-- হারিয়ে যাওয়ার গল্প --
2017 এর আগস্ট মাসে প্রচন্ড বৃষ্টিতে রেল ব্রিজ ভেঙে গিয়ে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঠিক আগের দিন আমরা (আমি/অর্ণব) নিউম্যাল পৌঁছোই। কিন্ত গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড় বন্ধ থাকায় নিরুপায় হয়ে আমাদের একরাত মূর্তিতে থাকতে হয়েছিল। মূর্তি পৌঁছে বিকেলের দিকে আমরা চলে আসি চাপড়ামারির জঙ্গলে। একপ্রান্তে মূর্তি ও অপরপ্রান্তে জলঢাকা নদীকে সীমানা চিহ্নিত করে উত্তরবঙ্গের সুবিশাল অভয়ারণ্য এই চাপড়ামারি। 960 হেক্টর ব্যাপী বিস্তীর্ণ এ বনভূমি 'Elephant Corridor' নামে পরিচিত। গগনচুম্বী ঘন শালের এই জঙ্গলে সুবিশাল বুনো হাতি ছাড়াও চিতাবাঘ, বাইসন, গন্ডার, ভাল্লুকের মতো বন্য জীবজন্তুর বসবাস। ক্রমাগত বর্ষণে অরণ্য তখন সবুজ ও সতেজ। জঙ্গলের বুক চিরে 9 কিমি দীর্ঘ সরু পিচরাস্তা চলে গেছে জলঢাকা পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে গাড়ির যাওয়া আসা ছাড়া কোন মানুষজন নেই। বৃষ্টি ভেজা শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ। থমথমে মেঘলা আকাশ। মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে পাখির ডাক ও ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। প্রকৃতির কাছাকাছি এসে একটা ভালোলাগার আভাস পাওয়া যায়। ঘড়িতে তখন 4:00 PM। গল্প করতে করতে আমরা চলতে থাকি জলঢাকার দিকে। পথে বিলাসিতা করে ছবি তুলে কাটতে থাকে সময়। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরেও জঙ্গল শেষ হয়না। শরীরে ক্লান্তি। মোবাইলে টাওয়ার না থাকায় অবস্থান বোঝার উপায় নেই। সেই সময় জলঢাকা উদ্দেশ্যে আসা একটি গাড়ির আওয়াজ পেয়ে আমরা দূর থেকে হাত দেখাই। গাড়িচালক স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি জানান জলঢাকা সামনেই। আর বেশি পথ বাকি নেই। নিজেদের অজান্তে অনেকটাই পথ যে আমরা পেরিয়ে এসেছি তা টের পাই। ভদ্রলোক আমাদের জলঢাকা পৌঁছে দেন। আর মিনিট 5/7 একের মধ্যে যখন আমারা জলঢাকা পৌঁছোই ঘড়িতে তখন 5:15 PM। সকাল বেলায় খাওয়া-দাওয়ার প্রথম পর্ব সম্পন্ন করার পর দ্বিতীয় পর্বের আর অবকাশ হয়নি। উপরন্তু বিগত একঘন্টা পদব্রজে বিচরণের ফলস্বরূপ খিদের চোটে নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার জোগাড়। জলঢাকা পৌঁছে একটা মোমোর দোকান খুঁজে পাই। পরম সুস্বাদু মোমো গোগ্রাসে গিলে খানিক শান্তি মেলে। মূর্তি থেকে আমরা হেঁটে এসেছি শুনে সে দোকানের দিদি বেশ অবাক হয় এবং তার চেয়েও বেশি অবাক হয় সেই একই পথে একই ভাবে আমরা আবার মূর্তি ফিরে যাব শুনে। মূর্তি উদ্দেশ্যে যখন আমরা রওনা হই চারিদিকে তখন বিকেলের আলো। মেঘলা আকাশের দরুন সে আলোর উজ্জ্বলতা ম্লান হলেও গাছের পাতার রং তখনও কালো হতে শুরু করেনি। কোনো না কোনো গাড়ি আবার ঠিক পেয়ে যাবো এই ভরসায় আমরা পা বাড়াই জঙ্গলের পথে। সম্ভবত দু-আড়াই কিমি পথ পার হই আনন্দেই। কিন্তু ঘড়িতে যখন প্রায় 6:35 PM তখনও কোন গাড়ির দেখা মেলে না। এদিকে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর আভাস ক্রমশ কমতে থাকে। অপর্যাপ্ত আলোয় ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে দূরের দৃষ্টিশক্তি। মনের মধ্যে ক্রমশ একটা বিপদের আশঙ্কা জাগতে শুরু করে। বিপদের সে আশঙ্কা বদ্ধমূল হয় ঠিক তখন যখন আলোর অবশিষ্টাংশকে নির্মূল করে হঠাৎ নামা অন্ধকারে আমরা সম্পূর্ণরুপে দৃষ্টিশক্তি হারাই। জঙ্গলে আকস্মিক ঘনিয়ে আসা অন্ধকার যে এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। ধারণা যখন তৈরি হয় তখন আমরা নিরুপায়। মেঘলা রাতে অভয়ারণ্যে নেমে আসা ঘন কালো অন্ধকারে তখন সবকিছু মিলেমিশে একাকার। রাস্তাঘাট, গাছপালা, আকাশ, জঙ্গলের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই। এ জঙ্গল তখন আর ঘুরতে আসা সে জঙ্গল নয়। জনমানব শূন্য এ অরণ্য তখন দুর্ভেদ্য অন্ধকারে গ্রাস করা এক অজানা আতঙ্কের আহ্বান। সে পরিস্থিতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। হঠাৎ দিক নির্ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে আমরা তখন দুই অসহায় অন্ধ পথচারী। সামান্য কিছু জোনাকি পোকা ছাড়া আলোর কোনো চিহ্ন নেই। এমনকি মোবাইলে আলো জ্বেলেও কোনো ফল হয়না। গাঢ় অন্ধকারে হাতের আলো কেবল পায়ের নখ স্পর্শ করে মাত্র। বোঝা যায় এ অন্ধকারে মোবাইলের আলো জ্বালা বা না জ্বালা সমান। বরং জঙ্গলে এ আলো জ্বালালে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। অতঃপর আন্দাজে অন্ধকার হাতড়ানোই তখন আমাদের একমাত্র উপায়। মোবাইলে টাওয়ার না থাকায় অবস্থান নির্ণয়ের চিন্তাও অমূলক। একই পথে প্রত্যাবর্তন। দিক পরিবর্তনের কোনো জটিলতাও নেই। অথচ চেনা পথেই পথ হারিয়ে দিশেহারা আমরা।
হঠাৎ এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মনের সাহস ও মাথার বুদ্ধি দুটোই প্রায় লোপ পেলেও আমরা থেমে যাইনি। থামার কোনো উপায়ও নেই। মূর্তি আমাদের পৌঁছতেই হবে। কথা বলার মতো মানসিক পরিস্থিতিও নেই। প্রাণ সঙ্কটে পড়ে তখন বাকরুদ্ধ আমারা। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর আওয়াজ স্পষ্ট। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসা অজানা শব্দ বাড়িয়ে দেয় হৃদস্পন্দনের গতিবেগ। বিকেলের ভালোলাগা ঝিঁঝিঁর ডাকেও ভয়ের ইঙ্গিত। মনে পড়ে একের পর এক ভয়ঙ্কর সব জীবজন্তুদের কথা। হাতি, চিতাবাঘ, বাইসন যেকোনো একটির সম্মুখ দর্শন ঘটলেই জীবন বিপন্ন। উপরন্তু বর্ষাকাল। সাপখোপ পোকামাকড় দের পারিবারিক ভ্রমণের আদর্শ সময়কাল। এদিকে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে একটা গাছের ডালও হাতে নেই। পাশাপাশি থেকেও অন্ধকারে পরস্পরকে দেখা যায়না। পায়ের শব্দ শুনে উপস্থিতি অনুমান করতে হয়। একজোট হতে একে অপরের হাত ধরি আমারা। বিপদ ঘটলে কতটা কি করতে পারব জানিনা তবে যা করব দুজনে একসঙ্গে করব এটাই উদ্দেশ্য। পরস্পরের অনিশ্চিত অবস্থান সুনিশ্চিত হলে মনে সাহস বাড়ে কিছুটা। ইতিমধ্যে মিনিট কুড়ি (আনুমানিক) অন্ধকার হাতরানোর পরেও দৃষ্টিশক্তির বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটেনা। আন্দাজে যতটা সম্ভব পিচ রাস্তার ওপর থাকার চেষ্টায় মাঝে মাঝে রাস্তার ডানদিক অথবা বাঁ দিকের ঝোপজঙ্গলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে হয়। অন্ধকারে হোঁচট খেতে হয় বারংবার। তবু লক্ষ্য স্থির রেখে পথ চলতে বাধ্য আমরা।
শেষ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে মূর্তির রিসোর্ট গুলোর আলো চোখে পড়ার পর। যদিও সে আলোর অবস্থান তখনও দু-এক কিমি দূরত্ব নির্দেশ করে। তবে গভীর জঙ্গল ততক্ষণে আমরা পেরিয়ে এসেছি। অন্ধকার নিজের ঘনত্ব কমিয়ে আমাদের দৃষ্টিশক্তি আংশিক ফেরত দিয়েছে। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার কারণে মনের ভয়টাও কেটে গেছে অনেকটাই। সাহস ফিরে পেয়ে প্রায় অন্তিমপর্যায়ে এসে এই ঘটনার সাক্ষী রাখতে খানিকটা অডিও রেকর্ডিংও করেছিলাম। অবশেষে যখন মূর্তি নদীর সেতুর উপর পৌঁছোই ঘড়িতে তখন 7:40 PM। জীবন সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেয়ে তখন ভীতি ও আনন্দ মিশ্রিত উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সক্ষম আমারা। সে রাতে মাত্র দুটি মূর্তিগামী গাড়ির দেখা আমরা পেয়েছিলাম। বারংবার হাত দেখানো সত্ত্বেও তারা কেউই থামতে রাজি হয়নি। পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিলাম যে না ভেবে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত মানুষকে কত বড় বিপদের মুখে ফেলতে পারে। আমাদের মত এমন অভিজ্ঞতা কারোর যেন কখনো না হয় এমন টাই কাম্য।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |