রৌদ্র বেলার গান ....
মনের মধ্যে আকুতি শুরু হলে, তাকে থামায় কার সাধ্যি ! বছরের দিন কার্তিক মাস ছুঁই ছুঁই তবু রোদের তেজ কমে না এতটুকু । মায়ের আগমনী গাইছে আকাশ -বাতাস, তার সাথে সব ফেলে মন ছুটছে । সকলে সকাল সকাল অর্ঘ্য সাজিয়ে সুবেশে চলেছে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে । আমি আজকাল অঞ্জলি দিই না, তেমনভাবে পুজো দিই না মাকে । আমার পুজো অন্যরকম , সে কথা পরে কখনো হবে। ছেলেদের মঙ্গল-কথা চিন্তা করে কোনরকমে মায়ের পুজো পাঠিয়েই দে ছুট । কু-ঝিক্ রেলের গাড়ি চড়ে গুপ্তিপাড়া, ৪০০ বছরের পুরোনো পুজো দেখতে সেন বাড়ি । মাঠঘাট ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন , তাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আমার মন ; সে আগেভাগে পৌঁছে যাচ্ছে পরের গন্তব্যে, এতটাই অস্থির সে । দিগন্ত ছোঁয়া ঘন সবুজ ধানজমি ছোটবেলার আঁকার খাতা থেকে উঠে আমার রেলগাড়ির জানলা ছুঁয়ে ফেলেছে । আমিও মনে মনে তার আশ্চর্য মসৃণ বুকে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গুপ্তিপাড়া । ট্রেন থেকে নেমে টোটো-ভাইদের সাথে হিসেবের বোঝাপড়া শেষ করে পাড়ি দিলাম গন্তব্যে। আজ সঙ্গে আছেন আমার ঘরের মানুষটিও; দুজনে মিলে এদিক-ওদিক নিরীক্ষণ করতে করতে চলতে লাগলাম । টোটো দাদা আমাদের অর্বাচীন পেয়ে গুপ্তিপাড়া সম্পর্কে নানা কথা বলতে লাগলেন । বেশ শহুরে মৌতাতে এক গ্রামীণ জীবনের ছবি প্রত্যেক বাড়ির আঙিনায় , তাতে অরণ্যের ঘ্রাণ টের পেলাম । রাতের বেলা শেয়াল ভাকে মনে হয় । জায়গাটার মাঝে মাঝেই ঘন জঙ্গল । নিবিড় বাঁশবন শ্লোক বলা কাজলা দিদির কথা মনে পড়িয়ে দিল । এ কিন্তু কোন মফস্বল নয় ; পুরোপুরি ধোপদুরস্ত একখানা গ্রামের গন্ধ না মুছতে পারা শহর। এখানে ওখানে বাঁশ পুঁতে তার ওপরে আরেকটা বাঁশ রেখে অনেকটা ধোপাদের জামা-কাপড় মেলার দড়ির মতো করে তাতে পাট শুকাতে দেওয়া হয়েছে, চুড়ো করে চুল বঁধার মতো করে পাশে পাটের কাঠিরাও ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে । দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গুপ্তিপাড়ার একমাত্র জমিদার বাড়ি, সেন-বাড়ি । বাড়ির সামনের মাঠে জোড়া শিব মন্দির পেরিয়ে দেখি বহুকাল আগের এক পেল্লায় লোহার দরজা হাট করে খোলা , হয়তো দুর্গা পুজো বলে । আমরা সে দরজা দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম ঠাকুর দালানে কেউ এলো না বাধা দিতে । অঞ্জলি সবেমাত্র শেষ হয়েছে । সাবেকী ঠাকুর দালান, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় , সুন্দর একচালা মূর্তি । চারদিকে রঙীন ফুলে সাজানো । পুজোর আবেশে মুগ্ধ মানুষজন আভিজাত্যের গন্ধ মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সুন্দর পরিবেশ যে ভক্তি আপনা থেকেই জেগে উঠবে । আমারও মা কে প্রণাম জানালাম । আমার মনে এইসব পুরনো বাড়ির দুর্গাপুজো দেখার আনন্দ জাগানো এক ফেসবুকতুতো ভাইয়ের সাথে দেখা । তার আসার কথা জানতাম, অনেকক্ষণ এসেছে সে । তার চেহারা সম্পর্কে মনে অন্যরকম ধারণা ছিল, সব ভেঙে গেল তাকে দেখে । সাধারণ চেহারার একজন মানুষ সে, গলায় একটা নিকনের দামী ক্যামেরা ঝুলছে । শুধু তার চোখ দুটিতে অসাধারণ কিছু কুড়িয়ে নেবার দৃষ্টি , অনেকটা তার ক্যামেরার মতো । এই যে কলকাতার পুজোর জাঁকজমক ছেড়ে এমন অল্পবয়সী একটা ছেলে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে গ্রাম বাংলার পথে পথে, আমার ঘরের লোকটি বলেন, এ এক ধরণের পাগলামি; যা সেই ভাইটি আমার মাঝে চারিয়ে দিয়েছে। আমার কর্তার মধ্যেও সে পাগলামি কিছুটা হলেও ছেয়েছে তা কে শোনে ! এমনি আরও কত ফেসবুকীয় বন্ধুর মধ্যেও এই পাগলামি ছেয়ে যাচ্ছে রোজ রোজ, সেসব জেনেছি, খুব ভালো লাগছে । এক বয়জেষ্ঠ্য ব্যক্তির মুখে শুনলাম এই পুজোটা বল্লাল সেনের বাড়ির পুজো, প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো ; মাটির বেদীতে বসানো হয়েছে মাকে । ওনারা সেই বেদীকে শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধাতে চেয়েও পারেন নি, স্বপ্নাদেশ পেয়ে থেমে গেছেন । মাটির ওই বেদীর নীচে পঞ্চ মুণ্ডির আসন আছে । তাঁদের কোন একএকজন পূর্বপুরুষ সেখানে কখনো তন্ত্র সাধনা করতেন বলে কথিত আছে । মায়ের মূর্তিটিও লম্বায় অদ্ভুতভাবে প্রতিবছর একই আকারের হয় ; আশ্চর্যজনকভাবে প্রতি বছর একই বংশ পরম্পরাগত মানুষজন ঠিক হাজির হয়ে যান মূর্তি গড়ার প্রাক্কালে । আর এই একচালার মূর্তিতে প্রত্যেক দেবতার বাহন থাকলেও মা-লক্ষ্মীর কোন বাহন কখনো বানানো হয় না । কোথাথেকে ঠিকসময়ে সাদা প্যাঁচা উড়ে আসে, যদিও পুজো চলাকালীন তার দর্শন আমরা পাই নি , কিন্তু বাড়ির মানুষের বিশ্বাসের হস্তক্ষেপ করতে মন সায় দেয় নি । অন্যরকম আবেগে সাময়িক বিভোর হয়ে গেলাম আমরাও। তাঁদের সেই পুরোনো দিনের জমিদারীর ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে আমাদের অবিশ্বাসী শহুরে মন কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হল না পুজোর গল্প শুনে । চোখ বুজে তাঁর কথাই মেনে নিতে কেউ যেন বাধ্য করল। (ক্রমশ ) --- উপহার আমার মধ্যে ইচ্ছা-চারিয়ে দেওয়া সেই ভাইটি কে Subhajit Dutta # পথ নির্দেশ : হাওড়া কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরে গুপ্তিপাড়া স্টেশনে নেমে টোটো ধরে যাওয়া যায় । হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে প্রায় পৌনে দু'ঘন্টা গুপ্তিপাড়া ।
Post By-Sen Mithu Sen
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |