পাশের ঘর থেকে ব্ৰাহ্মণির কান্না শুনে, কুন্তী বিচলিত হয়ে পড়ে। কিছুদিন ধরে কুন্তী পাঁচ পুত্র সহ এই ব্ৰাহ্মণের এই গৃহেই আশ্রয় লাভ করেছেন। অজ্ঞাতবাস এর এই দিনগুলো এই ভাবেই হস্তিনাপুর থেকে দূরে দূরে লুকিয়ে লুকিয়েই তাদের জীবনযাপন। তাদের বর্তমান এই ব্ৰাহ্মণের গৃহের আশ্রয়টা একচক্রা গ্রামে। আজ তার বাকি চার পুত্র গ্রামে ভিক্ষা করতে গেছে, খালি ভীম রয়েছে কুন্তীকে দেখাশোনা করার জন্য। ব্ৰাহ্মণির কান্নার কারন জানতে কুন্তী তার আশ্রয়দাতা ব্ৰাহ্মণ এর কাছে গেলে ব্ৰাহ্মণ জানায়, সেই রাজ্যে বকাসুর নামে এক ভয়ানক রাক্ষস এর প্রভাব রয়েছে। সেখানকার রাজা সেই রাক্ষসকে শান্ত করতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ খাবার দিয়ে একটা গরুর গাড়ি করে কোনো একজন প্রজাকে বকসুরের কাছে পাঠায়। বকাসুর সেই খাবার এর সাথে সাথে গরুর গাড়ির গরু এবং তার চালক সেই প্রজাটাকেও তার উদরোস্ত করে তার খিদে মেটায়। এই নিয়ম বহুদিন ধরে চলে আসছে। আজ ব্ৰাহ্মণের এক মাত্র ছেলের পালা সেই খাবার নিয়ে যাবার। তাই ছেলের আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় ব্ৰাহ্মণি কাঁদছেন। এই কথা শুনে কুন্তী কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে ব্ৰাহ্মণকে জানান যে ওঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজন যাবে আজ বকসুরের কাছে খাবার নিয়ে। মায়ের কথা মতন ভীম পাহাড় প্রমান খাবার নিয়ে গরুর গাড়ি করে বকসুরের কাছে যায় এবং রাস্তায় বকসুরের জন্য পাঠানো সব খাবার খেয়ে শেষ করে দেয়। বকসুরের কাছে পৌঁছলে সমস্ত খাবার শেষ দেখে বকাসুর ভীষণ রেগে যায়। এবং শুরু হয় ভীম আর বকসুরের ভীষণ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে বকাসুরকে নিহত করে ভীম সমস্ত রাজ্যবাসীকে উদ্ধার করে। কথিত আছে, সেই যুদ্ধের ফল স্বরূপ শিলাবতী নদীর তীরের পাথুড়ে মাটি ভেঙেচুরে যায়। যা আজ গণগনি নামে পরিচিত। যদিও আজকের একচক্রা গ্রাম থেকে গড়বেতার গণগনি অনেকটা দূরে তবু লোককথা অনুযায়ী এইখানেই ভীম বকাসুর বধ করেছিলো।
মহাভারতের এই গল্প শুনে গড়বেতা যাবার ইচ্ছে বহুদিন ধরেই ছিল। শীততো এই বছরের মতন গেছেই, বসন্তটাও প্রায় যাই যাই করছে। তাই আর দেরি না করে গত রোববার সকালে সাতরাগাছি স্টেশন থেকে সকাল 6:25 রূপসী-বাংলা-এক্সপ্রেস (12883) ধরে রওনা দিয়েছিলাম গড়বেতার উদ্দেশ্যে। ঠিক 9:20 তে ট্রেন আমাকে গড়বেতা স্টেশনে নামিয়ে পুরুলিয়ার দিকে বেরিয়ে গেলো। ছোট্ট শান্ত স্টেশনটা, ট্রেন আসায় যেমন হটাৎ করে জেগে উঠেছিল, ঠিক তেমনি ট্রেন চার-পাঁচ জন যাত্রীকে নামিয়ে চলে যাবার পর আবার সে ঝুঁপ করে ঘুমিয়ে পড়লো। স্টেশন থেকে বেরিয়েই টোটো স্ট্যান্ড আর গুটিকয় অস্থায়ী খাবারের দোকান। অত সকালে বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে বেরোইনি, পেটে ছুঁচোর প্যারেড টের পাচ্ছিলাম। তাই সোজা একটা দোকানে ঢুকে পেট পুরে লুচি, আলুর তরকারি আর চা দিয়ে প্রাতরাশ সারলাম। ফেসবুকের একটি ভ্রমণ গ্রূপের থেকে পেয়েছিলাম টোটো চালক শীতল এর নম্বর (9733709803)। ওকে আগে থেকেই ফোন করা ছিল। আমার খাওয়া শেষ হতেই সেও এসে হাজির। শীতল একজন অত্যন্ত ভদ্র আর শান্ত স্বভাবের মানুষ। প্রথমে সোনাঝুড়ি গেষ্ট হাউসে (9547514030) গিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম যথাক্রমে, শালবনের জঙ্গল, বারো-শিব-লক্ষী-নারায়ণ মন্দির আর সর্বমঙ্গলা মন্দির এর উদ্দ্যেশে। সব ঘুড়ে, দেখে, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সামনেই রাস্তার ধারে দেব হোটেল এ পঁয়ত্রিশ টাকায় সুস্বাদু নিরামিষ ভাত খেয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। অতঃপর, গেস্ট হাউসে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে, ৩:৩০ নাগাদ আবার শীতলের সাথে বেরিয়ে পড়লাম গড়বেতার সব থেকে আকর্ষণীয় স্থান, গণগনি দেখতে।
এক সময়ের খরস্রোতা শিলাবতী নদী, তার দুই পরের ল্যাটারাইট মাটির মালভূমিকে ক্ষয় করে সৃষ্টি করেছে প্রকৃতির এই অপরূপ ভাস্কর্য। যাকে আমেরিকার বিখ্যাত গ্রান্ড ক্যানিয়ন এর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। নব্বইটার মতন সিঁড়ি নেমে শিলাবতী নদী, যার স্থানীয় নাম শিলাই। এখানে নদী একটা সুন্দর বাঁক নিয়েছে যা এই দৃশ্যপটকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। লাল পাথরের এই ক্ষয়ে যাওয়া মালভূমি যারা না দেখেছে, তাদেরকে এই স্থানের সৌন্দর্য ভাষায় লিখে বর্ণনা করা কঠিন। প্রকৃতি যে একজন কত বড় শিল্পী তা এই স্থানে গেলেই বোঝা যায়। পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে কথাও যেন তৈরি হয়েছে শিবলিঙ্গ, কোথাও যেন পুরো পাহাড়টাই একটা রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বার, আবার কোনো দিকে যেন একটা বিশাল দুর্গের রূপ বলে মনে হয়। দু-ঘন্টা ধরে যত দেখেছি তত অবাক হয়েছি। গণগনিতে সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে গেস্ট হাউস থেকে ব্যাগ নিয়ে স্টেশন পৌঁছতে ফেরার ট্রেন মিস করলাম। অগত্যা সেই রাতটা সোনাঝুড়ি গেস্ট হাউসে থেকে গিয়ে, পরদিন সকাল 7:54 র হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস (12828) ধরে ঘরে ফিরলাম।
সাথে নিয়ে ফিরলাম গ্রাম বাংলার এক রাশ রূপ-রস-গন্ধের স্বাদ আর সেখানকার মানুষদের অকৃত্তিম আতিথেয়তার সান্নিধ্য। মহাভারতের গল্পের সত্যতা হয়তো এখন আর কেউ প্রমান করতে পারবে না। কিন্তু গণগনি যে আপনাকে তার সৌন্দর্য দিয়ে মুগ্ধ করবেই করবে, সেটার গ্যারান্টি আমি অবশ্যই দিতে পারি।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |