েছিল ঐ একই কারনে। চুন সুরকি আরও কত কি সব দেশী মাল মসলা দিয়ে তৈরী এই ইমামবাড়া। ইমামবাড়ার পেল্লায় মোটা দেওয়াল কে কিছু টা হাল্কা করে ভিতের উপর চাপ কমানোর জন্য দেওয়াল হয়েছিল ফাঁপা, আর দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে নানা দিকে চলে গেছিল সুড়ঙ্গ পথ। পরবর্তী কালে সেই সুড়ঙ্গ গুলোই ভুলভুলাইয়া বলে পরিচিত। তবে বাদশাহী আংটি তে ভুলভুলাইয়ার বর্ণনা পড়ার পর মনে যে রোমাঞ্চ হয়েছিল তা আজ পুরো ছানা কেটে গেল। এর পর আবার বাদশাহি আংটি পড়লে আজকের ভিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার স্মৃতিই মনে পড়বে। অবশেষে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে আমরা উঠে এলাম চার তলার ছাদে। এটা একটা দেখবার জায়গা বটে। দূর থেকে ছোটা ইমামবাড়া রুমি দরওয়াজা, আসাফা উদ দৌলার সমাধি, আরও দূরে ক্লক টাওয়ার, সাতখাণ্ডা, জামা মসজিদ, পিছন দিকে চক বাজার, কিং জর্জ মেডিক্যাল কলেজ সব এক নজরে দেখা যাচ্ছে এশিয়ার প্রথম আর সবচেয়ে বড় থাম বিহীন ইমামবাড়ার ছাদ থেকে। ছাদের চার কোনা থেকে চার টে সুড়ঙ্গ নেমে গেছে নিচে, যার একটা দিয়ে আমরা উঠেছি। ছাদে এক চক্কর লাগান তারপর সেলফি তোলা। তারপর আবার অন্য পথে সিধে এক তলায় পৌছান। নিচে নেমে দেখি প্রায় ২০০ লোকের লাইন। আমরা ইমামবাড়ার ভেতর টা একবার ঢুঁ মেরে বেরবার রাস্তা ধরলাম। বিকেল চারটে বেজে গেছে, খিদেয় পেট চুই চুই করছে। সকাল থেকে ছোটা ইমামবাড়ার গেটের ধারে নিম্বু পানি আর চিকন এর দোকানে এক কাপ চা ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। আমাদের যে কাবাব ডাকছে। কাবাব, আমরা আসছি। লখনৌর বিখ্যাত কাবাবের দোকান তুণ্ডে কাবাবি। এদের তিনটে আউটলেট। খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি আমিনাবাদের টাই সব চেয়ে ফেমাস। তাই এবার টোটো ছুটল আমিনাবাদের দিকে। পরিবর্তন চক, সহিদ স্মারক পার্ক, হাই কোর্ট ছাড়িয়ে আমরা আমিনাবাদের রাস্তায় এসে পড়লাম। এমনি তে লখনৌর রাস্তা ঘাট বেশ চওড়া আর রাস্তার নামও পরিষ্কার ভাবে লেখা মোড়ের মাথায়। তবে এদিক কার রাস্তা গুলো একটু সরু আর এই বিকেল বেলায় যান জট ও বেশী। আমিনাবাদ মোড়ে চারদিকের গাড়ি এসে পুরো প্যান্ডেমোনিয়াম অবস্থা। আর এই মোড়ের একধারেই দাঁড়িয়ে আছে তুণ্ডে কাবাবি। ১৯০৫ সালের দোকান। আমরা ঢুকে পড়লাম মুখের লালা সামলাতে সামলাতে। দুটো তলা। এক তলা আর বেসমেন্ট। আমরা এক তলায় গিয়ে বসলাম। সবাই খাচ্ছে। আমাদের পাশে বসা একটি ছেলে মন দিয়ে খেয়ে চলেছে। আঙ্গুলের হিসেবি টানে ছিঁড়ে আসছে এক টুকরো পরোটা। তারপর সেটার ওপর উঠে আসছে ছোট্ট কাবাবের টুকরো। তারপর পরোটা দিয়ে কাবাব এর টুকরো টা ভাল করে মুড়ে গ্রেভি তে চপচপে করে ডুবিয়ে আস্তে আস্তে ঠেলে দিচ্ছে মুখের ভেতরে। মুখ বুজে আসছে, সেই সঙ্গে চোখও। শুধু মুখের মাসল গুলো হাল্কা গতি তে নড়াচড়া করছে। এইসব দেখে শুনে আর তর সইল না। জয় দা হাজির হল যে লোক টি টাকা নিচ্ছে তার কাছে। সে আবার এক জন কে পাঠাল অর্ডার নিতে। গালোটি কাবাব, শিক কাবাব, রেশমি কাবাব আর কোর্মা আর সেই সঙ্গে পরোটা। আপাতত এই থাক। লোক টি আমাদের অর্ডারের নমুনা দেখে স্তম্ভিত। আমাদের একবার ভাল করে দেখে নিয়ে স্যালাডের প্লেট টা ঠক করে বসিয়ে দিয়ে সে চলে গেল আমাদের এই রাক্ষসের খাবার আনতে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, সময় এগচ্ছে। খাবার আর আসেনা। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের সন্ধ্যের প্ল্যান বাতিল করেছি। আগে তো ভাল করে খাই। জয় দা শুধু শুধুই এক প্লেট স্যালাড খেয়ে নিয়েছে। অবশেষে এল। এক এক করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেল কাবাবের বাটি গুলো। আর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম ক্ষুদার্ত সিংহের মতন। সে যে কি গন্ধ, কি স্বাদ, কি অনুভুতি মুখের ভেতরে, তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। গালোটি কাবাবের টুকরো মুখের মধ্যে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে আর মস্তিস্কের সব স্নায়ু আচ্ছন্ন হয়ে আসছে সেই স্বর্গীয় স্বাদে। অবশেষে খাওয়া শেষ হল। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে শেষ পাতে অওয়ধি ক্ষীর অর্ডার করলাম, যাকে আমরা ফিরনি বলি। চেটেপুটে খেয়ে বিল মেটাতে গিয়ে তো অবাক কাণ্ড। এত কিছু খাওয়ার পর বিল হয়েছে মোটে ৫০০ টাকা। কলকাতার কোনো রেস্টুরান্ট হলে কম সে কম ২০০০ টাকা হত। এর মধ্যে জানা গেল যে লোক টি খাবার সার্ভ করছিল সে বাঙালি। এই হোটেলের কিছু গল্প শোনাল। তারপর বেরলাম সেখান থেকে। ট্রেনে জয় দা টয়লেটে ঘড়ি ফেলে এসেছিল, কেউ নিজের মনে করে নিয়ে গেছে। তাই জয় দা একটা ঘড়ি কিনল। তারপর আমরা বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা মনস্থ করলাম। আমিনাবাদ মোড় থেকে যে রাস্তা টা নাজিরাবাদ হয়ে কাইজারবাগ এর দিকে যাচ্ছে সেই রাস্তা ধরলাম। সৌজন্যে গুগল দা। সন্ধ্যের রাস্তায় নানা মানুষের ভিড়। কেউ কাজ থেকে ফিরছে। কেউ বা সবে বেরিয়েছে। দু পাশের দোকানে দোকান দার রা নানান পশরা সাজিয়ে বসেছে। ঠেলা গাড়ি তে কাবাব সেঁকতে বসেছে দু এক জন। এক টা বড় বাড়ি তে অনেক দোকান। বাড়ি টার নাম কলকাতা মার্ট। একটা বাংলা ‘ক’ লেখা লোগোও আছে। হয়তো দোকানের মালিক বাঙালি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কাইজারবাগ মোড় অবধি চলে এসেছি। মোড়ের মাঝখানে একটা পাথরের গম্বুজ মতন। আর চারদিক থেকে সাত খানা রাস্তা এসে মিসছে। সাইকেল, বাইক, টোটো, অটো, বাস, গাড়ি সব তারঃস্বরে হর্ন বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলেছে। কান পাতা দায়। ট্রাফিক পুলিশের কোনো পাত্তা নেই। আমরা যে গলি দিয়ে বেরলাম তার বাঁ দিকে এক রাস্তা ছেড়ে দ্বিতীয় রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। এই রাস্তা টা চলে যাচ্ছে পরিবর্তন চকের দিকে। কাইজারবাগের মোড় যদি শ্যামবাজারের মোড় হয় তবে পরিবর্তন চক হল ধর্মতলার মোড়। আমরা একটু এগুতেই বাঁ হাতে পড়ল সফেদ বরাদরি ( নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের বানানো ইমামবাড়া) আর ডান দিকে গুরুদ্বোয়ারা। এইখানে আমরা একটা টোটো তে উঠে পড়লাম। টোটো পরিবর্তন চক হয়ে ছুটল। এদিকে আবার মেট্রোর কাজের জন্য রাস্তা খুবই সরু। তাই টোটো একটা শর্ট কাট ধরে শাহ নজফ রোডে এসে পড়ল। সেন্ট জোসেফ চার্চ পেরিয়ে দাঁড়াল তানিস্ক শো রুমের সামনে। আমরা হোটেলে ফিরলাম। আগেই দিয়েছি। নানা ঝক্কি সামলে লখনৌ পৌছেছি। আর দু রাত কাটিয়েও ফেলেছি এই পূরানো শহরের ইতিহাসের আনাচে কানাচে। আজই এখানে শেষ রাত। তবে রাতের এখনো অনেক দেরী। ৩১ শে মার্চ, দুপুর সাড়ে বারো টা, লোহিয়া পথ আমরা এখন লোহিয়া পথ ধরে চক্র তীর্থ মন্দিরের খোঁজে চলেছি গুগল দার হাত ধরে। কালকের অভিযান সেখানেই শেষ হয়নি। সাড়ে ৭ টায় হোটেলের ফিরে আসার পরে ঠিক হয় পাশেই হজরত গঞ্জ মার্কেটে সাহারাগঞ্জ মলে যাব। ঘুরব। তারপর একটা সিনেমা দেখব। তো ৮ টার সময় গিয়ে হাজির হলাম মলে। খুব একটা বড় মল নয়। সেন্ট্রাল এর একটা আউটলেট আছে। আর আছে পি ভি আর। বড় লবি টার দুতলায় নেট লাগানো আছে যাতে কেউ নিচে পড়ে না যায়। ট্রান্সপারেন্ট কাঁচে ঢাকা লিফটে চড়ে উঠলাম পাঁচ তলায়। সেখানেই পি ভি আর। টিকিট কাটলাম। এখানে বুকিং কাউন্টারে সবাই হিন্দি তে কথা বলে। আমাদের এখান কার ট্যাঁস দের মতন ইংরেজি ফলায় না। টিকিট কাটার পর আমরা পাশের ওপেন টেরেসে কিছুক্ষন হাওয়া খেলাম। দিনের আলো নিভলেই এখানকার ওয়েদার দ্রুত বদলে যায়। দিনের গুমোট গরমের বদলে ঠাণ্ডা আরামদায়ক বাতাস বইতে শুরু করে। পাঁচ তলার এই খোলা ছাদে হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। এখানেও তুণ্ডে কাবাবির একটা ছোট স্টল রয়েছে। সিনেমার টাইম হতে আমরা হলের দিকে এগলাম। সিনেমার নাম বাগী টু। নায়ক টাইগার শ্রফ। নায়িকা দিশা পাটানি। শো হাউস ফুল। কেমন লেগেছে আর বললাম না। সিনেমা শেষ হল প্রায় ১২ টায়। ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরলাম হোটেলে। পরেরদিন তাড়াতাড়ি উঠবো ভেবেছিলাম, কিন্তু উঠতে উঠতে সেই ৯ টা। তারপর আবার তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরলাম। আজকের প্রথম গন্তব্য চিড়িয়াখানা আর মিউজিয়াম। দুটো একই জায়গায়। ওলা তে চড়ে পৌঁছে গেলাম চিড়িয়া খানায়। তারপর টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। বলবার মত সেরকম কিছু নেই। কেবল একটা জায়গায় অন্ধকারে কিছু সজারু আর পেঁচা রাখা আছে। সাপের ঘরে শুধু পাইথন। এছাড়া জিরাফ, হরিণ, জলহস্তি, শিম্পাঞ্জি, সাদা বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, ভাল্লুক, ম্যাকাও, পেলিকান, বন বেড়াল ইত্যাদি। একটা বুড়ো ধবধবে সাদা শকুন দেখলাম। একটা ছোট টয় ট্রেন চিড়িয়া খানার চক্কর লাগিয়ে চলেছে। ব্যাটারির গাড়ি তেও ঘোরা যায়। আমরা হেঁটেই ঘুরলাম। এর মধ্যে মিউজিয়াম টাও কোনও এক অজ্ঞ্যাত কারনে বন্ধ। অওয়ধি আর্টের ভাল কালেকশন টা দেখা হল না। চিড়িয়া খানা থেকে বেরিয়ে এক গ্লাস নিম্বু পানি খেয়ে জয় দার ইচ্ছে হল চক্র তীর্থ মন্দিরে যাওয়ার। তাই গুগল দার ভরসায় হাঁটা শুরু। ডি জি পি এর বাংলো ছাড়িয়ে একটা মজা খালের ওপর ব্রিজ পেরিয়ে আমরা এসে পড়লাম লোহিয়া পথে। রাস্তা চকচকে, মসৃণ। হুস হুস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। কোনো সিগন্যাল নেই। রাস্তা পারের জন্য একটা ফ্লাই ওভার। তাতে র্যারম্পও আছে। হাঁটা ছাড়াও অনেকে সাইকেলে করেও তাতে উঠে যাচ্ছে। আমরা ফ্লাই ওভার পেরলাম। ফ্লাই ওভার এর উপর থেকে এলাকা টা বেশ সুন্দর লাগে। বার্ডস আই ভিউ। আমরা ফ্লাই ওভার পেরিয়ে বাঁ দিকে কিছু টা হেঁটে গুগলের লোকেশন দেখে মন্দিরের সামনে গিয়ে পৌছালাম। যাচ্চলে, এতো ফাঁকা মাঠ। মন্দির কোথায় গেল। আসে পাশের লোক জন কে জিজ্ঞেস করেও মন্দিরের হদিস পাওয়া গেল না। বুঝলাম গুগল দা আজ ছড়িয়েছে। আমরাও অগত্যা মন্দির দর্শনের আশা ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে ওলা ডেকে উঠে পড়লাম। ৩১ শে মার্চ, বিকেল পাঁচ টা, গোমতী ব্রিজ আমরা এখন গোমতী নদীর ওপর ব্রিজ পার হচ্ছি। গন্তব্য নদীর ওপারের গোমতী নগর। লোহিয়া পথ থেকে ওলা আমাদের নিয়ে এসেছিল নদীর পাড়ের সুন্দর রাস্তা ধরে পরিবর্তন চক। সেখান থেকে আরও এগিয়ে শহিদ স্মারক পার্ক পিছনে ফেলে তারপর বাঁ য়ে টার্ন নিয়ে সোজা রেসিডেন্সি। পথে ড্রাইভার আমাদের অনেক কিছু চিনিয়েছে। গোমতী নদীর তিরে বৈকুণ্ঠধাম শ্মশান। পরিবর্তন চকে হজরত মহল পার্ক, সাদাত আলি খানের সমাধি, গ্লোব পার্ক, ছত্তর মঞ্জিল। বোঝানোর উৎসাহে তিনি একটা টার্ন মিস করেন। ফলে কিছু টা ঘুরে আসায় আমাদের ৩০ টাকা বিল বেড়ে যায়। যাই হোক, রেসিডেন্সির সামনে এসে টিকিট কাটলাম। গলা শুকিয়ে গেছিল, তাই আম আনারসের সরবত খেলাম। দারুন করেছিল সরবত টা। এই সময় এত মিষ্টি আম কোথায় পেল কে জানে? এবার গেট দিয়ে ঢুকলাম। ভেতরে আবার কোনো খাদ্য পানীয় অ্যালাউড নয়। জয় দার সদ্য কেনা স্প্রাইটের বোতল টা টাই পত্রপাঠ দোকানে ফেরত দিয়ে আসতে হল। রেসিডেন্সি কে ঠিক কি বলা যায় আমি জানি না। নবাব আর ব্রিটিশ দের সখ্যতার প্রতীক, নাকি সিপাহী বিদ্রোহের জ্বলন্ত দলিল, ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য দের প্রথম জয়ের প্রতীক নাকি ব্রিটিশ ফৌজের বীরত্বের প্রতীক। সব ই নির্ভর করে দেখনে ওয়ালার দৃষ্টি ভঙ্গির ওপর। আমার চামড়া সাদা না কালো তার ওপরও। নৈর্ব্যক্তিক চোখে দেখলে বলা যায় যে এটা এক টুকরো সমৃদ্ধ ব্রিটিশ জনপদের ধ্বংসাবশেষ। একটার পর একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো টারই ছাদ আর আস্ত নেই। কোনো কোনো জায়গায় দেওয়ালও ভেঙে পড়েছে। তবুও বড় বড় থাম, খিলানের কাজ, বাড়ির গঠন আর তার সাইজ সেই সময় ব্রিটিশ দের সমৃদ্ধির কথাই বলে। ঢুকেই একটা ম্যাপে গোটা এলাকা টার একটা মানচিত্র আঁকা। প্রথম বাড়ি টাই হল ট্রেজারী হাউস। এর পাশে একটা ছোট স্মৃতি সৌধ আছে সেই নেটিভ দের জন্য যারা ব্রিটিশ দের হয়ে লড়েছিল। এর পর ডাক্তার ফেয়ারের বাড়ি। উনিই ছিলেন এখানকার হাউস সার্জেন। এরপর পড়ল ব্যাংকোয়েট হল। এটা আবার নবাব আসাফা উদ দৌলার বানানো ব্রিটিশ দের জন্য। ভাবলে হাসি পায়, ৭০-৮০ বছর পরে তারই বংশধরের নেতৃত্বে সিপাহী রা কামান দাগছে এর ওপর। নবাব দের সাথে ইংরেজ দের সখ্যতা তখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আজ এই বাড়ি গুলো দাঁড়িয়ে আছে ভুতের মত। এরা শুধু সিপাহী দের যুদ্ধের কথাই বলে না, বলে সেই সব মূর্খ রাজা বাদশা দের কথা যারা খাল কেটে কুমির এনেছিল নিজেদের লাভের জন্য আর একদিন সেই কুমির তাদেরই গিলে ফেলল। এই নির্বোধ দের জন্যই সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম দিকে সফল হলেও শেষ অবধি মুখ থুবড়ে পড়ে। এর পরের বাড়ি টা হল মেইন রেসিডেন্সি বিল্ডিং। ইংরেজ সৈন্য বাহিনীর হেড কোয়ার্টার। এর সঙ্গেই এক টা ছোট্ট মিউমিয়ামও আছে। মিউজিয়ামে তখন কার কিছু ছবি, কিছু দলিল। দেওয়ালে দু একটা মিউরাল যুদ্ধের। আমার যেটা সব চেয়ে ইন্টেরেস্টিং লাগল সেটা হল গভর্নর জেনারেল আর রেসিডেন্সীর প্রধান হেনরী লরেন্সের মধ্যেকার টেলিগ্রাফিক কথোপকথন। হেনরি লরেন্স প্রান পনে সৈন্য বাহিনী চেয়ে পাঠাচ্ছে আর গভর্নর গড়িমসি করছে। এ জিনিষ আজও আছে, সব দেশে। প্রশাসক রা ঠাণ্ডা ঘরে বসে নীতি নির্ধারণ করবে আর তার ফল ভোগ করবে যারা পথে নেমে আসল কাজ টা করে তারা। মিউজিয়ামের পিছনে ভাঙ্গাচোরা বাড়ি টা পড়ে আছে। ওলা তে আসতে আসতে ড্রাইভার তোতা ময়নার কথা বলেছিল। তখন বুঝিনি, এখন বুঝলাম। ভাঙ্গাচোরা বাড়ি টার আনাচে কানাচে কপোত কপোতি রা প্রেমালাপে ব্যস্ত। কোথাও কোথাও তা এমন ঘন নিবিড় হয়ে উঠেছে যে লজ্জায় তাকানো যায় না। দেওয়ালের গায়ে সিপাহী দের গোলার দাগ দেখে বেশ একটা বীর রস জাগছিল মনের মধ্যে, কিন্তু এইসব কাণ্ড দেখে রস ভঙ্গ হল। বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি টার পাশেই সবুজ লন। মেশিনের ফোয়ারা লনে জল ছেটাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে যে ওই বাড়ির দেওয়ালও ভিজে চলেছে সেদিকে কারুর খেয়াল নেই। বেশিরভাগ জায়গা তেই পলেস্তারা উঠে দিয়ে তলার ইট বেরিয়ে পড়েছে। ইটও ক্ষয়ে যাচ্ছে। এগুলোর আয়ু আর কত দিন কে জানে। এর পিছনেই আছে ইংরেজ দের গোরস্থান। যুদ্ধে মারা যাওয়া অনেক ইংরেজ কে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এক ইংরেজ তরুণী, মাদ্রাজ আরটিলারীর এক ক্যাপ্টেনের বউ, হয়ত সদ্য বিবাহিত, দেখলাম মাত্র বাইশ বছর বয়সেই দেশ থেকে এত দূরে এসে কবরে স্থান পেয়েছে, ১৬ঐ জুলাই, ১৮৫৭। ইংরেজ রাও এরকম বহু নিরাপরাধ মানুষ কে নির্বিচারে মেরেছে। যুদ্ধের ভাষায় একে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলে, আর মানবিকতার ভাষায় কি বলে জানি না। গোরস্থান এর পাশেই কম্পাউন্ড এর পাঁচিল ঘেঁসে একে একে আছে বা বলা ভাল ছিল কসাইখানা, পোস্ট অফিস, সৈন্য দের মেস ইত্যাদি। এর মাঝে রয়েছে বেগম কোঠি বা মহিলা দের থাকার বাড়ি আর একটা মসজিদ আর গুরুদ্বোয়ারা নেটিভ সৈন্য দের জন্য। সব কিছু ঘোরা হলে মসজিদ এর সামনে ঘাসের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসলাম। জায়গা টা ফাঁকা ফাঁকা। ইতি উতি দু একটা টুরিস্ট। মনের কল্পনায় ধীরে ধীরে চারপাশ আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠছিল। পিছনের মসজিদ টায় আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডান দিকে ডাক্তার ফেয়ারের বাড়ি তে চিকিৎসা চলছে অসুস্থ দের। ব্যাংকোয়েট হলে হাসির ফোয়ারা, উৎসব। আর এরি মাঝে হঠাৎ এসে পড়ল একটা গোলা। তঠস্থ ইংরেজের মধ্যে গোলা বর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসছে সিপাহী রা। ভাবনার টার কেটে গেল জয় দার ফোনে। এবার বেরতে হবে। গেট থেকে বেরিয়ে পাশেই একটা সিন্ধ্রি দোকানে রুটি ডাল আর মটর পনির তরকারি খেলাম। এই দুপুরের প্রচণ্ড রোদের মধ্যে এই লাইট খাবার টাই উপযুক্ত। রাতে আবার ভুরিভোজ তো রয়েছেই। এবার হাঁটা শুরু পরিবর্তন চকের দিকে। পাশে পড়ে রইল সেশনস কোর্ট। সেখানে বেজায় ভিড়। হাজারো বাইকের জঙ্গল কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। পথে এক আঙ্গুর ওয়ালার কাছ থেকে আঙ্গুর কিনলাম। অদুরেই পরিবর্তন চকের মোড়ে হজরত মহল পার্ক। সেখানে ঢুকে বসলাম। পার্ক টা বেশ সুন্দর সাজানো। মাঝ খানে বেগম হজরত মহলের একটা মেমোরিয়াল। একটা ছোট পুকুর। তাতে ফোয়ারা। আর সবুজ মাঠ। দূরে সাদাত আলি খানের সমাধির চুড়া দেখা যাচ্ছে। এর পাশেই গ্লোব পার্ক। পার্কের ঠিক মাঝ বরাবর বিশাল গ্লোব। তাতে ম্যাপ আঁকা আছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আফ্রিকার ম্যাপ টা চোখে পরেছিল। পার্কের সবুজ ঘাসে বসে আনমনে আঙ্গুর খেতে লাগলাম। ছোট্ট ট্রিপ টা আজ শেষের পথে। ভাল মন্দ মিশিয়ে খারাপ কাটছে না। আঙ্গুর খাওয়া শেষ হতে পার্ক থেকে বেরনোর পালা। ঢোকার সময় টিকিট দেখেনি। বেরবার সময় দেখি টিকিট চাইছে। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে টিকিট টা খুঁজে পেলাম। ভাগ্যিস। এখান থেকে আবার ওলা ধরেছি। গোমতীর ব্রিজ পেরিয়ে চলেছি ওপারে, আম্বেদকর পার্কে। ৩১ শে মার্চ, রাত সাড়ে আট টা, এম জি রোড এম জি রোডের বিধান সভা ক্রস করে আমরা এগিয়ে চলেছি ওলা তে চেপে। রাতের বেলায় সুন্দর আলো তে বিধানসভা টা দারুন লাগছে। তবে আমরা যেখান থেকে আসছি তার কথা বলে শেষ করা মুস্কিল। আম্বেদকর পার্ক বানান শুরু হয়েছিল মায়াবতী সরকারের আমলে। কিন্তু দেখা গেল সাধারনের জন্য পার্ক তৈরীর চেয়ে নিজের দলের প্রচারের তাগিদ টা বেশী। মায়াবতীর ক্ষমতা যেতেই গদি তে এল অখিলেশ যাদব। আর পার্কের টাকা পয়সা নিয়ে বসল এনকোয়ারী। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পার্ক তৈরী শেষ হল। আজ মায়াবতী বা অখিলেশ কেউ মসনদে নেই। ইউ পি তে এখন যোগী রাজ। কিন্তু এই পার্কের মধ্যে মায়াবতী রয়ে গেছেন। থেকেও যাবেন, যতদিন এই পার্ক থাকবে। ১৫ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই বিশাল একটা পাথরের টাইল বসানো চত্তর। ডান দিকে একটা গম্বুজ বা স্তুপের মত জিনিষ, ঠেলে আকাশে উঠেছে। তার চারিদিকে প্রকাণ্ড সিঁড়ি। বাঁ দিকে একটা স্তম্ভ। আরও কিছু টা এগোতে বাঁ দিকে পড়ল সাঁচির স্তুপের মত দুটো বাড়ি। চত্তরের ঠিক মধ্যি খানে একটা উঁচু জায়গা। সেটা পেরতেই এসে পড়লাম একটা লম্বা জায়গায়। সে খানে দু পাশে সার দিয়ে পাথরের হাতি দাঁড়িয়ে আছে, মায়াবতীর দলের প্রতীক। একেবারে শেষ প্রান্তে আম্বেদকর আর কাশীরামের মূর্তি। তার ও পিছনে আবার একটা পিরামিড। হাতি পেরিয়ে ভেতরে গেলে একটা উঁচু জায়গায় আম্বেদকরের মূর্তি, হাতে সংবিধান। সে টা পেরিয়ে একটা ঘেরা অর্ধ চন্দ্রাকার জায়গা। সেখানে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক দের বিশাল বিশাল মূর্তি। সব শেষে অবশ্যই হাতের ব্যাগ নিয়ে স্বমহিমায় মায়াবতী। চারিদিকে এত দর্শনীয় জিনিষের ছবি তুলতে তুলতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এবার গেলাম ওই গম্বুজের ভেতরে। সেখানেও আম্বেদকর আর মায়াবতী। তবে আসল জায়গা হল গম্বুজের মাথায়। সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে গেলাম ওপরে। এখান থেকে পুরো পার্ক টা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে দিগন্তে সূর্য ডুবছে আর একে একে পার্কের আলো জ্বলে উঠছে। রাতের আলোয় পার্ক টাকে আরও মায়াবী লাগছে, আর সেই সঙ্গে উত্তাল হাওয়া শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছে। এক কোনে একটা বেদির ওপর চুপ করে বসলাম। অনেক মানুষ এই সন্ধ্যে বেলায় একে একে উঠে আসছে ওপরে। সময় কাটাতে। কেউ এসেছে পরিবার নিয়ে, কেউ নিজের সঙ্গীর সাথে আবার কেউ বিলকুল একা। আমরাও বসে রইলাম কিছুক্ষন। তারপর যখন আস্তে আস্তে চারিদিক ফাঁকা হতে শুরু করল আমরাও নেমে পড়লাম। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা ঠিক করলাম নদীর ধারে যে রিভার ফ্রন্ট পার্ক আছে শুনেছিলাম সকালে ড্রাইভারের কাছে, সেখানে যাব। এক অটো ওয়ালা আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল সেই অন্ধকার চৌমাথায় কিছুই হদিশ পাইনা। অবশেষে একটা ছেলে পথের সন্ধান দিল। এটাও ব্রিজের এপারেই নদীর পাড়ের রাস্তা ধরে কয়েক শ মিটার এগলেই আইনক্সের সামনে এক টা সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর দিকে। সেখানে একটা সুন্দর পার্ক। নদীর ধার বরাবর চলে গেছে অনেক দূর অবধি। অনেক টা আমাদের প্রিন্সেপ ঘাট বা মিলেনিয়াম পার্কের মত। চড়া আলো নেই। হাল্কা আলো আধারি তে কেউ পায়চারি করছে। কেউ চুপচাপ বসে আছে। কেউ গান শুনছে, কেউ দল জমিয়ে গল্প করছে। কেউ কেউ আবার ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছে। সব মিলিয়ে একটা সুন্দর জমজমাট সন্ধ্যে। আমরাও বেশ কিছুক্ষন পায়চারি করলাম এমাথা থেকে ওমাথা। নদীর ওপর দিয়ে পর পর অনেক গুলো ব্রিজ দুপার জুড়ে রেখেছে। এক পার প্রবীন, প্রাচীন, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী, আর অন্য পার নবীন আজকের যুগের, প্রগতির পথে, ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছে। আর অতীত আর ভবিষ্যতের এই সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বয়ে চলেছে গোমতী মৃদুমন্দ গতি তে। এবার রাত হয়েছে। আমাদের প্রোগ্রাম যে এখনও শেষ হয়নি। তাই পার্ক ছেড়ে বেরলাম। আবার ওলা। এবার লক্ষ্য দস্তরখাওন। ব্রিজ পেরিয়ে এম জি রোড ধরে আমরা চলেছি লালবাগের দিকে। পথে একটা কনফিউশন হয়েছিল, কারন এই দোকানেরও অনেক ব্রাঞ্চ। দুটো চয়েস ছিল, লালবাগ আর তুলসি। গাড়ি আমাদের লালবাগে ছেড়ে গেল। সামনে ঝাঁ চকচকে রেস্টুরান্ট দস্তরখাওন। ৩১ শে মার্চ, রাত সাড়ে ১০ টা, শাহনজফ রোড মুখে মৌড়ি আর মিছরির দানা নিয়ে আস্তে হাঁটছি হোটেলের উদ্দেশ্যে। খাওয়া টা ভালই হল। তবে কাণ্ডও হল ভাল। দোকানে ঢুকেই মনে কু গাইছিল। মেনু কার্ড দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। এত ভয়ংকর দাম। কালকের চেয়ে ডবল, তিন ডবল। ভারি মুস্কিল হল। গুগলে দোকানের যে ছবি দেখেছিলাম তার সাথেও মিলছে না। কি করি। এত দাম হলে প্রান খুলে খেতেও পারব না। গরীব মানুষ। জয় দা প্রস্তাব দিল, চল কেটে পড়ি। আমিও একটু কিন্তু কিন্তু করে সেই পথই ধরলাম। অর্ডার নিতে আসার আগেই চুপচাপ কেটে পড়লাম। ধরলে কি বলতাম কে জানে। খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। যাই হোক, গুগল ঘেঁটে পরিবর্তন চকের কাছে আর একটা দস্তরখাওন পাওয়া গেল। সেই উদ্দেশ্যেই রওনা দিলাম। মিনিট ২০ হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। গিয়ে বসলাম। না, এখানকার দাম গুলো এত চড়া নয়। এখানেও এসে গেল এক বাঙালি ওয়েটার। তার পরামর্শে আমরা আজ গালোটি কাবাব, বোটি কাবাব আর চিকেন মসালা নিলাম আর সঙ্গে লাচ্চা পরোটা। খাবার ভালই, কিন্তু কালকের মত নয়। বিশেষ করে চিকেন মসালা টা একদম মুখ মেরে দিল। যাই হোক, এরপর বিল হল ৬০০ টাকা। বিল মেটাতে গিয়ে জানলাম এই দোকান সবচেয়ে নতুন সংযোজন। আর সবচেয়ে আদি দোকান দু পা এগিয়েই তুলসি তে। ফেরার পথে দেখলাম সেই দোকান। ছোট্ট সাইজ, এ সি নেই, ভেতরে বসার জায়গাও নেই। বাইরে ত্রিপলের ছাউনির তলায় বসার ব্যবস্থা, কিন্তু তবুও কি ভিড়। গুগল দা এবারও আমাদের ডোবাল। কি আর করা যাবে। বেটার লাক নেক্সট টাইম। খাবার হজম করব বলে হেঁটে ফিরব ঠিক করেছি। আমরা পরিবর্তন চক পার হয়ে ফুটপাথ ধরে পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে এসে শাহনজফ রোডে পড়লাম। সেখান থেকে একটু হেঁটেই হোটেল। ১ লা এপ্রিল, দুপুর দু টো, লখনৌ স্টেশন স্টেশনের লবি তে বসে আছি। ট্রেন কখন আসবে জানিনা। এক্সপেক্টেড টাইম ক্রমশ পিছচ্ছে। কাল রাতেই এর আভাস পেয়েছিলাম। সন্ধ্যে বেলা তেই মেসেজ এসে গেছিল যে উপাসনা এক্সপ্রেস দেরাদুন থেকে দু ঘণ্টা লেটে অর্থাৎ রাত ১০ টার জায়গায় রাত ১২ টায় ছাড়বে। ভেবেছিলাম ভালই হল। সাত সকালে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে না। সকাল সাড়ে আট টায়। আবার হাওড়া তেও মাঝরাতে না ঢুকে ভোর বেলায় ঢুকব। কিন্তু হোটেলে আসার পর এল দ্বিতীয় মেসেজ। ট্রেন আরও তিন ঘণ্টা লেট। এবার ছাড়বে রাত তিন টের সময়। অর্থাৎ লখনৌয় আসতে দুপুর দেড় টা। আর পথে আরও ঝোলাবার সমুহ সম্ভাবনা। কিন্তু ওইসব না ভেবে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত এই অতিরিক্ত সময় টা কি করে কাজে লাগানো যায় সেটা ভাবতে বসলাম। আসার সময় ট্রেন লেট আমাদের একটা বিকেল কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ফেরার ট্রেন লেট করে আমাদের একটা বাড়তি সকাল উপহার দিয়েছে। সকালে উঠে দেখলাম ট্রেন এখনও বরেলি ছাড়ায় নি। অর্থাৎ দুটোর আগে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা এগার টা নাগাত বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের হিসেব চুকিয়ে। এমনিতেই ১২ টায় ছাড়তে হত। আজ ওলা ধরে আমরা চললাম লখনৌ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দিলখুশা কোঠি আর বাগান দেখতে। জায়গা টা বেশী কেউ চেনে না। আমাদের ড্রাইভারও নতুন লোক। গুগল দার ভরসায় চালাতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ল। শেষে একে ওকে জিজ্ঞেস করে কোনও মতে পৌছান গেল। জায়গা টা বেশ নির্জন। এই ভর দুপুর বেলায় কেউ কোথাও নেই। আমরা গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। গেটে শিকল জড়ানো। পাশের সাইন বোর্ডে লেখা আবিষ্কার করল জয় দা। পার্ক নাকি সকালে দুই ঘণ্টা আর বিকেলে দুই ঘণ্টা খোলা থাকে। এদিকে গুগল দা বলছে পার্ক সব সময় খোলা। এই গুগল ব্যাটাচ্ছেলে কে হাতের কাছে পেলে না...। যাই হোক, এত দূর এলাম, ফিরে যাব? জয় দা সাহস যোগাল। আমরা শিকল গলে ঢুকে পড়লাম। ওমা, ভিতরে গিয়ে দেখি আরও লোক আছে। এইভাবেই ঢুকেছে নিশ্চয়ই। সুন্দর বাগান বাড়ি। সাদাত আলি খানের আমলে এক ইংরেজের বানান এই বাগান বাড়ি লখনৌ এর চিরাচরিত ঘরানার চেয়ে আলাদা। বরং অনেক টা ইউরোপিয়ান ধাঁচের। সবুজ বাগান। লম্বা তালের গাছ। আর মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো দুটো ভগ্ন প্রায় বাড়ি। ছাদ নেই, দেওয়াল গুলোও কোথাও কোথাও ধ্বসে পড়েছে। নির্জন ফাঁকা পরিবেশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা এক টুকরো ইতিহাসের গল্প মন্দ লাগল না। এক সময় হয়ত এই খানেই নবাব আর তার ইয়ার দোস্ত আর সঙ্গে নবাবের সখা ব্রিটিশ রা মিলে মেহফিল বসাত। খানা পিনা, নাচা গানায় গম গম করে উঠত গোমতীর তীরের এই প্রাসাদ। কিন্তু আজ সে সব ইতিহাস। কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে নাটকের চরিত্র রা, শুধু একা পড়ে আছে ভাঙা চোরা নাটকের মঞ্চ। আরও কিছুক্ষন বসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় বড় অল্প। তাই যেতে হবে। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার ওলা ডাকা। এবার চললাম লা মার্টিনিয়ের কলেজ। মেজর জেনারেল ক্লদ মার্টিনের উইল অনুসারে প্রতিষ্ঠিত এই লা মার্টিনিয়ের কলেজ। কলকাতায় ১৮৩৬ সালে আর লখনৌ তে ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই কলেজ। নবাব আসাফা উদ দৌলা যখন ফৈজাবাদ থেকে লখনৌ তে রাজধানী স্থানান্তর করেন তখন এই নতুন শহরের রুপকার ছিলেন এই ক্লদ সাহেব। ফ্রান্সের লিওন শহরের মানুষ তিনি। সেই শহরেও আছে তার নামের এই কলেজ। তারই তৈরী কন্সট্যান্সিয়া বিল্ডিং ই আজকের লা মার্টিনিয়ের লখনৌ। গাড়ি কলেজের গেটে দাঁড়াতে আমরা গেটের সিকিউরিটির কাছে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চাইতে সানন্দে পাওয়া গেল। আমরা কলকাতা থেকে আসছি শুনে উনি জানালেন কলকাতার লা মার্টিনিয়ের এর কথা। আমরা সুন্দর সাজানো রাস্তা ধরে এগলাম। চারিদিক পরিপাটি করে সাজানো। আজ রবিবার, ছুটির দিন, তাই কলেজের ব্যস্ততা চোখে পড়ল না। রাস্তা ধরে একেবারে শেষে গিয়ে একটা ঘোড়ার আস্তাবলের পাশ দিয়ে, স্টাফ কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে পৌছালাম ওই বাড়ি টার পিছনে। কিন্তু পিছন থেকে দেখলে কি হয়? ওই বাড়ির ফাঁক ফোঁকর গলে চলে এলাম সামনে। দারুন সুন্দর সাদা রঙের ইউরোপিয়ান স্থাপত্তে গড়া বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি। দু পাশে দু টো সিংহ। একদম উপরে চার টে বাঁকানো থাম মধ্যিখানে এসে মিশেছে। বাড়ির সামনে একটা কামান রাখা। শুনেছি সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র রা সিপাহী দের বাধা দিয়েছিল। ফলে এখানেও গোলা বর্ষণ হয়। পরে এই কলেজ কে ‘ব্যাটল অফ অনার’ এর সম্মান দেওয়া হয়। বিশ্বে এটিই একমাত্র কলেজ যা এই সম্মান পেয়েছে। আমাদের দেশের প্রথম স্বাধীনতার লড়াই তে এই কলেজ ব্রিটিশ দের হয়ে লড়েছিল। জানিনা, আজকের ছাত্র রা এটা নিয়ে গর্ব অনুভব করে না লজ্জা। দেখা শেষ, ঘোরা শেষ। এবার ফেরার পালা। বাইরে বেরিয়ে দেখি সেই ওলা টাই দাঁড়িয়ে আছে। তাতে করেই এলাম স্টেশন। তারপর স্টেশনের ক্যান্টিন এ খাওয়া সেরে এসে বসেছি এই লবি তে। ট্রেনের পাত্তা নেই। যা বুঝছি, চার টের আগে আসছে না। কি ভোগান্তি! ২ রা এপ্রিল, সকাল ৯ টা, উপাসনা এক্সপ্রেস সবে ঘুম টা ভেঙ্গেছে। শুনলাম ট্রেন সবে আসানসোল ছাড়ল। তার মানে রাতে কিছুই মেক আপ করতে পারেনি। সেই বারো টা বাজাবে। কাল ট্রেন এসেছিল সাড়ে চার টেয়। তার আগে একবার চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে দৌড় করিয়েছে। তারপর সেই এক নম্বরেই গাড়ি ঢুকেছে। ট্রেনের কামরা প্রায় ফাঁকা করে দিয়ে সব লোক নেমে গেছে। তারপর আমরা চড়ে বসেছি। ট্রেন তারপর থেকে ভালই এসেছে বারানসী অবধি। আমাদের রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। জয় দা সবে লোয়ার বার্থ টা দখল করার কথা ভাবছে তখনি বারানসী থেকে তিন টে ছেলে উঠল। কলকাতা যাবে। বারানসী তে পুজো আচ্চা দিয়ে এতক্ষন স্টেশনে হত্যে দিয়ে পরেছিল। তারাই লোয়ার বার্থের মালিক। বারানসীর দল ট্রেনের অপেক্ষা করে ক্লান্ত। শুয়ে পড়তে চায়। অগত্যা, ট্রেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গঙ্গা পেরোনোর পর আস্তে আস্তে আপার বার্থে উঠে পড়েছি, তারপর ঘুম। রাতে একবার ক্যাচর ম্যাচরে ঘুম ভেঙ্গেছিল। যথারীতি বিহারের নিয়ম মেনে লোকে কামরা ভরিয়ে ফেলেছে। একটা ছেলে আপার বার্থে ওঠার চেষ্টা করছিল। তাকে নামালাম। টয়লেট থেকে ফিরে এক ঘুমে রাত কাবাড়। ট্রেন চলেছে নিজের গতি তে। এদিকে আমার কিটো জুতো খুঁজে পাচ্ছি না। সীটের তলা তেই তো রেখেছিলাম। কোথায় গেল? শেষে কি খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে হবে? এমন সময়ে কালকের সেই আমার বার্থ দখলের চেষ্টা করা মক্কেল দেখি টয়লেট থেকে হেলতে দুলতে এসে আমার জুতো টা খুলে রাখল। বারোয়ারি জুতো ভেবে পড়ে টয়লেটে চলে গেছিল। আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। আমার হতভম্ব মুখ দেখে বারানসী পার্টির একজন মুচকি হাসল। অবশেষে ট্রেন টা ঝিমোতে ঝিমোতে বর্ধমান পার করল। ইতিমধ্যে আমরা লখনৌ স্টেশনে কেনা কেক বিস্কুট খেয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেছি। ডানকুনি তে নামবো ভেবেছিলাম, কিন্তু সেখানে ব্যাটাচ্ছেলে দাঁড়াল না। অগত্যা হাওড়া তে সাড়ে বারো টায় ঢোকার পর ট্যাক্সি নিয়ে শিয়ালদা। সেখান থেকে ট্রেনে যে যার পথে। আমার জার্নাল এইখানেই শেষ হল। কিন্তু স্মৃতি পাতায় রয়ে গেল কিছু দাগ। দু দফায় ট্রেন বিভ্রাট এর অভ্যিজ্ঞতা প্রথম বার হল। রাত দেড় টায় অজানা শহরের রাস্তা তেও এই প্রথম। গালোটি কাবাবের প্রথম স্বাদ। অদ্ভুত ভুলভুলাইয়া, রেসিডেন্সির গোলার দাগ, আম্বেদকর পার্কের সন্ধ্যে টা, বয়ে চলা গোমতী নদী আর নতুন পুরানো মিলে ছিমছাম শহর টা। আমার দেখা শহর গুলোর মধ্যে আর এক শহরের সাথে এর মিল খুঁজে পেলাম। পুনে। সেও পুরানো ঐতিহ্য ধরে রেখে আগামীর পথে এগোচ্ছে। ইচ্ছে রইলো আবারো এমন কোন নানা রঙের শহরে গিয়ে হাজির হওয়া। আর ততক্ষণ এই কলমের ছুটি। শেষ। Post By:- Sid Ray
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |