কুমায়ুনের মুক্তেশ্বর ****************** বেশ কিছুদিন ধরেই নৈনীতালের কাছে কুমায়ুন হিমালয়ের সুন্দর নিসর্গে ঘেরা অপরূপ হিল স্টেশনটির কথা শুনে আসছিলাম। নভেম্বরের শুরুতে দিওয়ালীর ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম মুক্তেশ্বর। দিল্লি থেকে গাড়িতে। আমরা দুটি দম্পতি। চাকরি সূত্রে আমি তখন দিল্লিতে। বাড়ি থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে ৩৫০ কিমি পথ পারি দিয়ে বিকেলের মধ্যেই মুক্তেশ্বর পৌঁছনোর পরিকল্পনা। এবারের বাহন ভাড়া করা একটা ইন্ডিকা। NH 24 ধরে গজিয়াবাদ, হাপুর, গড়মুক্তেশ্বর, জোয়া পার হয়ে মোরাদাবাদ অবধি ঠিকঠাক পৌঁছনো গেল। এখান থেকে ‘কুমায়ুনের গেটওয়ে’ হলদুয়ানি যাবার দুটি পথ। একটি মূল রাস্তা ধরে রামপুর, পন্থনগর হয়ে। অন্যটি টান্ডা, বাজপুর, কালাধুঙ্গি হয়ে। মাইলেজ কম ও করবেটের জঙ্গলের সান্নিধ্য থাকায় দ্বিতীয় রাস্তাটি আমার বরাবরের পছন্দের। কিন্তু সে রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই বাধ সাধল খারাপ রাস্তা। কয়েক বছর আগেও এ রাস্তায় যাতায়াত করেছি, কিন্তু রাস্তার হাল এরকম হবে স্বপ্নেও ভাবি নি। পিচ বিহীন, খানাখন্দে ভরা রাস্তায় টান্ডা থেকে বাজপুর অবধি ৩২কিমি পথ পেরোতে ৩ ঘণ্টার উপর লেগে গেল। এর মধ্যে একবার টায়ার পাংচারও জুটেছিল খারাপ রাস্তার কল্যাণে। এরপর হলদুয়ানি, কাঠগোদাম হয়ে পাহাড়ে চড়া যখন শুরু হল, তখন দিনের আলো নিভে এসেছে। ভীমতালের পাশ দিয়ে যাবার সময় উপর থেকে লেকের একটা ভিউ পাওয়া যায়। কিন্তু এখন সন্ধ্যে। পথেই ইন্টারনেট দেখে, রিভিউ পড়ে, একটি হোটেলে ফোন করে দিয়েছিলাম মুক্তেশ্বরে। হোটেল ওয়ালার নির্দেশিত পথে খাটাউলি থেকে ভাওয়ালি গামী মূল রাস্তা ছেড়ে, ডানহাতি উপরে উঠে যাওয়া একটি রাস্তা ধরলাম। এপথ একেবারে নির্জন, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে অন্ধকার লেপ্টে আছে। সন্তর্পণে গাড়ি চালাচ্ছে চালক পদম সিং। হোটেল থেকে মিঃ নাগেন্দার সমানে ফোনে আমাদের পথের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই মত চাষী, ধনচুলি হয়ে, আঁধার হাতড়ে, অবশেষে পৌঁছলাম মুক্তেশ্বরের ঠিক আগে পথের পাশে আলোক ঝলমলে একটি বড়সড় হোটেলের সামনে। আমাদের অভ্যর্থনা করতে জনা দুয়েক হোটেল কর্মী দাঁড়িয়ে গেটের বাইরে। Mukteswar Himalayan Resort। তিনতলার কোণার দিকে দুটি ভিউ ফেসিং রুম আমাদের দেওয়া হল। দিওয়ালীর সময় উত্তর ভারতে অফ সিজন। তাই এসময় আর গেস্ট না থাকায় ৫০% ডিসকাউন্টও মিলল। ডিলাক্স রুম ১০০০ টাকা। দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা যাত্রার পর রিসর্টের তোফা রুমের আরামকেদারায় বসে নিজেকে রাজার মত মনে হল। রিসর্টের সাজসজ্জায় মালিকের বেশ একটা রুচির পরিচয় মেলে। নভেম্বেরের শুরুতে পাহাড়ে কনকনে ঠান্ডা। ডাইনিং রুমে গিয়ে গরম গরম রুটি ও ডিমের কারি সহযোগে ডিনার সারা হল। পরদিন ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্য ৬টার অ্যালার্ম লাগিয়ে, দুগ্ধফেনিত বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম লেপ কম্বলে মুড়ে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে পর্দা সরিয়ে বিশাল কাঁচের জানলা দিয়ে পাহাড় শ্রেণী চোখে পড়ল। সামনের পাহাড়গুলির মাথায় রক্তিম আভা। কনকনে ঠান্ডায় কান মাথা মুড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তিনদিকে পাহাড়, সামনে ভ্যালি, পিছনে রিসর্ট – সব মিলিয়ে ভোরের উদাত্ত পরিবেশে দারুণ লাগছিল মুক্তেশ্বরকে। সামনের পাহাড়ের আড়াল থেকে একটু একটু করে রক্তিম সূর্য উঠে এল। বাঁদিকের পাহাড়ের মাথার উপর আবছা দুটি বরফের চূড়া দৃশ্যমান। রিসর্টের এক কর্মী চলে এসেছে আমাদের আশপাশটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে। তাকে অনুসরণ করে, মিনিট দুয়েকের খাড়াই পথে উঠে গেলাম রিসর্টের পিছনের পাহাড়টির মাথায়। সামনে তাকিয়ে দেখি বাঁদিক থেকে ডানদিকে একে একে বরফে মোড়া হিমালয়ের পাহাড় চূড়া গুলি। ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর সরিয়ে তারা দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে। ত্রিশূল, নন্দাঘুন্টি, নন্দাকোট ও একেবারে ডানদিকে মানে পূর্বদিকে পঞ্চচুল্লী। বেশ কিছুক্ষণ এদৃশ্য দেখে নেমে চললাম রিসর্টে। লোকটি বলল জিরো পয়েন্ট থেকে আরো ভাল দেখা যায় বরফ চূড়াগুলি। বাঁদিকের পাহাড়টার মাথায় জিরো পয়েন্ট। এখান থেকে ৬কিমি। স্নান সেরে রিসর্টের সুসজ্জিত লনে চেয়ার টেবিল পেতে ব্রেকফাস্ট। মিঠে রোদে বসে আলু পরাঠা, অমলেট ও চা খেতে খেতে উপভোগ করছিলাম চারপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য। মুক্তেশ্বরে দেখার জায়গা বলতে 'জিরো পয়েন্ট', 'চৌলি কি জালি', মুক্তেশ্বর মহাদেবের মন্দির ও ভেটার্নারি ইনস্টিটিউটের বিশাল ক্যাম্পাস। প্রাতরাশের পর বেরোতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। ড্রাইভার পবন সিং জানাল গাড়িটি বিকল হয়েছে। আমাদের মাথায় হাত। রিসর্টের মালিক নাগিন্দার জি আমাদের বললেন, যে আপনারা বেড়াতে এসেছেন, গাড়ির জন্য যাতে সময় নষ্ট না হয়, তাই তিনিই সাইট সিয়িং করিয়ে দেবেন। প্রথমে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন গেটের বাঁদিকে একটু নিচে একটি পাইন ঘেরা মাঠে। এখান থেকে পঞ্চচুল্লীর দারুণ ভিউ পাওয়া যায়। তারপর আবার ফিরে এসে আমাদের গাড়ির জন্য মেকানিকের ব্যবস্থা করে, তাঁর নিজের গাড়িতেই আমাদের নিয়ে চললেন সাইট সিয়িং করাতে। এবার গেটের ডাইনে উপরের দিকের রাস্তা ধরে। খানিক চলে একটা তিন রাস্তার মোড়ে কিছু দোকানপাট। সোজা রাস্তাটি এসেছে ভাওয়ালি হয়ে নৈনীতালের দিক থেকে। আমরা চললাম ডানহাতি রাস্তায়। মুক্তেশ্বরের মূল টাউন শুরু এখান থেকে। প্রাকৃ্তিক সৌন্দর্য্যের ঘেরা, হিমালয়ের ৬৫০০ ফুট উচ্চতায়, শান্ত, নিরিবিলি এই জনপদ ব্রিটিশদের হাতে তৈরী। কিছু পুরনো আমলের বাড়ি, ছোট বাজার, বেশ কিছু হোটেল ও শহরের অনেকটা জুড়ে Indian Veterinary Institute এর প্রাচীর ঘেরা জমি, বাড়ি ও একরের পর একর পাইন-দেওদারের জঙ্গল। সুপ্রাচীন এই ইনস্টিটিউটের জন্য খ্যাতি মুক্তেশ্বরের। সব ছাড়িয়ে শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে জিরো পয়েন্টে নামিয়ে দিলেন নাগিন্দারজি। বললেন, দেড় দু কিমি ওয়াকিং ডিস্ট্যান্সের মধ্যেই আমরা ‘চৌলি কি জালি’ ও মন্দির সহ সব দেখে নিতে পারব। কথা হল যে সব ঘুরতে আমাদের ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে, আর তার মধ্যেই গাড়ি সারিয়ে আমাদের ড্রাইভার চলে আসবে আমাদের পিক আপ করতে। কোন দিকে কি দেখার আছে, তা আমাদের গাইড করে দিয়ে নাগিন্দারজি বিদায় নিলেন। তুলনা নেই মানুষটির। এরকম অতিথিবৎসল ও হেল্পফুল হোটেলিয়ার এর আগে খুব কম দেখেছি। জিরো পয়েন্ট মুক্তেশ্বরের সর্বোচ্চ স্থল। জিম করবেটের আমলের প্রাচীন PWD বাংলো ও তার পিছনে খোলা একটা প্রান্তর। সে প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যা দৃশ্য দেখলাম তাতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম সবাই। ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে দন্ডায়মান হিমালয়ের সব তুষাড় শৃঙ্গগুলি। বাঁদিক থেকে ডানদিকে যথাক্রমে চৌখাম্বা, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল (পূর্ব ও পশ্চিম), নন্দাদেবী (পূর্ব ও পশ্চিম), নন্দাকোট, পঞ্চচুল্লী। একটি ফলকে শৃঙ্গগুলির নাম লিখে দিক নির্দেশ করা আছে। সামনের পাহাড়ে অনেকগুলি খেলনার মত বাড়িঘরে সাজানো আলমোড়া শহর ও তার মাথার উপর তিনটি তুষার শৃঙ্গ। শুনলাম বাঁদিকে, মানে উত্তর পশ্চিমের পাহাড়টির মাথায় শীতলাখেত ও শাহিদেবী মন্দির। বাইনকুলারে চোখ লাগিয়ে পাহাড়ের মাথায় মন্দিরটি দেখতে দেখতে স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। বছর তিনেক আগে গিয়েছিলাম কুমায়ুনের আরেক জনপদ শীতলাখেতে। চার কিমি খাড়াই রাস্তায় ট্রেকিং করে উঠে পাহাড়ের মাথায় ঐ শাহিদেবীর মন্দির দর্শন ছিল সেবারের এক দারুণ আভিজ্ঞতা। নির্মল আকাশে, হিমালয়ের এতগুলি বরফে মোড়া বিখ্যাত শৃঙ্গ এত স্পষ্ট – এ অনবদ্য দৃশ্য কুমায়ুনের অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বেলা বারোটা বাজে, এখনও মেঘের আনাগোনায় একটুও অস্পষ্ট হয় নি শৃঙ্গগুলি। অকল্পনীয় ভাবে খুব দামি জিনিস পেয়ে গেলে মানুষ আনন্দের আতিশয্যে যেমন আত্মহারা হয়ে যায়, আমাদেরও যেন কতকটা সেই অবস্থা। দুচোখ ভরে হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে, নানা অ্যাঙ্গেলে ও নানা পোজে তুষার শৃঙ্গ গুলির ছবি ক্যামেরাবন্দী করে, পার হয়ে গেল বেশ কিছুটা সময়। পিছনের শতাধিক প্রাচীন বাংলোটিতে একসময় জিম করবেট এসে থাকতেন। এই মুক্তেশ্বরেই করবেটের একটি বাঘ শিকারের কাহিনী আছে – ‘Man-eater of Kumayun’। এবার পরের গন্তব্য। রাস্তার ওপারে খাদের দিকে নেমে যাওয়া পথ ধরে পৌঁছলাম প্রকান্ড সব চ্যাপ্টা পাথর ছড়ানো প্রস্তরময় এক অদ্ভুত জায়গায়। এটিই ‘চৌলি কি জালি’। পাথর গুলো সব ঝুলে রয়েছে খাদের উপর। একটা পাথর খন্ডের উপর বসে নিচে অতলান্ত গভীর খাদের দিকে চেয়ে মাথা ঘুরে যায়। শুনলাম এটি নাকি সুইসাইড পয়েন্ট। কিছুটা সময় কাটিয়ে এবার চললাম মন্দিরের দিকে। সরু প্রস্তরময়, জঙ্গলে ঢাকা, খাড়াই একটি পথ বেয়ে খানিক চলার পর, পাহাড়ের উপর একটা চাতাল মত জায়গায় পৌঁছলাম। সামনেই সিঁড়ি উঠে গেছে মুক্তেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে। জায়গাটিরও নামকরণ হয়েছে মুক্তেশ্বর মহাদেবের নামানুসারেই। মন্দির দর্শনের পর মোবাইলে যোগাযোগ করে ডাকা হল ড্রাইভার পবন সিংকে। রিসর্টে ফিরে খানিক বিশ্রাম ও তারপর সুন্দর কম্পাউন্ডের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো। ভিতরেই একটি মন্দির, নাগিন্দারজি ব্যস্ত উপাসনায়। নেটে ছবি দেখে ও ট্রিপ অ্যাডভাইসারে রিভিউ পড়ে এই রিসর্টটির যে ধারণা নিয়ে এসেছিলাম, বাস্তবে রিসর্টটি তার চেয়েও বেশি সুন্দর। ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না এই মুক্তেশ্বর হিমালয়ান রিসর্ট। কিন্তু পথ চলাই ভ্রমণার্থীর ধর্ম। আমাদের এবার গন্তব্য সেই চেনা নৈনীতাল। লাঞ্চ সেরে, নাগিন্দারজি ও তার সুন্দর রিসর্টের সব স্টাফ ও বিশেষ করে তাঁর আতিথেয়তা ও সাহায্যের জন্য বারংবার ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। মুক্তেশ্বরের অপার নিসর্গ ছেড়ে নিসর্গের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চললাম ভাওয়ালি গামী রাস্তায়, নৈনীতালের উদ্দেশে। শেষ বিকেলে পৌঁছে গেলাম নৈনীতাল। -SDG Post By:- Subhrangsu Dasgupta
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |