"নদিয়া(কৃষ্ণনগর) রাজকাহিনী" -----------পৃথ্বীশরাজ কুন্তী গত ২৯ শে এপ্রিল প্রভু নরসিংহ দেবের আবির্ভাব তিথিতে যোগ দিতে হাজির হয়েছিলাম শ্রীচৈতন্যদেব ও পরম গুরু প্রভুপাদের পাদস্পর্শে ধন্য পুণ্যভূমি মায়াপুরে।ঐদিন সন্ধ্যায় ইসকন মন্দির প্রাঙ্গণে বসে ম্যাপ সার্চ করতে গিয়ে হঠাৎই দেখতে পেলাম খুব কাছেই রাজার শহর 'কৃষ্ণনগর' অবস্থিত। ব্যস! আর দেরি করলাম না।পরদিন তথা ৩০ শে এপ্রিল খুব ভোরেই মঙ্গল আরতি দেখেই বন্ধু ঋতম ও ভাই সৌম্যদীপকে নিয়ে ভাগিরথীর স্নিগ্ধ পরিবেশে সকালের নিষ্কলুষ,পবিত্র হাওয়া উপভোগ করতে করতে অজানা-অদেখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে চাক্ষুষ করার অনুসন্ধিৎসা নিয়ে রওনা দিলাম কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে।রাজবাটীতে গিয়ে বাইরে থেকে রাজবাড়ির অতুলনীয়া স্থাপত্য ও অসাধারণ শিল্পকর্মকে চাক্ষুষ করলাম।আমার অভ্যাসবশত সেখানে গিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ ও রাজদরবারের প্রহরীদের থেকে রাজবাটীর ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করলাম।সেই সামান্য অনুসন্ধান থেকে যা কিছু খুঁজে পেলাম তাই আপন মনের মাধুকী মিশিয়ে এই লেখায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী,নদিয়া রাজ বংশের আদিপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেওয়া ফরমানে নদিয়ার রাজ সিংহাসন অলংকৃত করেন।তাই নদিয়ার এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে রাজা ভবানন্দ মজুমদারকেই ধরা হয়।রাজা ভবানন্দ মজুমদারের পৌত্র রাজা রাঘব রায় তার জমিদারির প্রায় মাঝখানে জলংগী নদী তীরবর্তী 'রেউই' নামক গ্রামের চারিদিকে পরিখা খনন করে নদিয়া রাজের রাজধানী স্থাপন করেন।রাজা রাঘব রায়ের পুত্র রাজা রুদ্র রায় 'রেউই'-এর নাম পরিবর্তন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-এর নামানুসারে 'কৃষ্ণনগর' নামকরণ করেন।রাজা রুদ্র রায় তার স্বপ্নের রাজধানীকে সাজিয়ে তুলতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন।সেকারণে তিনি দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে 'আলাল বক্স' নামক এক প্রখ্যাত স্থপতিকে এনে কৃষ্ণনগর শহরের রাজবাটী সংলগ্ন অঞ্চলে চকবাড়ি,কাছারিবাড়ি,হাতিশালা,আস্তাবল,নহবতখানা নির্মাণ করেন।মুসলিম স্থাপাত্যানুগ চারমিনার সদৃশ তোরণ আজও স্বমহিমায় দণ্ডায়মান হয়ে যে কোনো দর্শকের মনকে জয় করে নেয়। রাজা রুদ্র রায়ের উত্তর পুরুষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০খ্রি;–১৭৮২খ্রি;)নদিয়া রাজপরিবারের সর্বশ্রেষ্ঠ মহারাজা হিসাবে পরিগণিত।বাংলা সাহিত্য, বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালি হিন্দুসমাজের ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।তিনি বিদ্বানসংস্কৃত ও ফার্সিভাষায় শিক্ষিত, সংগীতরসিক ছিলেন। তীব্র রক্ষণশীল রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শাক্তপদাবলিকার রামপ্রসাদ সেন, অন্নদামঙ্গল কাব্য প্রণেতা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, বিদূষক গোপাল ভাঁড় প্রমুখ বাংলার প্রবাদপ্রতিম গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক। অন্নদামঙ্গলকাব্য তারই রাজসভার ফরমাসে রচিত হয়। কৃষ্ণনগরের জগদ্বিখ্যাত মৃৎশিল্পের সূত্রপাত তার সময়ে তারই উদ্যোগে ঘটে।বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজো ও নবদ্বীপ ধামে শাক্তরস প্রচলন কৃষ্ণচন্দ্র রায়েরই কৃতিত্ব।তিনিই ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দেবীর স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমার পূজার প্রচলন করেন।এর পরের বছর তথা ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে তার সুহৃদ ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী চন্দননগরে বিশ্ববিশ্রুত জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন।এছাড়াও রাজবাটী সংলগ্ন স্থানে পংখ অলংকৃত দুর্গাদালান নির্মান করেন।এর বিচিত্র কারুকার্য যেকোনো ব্যক্তির মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।দুর্ভাগ্যবশত নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাশেম। রাজবাটীর সুবিশাল পূজামণ্ডপ সত্যিই এক দর্শনীয় পুরা সম্পদ।পূজামণ্ডপের থাম,খিলান প্রভৃতিতেও আজও রাজকীয়তার ছাপ স্পষ্ট।বিভিন্ন পূজাপার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে যাত্রা,গান,কথকতা,তর্জাগানের আসর বসত রাজবাড়ি সংলগ্ন ময়দানে।কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে,পশ্চিমবঙ্গ-এর অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম পূজামণ্ডপ হওয়া সত্ত্বেও সংস্কার ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী পূজামণ্ডপের অবস্থা খুবই করুণ।বলাবাহুল্য,রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ই সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেছিলেন যা আজ সমগ্র বাংলাব্যাপী 'সর্বজনীন' রূপে পরিচিতি লাভ করেছে।এই রাজবংশের আরাধ্য দেবতা হলেন 'বড়োনারায়ন'।দোলপূর্ণিমার পর দ্বিতীয় একাদশী তিথিতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে এক বিশাল মেলা বসে।মেলাটি 'বারোদোলের মেলা' নামে প্রখ্যাত।বরনারায়ণের সাথে বারোটি কৃষ্ণমূর্তি সমম্বিত রাজবাড়ির মন্দির প্রাঙ্গণ সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এই সময়।তাই এই মেলা 'বারোদোলের মেলা' নামে পরিচিত।দোলযাত্রা ছাড়াও দুর্গাপূজা,ঝুলন উৎসব,জন্মাষ্টমী উৎসব সহ বিভিন্ন তিথি পূর্বরীতি অনুযায়ী রাজবাড়িতে আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়।তখন রাজবাড়ির পুজোর ঠাঁটবাট ছিলই আলাদা৷ হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া৷ ছাগবলি, নানা আয়োজনে এলাহি ব্যাপার থাকত৷ ঠাঁটের বাইরে ছিল মানুষের মঙ্গল কামনা৷ যাত্রামঙ্গলে তারই প্রতিফলন ঘটেছে৷ কী ছিল সেই প্রথার বিশেষত্ব? দশমীর দিন পুজো শেষে মহারাজারা ঠাকুরদালান থেকে শুভদৃষ্টি সেরে রাজপ্রাসাদে ঢুকতেন৷ শুভদৃষ্টির তালিকায় ছিল মোষ, ঘোড়া, হাতি, জ্যান্ত মাছ, সদ্য কাটা মাংস, দক্ষিণাবর্ত অগ্নি, গণিকা, ঘি, দই, ধান, আরও কত কী৷ দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে মহারাজকে দেখাতেন রাজপুরোহিত৷ বিশ্বাস ছিল, রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে এদের দর্শন রাজ্যের মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে৷ সেই যাত্রামঙ্গল এখনও টিকে আছে৷ কালের নিয়মে তার ভোলবদল হয়েছে৷ রাজতন্ত্র বহুদিনই অতীত।বহু প্রাচীন এই রাজবংশ বহু উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে আজ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে উপনীত হয়েছে।বর্তমানে এই রাজবংশের সিংহভাগ প্রতিনিধিই ব্যবসায়ীক কারণে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন।দুর্গা পুজোয় ও দোলযাত্রা উৎসবে সকলে মিলিত হন। আজও রাজবাড়ির প্রতিটি কণায় লুকিয়ে আছে কতশত ইতিহাসের গল্প,আজও রাজবাটীর প্রবেশপথে স্বমহিমায় দণ্ডায়মান তোরণ শত শত বছরের কতশত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকরে আসছে,আজও প্রবেশদ্বারের মুখে অবস্থিত সুগভীর গড় কিমবা রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন আমবাগান ইতিহাস সচেতন মানুষের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।আজও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বুকে তৈরি হয় হাজারো নিত্যনতুন গল্প।কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস সমৃদ্ধ সেইসব গল্প হারমানায় সহস্র আরব্য রজনীকে।এর কোনো অতীত নেই।নিজেই নিজের চিরপ্রবাহিত গল্পকথা। ।।ইতিহাস নয়,এখানেই শেষ হল নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজের কাহিনী।। ★যেহেতু তথ্য সংগৃহীত তাই ত্রুটি মার্জনীয়। ★তথ্য সহায়তাঃ- ১)স্থানীয় মানুষজন, ২)নদীয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থ। ★চিত্র সহায়তাঃ- ১)পৃথ্বীশরাজ কুন্তী, ২)ঋতম প্রামাণিক, ৩)সৌম্যদীপ পাল। Post By:- Prithishraj Kunti
1 Comment
G A Krishna
9/23/2020 07:59:02 pm
এত কথা যখন বললেন, তখন সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তার অন্যতম মুখ্য কারিগর হিসাবে কৃষ্ণচন্দ্রের নাম এড়িয়ে গেলেন কেন? সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে যারা হাত মিলিয়েছিল তাদের মধ্যে পরোক্ষভাবে মীর কাশিম নিজে একজন হলেও, নবাব হওয়ার পর তাদের সাথে বিরোধীতার সূত্রেই সপুত্র কৃষ্ণচন্দ্রকেও মৃতুদণ্ড দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কৃষ্ণচন্দ্র একদিকে অনেক গুণের অধিকারী হলেও অন্যদিকে তাঁর মধ্যে বীরত্বের অভাব এবং ধূর্ততা ও কপটতার প্রাচুর্য ছিল। দিল্লীর সম্রাট ও ইংরেজদের কাছে অনেক উপাধি ও সম্মান পেলেও তাঁকে মুর্শিদাবাদের নবাবদের এবং পরে ইংরেজদের রাজকর্মচারীদের হাতে বারবার কারাবন্দী ও হেনস্থা হতে হয়। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামোকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেকবারই তিনি বাঙালী সমাজের উন্নতির সম্ভাবনাকে শুরুতেই ধ্বংস করেছেন।
Reply
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |