একটি ভ্রমণ গ্রুপে প্রথম গনগনি,বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সম্পর্কে জানতে পারি।লাল-কমলা-সবুজ মেশানো অদ্ভুত ভূমিরূপের প্রেমে পড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের গনগনির পথে পা বাড়িয়ে দিলাম। ২৭শে ডিসেম্বর,সকাল ৭টা ৫৫মিনিটে সাঁতরাগাছি থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেসে চেপে আমারা আমাদের যাত্রা শুরু করি। যদিও আমাদের আরণ্যক এক্সপ্রেসে যাওয়ার কথা ছিল না,সকাল ৬টা ২৫ এর রূপসী বাংলা করে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু,ওলা ক্যাবের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখার দরুণ আর সাঁতরাগাছি ব্রিজে ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য আমরা ট্রেন মিস করি। আমরা সকাল ১১টায় গড়বেতা স্টেশনে নেমে টোটো ধরে(ভাড়া জনপ্রতি ২০টাকা) আগে থেকে বুক করে রাখা আপ্যায়ন লজে উঠি।হোটেলের রুম মোটামুটি পরিচ্ছন্ন (এসি ও গিজার আছে)।এরপর হোটেলে ভাত,ডাল,সবজি,মাছ,চাটনি খেয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি গনগনির উদ্দেশ্যে (আমরা ছ'জন ছিলাম,সুমো ভাড়া নিই ৪০০টাকায়,এমনিতে টোটো ভাড়া ১০০-১৫০টাকা)। প্রথমে আমরা বিখ্যাত সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে যাই।মন্দিরে দুপুর ১টার মধ্যে ভোগ খাওয়ার (জনপ্রতি ৫০টাকা) আছে।ওড়িশার স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত মন্দিরটি এবং মন্দিরের মাতার বিগ্রহটি অপূর্ব।বিগ্রহের ছবি তোলা নিষেধ। এরপর আমাদের গন্তব্য দ্বাদশ শিবালয় নামের একটি বহু প্রাচীন শিবমন্দির। মন্দিরে ১২টি শিবের পৃথক মন্দির,একটি জলাশয়(রক্ষণাবেক্ষণের অভাব পরিলক্ষিত) আছে। এরপর আমাদের গন্তব্য গনগনি।গনগনি পৌঁছে বুঝতে পারলাম কেন আমেরিকার অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাথে গনগনির তুলনা করা হয়। শিলাবতী নদীর ক্ষয় কার্যের ফলে তৈরি প্রায় 70 ফুট নিচু গিরিখাত এক অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।লাল ল্যাটেরাইট পাথর আর মাটি বাতাস আর জলের ক্ষয়কার্যের ফলে নানারূপের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তৈরি করেছে। লালমাটি,শিলাবতী নদী,ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি গাছের জঙ্গল যেন শিল্পীর তুলির টানে পটে আঁকা সুন্দর ফ্রেম। যাওয়ার সময় লালমাটির আঁকাবাঁকা পথের দুদিকে ঘন জঙ্গল।গিরিখাত এর নিচে নামার জন্য রয়েছে আঁকা বাঁকা সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নদীর তটে পৌঁছে যেতে পারেন কিংবা হারিয়ে যেতে পারেন গিরিখাত এর গুহায়। চারপাশে শুধু গুহা,ভাঙা দুর্গ বা অদ্ভুত ভূমিরূপ।কথিত আছে,ভীম ও বকাসুরের যুদ্ধের সময় দুই যোদ্ধার পদচালনায় এখানের এইরূপ ভূমির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছে। আমরা গনগনির সূর্যাস্তর লাল রং মেখে হোটেলে ফিরে এলাম।রাতে হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথের দূরে একটি খাওয়ার হোটেলে(সস্তা কিন্তু ভালো গুণমানের)রাতের খাওয়ার খেলাম।
পরদিন সকালে টিফিন খেয়ে ভাড়ার গাড়ি(১৫০০টাকা;ওমনি নিলে ১২০০টাকা)করে বিষ্ণুপুরের দিকে রওনা দিলাম।প্রায় আধঘণ্টা লালমাটির রাস্তায় চলার পর আমরা পৌঁছলাম বিষ্ণুপুরে। প্রথমে গেলাম রাসমঞ্চে।ওখানে টিকিট কাটতে হলো।ঐ টিকিট দেখিয়ে সব মন্দিরে যাওয়া যাবে।
আমরা রাসমঞ্চ,রাধামাধব মন্দির,শ্যামরাই এর মন্দির,পাথর দরজা, মদনমোহন মন্দির, লালজী মন্দির,ছিন্নমস্তার মন্দির,দলমাদল কামান,মা মৃন্ময়ীর মন্দির,জোড় বাংলা মন্দির প্রমুখ মন্দির দেখলাম। প্রত্যক্ষ করলাম প্রতিটি মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা শৈলীতে নির্মিত মহাভারত, রামায়ণ,বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন চিত্র। মধ্যাহ্নভোজন করলাম ছিন্নমস্তা মন্দিরের কাছের বিরিয়ানি হাউসে।পোড়া মাটির জিনিসপত্র কেনাকাটাও পথের পাশের দোকানে করলাম। বাঁকুড়ার মল্লরাজাদের তৈরি পোড়া মাটির টেরাকোটা শৈলীর ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথরের অপূর্ব ভাস্কর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেছিলাম ইতিহাসের পাতায়।আজ মল্লরাজারা নেই, কিন্তু তাঁদের সময়ে তৈরি সেই অপূর্ব ভাস্কর্য আজো দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।তবে তারা আজ বৃদ্ধ, জীর্ণ, জরাগ্রস্ত। সন্ধ্যার বিষন্নতা মেখে ফিরে এলাম আবার গড়বেতার হোটেলে।সেদিন রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকাল ৭টা ৫০মিনিটের হাওড়া সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস গড়বেতা স্টেশন থেকে ধরে হাওড়া ফিরে এলাম আর সাথে নিয়ে এলাম একমুঠো গনগনি আর বিষ্ণুপুরের সুন্দর স্মৃতি। তবে গনগনিতে বহু থার্মোকলের ব্যবহৃত থালা,বোতল পড়ে থাকতে দেখলাম যা পরিবেশ দূষণ করছে। এসম্পর্কে আমাদের নিজেদের সচেতন থাকা উচিত।
কিভাবে যাবেন:
রেল বা সড়ক দুভাবেই গড়বেতা যাওয়া যায়। সাঁতরাগাছি থেকে রুপসী বাংলা এক্সপ্রেস (সকাল 6.30), শালিমার থেকে( সকাল 7.45) আরন্যক এক্সপ্রেস এ চেপে গড়বেতা নামতে হবে । গড়বেতা থেকে টোটোতে দশমিনিটে গড়বেতা। যদি সেদিনই ফিরতে চান বিকেল ৩টে ২০তে আরণ্যক এক্সপ্রেস আছে গড়বেতা স্টেশন থেকে। গড়বেতা থেকে বিষ্ণুপুর ট্রেনে করেও যাওয়া যায়।ট্রেনে কুড়ি মিনিট সময় লাগে। থাকার ব্যবস্থা: গনগনিতে থাকার ব্যবস্থা নেই।গড়বেতাতে থাকতে হবে।সোনাঝুরি গেস্টহাউস (৯৫৪৭৫১৪০৩০),আপ্যায়ন লজ(৮৩৪৮৬৯৪৮০১), শ্যামভবন ধর্মশালা (৯৮৩২৭৪২২৯৩) এ থাকার ব্যবস্থা আছে।ভাড়া ৫০০/১০০০টাকার মধ্যে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |