একঘেয়েমি জীবনের স্বাদ বদল করতে চলুন ঘরে বসেই মানস ভ্রমণ করে আসি।
আমার স্মৃতি রোমন্থন আর আপনাদের ক্ষনিকের মধুর মুহুর্ত যাপন। প্রতি বছরই বাক্সপ্যাঁটরা গুঁছিয়ে ইতিউতি ছুটে বেড়াই। যাকে বলে পায়ের তলায় সর্ষে। আমার পছন্দের তালিকায় সর্বাগ্রে স্থান পায় জঙ্গল। তার নিস্তব্ধতা, তার অপার শান্তি আমায় নিশির ডাকের মত হাতছানি দেয়। সেই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। অতএব সেই নিশির ডাকের বশবর্তী হয়ে গন্তব্য নির্বাচিত হলো আসামের মানস জাতীয় উদ্যান। ছবির মত ছোট্টো স্টেশন নিউ বঙাইগাঁও থেকে আমাদের যাত্রা হল শুরু। এপ্রিল মাসের প্রথম দিক, প্রকৃতি অতি মনোরম, সবুজে মোড়া গ্রাম, ছোট ছোট নদী, চারপাশের দৃশ্যাবলী যেন পটে আঁকা ছবি। চেটে পুটে নিচ্ছিলাম প্রকৃতির রূপ। আর মনে মনে ভাবছিলাম---মিলন হবে কত ক্ষণে, আমার মনের মানসেরও সনে। ভাবনায় ছেদ পড়ল, পৌঁছে গেছি বাঁশবাড়ি--- এই যায়গা থেকেই মানসের জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হবে বন দপ্তরের কার্যালয় থেকে। গাড়ি থেকে একটু নামলাম বাঁশবাড়ির সৌন্দর্য কে আরএকটু নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ছোট্ট এক লোকালয়, চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ, চা বাগানের সমাবেশ।ঐ যায়গাটির প্রাকৃতিক শোভা ভাষায় প্রকাশ করা আমার মত আনকোরা লেখিকার পক্ষে অসম্ভব। আমার মত কংক্রিটের জঙ্গলে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিধারীদের চোখে ঘোর লাগায় এই আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। সেই ঘোর লাগা চোখ, ঘোর লাগা মন নিয়ে এগিয়ে চলেছি সমুখ পানে। পিছে পড়ে থাক সকল বাঁধন, পিছে পড়ে থাক পুরাতন নতুন পথের হাতছানিতে হরিৎ ক্ষেত্রে হারাক এ মন। ঘোর কাটলো স্থানীয় এক মহিলার ডাকে। আমায় আর অগ্রসর না হতে বলার কারণ হিসেবে তিনি বললেন গতকালই চা বাগানে চিতা বাঘের আর্বিভাব ঘটে ছিল। ফিরে এলাম আপন জগতে। ততক্ষণে কাগুজে নিয়মকানুনও সাঙ্গ। এবার জঙ্গলে প্রবেশ এবং আমার মনের মানসের সাথে মিলন। জঙ্গলের একটা আলাদা গন্ধ আছে। সেই গন্ধ মন কেমন করা, উদাস করা। মন ভাবছে কত কি, চোখ দেখছে সবুজ বনানীর অপূর্ব রূপ। হঠাৎ গাড়ির চালক বললেন একটু সাবধানে বসুন সবাই। গাড়ি একটু জোরে ছোটাতে হবে কারণ সামনেই হস্থীযূথ। বাঁ দিকে তাকাতেই সম্মুখ সাক্ষাৎ। খানিক উত্তেজিত দলের সর্দার। ভাবখানা এমন যেন আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্যই ওনাদের আগমন।কিছু দূর গাড়ির পেছন পেছন আবার এগিয়েও দিয়ে গেলেন। সুন্দর সুন্দর ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই মুহুর্তের বর্ননা যতই কাব্যিক শোনাক মোদ্দা কথা হল হাতির তাড়া খেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে ছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে।
অবশেষে পৌঁছোলাম আমাদের তিন দিনের আস্তানা 'মাথানগুড়ি বন বাংলোতে'। এক কথায় অনবদ্য বাংলোটির অবস্থান। সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মানস নদী। পরম মমতায় বাংলোটি কে আগলে রেখেছে সুবিশাল বৃক্ষরাজি, ফুলের গাছ। পাখিদের কলকাকলিতে, বাঁদরের বাঁদরামিতে সরগরম আমাদের আস্তানা। বাংলোর কাঠের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মানস নদীর অপর পাড়ে ভূটানের রয়্যাল মানস জাতীয় উদ্যান। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল সময় থমকে যাক্, এই নিস্তব্ধতা, এই সবুজ বনানী, ঐ অনুচ্চ পাহাড়, নদীর জলতরঙ্গের মাঝে। সকল চাওয়া পাওয়া, অভাব অভিযোগ কে জলাঞ্জলি দিয়ে এক নতুন মানবজীবন প্রাপ্ত হোক। ভাবের জগৎ থেকে ফিরতে হল বাস্তবতায়। দ্বিপ্রাহরিক আহারের সময় হল।
পেট পুজোর পর জঙ্গল ভ্রমণের পালা। জঙ্গলে ভ্রমণ কালে সর্বদা যে জীবজন্তুর সাক্ষাৎ মিলবে এমন কিন্তু নয়। এই জঙ্গল তাদের চারণভূমি, আমরাই অনুপ্রবেশকারী। তাই তাদের বিন্দু মাত্র বিরক্ত না করে জঙ্গলের নিজস্বতাকে উপভোগ করাই বাঞ্ছনীয়। জঙ্গলের বাসিন্দাদের সাথে সাক্ষাৎ উপরি পাওনা মাত্র। ছায়াঘেরা বনপথ,উন্মুক্ত প্রান্তর, নীলাকাশ, নেপথ্যে হরেক রকম বন্য সুর মনকে এক অনন্য প্রাপ্তির পথে পরিচালিত করছিল। মনের গতি পথ দৃষ্টি পথকে অনুসরণ করে বাধাপ্রাপ্ত হল। আবার সাক্ষাৎ হস্তীবাহিনীর সাথে। ৩০/৩৫ জনের দল। নিজেতেই মগ্ন তারা। কাদা মাটি নিয়ে ক্রীড়া মগ্ন কেউ ,কেউ আবার আহারে ব্যস্ত। দলের কনিষ্ঠ সদস্যটি কেবল দস্যিপনায় মাতিয়ে রেখেছে চারপাশ। তাদের বিরক্ত না করে আমরা এগিয়ে চললাম। চলার পথে জলক্রীড়া রত গন্ডার যুগলের সাথে কনে দেখা আলোয় দৃষ্টি বদল ও হলো। আজকের মত সময় শেষ। সাঁঝের বেলায় বাংলো পথে গাড়ি ছুটলো। "জোনাকি কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছো,আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছো। বাংলোর বারান্দায় বসে জোনাকির আলোর নাচন দেখছিলাম। মিঠে বাতাস, নদীর জলধারার শব্দ, আহা! এই তো পরম প্রাপ্তি। পরের দু দিনও এ বেলা ও বেলা জঙ্গল আর জঙ্গলের রূপ আস্বাদন চলল সাথে পরম প্রাপ্তি হরেক রকম পাখি, ভাল্লুক, ভারতীয় গাওরের দর্শন। এরই মাঝে ঘুরে আসলাম ভারত ভূটান বর্ডার পেরিয়ে রয়্যাল মানস জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত পাহাড়ি পথে ভূটানের প্রথম গ্রাম (বর্ডার সংলগ্ন) পানব্যঙ।পথে যেতে যেতে চোখে পড়লো একাধিক হর্নবিল। চোখ জুড়িয়ে গেল পাখিটির রূপ দেখে। আসামে যে নদী মানস নামে পরিচিত, ভূটানে তারই নাম ড্রাঙমে চু।পাহাড়ি পথের ওপর থেকে দেখা নদীর রূপ অবর্ণনীয়। আরেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল মানস নদী তে রিভার রাফটিং এর সৌজন্যে। নদী বক্ষে জলযানের লম্ফঝম্ফ, হৃদয়ে ঘটাচ্ছিল হৃদকম্প। শেষের রাতটিকে প্রাণ ভরে উপভোগ করার জন্য মধ্য রাত পর্যন্ত বসেছিলাম বারান্দায়। মনের মানসকে মনের মধ্যে বন্দী করে এবার ফেরার পালা। ভ্রমণ হল জীবনের এস্কেলেটর, যা জীবনকে এক স্বপ্ন রাজ্যের উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় জীবন পরিপূর্ণ হয়। আমার আছে একটা আকাশ সবুজ পাহাড়, উতল বাতাস, আর আছে এক মন দৈনিকতায় হাঁপিয়ে ওঠে, স্বপনলোকে বেড়ায় ছুটে ভ্রমণ মাঝেই মুক্তি খোঁজে, রোজনামচায় সেই মুক্তি সুখের অনুরণন।.....
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |