গ্রামের বাড়ির দুর্গাপূজা
পুজো আসলেই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবার পুজোয় কার কি প্ল্যান ? কেউ বলে সারারাত ঠাকুর দেখতে যাব , কেউ বলে ঘুরতে যাবো কলকাতার বাইরে । আর আমায় কেউ বললে আমি হেসে শুধু বলি আমার বাড়িতে পুজো হয়। ব্যাস তখন সবাই স্বীকার করে নেয় বাড়ির পুজোর কাছে বাকি সব আনন্দ কিছুই না। আসলে বাড়ির পুজোর যে কি মজা , লিখে প্রকাশ করা যায় না। তাই প্রতি বছর পুজোর আনন্দের কথা উঠলে আমার শুধু আমাদের বাড়ির পুজোর কথা মনে আসে । আমাদের বাড়ির পুজোর ইতিহাস অনেকটা গল্পের মতোই। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে বাংলাদেশের ঢাকার বিক্রমপুরে আমাদের পরিবারে দুর্গাপুজোর সূচনা হয় ১৯৪০ সালে আমাদের পরিবারের প্রাণপুরুষ সুঁরেন্দ্রমোহন সরকারের হাত ধরে। আর তারপর দেশভাগের পর পরিবারের সদস্যরা হুগলী জেলার সোমড়াবাজারের যশড়া গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং দেশ ভাগের জন্য আর্থিক অনটনের কারণে পুজো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কিন্তু আবার মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই সোমড়া বাজারে বাড়ির সামনে খোলা মাঠে বাঁশের খুটি ও শাড়ির বেড়া ও হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে পুনঃরায় পুজো শুরু হয়। সেই থেকে আজও ওই স্থানেই মায়ের পুজো হয়ে আসছে পরম্পরা মেনেই । এবং এই আমাদের পুজোর সাথে জড়িয়ে আরও একজনের কথা না বললেই নয় তিনি সুঁকুমার দত্ত। উনার সহযোগিতা পুজোর সাথে অনেকাংশে জড়িত।এবং আরও অনেকের সাহায্য আমাদের পুজোকে অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আজও। আমরা কেউই পরিবারের সদস্যরা সোমড়াবাজারে সারাবছর থাকি না। শুধুমাত্র পুজোর ৫ দিন ও কিছু বিশেষ কারণ ছাড়া সোমড়াবাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমাদের ঠাকুর বাড়ির সাথেই আমাদের ঝুনু দিদা থাকেন ও অন্য আত্মীয়রাও থাকেন তাদের উপর বাড়ির দেখাশুনার ভার দিয়ে আমরা সারাবছর যে যার কাজ নিয়ে কলকাতাতেই কাটাই কিন্তু পুজোর ৫ দিন পরিবারের কারোরই কলকাতাতে থাকা হয় না। আমাদের কাছে পুজো মানেই আমাদের বাড়ির পুজোই সেরা।
পুজোর সময় হলেই ছোটবেলায় আমাদের খুব আনন্দ হতো সোমড়াবাজার যাবো শুনলেই । ষষ্টীর দিন সকাল ৬ টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শিয়ালদা স্টেশানে যাওয়া। পুজোর সময় শিয়ালদা স্টেশানের বাইরে হাজার ঢাকিরা এক সাথে ঢাক বাজাতো যেটা এখনও গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সেই ঢাকের তাল শুনতে শুনতে নমে একরাশ আনন্দ নিয়ে স্টেশানের ভিতর পৌছে খুব কম করে ৩০ থেকে ৩৫ জন আমাদের পরিবারের আত্মীয়দের সাথে দেখা হতোই । তারপর সবাই এক জায়গায় দাড়ানো হতো ও টিকিট বড়ো কেউ কেটে আনতো ব্যাস তারপর কাটোয়া লোকাল যা আগে সালার নামে খ্যাত ছিল। সেই ট্রেনে সবাই মিলে একটি কামরাতে উঠে পরা হতো । ট্রেনের কামরাতে যে দিকে তাকাতাম শুধু আমাদের বাড়ির লোকজন দেখতে পেতাম । খুব আনন্দ হতো জানলার ধারে বসে শিয়ালদা থেকে সোমড়াবাজার যাওয়া । খুব বেশি না ট্রেনে মাত্র ৩ ঘন্টার পথ । সেই যাত্রাতে কি না হতো তখন গান, গল্প, আড্ডা খাওয়া দাওয়া ও হাসাহাসি করতে করতে সোমড়াবাজার স্টেশান এসে পড়তো আর স্টেশানে আমাদের এক দাদু দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং স্টেশান মাষ্টারের সাথে আলাপ থাকায় তাকে বলে রাখতেন কলকাতা থেকে বাড়ির লোকজন আসছে ট্রেন একটু বেশী দাঁড় করাবেন পুজোর সামগ্রী, ফুলফল সব নামানো হবে তাই। তারপর আমরা সবাই নেমে পড়তাম আর তারপর ভ্যানে বসে যশড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। এখন এই ট্রেন যাত্রার আর হয় না এখন নিজস্ব গাড়ি আথবা ভাড়ার গাড়ি নিয়েই পুজোর সময়ে সোমড়াবাজার যাওয়া হয়।
আমাদের বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ঠ হলো রথের দিন নিজস্ব বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে কাঠামো বেঁধে কুলপুরহিতের তত্ত্বাবধানে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রথা মেনে মহালয়ার দিন মায়ের চক্ষুদান হয়। ষষ্টীর দিন সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক দম্পতি জোড় বেঁধে মা গঙ্গাকে গিয়ে আমন্ত্রন জানানো হয় ও তারপর তারা মায়ের স্নানের জল মাথায় করে বাদ্যযন্ত্র সহকারে বাড়ি নিয়ে আসা হয়।এরপর ঠাকুর দালানের পাশে বেলতলায় মায়ের বোধন শুরু হয়। এরপর প্রতিদিন তিথি মেনে পুজোর পাশাপাশি আমাদের পরিবারের আরও এক প্রাণপুরুষ ডাঃ শৈঁলেন্দ্র চন্দ্র সরকারের রচনা করা মায়ের গান মা ' কে শোনানো হয় সকলে একত্রে । আমাদের বাড়ির পুজো বৈষ্ণব মতে হওয়াতে আমাদের কোনও বলি প্রথা নেই এবং আমাদের পুজোয় মা' কে অন্নভোগ নয়, ফল ভোগ ও লুচি সুজি ভোগ দেওয়া হয়। আমাদের পুজোর সন্ধিপুজো খুবই আকর্ষনীয় । তারপর দশমীতে আমাদের আরও একটি বৈশিষ্ঠ্য আমাদের মায়ের আশির্বাদ নাচ ও গান সহযোগে আমরা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নগরকীর্তনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ও বিকালে গঙ্গার ঘাটে মা'য়ের বিদায়ী গান শুনিয়ে বিসর্জনের মাধ্যমে মাকে বিদায় জানানো হয়। শেষ কয়েক বছর ধরে আমরা পুজোর সাথে সাথে কিছু সামাজিক কাজ আমরা করছি আমাদের পরিবারের সদস্য কল্লোল সরকারের হাত ধরে। বস্ত্রদান ,কম্বলদান অষ্টমীতে ভোগদান , বসে আকোঁ প্রতিযোগিতা , ও গ্রামের কৃতি ছাত্রীদের সম্মান জানানো , ছাতা প্রদান ও পরিবারের ছোট সদস্যের প্রচেষ্ঠায় নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের পুজোর প্রতিটি দিন কাটে।
বর্তমানে কর্মসূত্রে পরিবারের অনেক সদস্যকেই বাইরে থাকতে হয় কিন্তু পুজোর কয়েকটি দিন আনন্দ উপভোগের জন্য ও মায়ের টানে সমস্ত কাজ ফেলে রেখে আমরা একত্রিত হই সোমড়াবাজারে । এই ভাবেই দেখতে দেখতে এই বছর আমাদের বাড়ির পুজো ৮১ বছরে পা রাখছে আমাদের সরকার ভিলা দুর্গোৎসব । মায়ের আশির্বাদ মাথায় নিয়ে বংশ পরম্পরায় এই ভাবেই এগিয়ে যেতে চাই বছরের পর বছর ।।।। ধন্যবাদ । ছবি সংগ্রহে -আমাদের পরিবারবর্গ ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |