কিছুদিন আগে লিখেছিলাম মেদিনীপুর জেলায় বেলদার কাছে একটি বিস্মৃতপ্রায় দ্রষ্টব্য কুরুমবেড়া দুর্গ নিয়ে। আজ লিখতে বসেছি ওই কুরুমবেড়ার কাছেই আর একটি প্রত্নতাত্বিক স্থান মোগলমারী নিয়ে।
মোগলমারী মেদিনীপুরের দাঁতন ব্লকের অন্তর্ভুক্ত স্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে এক বিরাট বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। সম্প্রতি বলছি এই কারণে যে, এখানকার বৌদ্ধবিহারটি প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো হলেও দীর্ঘদিন আগেই এটি চলে গিয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। দাঁতনের কাছে এই জায়গাটিতে দীর্ঘদিন ধরে দেখা যেত একটি ঢিবি, যেটিকে অনেকে বলতেন সখী সেনার ঢিবি। এই অঞ্চলের এক সামন্ত রাজা বিক্রমকেশরীর কন্যা সখীসেনার নামেই তার নামকরণ, আর এখানেই নাকি ছিল তাঁর অধ্যয়নকেন্দ্র। কিন্তু জনশ্রুতির সেই কাহিনি অতিক্রম করে এই ঢিবির কাছ থেকেই বিভিন্ন সময়ে গ্রামবাসীরা পেয়েছেন বিভিন্ন ধরণের ইঁট, মূর্তি, মুদ্রা ইত্যাদি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দাঁতনের এক শিক্ষক আর ইতিহাসপ্রেমী নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সাহচর্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ অশোক দত্ত এখানে খনন কাজ শুরু করেন আজ থেকে মাত্র বছর পনেরো আগে ২০০৩ সালে। প্রথম পর্যায়ে ২০০৩-২০০৪ সালের এই খনন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সালে বিভিন্ন পর্যায়ে দফায় দফায় এখানে খনন কাজ হয়েছে ২০১৫-১৬ অবধি, আর সেই খননের সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসেছে এখানকার একসময়ের বিশাল এক বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। আর খননের সেই কাজ যতই এগিয়েছে ততই ধারণা করা গেছে এই বিহারটির বিশালত্ব সম্পর্কে। হিউয়েন সাং তাঁর ভারত ভ্রমণের সময়ে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, বাংলার প্রাচীন তাম্রলিপ্ত এলাকার ১০টি বৌদ্ধ বিহারের উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে এখনো অবধি শুধুমাত্র এই মোগলমারী বিহারই আবিষ্কৃত হয়েছে। আর সেই বিহারের বিশালত্ব দেখে মনে করা হয়, এখনো অবধি আবিষ্কৃত এটাই বাংলার সবচাইতে বড় বুদ্ধবিহার। তাই এটিকে শুধু বিহার নয়, মহাবিহারই বলা চলে। আর প্রথমে এই বিহারের নাম সঠিকভাবে জানা না গেলেও ২০১৩-১৪ সালের সপ্তম পর্যায়ের খননের সময় এখানে একটি নাম ফলক উদ্ধার হয়, আর তখনই জানা যায় এই বিহারটির নাম – “শ্রীবন্দক মহাবিহার”। তবেঁ, জায়গার নামানুসারে এটির সাধারণ পরিচিতি “মোগলমারী বুদ্ধবিহার” নামেই। অনেকে বলেন বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবের সময় এই জায়গার নাম ছিলো অমরাবতী। পরে ধীরে ধীরে এখানে বৌদ্ধ প্রভাবের অবলুপ্তি ঘটে, জায়গাটিও চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। ১৫৭৫ সালে এই এলাকাতেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল পাঠানদের সঙ্গে মোগলদের।যুদ্ধে শেষ অবধি মোগলরা জয়ী হলেও, মৃত্যু হয়েছিল অনেক মোগল সেনার। হয়তো সেই ঘটনা থেকেই এই মোগলমারী নাম । ইতিহাসের এই তথ্যটুকু মাথায় রেখে এবারে আসি আমার দেখা মোগলমারী বুদ্ধবিহারের কথায়। এখানে প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভালো। প্রত্নতাত্বিক আগ্রহ বা ইতিহাসের চোখ নিয়ে দেখতে গেলে কিন্তু এই বিহার দেখতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু সেই সময় অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের হাতে থাকে না। তাই দেখতে হয় কিছুটা ওপর ওপর। সেই দেখায় আমার মন ভরে না, ইতিহাসের ফেলে আসা দিনগুলোকে ছুঁতে গিয়েও তাই সেভাবে ছোঁয়া আমার হয়ে ওঠে না। তবু যেটুকু দেখেছি সেটাও তো কম কিছু নয়। এক ফেলে আসা ইতিহাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারছি, কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করছি সেদিনের সেই বিশাল বৌদ্ধবিহারের প্রাণচঞ্চল অথচ ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ। বর্তমানের একবিংশ শতাব্দী থেকে এক লহমায় পিছিয়ে যাওয়া সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে, তাও তো কিছু কম কথা নয়। রাস্তার ওপরেই বিহারে প্রবেশের দরজা। বর্তমানে এটি রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তরের অধীনে। ভেতরে ঢুকে তিনটি ভাগে জায়গাটিকে দেখা যায়। ভেতরে প্রবেশের পর বাঁদিকে মূল ধংসাবশের অংশ, যার বেশীরভাগটাই এখন মাটির তলায়। ওপর থেকে কিছুটা আভাস পাওয়া যায় সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিহারের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের। কোথাও ভেতরে যাওয়ার রাস্তা, কোথাও ভেঙে পড়া সিঁড়ি, আর কোথাও বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ, আর সেই সঙ্গে বিহারের প্রাচীর। ওপর থেকে দেখলে শুধু একটা ধারণা করা যায় এই বিহারের, কারণ এখনো বেশীরভাগটাই আছে মাটির তলায়। ওখানেই শুনলাম, এই মুহূর্তে খননের কাজ হচ্ছে না, যতটুকু হয়েছে, নীচের থেকে কিছু প্রত্ন নিদর্শন উদ্ধার করে, আবার মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে, কারণ তা না হলে, ওপরের খোলা আবহাওয়ায়, ঝড়ে জলে, রোদে, বৃষ্টিতে ভঙ্গুর সেই বিহার হয়তো আরও বেশী করে ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। মাটির তলায় যে বিহার আছে, তার বেশ কয়েকটি তলা আছে আর সেগুলির নির্মাণকাল ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী আরো কিছু শতাব্দী জুড়ে মোট তিনটি পর্যায়ে। একেবারে প্রথম যুগের নির্মাণ আছে সবচাইতে তলায়, সেগুলি উদ্ধার করে লোকচক্ষুর সামনে আনতে বহু সময়, ধৈর্য্য, প্রযুক্তি আর সাবধানতা দরকার। তাই ২০০২ থেকে শুরু করে ২০১৫ -১৬ সাল অবধি কাজ হওয়ার পর এখন কাজ চলছে খুব সতর্কতার সঙ্গে। তবে প্রবেশপথের বাঁ দিকে যে অংশটির কথা এতক্ষন বললাম, সেখানে নয়, হচ্ছে ওই রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে আরেকটি অংশে। এবারে দেখা যাক সেই অংশটি। গেট দিয়ে ঢুকে মূল ধ্বংসাবশেষের জায়গাটিকে বাঁ দিকে রেখে সোজা এগিয়ে গেলে ফাইবারগ্লাসের ছাউনি দিয়ে পুরো ঘেরা একটি জায়গা। সেখানেই ঐ বিহারটির একটি অংশ মাটি খুঁড়ে বার করে অনেকটা পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। সেই ছাউনির মধ্যে ঢুকে মাটির সিঁড়ি বেয়ে একটু নীচে নামতে হয়, আর চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেই বিশাল ভবনের একটি সামান্য অংশ। তাতে দেওয়ালে প্রোথিত কিছু মূর্তি, আবার কিছু জায়গায় মূর্তির জন্যে খোপ করা থাকলেও কোন মূর্তি সেখানে নেই। পাশেই বড় প্ল্যাকার্ডে ছবির মাধ্যমে দেখানো আছে এখানে পাওয়া বিভিন্ন মূর্তি আর খননের পর বিহারের বিভিন্ন অংশের ছবি।এই অংশটি উদ্ধার করে তার সংরক্ষণের কাজ যে হচ্ছে, তা জায়গাটি দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এ কাজ প্রচুর সময়সাপেক্ষ আর অনেক ধীরে ধীরে সাবধানে তা করতে হয়। তবে এখানে এসে দাঁড়ালে বোঝা যায় যে, কি বিশাল বিহার ছিল এটি। বাইরের ধ্বংসস্তূপের জায়গাটি ধরেও তা সমস্ত এলাকার একটি অংশ মাত্র। আসলে, মনে করা হয় যে পুরো গ্রাম জুড়েই এই বিহারের ব্যাপ্তি, চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, তা তার ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। এবার এখানকার আরেকটি ভাগ - একটি ছোট্ট মিউজিয়াম। গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে মোগলমারী তরুণ সেবা সঙ্ঘ বলে একটি পাঠাগার আছে, আর তার ভেতরেই একটি অংশে এখানকার মোগলমারী মিউজিয়াম। সেখানে এই খনন কাজ থেকে পাওয়া ইঁট, মূর্তি, বাসন, গয়না এসবের কিছু সংগ্রহ রাখা আছে। শুনলাম এখানে নাকি মোট বাহান্ন রকমের ইঁট পাওয়া গেছে, সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে প্রচুর মূর্তি, মুদ্রা, ফলক, এমনকি সোনার পাতও। এ ছাড়া রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাজের সময় এখানে একদিনে, একসঙ্গে ৯৫ টি ব্রোঞ্জ মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, যা প্রত্নখননের ইতিহাসে এক অত্যন্ত বিরল দৃষ্টান্ত। তবে সে সব মূর্তি আছে রাজ্য প্রত্নতত্ব বিভাগের হেফাজতে, মোগলমারী মিউজিয়ামে আছে তার মাত্র সামান্য কিছু নিদর্শন। একটি মাত্র ছোট ঘরে সেই মিউজিয়াম, তাও আমি যখন যাই, সে সময় কারেন্টও ছিল না, তাই খুব ভালো করে যে দেখতে পেরেছি তাও নয়। তবু, সব মিলিয়ে এ ভ্রমণ রোমাঞ্চকর বইকি। যুগ যুগ ধরে এই ইতিহাস থেকে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। এখন খুব ধীরে ধীরে হলেও সে সামনে আসছে, নিয়ে আসছে নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে নতুন নতুন রোমাঞ্চ। ক্লাব ঘরের ভিতরে ভগবান বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন প্রসন্ন ছবি, যুগ যুগ ধরে তিনি ধ্যানস্থ, অপেক্ষায় আছেন কবে তাঁর অনুগামীদের মন্ত্রে মন্দ্রিত এই মহাবিহার আবার কথা বলে উঠবে, সামনে নিয়ে আসবে তার সেই হারানো দিনের অনেক না বলা ইতিহাসকে। ভ্রমণ সহায়ক ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার - ইতিহাস সন্ধানী ও ব্লগার - শ্রী অমিতাভ গুপ্ত তথ্য সূত্র - অতনু প্রধান, অনিরুদ্ধ সরকার, আনন্দবাজার, বর্তমান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, উইকিপিডিয়া
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |