রঙচঙে কিছু ছবি থাকলেও এটা সেই অর্থে ঘুরতে যাওয়ার গল্প নয়। আবার হয়তো এটা আমার ঘুরতে যাওয়ার ই কথা। পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র নয়, শুধুমাত্র শিকড়ের টানে।
অজয় নদীর তীরে ছোট্ট একটা অজানা গ্রাম আমাদের। বাবার জন্মভূমি। অনেক ছোটবেলায় যেতাম যখন তখন ব্রিজ বলে কিছু ছিলনা। পুরনো রাজদূত মোটরসাইকেল চড়ে নদী ঘাট, সেখান থেকে নদী পেরোতে ভরসা বুড়ো মাঝির লড়ঝরে নৌকা। নিদারুণ দারিদ্র্য তখন তো বুঝতাম না। এখনো হয়তো বুঝিনা। যে সয় সেই জানে। আমরা তো বেশিরভাগ ই আহা উহু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ফিলিং স্যাড পোস্ট দিয়েই খালাস। তথাকথিত শহর থেকে আসা আমরা তখন সবার ফিসফাস আর অবাক বিস্ময় চাহনির একচ্ছত্র মালিক। মোটরসাইকেলের ধুলো ধোঁয়ার পেছনে ছুটে চলা একগুচ্ছ ন্যাংটো বাচ্চা। শুনেছি দাদু নাকি পুরোহিত ছিলেন।তৎকালীন জমিদার বাবু কিছু জমি দান করেছিলেন। সেই সুবাদে আমরাও নাকি জমিদার। পুরনো প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া মাটির বাড়িটার উঠোনে যখন গ্রাম বাংলা কেমন হয় দেখছি তখন একজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। এই সময়টায় আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত থাকি। প্রণাম টোনাম আমার ছোটবেলা থেকেই আসেনা। আড়চোখে মার দিকে তাকাচ্ছি, টরে টক্কা তরঙ্গে কি নির্দেশ আসে। আমাকে অবাক করে ভদ্রলোক আমার পা এর দিকে ঝুঁকে পড়লেন। "ঠাকুর ভালো আছেন?" মনে হলো সপাট করে এক বেতের বাড়ি পড়লো যেনো পিঠে। একটু ভালো পোশাক, পা এ জুতো আর দুবেলা খাবার, আর একটু শহরের গন্ধ কি মানুষকে এতটা তফাৎ করে দেয়? যেখানে বয়সের ভেদ হার মেনে যায়? আমাদের গ্রাম এ তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। স্কুল তো ছাড়, একটা প্রাথমিক চিকিৎসালয় অবধি নেই। এই নেই এর ফিরিস্তি বিশাল। রাস্তা নেই, চাষবাস ছাড়া উপার্জন নেই, মেয়েদের ন্যূনতম আবরণ কেনার সামর্থ নেই। রুগ্ন শরীরে প্রতি বছর সন্তান, হয়তো তাদের জন্য বুকে দুধ ও নেই। সন্ধ্যে নামলেই ঘুমোতে যাওয়ার তোড়জোড়। কারণ সূর্যের আলো ছাড়া দিনের অস্তিত্বই নেই । অবসর বিনোদনের একমাত্র আদিম নির্ভেজাল উপায় সম্ভোগ। ফলস্বরূপ প্রতি বছর সন্তান। কি খাবে না খাবে।বউটা সেই ধকল নিতে পারবে কিনা মারা যাবে সেসব ভাবারও সময় নেই। তবে ভাববেনা সবই নেই এর দিকে। কিছু কিছু জিনিষ আছে। প্রবল পরাক্রম এর সাথে আছে। অলিতে গলিতে দেশী মদ আর চোলাই মহুয়ার ঠেক আছে। নদীর ধারে জুয়া এর আসর আছে। জমি বাড়ি যেটুকু যা আছে সব বন্ধক দিতে হলেও পরোয়া নেই। আমি ভাবি তাহলে কেন একটা কোথাও যেন সূক্ষ্ম কিসের টান? বৃষ্টির পরে ওই সোঁদা মাটির গন্ধ? নাকি বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ? কোন টা আমায় টানে? নাকি সেই রাত্রে দুর থেকে ভেসে আসা বেসুরো কীর্তন? নাকি নদীর পাড়ের ওই স্মশান টা? গত বছর শীতকালে গেলাম যখন ঝটিতি সফরে, ফেরার সময় সান্তা কাকুর সাথে দেখা রাস্তায়। উনি ভাগ চাষী। নিজের জমি নেই।অন্যের জমিতে চাষ করে ভাগ দিতে হয় মালিক কে। এক ব্যাগ ভর্তি তাজা সবজি জোর করে গাড়িতে তুলে দিলেন।বলল "আমার নিজের বাগানের সবজি।একদম তাজা। ছেলে টা পড়াশোনা করে নিজের গ্যারেজ খুলেছে। বাড়িটা দোতলা করে নিচে একটা মিষ্টির দোকানও দিলাম। পরের বার আসো মিষ্টি খাওয়াবো প্রচুর। তখন কিন্তু থাকতে হবে কদিন।পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরবো।কেমন?" পান খাওয়া কালো ভাঙ্গা দাঁতের ফাঁকে অমলিন হাসিটা দেখলাম। একজন গর্বিত পিতা, একজন সফল খেটে খাওয়া মানুষ এর হাসি। হয়তো এটাই আসল "জমিদার" এর হাসি।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |