উত্তর সিকিম, লাচেন, লাচুং, য়ুমথ্যাং উপত্যকা ও গুরুদঙ্গমার হ্রদ- ©শান্তম বিরুনী পঞ্চম এবং অন্তিম পর্ব । লাচুং, য়ুমথাং উপত্যকা ও গ্যাংটকে প্রত্যাবর্তন। 28.09.2018 "সক্কাল সক্কাল অমন দাঁত কেলিয়ে সেলফি তুলিস না। মোটেও ভাল্লাগছে না। আজ আমাদের ফেরার দিন। সেটা মনে করে একটু দুঃখু দুঃখু মুখ করে সেলফি তুলি চল।" সকাল ৭টা । স্থান লাচুং এ একটি সুন্দর হোটেল এর ব্যালকনি। পেছনে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণা। কাল সারারাত ঝর্ণার ডাক শুনেছি। একটা নাম না জানা পাখি টি টি করে ডেকে চলেছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার ওপরে হোটেল এর তিনতলা থেকে টুংটাং করে বাসন এর আওয়াজ হচ্ছে। কাল রাত্রে সেই ভয়াবহ মুলো কাণ্ডের পরেই হোটেল এর একজন দায়িত্ববান ব্যবস্থাপক আমাদের বলেছিলেন আজ সকালে প্রাতরাশ এর জন্যে পোহা বানিয়ে দেবেন। আর গাড়ি ছাড়ার আগে আমরা গরম গরম কফি খেয়ে নেবো। সে দুটো বানানোর শব্দ আসছে বোধহয়। দেরি হচ্ছে দেখে, আমি একটু হাঁটাহাঁটি করবো বলে বেরিয়ে এলাম হোটেল চত্ত্বর থেকে। লাচেন গ্রামের সাথে লাচুং গ্রামের বেশ তফাৎ। লাচেনে একটাই রাস্তা, যার নাম গুরুদংমার রোড। তার দুপাশে গজিয়ে উঠেছে বাড়ি, দোকান, হোটেল, হোমস্টে। আর কোনো রাস্তা চোখে পড়ে নি। অবশ্যি আমরা ছিলামই একটা রাত্রের জন্যে। তার সাথে লাচুং এর তফাৎ এখানেই। এর ব্যাপ্তি অনেক খানি। লাচুং এর দুটো ভাগ। ওল্ড লাচুং আর নিউ লাচুং। এখানে ট্যুরিজম আসার আগে নিউ লাচুং গড়ে ওঠে নি। ছোট একটা জনপদ। ঘোরানো রাস্তা। ইতি উতি বেড়ে ওঠা দোকান, পসার সাজিয়ে দোকানি। অর্গানিক সিকিম এর দৌলতে বাড়ির বাগানের আলুটা, মুলোটা , বাঁধাকপিটা- এসব নিয়ে বসেছে কেউ কেউ রাস্তার মোড়ে ।বাড়ি ঘর গুলোতেও দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে, নিউ লাচুং ঢোকার মুখেই একটা ব্রিজ আছে। তার তলা দিয়ে কোনো এক পাহাড়ি নদী নাচতে নাচতে বইছে । প্রণয় কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখানে সব ছোট বড়ো স্রোতই তিস্তায় গিয়ে মিশবে। ব্রিজ থেকে এগিয়ে এসে দুদিকে রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। দুদিক দিয়েই উঁচু রাস্তা উঠে গাছে পাহাড়ের ওপর অবধি। পাশে সারি সারি দোকান, হোটেল, বেশ দামি হোটেল ও আছে, আবার সস্তার হোটেল ও পাওয়া যায়। ওল্ড লাচুং এর একটা জায়গায় রাস্তা দুটো ভাগ এ ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে ওপর দিকে, যেটা আজ আমাদের গন্তব্য। য়ুমথাং উপত্যকা ও জিরো পয়েন্ট। আর একটা গ্রামে ঢুকেছে। কাল রাত্রে বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রণয় নিয়ে এসেছিলো এই নিচের রাস্তা দিয়ে। আজ ওই বাঁকে ঘুরেই ওপরে উঠতে হবে। গাড়ি ছাড়ার আগে প্রণয় কে বেশ চিন্তিত দেখলাম। দু চারবার কাউকে ফোন করলো, নেপালি ভাষায় উত্তেজিত হয়ে কিসব বললো। আমাদের সামনে দেখে আবার সেই নিপাট নিরীহ ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম, "ব্যাপার কি? এতো হৈচৈ কিসের?" বললো দুটো জিনিস। প্রথমত, গাড়ির তেল নিয়ে চাপে আছে ও। আজ গ্যাংটক ফিরতে অনেক খানি রাস্তা। তেল শেষ হয়ে গেলে আরেক ভোগান্তি। আর দ্বিতীয়ত, জিরো পয়েন্ট যাওয়া নিয়ে। এখানে আপনাদের একটি বিশেষ ব্যাপার জানিয়ে রাখি। প্রায় ৯৯% টুর এজেন্সী য়ুমথাং ভ্যালি পর্যন্ত আপনাদের প্যাকেজ দেবে। কারণ এটাই এখানকার নিয়ম। য়ুমথাং ভ্যালি থেকে জিরো পয়েন্ট মোটামুটি ২৫ কিমি দূরে। ওখান থেকে লাগবে দেড় ঘন্টা মতো। সেটার জন্যে এজেন্সী আলাদা চার্জ করবে। এই তথ্য টি য়ুমথাং ভ্যালি তে যে সাইনবোর্ড আছে তাতেও লেখা আছে। লাক্সারি গাড়ি হলে ৩০০০ টাকা মতো নেবে য়ুমথাং ভ্যালি থেকে জিরো পয়েন্ট। আমাদের এজেন্সির সাথে আমার যখন কথা হয়েছিল, জিরো পয়েন্ট প্যাকেজেই ধরা ছিল। (আপনারা আমাকে এর আগে অনেকজন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার প্যাকেজের ব্যাপারে। সবাইকে যা বলেছি এখানে খোলাখুলি বলি। আমি যে এজেন্সির সাথে গেছিলাম, তার সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্ক। আমার অন্যরকম প্যাকেজ ছিল এবং বিশেষ কারণে কিছু ছাড় পেয়েছিলাম। কিন্তু যদি আপনারা ইচ্ছুক হন, আমার সাথে আলাদা ভাবে যোগাযোগ করবেন, আমি ওদের ফোন নম্বর দিয়ে দেব।) প্রণয়ের সাথে এই জায়গায় একটু মিস কমিউনিকেশন হয়ে ছিল অবিনাশের। আমরা বার বার বলছি জিরো পয়েন্ট ধরা আছে। কিন্তু সে মানতে নারাজ। শেষে আমি আমার কলকাতার ব্যবস্থাপক কে ফোন করে বলার পরে সে আবার অবিনাশ ও প্রণয় কে জানায়। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিলো প্রণয়। মুখে ছুরপি। চোখে রোদচশমা । আমাকে সামনে বসতে দেখে বললো, "স্যার আপ বুরা তো নাহি মানা ?" আমি হাসি মুখে উত্তর দিলাম, "না ভাই, তোমার কাজ তুমি করেছো। তোমাকে যা বলা হয়েছিল তুমি সেটাই করবে, এর ওপর খারাপ লাগার জায়গা নেই।" উত্তর শুনে প্রণয় খুশি হলো। হাসি দেখে বুঝলাম, বেচারা খুব ই চাপ এ পড়েছিল। প্রণয় লাচুং থেকে বেরোনোর সময় একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দোকানের কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেন নি। প্রণয় এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করলো খানিকক্ষণ । তার পর ফিরে এলো। সে তেল এর সন্ধান করছিলো। পায় নি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, চুমথাং এর পরে আর তেল ভরার জায়গা নেই। দেরি হচ্ছে দেখে গাড়ি স্টার্ট করে আমরা এগিয়ে চললাম য়ুমথাং উপত্যকার দিকে। আজ ফেরার জন্যেই বোধহয় গাড়ির ঝাঁকুনি টা বেশি লাগছে। কেমন একটা তিতকুটে ভাব আমাদের তিনজনের ই। ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠা আর ভালোলাগছে না যেন। এখানেও একটা সেনা ছাউনির চেক পয়েন্ট। পারমিট দেখিয়ে আবার চললাম। এই সেনা ছাউনি আমাদের ফেরার পথে অনেক সাহায্য করেছিল। লাচুং এর ওপর দিকের রাস্তা গুরুদংমারের থেকেও খারাপ কয়েক জায়গায়। একজায়গায় তো রীতিমতো নদী বইছে ।রাস্তার ওপরে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই । এদিক সেদিক স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে প্রণয় আর তার জাইলো দুলতে দুলতে চলল। পিঠে অসহ্য ব্যথা। তিনজনেরই। খানিক টা গিয়ে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটলো। প্রণয় রাস্তা চেনে হাতের তালুর মতো। একটা ঘোরানো পথে উঠতে গিয়ে গতি একটু বাড়ালো সে। উঠেই আবার বাঁ দিকে ওঠা আছে। সেরকমই তার জানা আছে। প্রথম বাঁক টা নিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই সশব্দে ব্রেক কষতে হলো তাকে। পাথর। একটা একতলা বাড়ির সমান। ভ্রূ কুঁচকে গেলো এতো অভিজ্ঞ চালকের। এতো টাটকা ধস। আমাদের দিকে ঘুরে যেটা বোঝালো সেটা হলো, ধস নামার সময় কখনো পাথর শেষে পড়ে না। শেষে পড়ে বালি, আর ছোট পাথর। এখানে সেটা নেই। অর্থাৎ ধস আবার নামতে পারে। আমরা ভয়ে ভয়ে ওপর দিকে তাকালাম। আলাদা করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।পাথরের ঢল নেমেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কিন্তু যাবো কিভাবে। ঘুরে গিয়ে একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই রাস্তা গাড়ির নয়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে লাচুং নদী । এটি তিস্তার প্রধান উপনদী। সেই লাচুং নদীর তীরের ওপর এবড়োখেবড়ো রাস্তা একটি আছে। প্রণয় আমার দিকে তাকালো। মুখে হাসি। "মজা আয়েগা স্যার!!" চোখের নিমেষে গাড়ি ঘুরিয়ে লাচুং নদীর তীরে আমরা। কোনো পথ নেই। পাথরের ওপর দিয়ে গাড়ি গড়াচ্ছে। জল পড়ছে এদিক ওদিক থেকে রাস্তার ওপরে। এভাবে যাওয়ার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শরীর খারাপ করছিলো। কোনোক্রমে ওই রাস্তা টা পেরোতে আমাদের সময় লাগলো কুড়ি মিনিট। পেছনে তাকিয়ে দেখি, আমাদের এক সঙ্গীর মুখ চুন। জিজ্ঞেস করতে জানলাম, পেটে ব্যাথা তার। বেগ আসছে। প্রণয় বললো, য়ুমথাংএর ওখানে পাবলিক টয়লেট আছে। কোনো চিন্তা নেই। খানিকটা ওপরে উঠে দৃশ্য বদলে গেলো। দুপাশে রোডোডেন্ড্রনের বন । কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে। এদিক ওদিক সাইনবোর্ড। গাছ থেকে ফুল ছিড়বেন না, জন্তু জানোয়ার কে বিরক্ত করবেন না এইসব। কি মুশকিল বলুন তো। চারদিকে একটা দৈবিক পরিবেশ। উঁচু উঁচু গাছ। মাঝখান দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঝর্ণা, সেই ঝর্ণা ঘোরানো পথের ওপর বার বার এসে যেন পা ধুইয়ে দেয়, এরকম একটা পরিবেশে কোন সুস্থ মানুষের মনে হয় ফুল ছেঁড়ার কথা? জন্তু জানোয়ার পাখি কে বিরক্ত করার কথা? অথচ এমন হয় বলেই না সাইনবোর্ড লাগানো আছে!! যাইহোক, এগিয়ে চলেছি ঘোরানো রাস্তা দিয়ে। এই উপত্যকা ন্যাড়া নয়। পাশ দিয়ে লাচুং নদি বইছে। তার তীর বরাবর অনেক খানি ফাঁকা জায়গা। মেঘ ভিড় করেছে তার ওপর। বড় বড় পাথর ছড়িয়ে আছে নদীখাতের চার পাশে। কেমন একটা মায়াবী পরিবেশ। দূর থেকে দেখলে সবুজ আর বাদামি রং মেশানো এক জলাভূমির মতন লাগছে। পাখি উড়ছে ইতি উতি। নদি এখানে বেশ খরস্রোতা। তার এপাশে পাতলা বন। ওপাশে ঘন জঙ্গল। প্রণয় এর থেকে জানলাম এখানে "ভালু " থাকে। প্রণয় গাড়ি চালানো ছাড়াও ট্রেকিং এর ব্যবস্থাও করে। সে নিজে ট্রেক করতে পছন্দ করে। এসব কথা বলতে বলতেই আমরা এগিয়ে গেলাম য়ুমথাং উপত্যকার দিকে। রাস্তার ডান দিকে একটা ছোট রাস্তা বেঁকে নিচের দিকে নেমে গেছে। প্রণয় বললো উষ্ণ প্রসবন। চামড়ার রোগ সারানোর জন্যে এই প্রসবন নাকি বিখ্যাত। খানিক দূর গিয়ে গাড়ি থামালো প্রণয়। আমরা পৌঁছে গেছি য়ুমথাং উপত্যকা। এখানে রাস্তার চারিধারে দোকানপাট। এখন অফ সিজন।তাই লোক জন কম। এই দোকান গুলোয় গামবুট, জ্যাকেট, গ্লাভস ভাড়া পাওয়া যায়। ম্যাগি পাওয়া যায় গরম গরম। চামরিগাইয়ের মাংস, কফি, চা। আর পাওয়া যায় আগুন। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম পুরো উত্তর সিক্কিমে। গাড়ির চালকদের কোনো টাকা লাগে না খেতে গিয়ে। এখানেও তাই। আমরা পৌঁছানোর আগে অন্তত ১০টা গাড়ি এসে পড়েছিল এখানে। একটা দোকানে আমাদের প্রণয় নিয়ে গেলো। সেখানে গাড়ির চালকেরা বসেছে আগুনের পাশে। সবাই গোল হয়ে বসে ম্যাগি খাচ্ছে। সাথে চামরিগাইয়ের মাংস। আমরা বসলাম না ওখানে। প্রণয় এর থেকে বাথরুম এর সন্ধান নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আমাদের তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা করুন। সে পেট চেপে বসে আছে। আমাদের বাকি দুজনের অবস্থা অনেকটা ভালো। বেশি জল খেয়েছিলাম বলে আমারো ছোট বাইরের বেগ আসছিলো। কিন্তু বিপদ টাএলো অন্যদিক দিয়ে। বাথরুম এর কাছাকাছি পৌঁছতেই বুঝতে পারলাম সেটি বন্ধ। তালা দেওয়া। এদিক ওদিক জিজ্ঞেস করে জানলাম অফ সিজন তাই। ছেলেদের অসুবিধা নেই। ঝোপ ঝড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেলেই হলো। সমস্যা বড় বাইরে আর মহিলাদের নিয়ে। আমার সামনেই দুজন ভদ্রমহিলা চিন্তিত মুখে আবার তাদের গাড়িতেই উঠে বসে পড়লেন। আমাদের সাথে যে বন্ধু ছিল, তার চোখ ছল ছল করছে। এমনকি প্রণয় ও এদিক ওদিক থেকেও ম্যানেজ করতে পারলো না। কোনো দোকানেও ব্যবস্থা নেই। এরপর আমাদের জিরো পয়েন্ট যাওয়ার পালা। তবে আমাদের সঙ্গীটির পক্ষে আর গাড়িতে বসে ওই ঝাঁকুনি সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি প্রণয়কে কাছে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম, জিরো পয়েন্ট এ এখন গিয়ে লাভ হবে না। তাছাড়া আমাদের সঙ্গীটির যা অবস্থা, সে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কাজ সারবে না। কারণটিও যুক্তিযুক্ত। মাটিতে জোঁকের ভয়। তাই সে পেট চেপে বসে আছে। অগত্যা জিরোপয়েন্ট বাদ দেওয়া হলো প্ল্যান থেকে। আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের প্যাকেজ এ থাকলেও আমরা যেতে পারি নি। কারণ ওই রাস্তার ঝাকুনি আর ভালোলাগছিলো না। তাছাড়া গুরুদংমার দেখার পর আর সব কিছুই ফিকে লাগছে। গাড়ি ঘুরিয়ে প্রণয় গতি বাড়িয়ে দিলো। সাবধানে অথচ দুরন্ত গতিতে অভিজ্ঞ চোখে রাস্তা মেপে প্রণয় গাড়ি ছোটাচ্ছে। আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। বিশাল বিশাল রোডোডেন্ড্রন, তাদের গায়ে সবুজ শ্যাওলা, কাঠঠোকরা পাখি, মাছরাঙা, আরো কত নাম জানা, না জানা পাখি, প্রজাপতি, সব কিছু পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে চলেছি সমতলের দিকে। আর একদিন পরেই আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে এই সজীব বনলতার স্নিগ্ধ হাওয়া, দূষণ হীন প্রকৃতি, পাহাড়ি খেয়ালে চলা লাচুং নদী , তিস্তা,আঁকাবাঁকা রাস্তা, বৌদ্ধ গুম্ফা , সব কিছুই। আবার আসবো।কথা দিলাম নিজেকে। ফেরার পথে ওই সেনা ছাউনি তে আমাদের সঙ্গীর বেগ হালকা হলো। বেচারার চোখে জল এসে গিয়েছিলো। সে দু বার দুঃখ প্রকাশ করলো যে তার জন্যে আমরা যেতে পারলাম না জিরো পয়েন্ট। প্রণয় সেটা শুনে বললো, এখন ওখানে কিছুই দেখার নেই। শুধু হাওয়া খেতে ওখানে যাওয়ার মানে নেই কোনো। আমার কানে এসব কিছুই ঢুকছিল না। আমি তখন গাড়ির জানলা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে চেষ্টা করছি প্রকৃতির নির্যাস যেটুকু শুষে নেওয়া যায় সেটুকুর খোঁজ করতে।লাল লাল ফোলা ফোলা গালের বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে আমার মন টা প্রতিবারের মতো খারাপ হয়ে গেলো। ক্যামেরায় তোলা ফটো গুলো দেখতে দেখতে মনের ভেতরে উঁকি মারলাম। প্রথম দিন থেকে কিছু সুন্দর মুহূর্ত তুলে রাখা আছে মনের দেওয়ালে। তাতে প্রণয় এর সাথে আমাদের খুনসুটি, তাকে রাগানো, তার হাসি, তার আত্মবিশ্বাসী গাড়ি চালানো, আমাদের কত স্মৃতি , তিস্তা কে পাশে নিয়ে, সেই কির্নে বাজারের খাসির মাংস থেকে শুরু করে গ্যাংটক এ সেই সুস্বাদু খাবার, লাচেন এ রিনঝিং কাজির গল্প, লাচুং এর মুলো কান্ড , সব কিছুই বাঁধানো আছে মনের মনিকোঠায়। অবাক লাগছিলো প্রণয় কে দেখে। সে প্রায় প্রতিদিনই প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বাঁচে। রাস্তার ধস, পাহাড়ী নদীর জল, সব কিছুকেই জয় করার জন্যে সে দুর্বার গতিতে চুটিয়ে দেয় তার প্রিয় জাইলো। সাথে থাকে একটি শিব ঠাকুরের ছবি। বড় ভক্ত সে শিব এর। আবার সে গোর্খা। তার কাজে সে তার পরিচয় দেয়। বড্ডো প্রণয়-ময় হয়ে গেছিলো চিন্তা গুলো। ঘোরানো রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে পেরিয়ে যাচ্ছি সেই প্রথম দিনের ধস এর জায়গা গুলো। ফেরার পথে একটা ঝর্ণায় থেমেছিলাম। ঝর্ণার একদম কাছে গিয়েছিলাম আমরা। সে ঝর্ণার নাম অমিতাভ বচ্চন ফলস। কারণ এখানে অমিতাভ অভিনীত আঁখে সিনেমাটির একটি দৃশ্য শ্যুটিং হয়েছিল।আরেকটি নাম ও আছে। ভীম নালা ফলস। আমাদের জোর করে ফলস এর একদম কাছে নিয়ে এলো প্রণয়। প্রবল জলোচ্ছাস দেখতে গিয়ে বিন্দু বিন্দু জলের ছিটায় আমাদের মাথা থেকে পা অবধি ভিজে গেলো। ক্লান্তি দূর হলো সারাদিনের। ওখানেই একটা হোটেলে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে আবার শুরু হলো আমাদের ফেরার যাত্রা। রংরাং-এ থামলাম। Chirag Da Dhabaতে আর যাই নি। তার উল্টো দিকে আরেকটা হোটেল এ ডিম্ ভাজা সহযোগে ভাত খেলাম। গ্যাংটক ফিরতে ফিরতে বিকেল ৫টা। রাস্তায় উল্লেখ্য একটাই জিনিস ছিল। সেই বিখ্যাত চড়াই উৎরাই এর জায়গায় দেখলাম, একটি সেনা বাহিনীর বাস উল্টে গেছে। প্রণয় মুখ টা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে বললো, "স্যার , ইয়ে লোগ ভি মজা নাহি লে পায়া !!" আজ লিখতে লিখেত ভাবছি, প্রণয় ছেলেটা আমার কাছে অন্তত, "মজা" কথাটার অর্থটাই পাল্টে ফেলেছে যেন। "দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার" এর সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়াই করা কেই পাহাড়ের প্রণয়রা মজা আখ্যা দেয়। হোটেল এ ফিরে অবিনাশ এর সাথে দেখা। তার সাথে ইচ্ছে না থাকলেও MG MARG যেতে হলো। এদিক ওদিক হেঁটে, ফিরে এলাম হোটেলে আবার। পরেরদিনের জন্যে গোছানো শুরু করলাম। রাত্রে গ্যাংটক এর হোটেলে শুয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম গত তিনদিনের স্মৃতি রোমন্থনের। দেখলাম, নিজের স্বত্বা কে দুভাগে ভাগ করে ফেলেছি যেন। কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না সেই নীল আকাশের তলায় নীল হ্রদ এর ঘোর থেকে। আমি চলে এলেও, আমার আত্মা যেন আটকে পড়েছে সেই জলের মধ্যে। অথবা লাচেনের সেই মায়াবী রাতে পাশের পাহাড়ের ঝর্ণার শব্দ, অত্যন্ত ঠান্ডায় হোমস্টের ঘষা কাছে বায়বীয় বাষ্পের প্রলেপ, দূর থেকে ভেসে আসা বৌদ্ধ গুম্ফা থেকে সেই বিষাদকাতর বাঁশির সুর, পাহাড়ি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যা অবিকল ঘন্টা বাজানোর মতো শোনায়, বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলেই মনে হচ্ছে পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তায় আমরা চার জন গাড়ির মধ্যে বসে দুলে দুলে চলছি । নেপালি গান চলছে মিউজিক সিস্টেম এ। কানে আসছে প্রণয়ের আমাদের মতো মুখ গোল করে রসগোল্লা উচ্চারণ করা বাঙালি কে নেপালি ভাষা শেখানোর প্রবল চেষ্টা- "মেরো নাম প্রনয়। "তেমেরো নাম কিও?" অথবা বিশ্বের সর্বভাষায় অন্যতম প্রচলিত বাক্য "আমি তোমায় ভালোবাসি"-র নেপালি উচ্চারণে "মো তিমিলাই মায়া গারচু"।।। -সমাপ্ত- ***************************************** লেখা চলাকালীন আমি অনেক বন্ধুদের ইনবক্সে বলেছিলাম কিছু টিপস দেব যেগুলো আমার দরকারি মনে হয়েছে। নিচের কথা গুলি নিয়ে কারো কিছু বলার থাকলে আমাকে ইনবক্স করতে পারেন। ১. গুরুদংমার যেতে গেলে অবশ্যই ডাক্তার এর সাথে একবার পরামর্শ করে নিন। ওখানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে ভালোই শাসকষ্ট হয়। . ২. amazon e commerce site এ ছয় লিটার বা দশ লিটার এর অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যায়। দশ লিটার এর সিলিন্ডার এ আনুমানিক দেড়শোবার আপনি শ্বাস নিতে পারেন। যদি পারেন প্রতি তিনজনের জন্যে একটি সিলিন্ডার কিনে নিয়ে যান। আমি কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডেলিভারি ডেট দেরি করে ছিল বলে নিতে পারিনি সাথে। ৩. coca ওষুধ টি 6 এবং 30 এই দুটো dose এ পাওয়া যায়। আমরা গ্যাংটক এ পৌঁছানোর দিন থেকে গ্যাংটক ফায়ার আসার দিন অবধি খেয়েছি। এই ওষুধ সাথে সাথেই কাজ করে না। সময় নেয় । তাই আগে থেকে খান। coca30 বড়দের জন্যে ৫-৬ টা গুলি, এবং বাচ্চাদের জন্যে ৩-৪টি গুলি খেলেই চলে। এটি আমি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছি। ৪. সাথে কর্পূর রাখুন। শুধু গুরুদংমার না। যেকোনো পাহাড়ে বেড়াতে গেলে সাথে কর্পূর রাখুন। শ্বাস কষ্ট হলে, বা গা গোলালে কর্পূর শুকলে অনেক কাজে দেয়। ৫. এই কথা টি মহিলাদের জন্যে। amazon e commerce site এ একটি জিনিস পাওয়া যায়, peebuddy নামে। বাড়ির বাইরে মহিলাদের টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে নানা রোগ, ইনফেকশন এসব হয়ে থাকে প্রায় ই। এই peebuddy জিনিস টি একটি ফানেল এর মতো। এটি দু ধরণের হয়, use and throw এবং reusable । এটি ব্যবহার করে মহিলারাও দাঁড়িয়ে, অথবা অর্ধেক বসে অথবা ঝোপ ঝড়ের আড়ালে ছেলেদের মতোই টয়লেট করতে পারবেন। এটি হাইজেনিক ও নিজস্ব ব্যবহারের জন্যে। তবে বেড়াতে যাওয়ার দিন ই কিনে ব্যবহার করতে অসুবিধে হতে পারে। তাই কিছুদিন আগে থেকে কিনে ব্যবহার করে দেখুন। ৬. উত্তর সিকিম বেড়াতে গেলে পারমিট পেতে একটা নিয়ম আছে। ওখানকার লোকাল ড্রাইভার থাকতেই হবে। আপনি নিজে ড্রাইভ করলেও একটি লোকাল ড্রাইভার আপনাকে সাথে রাখতে হবে। এই নিয়ম বোধহয় বেশিদিন হয় নি। এ ব্যাপারে কিছু জানতে আপনি পারমিট অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। ৭. একটি হাওয়া ভরা বালিশ বা neck rest অবশ্যই নেবেন। রাস্তা খারাপএর জন্যে ঝাঁকুনির জন্যে পিঠের আর কোমরের ব্যাথা হয়ে থেকে খানিকটা উপশম হবে। ৮. নিজস্ব ফ্লাস্ক বা বোতল রাখুন। টুং এর পর থেকে প্লাষ্টিক বোতল পাওয়া যায় না। পাহাড় কে পরিচ্ছন্ন রাখুন। ৯. টর্চ রাখবেন সাথে। লাচেনে লোডশেডিং বেশি হয়। মোবাইল টর্চ এর ভরসায় থাকবেন না। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। মন ভরে ভ্রমণ করুন। অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিন আমাদের সবার সাথে। ইচ্ছা আছে কিছুদিন পর ফিরে আসবো মেঘালয়-শিলং-চেরাপুঞ্জীর গল্প নিয়ে। আবার দেখা হবে বন্ধু!!! Post By-Santam Biruni
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |