তিনচুলেতে ত্রিরত্ন – বাইক, বৃষ্টি ও বন্ধু:::::::----- ২০১৫ সাল, কয়েক বছরে প্রথমবার পুজোয় কোথায় ঘুরতে যাবো প্ল্যান করা হয়নি। দায় মূলত আমার। নিজে তখন PhD নিয়ে চাপে, আগস্ট মাসের পর কি করব নিজেই জানি না এই অবস্থায় কি ভাবেই বা ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবা যায়। যাই হোক, চাকরিটা হয়ে গেল। আগস্টে যোগ দিলাম চাকরিতে।ততদিনে পুজোর সব বুকিং শেষ। মনে হচ্ছিল কোথাও যাওয়া হবে না। পুজোর সময়, মনে হয় পঞ্চমীতে বন্ধুর পাম্পে আড্ডা দিতে দিতে মনে হল দেখায় যাক না কোথাও যদি একটি ঘরও ফাঁকা পাওয়া যায়। শুরু হল ইন্টারনেট ঘেটে ফোন করা। প্রায় সব জায়গায় যখন নাকচ করে দিল, হঠাৎ মনে পরে গেল অঞ্জন দত্তর ‘চলো লেটস গো’ সিনেমার গান। ফোন লাগলাম তিনচুলেতে অভিরাজ homestay তে। ভাগ্য সহায় ছিল। একটা ছোট ঘর খালি ছিল, তাতে চার জন কোনোরকমে হয়ে যাবে। বরাবরের সঙ্গী সৌম্য তখন চাকরি সূত্রে দিল্লীতে। আমি, বিপ্লব, যুবরাজ আর সৌমেন যাবে ঠিক হল। সৌমেনের সেই প্রথম যাওয়া আমাদের সাথে। ঠিক হল আমরা গাড়িতে নয় বাইকে যাব, তাতে যেমন একটা আলাদা এডভেঞ্চার হবে আর পয়সাও কম খরচ হবে। তিনচুলে নামটি এসছে তিনটি চুলা বা উনুন থেকে। তিনটি পাহাড় তিনটি উনুনের রূপ ধরেছে এখানে। শিলিগুড়ি থেকে ঘুম হয়ে বা সেবক, তিস্তাবাজার, তাকদা হয়েও যাওয়া যায়। আমরা ঠিক করলাম সেবক হতে যাব আর ঘুরপথে ফিরে আসব। বিপ্লবের পালসার আর সৌমেনের avenger নিয়ে রওনা দিলাম। মাঝেমধ্যে দু-একটা ছোটখাটো চা বিরতি বাদ দিলে প্রথম দাড়ালাম lovers meet point এ। তিস্তা আর রঙ্গিতের মিলন এত সুন্দর ভাবে আর কোথাও দেখা যায় না। এর আগে ত্রিবেণী পিকনিক স্পটে এরকম মিলন দেখেছি, তবে সেটা একদম সামনে থেকে আর এখানে ওপর থেকে পাখির চোখের মত দেখার অনুভব আলাদা। প্রায় কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা আর রঙ্গিত দেখা যায় এখান থেকে। তারপর শুরু হল পেশক রোড ধরে যাত্রা। এসে পৌছালাম পেশক চা বাগান।আমার দেখা পাহাড়ে অন্যতম সুন্দর চা বাগান। পাহাড়ের ঢালে চা বাগানের বুক চিরে চলে যাওয়া এক বাঁকা রাস্তা আরও সুন্দর করে তুলেছে সেই দৃশ্যপট। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যায় এখানে। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা কেই বা বুঝতে পারে। হঠাৎ করে ঘন মেঘের ঝাপটা লাগলো আমাদের গায়ে, বুঝলাম বৃষ্টি শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ওখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার ওপরে তিনচুলে যেতে যেতেই শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। যেহেতু বৃষ্টি তে আর কিছু করার নেই তাই খেয়ে বিশ্রাম নেবার মনস্থির করলাম। অভিরাজের নিজের বাগানের সবজি দিয়ে ওর মায়ের হাতের তৈরী খাওয়ার, যে কারও মুখে লেগে থাকবে। গিয়ে মনে হয়নি যে আমরা টাকা দিয়ে থাকতে এসেছি। মনে হচ্ছিল যেন কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছি অবাক দিন পর যাকে একটু কম চিনি হয়ত। নিজেদের বাগানেই ওরা কোয়াশ, রাই শাক, বেগুন, বাধা কপি, গাজর, বিনস, আদা, এলাচ এমনকি চা পর্যন্ত চাষ করে। হ্যা, ওদের একটি ছোট্ট চা বাগানও আছে বাড়ির সাথেই। খাওয়ার পর বৃষ্টি একটু কমলে আমরা ঘুরে দেখলাম বাগান। ঘন মেঘের মধ্যে তিনচুলে রাস্তা তখন চেনা মায়াবী রূপ ধারন করেছে। দিনের বেলাতেও গা ছমছমে ব্যাপার। বেশ খানিকটা হেটে এসে বৃষ্টির দয়ায় আবার ঘরে চলে এলাম। ঘরটা ছোট হলেও ঠিকঠাক ছিল। শুধু বাথরুমটা বাইরে, যা শীতের জায়গায় একটু নয় অনেকটাই চাপের। অলস ভাবে শুয়ে বসে বৃষ্টি, ঝি ঝি পোকা, পাখির ডাক শুনতে শুনতে সন্ধ্যা কেটে গেল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি মনে হচ্ছিল আমাদের পিছু ছাড়বে না। ঘরে শুয়ে বসে আরাম করে, তাস খেলে রাতটাও ভালই কাটছিল শুধু ওই ঠাণ্ডায় বাইরে বাথরুম যাওয়া ছাড়া। পরদিন সকালে এক বুক আশা নিয়ে অ্যালার্ম দিয়ে উঠলাম যদি সূর্যোদয় দেখা যায়। ঘুম ভাঙলে বুঝলাম আর যাই হোক বৃষ্টি টা কমেছে। হালকা আলোতে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ওদের উঠোন ঠেকেই দেখা যায় সূর্যোদয়, ঠিক সামনের কালিম্পং শহরের পেছন থেকে। আকাশে মেঘ কেটে গেছে তবে মেঘ গুলো কেমন যেন নিচে থিতিয়ে গেছে। তখনও বুঝতে পারছি না আদৌ কিছু দেখতে পাব কিনা। ইতিমধ্যে যুবরাজ আর সৌমেন ঠাণ্ডার চাপে ঘরে ফিরে গেছে। আরও মিনিট পনেরো পরে সূর্যি মামা দেখা দিলেন। তখন জানতে পারলাম কাছেই কেতা ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তখনই বিপ্লবকে পাকরাও করে বাইক নিয়ে ছুটলাম। ওখানে গিয়ে যা দেখলাম তাতে সত্যি মুখ হা করে শুধু চুপ করে দুচোখ ভরে দেখতে হয়। আগেই বলেছি, তিনচুলে মানে তিনটি চুলা। সেই তিন পাহারের মাঝের নিচু জায়গায় সাদা ঘন তুলোর মত মেঘ গুলো জমে আছে। যেদিকে তাকাই সেইদিকেই একই দৃশ্য। একদিকে কালিম্পং ডেলো অন্যদিকে সিকিমের নামচি । আর চারিদিকে শুধু সাদা মেঘ, মেঘের ওপরে আমরা। ঠিক যেমন প্লেন থেকে জানলা দিয়ে দেখা যায় ঠিক তেমন ই তবে প্লেনের মত অত ছোট জানলা নয়, চারিদিক দেখা যাচ্ছে মেঘ আর মেঘ। ফিরে এসে প্রাতরাশ করে আমরা এলাম লামাহাটা। অপেক্ষাকৃত নতুন এই জায়গা। পাহাড়ের কোলে সুন্দর একটি পার্ক। অনেক রকম ফুলের সমাহার, আর সাথে হালকা ট্রেকিং করে ওপরে উঠে একটি সমান জায়গায় সুন্দর একটি লেক, চারিদিকে গাছ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সেইসব দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে রওনা দিলাম ঘুমের উদ্দেশ্যে। ঘুম থেকে কাছেই বাতাসিয়া লুপ। বাতাসিয়া লুপে গিয়েই দেখা পেলাম বিখ্যাত খেলনা ট্রেন, ষ্টীমের ধোঁয়া উড়িয়ে চলা অল্প কিছু ট্রেনের মধ্যে এটিই অন্যতম। সেখানে মোমো খেয়ে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম লেপচাজগত, সুখিয়াপোখরি হয়ে ঘুর পথে। লেপচাজগতের মত পাহাড়ি গ্রাম গুলোয় রাত্রিবাস না করলে ঠিক সৌন্দর্য উপভগ করা যায় না। তাই ওই সব জায়গায় খুব বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা বরং রাস্তায় ফিরতে ফিরতে যে সব জায়গায় দাড়িয়ে প্রকৃতির মজা নিলাম যেখানে কখনই হয়ত যাওয়া বসা হবে না। সীমানা বস্তিতে দাড়িয়ে পাহাড়ের অপর থেকে নেপাল দেখতে দেখতে চা, মোমো খাওয়ার মজা কি আর সব জায়গায় পাওয়া যায়। এরকম ভাবে বাইকে নিয়ে সুন্দর রাস্তা, ততোধিক সুন্দর পাহাড়, চা বাগান উপভগ করতে করতে ফিরছি আর মনে মনে ভাবছি আর একটু পর ঘরে পৌঁছে যাব, তখনই ঘটল বিপত্তি। সবে মিরিক বাজার পার করেছি, মিরিক লেক তখনও আসেনি সৌমেনের বাইকের পেছনের চাকায় পাঙ্কচার দেখা গেল। বিপত্তিটা একটু বেশি কারন অতা টিউবলেস টায়ার ছিল না আর আমাদের সাথেও লিক সারানোর কিছু ছিল না। আবার ফিরে গেলাম মিরিক বাজার,গিয়ে দেখি দশেরার জন্য সমস্ত গ্যারাজ বন্ধ। আমাদের তো শিরে সংক্রান্তি অবস্থা তখন। কি করব কিছু মাথায় আসছে না। যুবরাজ অভয় দিল আমরা তিনজন বিপ্লবের বাইকে নেমে যাই আর ও, ওই বিকল বাইকেই নামতে থাকবে কোথাও গ্যারেজ পেলে সারিয়ে নেবে। কিন্তু, বিপ্লব পাহাড়ি রাস্তায় তিনজন নিয়ে নামার সাহস পেল না। অতএব ঠিক হল, আমি আর সৌমেন একটি জিপ করে গারিধুরা যাব, বিপ্লব বাইকে করে আর যুবরাজ ওই বিকল বাইকে আসবে। যুবরাজ কোনরকমে সামনের দিকে নিজের সমস্ত ওজন দিয়ে নামছিল। দুর্ভাগ্যবশত, রাস্তায় কোনও গ্যারাজ পাওয়া যায় নি। আবার চারজন গারিধুরায় একত্রিত হলাম, বাইকের টিউব ছিঁড়ে একাকার। ওই অবস্থায় বাইক ঠেলে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। আমি আর যুবরাজ ওটাকে প্রায় ৪-৫ কিমি ঠেলে আসলাম রোহিণী মোড়ে, যেখানে একটি গ্যারাজ পাওয়া গেল।কিন্তু সেখানে টিউব ছিল না। বিপ্লব ছুটল বাইক নিয়ে টিউব আনতে। প্রায় ১০-১২ কিমি দূরে গিয়ে অবশেষে টিউব নিয়ে ফিরে এল বিপ্লব। আর আমরা ঘরে ঢুকলাম প্রায় রাত তখন দশটা। সবকিছু মধুরেন সমাপয়েত হয় না, কিন্তু অনেক দিন পরে এসে এই সব ঘটনা গুলোই বারবার মনে পরে। Post By:- Suvankar Chakraborty
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |