ফতেপুর সিক্রির আনাচে-কানাচে
দুপুরের রোদে তেমন তেজ নেই। গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস আসছিল হু হু করে আর তাতেই চোখ বুজে আসছিল আলতো ভাবে। গাড়ি ফতেপুর সিক্রি পৌঁছানোর আগে আমাদের ড্রাইভার ফতেপুর সিক্রি কি আর কি তার ইতিহাস তা সংক্ষেপে জানিয়ে দিল আমাদের। এবং এও জানলাম এখানে গাইড না নিলে কিছুই বোঝা যাবে না। সরকার স্বীকৃত গাইড নিতে হবে। ওরা চাইবে সাড়ে ছয়'শ টাকা, তবে দর-দস্তুর করে এগানো উচিত কাজ হবে। ফতেপুর সিক্রিতে পাইভেট গাড়ি যায় না। বাসস্ট্যান্ড থেকে আগ্রা ডেভলাপম্যান্টের গাড়ি ধরতে হয়। ভাড়া জন প্রতি দশ টাকা। তবে অটোও যাচ্ছে কিছুটু আগে পর্যন্ত। একজন গাইডের সঙ্গে কথা হল, চার'শ তে রাজি হল লোকটি। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে জয় লাভ করে বাবার আল্লাহকে সুক্রিয়া জানিয়ে নির্মান করেন সিক্রি নগর। পরবর্তীকালে মুঘলই-আজম- জাল্লাউদ্দিন -মহম্মদ আকবর গুজরাট জয়ের স্মারক হিসাবে লাল বেলে পাথরে নির্মান করেন ফতেপুর সিক্রি। ফতে অর্থাৎ বিজয়। আসলে আকবর ছিলেন নিঃসন্তান। পুত্র সন্তানের আশায় দরবেশ শেখ সেলিম চিস্তির কাছে প্রার্থণা করেন। দরবেশের আশীর্বাদে আকবরের পাদসা বেগম যোদ্ধাবাঈ এর সন্তান হয়। যোধাবাঈ ছিলেন আমের(জয়পুরের) রাজকন্যা। রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করার জন্য সম্রাট রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু ভারত সম্রাট সন্তানহীন হওয়ায় উত্তরাধীকারীর ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। দরবেশ সেলিম চিস্তির ভবিষ্যত বানী মিলে যায়। আকবরের তিন বেগম সন্তান সম্ভবা হন। একদিকে গুজরাট জয় অন্য দিকে সেলিম চিস্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা হেতু চিস্তির গ্রামে শৈলশিরায় ১৫৬৯ -এ নির্মান করেন রাজধানী। হিন্দু আর মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন যার নাম ফতেপুর সিক্রি। এই ফতেপুর সিক্রি তে আকবরের রাজধানী ছিল দীর্ঘ ষোল বছর। পরবর্তী কালে জলের অভাবে তিনি আবার ফিরে যান আগ্রায়। অবশ্য ফতেপুর সিক্রির পতনের অন্য এক গাঁথা শুনলাম গাইডের কাছে। জেরিনা নামে এক নর্তকী স্থান পায় সম্রাটের হারেমে। জেরিনা ছিল সিক্রি গ্রামের অখ্যাত নর্তকী। তার ইচ্ছা ছিল সম্রাটের নর্তকী হওয়ার। তার সেই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ তৈরি হয়ে যায় কাকতালীয় ভাবে। একবার সম্রাটের ইচ্ছে হয় তানসেনের সঙ্গীতের সঙ্গে একজন নর্তকী নাচুক। সে সময় নর্তকী মিলল না। এক দাসী মারফৎ সুযোগ পেয়ে যায় জেরিনা। জেরিনার নৃত্যে মুগ্ধ হন সম্রাট। ক্রমে জেরিনা আকবরের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেন। আর তাতেই ঈর্শান্বিত হয়ে পড়েন যোধাবাঈ তথা মরিয়ম-উজ-জামানীর( প্রতি যুগের আনন্দ ) দাসী মাধবী। চক্রান্ত করে মাধবী চোর সাবস্ত্য করে জেরিনাকে। সম্রাট বিশ্বাস ভঙ্গে আঘাত পান। জেরিনা বারবার করে সম্রাটকে জানায় যে সে চুরি করে নি। কিন্তু রাজধর্ম পালনে আকবর বাধ্য হন শাস্তি প্রদানে। পরদিন বিচার সভা বসার আগেই ভোর থেকে আর জেরিনার দেখা মেলে না। বিচারের আগেই অাত্মহত্যা করে জেরিনা। ভেঙে পড়েন সম্রাট। জেরিনার বাবা অভিশাপ দেয় তার মেয়ের আকাল মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাবে সম্রাটের স্বপ্নের নগর ফতেপুর সিক্রি। কিছু কাল পরে পুর নগরে জল কষ্ট দেখা দেয়। মৃতের নগরী হয়ে যায় ফতেপুর। সম্রাট ফিরে যান আগ্রায়। ফতেপুরের দুটি ভাগ রাজবাড়ি আর গুরুবাড়ি। পূর্ব দিকের রয়েল গেট থেকে রাজবাড়ি তে প্রবেশ করতে হয়। ঢুকেই সবুজ মখমল বিছানো 'দেওয়ানী আম' প্রতি দিন সকালে সম্রাট দেখা দিতেন প্রজাদের। একটু উচুঁতে সম্রাটের বসবার জায়গা। 'দেওয়ানী আম' পেরিয়ে 'তোলা-দান' এখানে সম্রাট আকবর তার সন্তান সেলিম তথা জাহাঙ্গীরকে তোলার একদিকে রেখে অন্য দিকে সোনা দিয়ে ওজন করেছিলেন। ঐ সোনা দান করেছিলেন গরীব প্রজাদের মধ্যে। তোলাদানের পাশে জ্যোতিষ পরুষোত্তম দাসের কার্যালয়। পাশেই 'ইবাদতখানা'। এখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা হত। সম্রাট আকবর সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। আকবরের 'দীন ইলাহির' প্রচার হয় এই 'ইবাদতখানা' থেকে। সংলগ্ন 'পাঁচ-মহল'। পাঁচতলা বিশিষ্ট 'হাওয়া মহল'। কোন দেওয়াল ছাড়া পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই 'হাওয়া মহল'। আকবর জয়পুরের হাওয়া মহলের আদলে নির্মান করেন এই 'হাওয়া-মহল'। মোট পিলার সংখ্যা ১৭৬টি । সব চেয়ে নিচে ৮৪টি, তারপর ৫৬,২০,১২ ও সবচেয়ে উপরে ৪টি। ওখানে হাওয়া খেত সম্রাট আকবর ও তার পাটরানী যোধাবাঈ। সবথেচে নিচের তালায় আর্বি ও পার্সী শিক্ষা দেওয়া হত। সে কাজে যুক্ত ছিলেন আবুল ফজল ও আবুল ফৌজী। সম্রাট আকবরের লাইব্রেরী ছিল ওখানে। সম্রাট লেখাপড়া না জানলেও সভাসদরা পাঠ করে শোনাতেন। সম্রাট আকবরের খাস সভা বসত 'দেওয়ানী খাসে'। বড় পিলারের আসনটিতে বসতেন সম্রাট, চারদিকে তার নয় সভাসদ। 'দেওয়ানী খাস' এর স্থাপত্য আজও অম্লান। দেওয়ানী খাস সংলগ্ন চাতালে সম্রাট দাসীদের ঘুঁটি করে দাবা খেলতেন। চাতালের পাশে 'অনুপ তালাও'। 'অনুপ তালাও'-এ বসে গান গাইতেন তানসেন। 'অনুপ তালাও'-এর চারপাশে গোলাপ জলের জলকেলি। সঙ্গীতের সঙ্গে মুজরাও বসত সেকালে। সম্রাট আকবরের প্রধান তিন মহিষী ছিলেন হিন্দু(যোধাবাঈ জয়পুর থেকে),মুসলিম(রুকাইয়া তুর্কীর সুলতানা), খ্রিস্টান(মারিয়াম গোয়া থেকে)। তিন পত্নীর পৃথক পৃথক মহল ছিল। রুকাইয়া বেগম মুসলমান হলেও তার মহলের স্থাপত্যে তুলসীগাছ,মঙ্গল ঘট,স্বস্তিক চিহ্ন নজরে পড়ে। মহামতি আকবরের আরামখানা ঢোকার মুখে প্রকান্ড এক জলপাত্র। যা আজ ভগ্নাবশেষ মাত্র। ঐ পাত্রে নাকি পানের জল থাকত সম্রাটের। জল আসত ঘটা করে হরিদ্বার থেকে। সম্রাটের শয়ন কক্ষটিও রাজকীয়। আকবরের উচ্চতা ছিল ৫ফুট-৪ইঞ্চি কিন্তু পাথর নির্মিত খাটটির বহর ছিল- ১৮x১৫ বঃ ফুট। দেখে নিলাম রাজকীয় ভোজনালয়। পাথরের কোটরে কোটরে থাকত মোগলাই খানা। আরামখানার প্রবেশ পথটি উচ্চতায় বেশ ছোট। ছোট কেন তা জানা গেল গাইডের থেকে। সম্রাটের এক মন্ত্রী মহেশ দাসের পরামর্শ ক্রমে নির্মান হয় প্রবেশ পথের। মহেশ দাস বলেন প্রবেশ পথ এমন হোক যাতে যে কেউ মাথা নিচু করে প্রবেশ করবেন সম্রাটের কাছে। গাইড ফেললেন ঝামেলায়। প্রশ্ন করে বসলেন -- --কে এই মহেশ দাস? আপনি তো বাঙালী বলুন? মাথা চুলকে, ঠোঁট কাঁমড়ে সে এক যা তা অবস্থা। পরে জানা গেল এই মহেশ দাস হলেন-- "বীরবল"। সম্রাটের পাটরানীর রন্ধনশালায় ১৫৬টি ঝুমকোর নকসা্। যোধাবাঈয়ের পচ্ছন্দ মাফিক সম্রাট নকসা্ -র আদলে সোনার ঝুমকো গড়ে দিতেন। গাইড বেশ মজার মানুষ। হঠাৎ ভাঙা ভাঙা বাংলায় জানতে চাইলেন-- -- যোধাবাঈ কি আছেন? আমি বললাম-- -- সে কত যুগ আগের কথা, কি করে থাকবে? আমার গিন্নীর দিকে ইশারা করে বলল-- -- বলেন কি! এই তো যোধাবাঈ। আমি বললাম-- -- না এটি আমার যা তাইই যোধাবাঈ হতে যাবে কেন! যোধাবাঈ হতে গেলে রুকাইয়া,মারিয়াম দরকার হয়ে পড়ে যে। পুরো চত্তরে ভেঙে পড়ল হাসি। যোধাবাঈ-এর মহলটি 'যোধাবাঈ প্যালেস' নামে পরিচিত। নির্মান রীতি রাজস্থানী হাভেলীর মতো। ভেতরে কৃষ্ণ মন্দির ছিল উপাসনার জন্য। এখন তুলসীমঞ্চে জবা গাছ দেখলাম। ঝরোখার কাজ চোখে পড়ার মতো। রাজবাড়ি ছেড়ে চললাম গুরুবাড়ি। এর প্রবেশ পথে এশিয়ার বৃহত্তম দরজা 'বুলন্দ দরওয়াজা' এ দরজা নির্মিত হয় গুজরাট জয়ের স্মারক হিসাবে। উচ্চতায় ৪১ মিটার। ভিতরে মক্কার আদলে হিন্দু ও পারসীক শৈলীতে 'জামি মসজিদ'। মসজিদে এক সঙ্গে ১০০০০ নামাজী নামাজ আদায় করতে পারে। গুরুবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ 'সেলিম চিস্তির দরগা' তথা 'মকবারা'। অনন্য তার স্থাপত্য। পাথরের জালি বা জাফরির কাজে চোখ আটকে যায়। তবে এ দরগা ধর্মীয় মাহাত্ম্য আজও অম্লান। আজও নিঃসন্তান দম্পতি দরগায় সন্তান কামনায় দাগা বাঁধেন অনন্ত বিশ্বাসে। ইতিহাসের আনাচ-কানাচে ঘুরতে ঘুরতে বেলা ফুরিয়ে এসেছে। সূর্যাস্তের লাল আভায় ধুয়ে যাচ্ছে ফতেপুরের প্রান্তর। আরো মোহময়ী হয়ে উঠেছে নির্মাণ। অন্ধকার নামার আগেই ফিরে যেতে হবে গন্তব্যে। শেষবারের মতো চোখ আটকে গেল 'বুলন্দ দরওয়াজায়' যেন একটা ছায়া মতো সরে গেল আচমকা চোখের সামন থেকে। গাইড বলে ছিল আজও গভীর রাতে দরওয়াজায় কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো মাধবী দাঁড়িয়ে থাকে জেরিনার অপেক্ষায়। জেরিনার কাছে তার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু হয় নি যে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |