সে এক সময় ছিলো ! আহা ভাবলেই আহ্লাদে গলে যেতে ইচ্ছে করে ! আমরা দেখতাম, লোকের খিদে পায় , ঘুম পায়, তেষ্টা পায়, আমাদের থেকে থেকে বেড়ানো পায় ! 2012 সাল তখন | বৈকালিক চায়ের আড্ডায় আমার বাড়িতে দুই প্রাক্তন ছাত্র তথা আমার ডানহাত-বামহাত সোমনাথ-সৌমাল্য এবং দাদাস্থানীয় ভোলাদা । চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎই মনে হলো অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি ! সুতরাং চা উঠলো মাথায় ! আমাদের তখন বেড়ানোতে পেয়েছে, পকেট প্রায় গড়ের মাঠ কিন্তু ছোটো খাটো একটা ট্যুরে তো যেতেই হবে । অতএব যেমনি ভাবা তেমনি কাজ ! ঝটপট জায়গা ঠিক হয়ে গেলো !
ট্রেনের টাইম টেবিলে দেখলাম ভোর রাতে আড়াইটের সময়ে হাওড়া থেকে একটা প্যাসেঞ্জের ট্রেন ছাড়ে হাওড়া থেকে, খড়্গপুর লোকাল হিসাবে যায় কিন্তু মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ওটাই আবার টাটানগর প্যাসেঞ্জের হয়ে রওনা হয় । কিন্তু সমস্যা হলো, হাওড়ার পরে প্রথম স্টপেজ সাঁতরাগাছি, তাই ওই ট্রেন ধরতে হলে রাতে আড়াইটের মধ্যেই সাঁতরাগাছি পৌঁছতে হবে, নতুবা পরের ট্রেন ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরতে হবে, তাতে ভাড়াও বেশি আবার পৌঁছতেও অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে ! পকেট ও সময় দুইয়ের কথা ভেবেই আমার সঙ্গীরা ওই মাঝরাতের ট্রেন ধরাতেই সায় দিলো ! রাত নটার সময় আড্ডা ভাঙলো আর কয়েকঘন্টা পরেই আমাদের যাত্রা শুরু.... গন্তব্য ইতিহাসের ধল রাজাদের পীঠস্থান-- ধলভূমগড় | আমার বাড়ি থেকে সাঁতরাগাছি স্টেশনের দূরত্ব মাত্র দুই কিমি, ছাত্র সৌমাল্যও আমার পাশেই থাকে, আরও এক ছাত্র সোমনাথ থাকে স্টেশন থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে কিন্তু ভোলাদার বাড়ি তো কাসুন্দিয়ায় ! ভোলা দা বললো, "কুছ পরোয়া নেহি ! আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো" । সুতরাং পরেরদিন মাঝরাতে আমরা চার ভ্রমণ পাগল হাজির হলাম সাঁতরাগাছি স্টেশনে । ট্রেন প্রায় গড়ের মাঠ, তাই বাকি ঘুমের কিছুটা ট্রেনেই সেরে নিলাম সকলে| ধলভূমগড়ে ট্রেন পৌঁছলো প্রায় সকাল সাতটায় ।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে চা-বিস্কুট, গরম গরম কচুরি আলুর তরকারি আর বড় মাপের জিলিপি দিয়ে জলযোগ সেরেই, দরদাম করে একটা বড় ডিজেল অটো ঠিক করে ফেললাম ! তাতে সওয়ার হয়ে প্রথমেই গেলাম এখানকার প্রসিদ্ধ ধল রাজাদের প্রাচীন দূর্গা মন্দিরে ! কালো কষ্টি পাথরের তৈরি অভিনব দূর্গা প্রতিমার অসাধারণ রূপ! নিত্য পুজো তো হয়ই, তাছাড়া দুর্গাপূজা ও বাসন্তী দূর্গাপূজায় জাঁকজমক করে পুজো হয়ে থাকে, বিশেষতঃ শারদীয়া দুর্গাপূজায় ! মন্দিরের ভিতরের দিকে গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের দুইদিকে রয়েছে সিংহের এবং হস্তীর মূর্তি ।
পাশেই রয়েছে একটি শিব মন্দির, যেখানে তিনটি ভাঙা শিবলিঙ্গ রয়েছে । মন্দিরের পূজারী বললেন, মুঘল যুগে শের শাহের আমলে কিছু মানুষ অকারণে স্থানীয় হিন্দু মন্দিরগুলির সমস্ত মূর্তি ভাঙা শুরু করে, সেই ভাংচুর থেকে রেহাই পায়নি এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ গুলিও ! কিন্তু যারা এই শিবলিঙ্গ গুলি ভেঙেছিলো, কোনো অজ্ঞাত কারণে কয়েকদিন পরেই তারা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে ! ফলে বাকি মন্দিরগুলো এবং স্থানীয় অন্যান্য মন্দিরগুলোও রেহাই পায় ভাংচুরের হাত থেকে । এই মন্দিরে স্থানীয়দের বিবাহ হয় প্রায়ই, এবং স্মারক হিসাবে বরের টোপর রেখে দেওয়া হয় মন্দিরে । সম্রাট শের শাহ এর কানে এই খবর পৌঁছলে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং স্থানীয় মানুষের কাছে অবিলম্বে ক্ষমা চেয়ে ওই ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলি পুনর্নির্মানের আদেশ দেন তাঁর স্থানীয় প্রতিনিধিদের ! সে সময়ে মন্দিরের পূজারী স্বপ্নাদেশ পান যে, শিবলিঙ্গগুলির কোনোরকম প্রতিস্থাপন না করে ভাঙা অবস্থাতেই পুজো চালু থাকে যেন ! ফলে, মন্দিরের পুনর্গঠন হলেও মূর্তি বা শিবলিঙ্গগুলি একই অবস্থায় রয়ে যায় ।
এই মন্দিরের আশেপাশে আরও কয়েকটি মন্দির এবং রাসমঞ্চ আছে, সেগুলো ঘুরে দেখে রওনা দিলাম স্থানীয় শিল্পগ্রাম আমাডুবি-র দিকে ! আমাডুবি শিল্পগ্রামে বেশ কয়েকঘর শিল্পীর বসবাস ! পাশাপাশি ঝাড়খন্ড ট্যুরিজম এর শিল্পকেন্দ্র তখন সদ্য তৈরি হয়েছে, যেখানে পর্যটন ও শিল্পকলার বিকিকিনি একসাথে করা যাবে অদূর ভবিষ্যৎ-এ এমন কথা শুনে এসেছিলাম ! আট বছর আগের কথা, তাই এখন কি পরিস্থিতি সেটা জানা নেই, তবে যেটুকু ব্যবস্থাপনা দেখেছিলাম , বেশ ভালো লেগেছিলো ।
বিহারের মধুবনী শিল্প এবং বাংলার পট শিল্পের চর্চা এই গ্রামের বিশেষত্ত্ব বলে জানলাম স্থানীয়দের কাছে | এখান থেকে বেরিয়ে পাড়ি দিলাম পরিত্যক্ত ব্রিটিশ আমলের এয়ারবেস এর রানওয়ে দেখতে এবং তারপরে গ্রামের লাল মাটির রাস্তা ধরে সুবর্ণরেখা দেখতে | বর্ষার জলে তখন সুবর্ণরেখা টইটুম্বুর ! এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটো ছোটো টিলা আর শারদ প্রকৃতির মাঝে সুন্দরী সুবর্ণরেখা.... ঘরে ফিরতে কি আর মন চায় ! সেই সাতসকালে চা জলখাবার খেয়েছিলাম, স্নান হয়নি, ঘেমো গরমের মধ্যেও স্টেশনের কাছের শালবন ঘুরে নিলাম একঝলক ! এরপরে স্নান খাওয়া সেরে দুপুর একটার ঘাটশিলা লোকাল ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলাম । তথ্যমিত্রঃ ধলভূমগড় হাওড়ার দিক থেকে টাটানগরের দিকে যেতে ঘাটশিলার আগের স্টেশন । সব ট্রেন থামে না , তবে যেহেতু ঘাটশিলা থেকে দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি, তাই ঘাটশিলায় নেমে সহজেই এখানে আসা যায় । এখন অবশ্য ট্রেন বন্ধ আছে, কিন্তু হাওড়া-বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস রোজই স্পেশাল ট্রেন হিসাবে হাওড়া থেকে চলছে । তাই প্রাইভেট গাড়িতে না যেতে পারলেও উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ট্রেনেও যাওয়া যায় একবেলার জন্য । এখানে থাকার মতো জায়গা বিশেষ নেই, তবে বনবাংলোর বুকিং পাওয়া যায় । আমাডুবিতে শিল্পীদের বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এছাড়া শিল্পগ্রামের গেস্ট হাউসে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন । রাত কাটানোর ইচ্ছে হলে অবশ্য ঘাটশিলাতেই কাটাতে পারেন কিম্বা গালুডিতে । সেক্ষেত্রে পুরদস্তুর দুরাত্রি তিনদিনের সফরে ফুলদুংরি পাহাড়, বিভুতিভূষণের বাড়ি, অপুর পথ , বুরুডি লেক, ধারাগিরি ফলস, জাদুগোড়ার জাগ্রত রঙ্কিণী মায়ের মন্দির, গালুডি ড্যাম, সুবর্ণরেখা নদী , নারোয়া ফরেস্ট ইত্যাদি জায়গা ঘুরে দেখে নিতে পারেন । তবে একবেলার বা একদিনের ট্যুরের জন্য শুধুমাত্রই ধলভুমগড় আদর্শ ।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |