অচেনা খাম. ( বোলপুর ভ্রমণ )........ রবিবারের আড্ডায় হঠাৎ ঠিক হলো এই প্রথম শীতে ছোট খাটো ভাবে একটা winter camp হয়েযাক l অনেক মতামতের পরে স্থির হলো শান্তিনিকেতন যাওয়ার l এই সময় শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ট্রেন এ যে টিকেট হবে না তা এই ভ্রমণ নেশাগ্রস্ত মানুষ গুলো জানে, তাই train এর টিকেট গুলো হলো সিউড়ি এক্সপ্রেস এ যাবার ও বিশ্ব ভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার এ ফেরার, দুটো গাড়িরই ভাড়া ২৯০ টাকা করে AC chair car . সকাল ৮.৩৫ এ সিউড়ি এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে ছাড়লো এবং ১২ তার পরিবর্তে ১২.২৫ এ শান্তিনিকেতন পিছালো l স্টেশন থেকে দুটো টোটো নিলাম ভাড়া ২০ টাকা মাথাপিছু, গন্তব্য santiniketan international guest house l তিন কিলোমিটার পথ 20 মিনিটে পেরিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন আমাদের সকলেরই বেশ খিদে ও ক্লান্তি লাগছিলো l এখানে এসে এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়লাম, জানতে পারলাম যে আমাদের book করা ঘর অন্য লোক কে দিয়ে দিয়েছে l আমাদের থেকে ভাড়া নিয়ে রশিদ দেবার পরেও কি করে অন্য ব্যক্তি কে সেই ঘর দিয়ে দেয় এটা আমরা বুঝতে পারলাম না l সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি, অনেক সরকারি গেস্ট হাউস এ থেকেছি কিন্তু এই বাংলায় এবং বিশ্ব ভারতীর মতো একটা সংস্থা ও সর্বোপরি যার নাম international guest house , সেখানে এমন বিশৃঙ্খলতা দেখে সত্যি সত্যি মর্মাহত হলাম l এটা বিশৃঙ্খলতা না অসাধু চক্রের শিকার তা বুঝলাম না l আমাদের গ্রুপ এর এক দাদা, ওনার নাম সুন্দর চৌধুরী, উনি আগেই এই বুকিং করেছিলেন l ভদ্রলোক খুব অপ্রস্তুত ও বিব্রত বোধ করছিলেন, ওনার স্ত্রী রিতু দিদি ও খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন.কিন্তু আমরা একদমই সুন্দরদাকে দোষী ভাবছিলাম না l মনে মনে সকলে এই dirty system কে ধিক্কার জানিয়ে অনত্র থাকার জন্য প্রস্তুত হলাম l অবশেষে শ্যামবাটিতে Birbhum Guest House এ জায়গা পেলাম , ম্যানেজার অসীম বাবু আমার পূর্ব পরিচিত l অত্যন্ত ভদ্র ও ভালো প্রশাসক, ছোট্ট গেস্ট হাউসটাকে ভালো খাবার, সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ন্যায্য মূল্যের মধ্যে বেঁধে রেখেছেন l সামনেই বাজার , সকালের লোকাল মাছের মেলা বসে l আপনার মন চাইলে নিজের ইচ্ছা মতো মাছ কিনে হোটেলে দিলে ওরা অতি সামান্য খরচ নিয়ে আপনার মনের মতো পদ আপনাকে রেঁধে দেবে lএই শ্যামবাটির বৈশিষ্ট হলো, এখান থেকে খোয়াইয়ের হাট , কঙ্কালী তলা , কোপাই নদী, আমার kuthi সায়ার বীথি ও বিশ্ববাংলা হাট খুব কাছে l এখন শ্যাম বাটিতে অনেক হোটেল হয়েছে যেমন মালঞ্চ, মনোরমা , নটরাজ, শান্তিনিকেতন রিসর্ট ও স্টিল অথরিটি এর গেস্ট হাউস আছে l ভাড়া ৪৫০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা DAB l বোলপুর স্টেশন থেকে ৩.৫০ কিমি আর প্রান্তিক স্টেশন থেকে ১.৫০ কিমি হবে lতবে খাবার দাবারের কোয়ালিটি ও টেস্ট ভালো বীরভূম গেস্ট হাউস এর l গনেশ নামের রাঁধুনির হাতে যেন জাদু আছে l দাম ও খুব সস্তা , যেমন মাছ বা চিকেন ভাত সাথে সবজি ভাজা,ডাল চাটনি ও পাঁপড় ১২০ টাকা পেট চুক্তি আর নিরামিষ ভাত ৭০ টাকা নিরামিষ রুটি ৬০ টাকা l তবে হাঁ খরচ একটু বেশি হলেও রাম শ্যাম রিসর্ট, সোনাঝুরি, এর খাবারের কোয়ালিটি অসাধারণ l এখন আর শান্তিনিকেতন থেকে ৭ কি মি ড্রাইভ করে বনলক্ষী যেতে হয়না l ১২০ টাকায় নিরামিষ থালা প্রায় ১১ পদে সমৃদ্ধ থাকে আর আমিষ থালায় ২৫০ থেকে শুরু l নিজেদের চাষের জৈব সার এর সবজি l ভারী সুন্দর এর পরিবেশ l কাঁসার থালা বাটি গ্লাস এ খাবার সাজিয়ে দেয় , আর থাকার ভাড়া ১৬০০ থেকে শুরু. ভুবন ডাঙ্গার একটা কাপড় জামার দোকান থেকে আজ এরা কত বড় জায়গায় পৌঁছেছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না l আরে এতক্ষন আপনাদের সাথে আমাদের এই winter camp এর সদস্যেরই পরিচয় হলো নাতো l এবার বলি আমায় নিয়ে আমাদের এই টীম এ ৮ জন ছিলাম l আমাদের ঘোরা পাগলদের একটা টীম আছে যা "Gang " নাম এ পরিচিত. এর ৪২ জন সদস্য ও সদস্যা l আজকের টীম -- "শ্রীলিপি দিদি , যার কথা শুরুতেই বলা উচিত , এই শ্রীলিপি দিদি অসম্ভব ভালো গান করেন ও গোটা টিমটাকে সর্বক্ষণ জমিয়ে রাখেন l কল্পনাদি, একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হলেও খুব ভালো মনের ও ভালো সুরেলা গলার l খুবই শান্ত মনের l সুন্দর দাদা, ওনার গান শুনলে মনটা যেন ভোরে যায় , সরলতা কাকে বলে তা ওনাকে দেখলেই বোঝা যায়, মানুষটা বড্ডো ভালো l ঋতুদি , খুব ঠান্ডা মানুষ , যেন শীতকালের ই একটা রূপ l ভালো গানের কণ্ঠ ও ভালো ভালো খাবার পরিবেশক l মেঘরাজ, খুব হাসি খুশি একটা চরিত্র, অবাঙালি হলেও রবিঠাকুর ওনার সারা মন জুড়ে, খুব ভালো সুরের দখল ওনার কন্ঠে l চূর্ণী দিদি , যেমন ওনার গানের গলা তেমন ওনার মিশুকে স্বভাব , এইবার আসছি শতদ্রু দিদি মানে আমি এনাকে ব্রাম্হনি বলে ডাকি,ভালো কবিতা লেখেন ও পাঠ করেন তার সাথে আছে ভারত নাট্টাম এর জাদু. তবে শুকনো পথেও আছাড় খান l বার বার যার কথা মনে হচ্ছে সে হলো গিয়ে দীপ , হাঁ ২০ বছরের একটি ছেলে, বিশ্বভারতী থেকে লেখা পড়া করে এখন টোটোর মালিক ও চালক l একেই বলাযায় সততার প্রতীক l আমার টাকার থলি ও ছাতা ওর টোটো তে ফেলে চলে এসেছিলাম, রাত্রি ১০.৩০ এ আমার হোটেলে এসে সব কিছু ফেরত দেয় l ফোন গুলো ওই ব্যাগে ছিল তাই ও যোগাযোগ করতে পারছিলো না l আমি ওকে টাকা দিয়ে ছোট করিনি , তবে হাঁ যখন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম তখন বীরভূমের সেধো মাটির একটা সরলতার গন্ধ প্রানটাকে জুড়িয়ে দিলো l আমিও এই লালমাটির দেশের লোক তাই ভুলে যাওয়া মুছে যাওয়া লালমাটির ধুলো গুলো আমার সারা শরীর জুড়ে লেপ্টে গেল l পরেরদিন ওর বাড়িতে গেছিলাম, ওর দিদার হাতে চুপটি করে ৫০০ টাকা দিয়ে বললাম যে আপনাদের জন্য একটু ফল মিষ্টি আনার ইচ্ছা ছিল তাই এটা, যদি নেন আমার ভালো লাগবে l আমি পরে আবার দীপের কথায় আসছি l খোয়াই এর হাট এখন কেমন জানি দিনকেদিন একটা শহুরে রূপ নিচ্ছে l সোনাঝুরির এক কোনে পরে থাকা শুধু শনিবারের হাট এখন রোজের হাট এ পরিণত হয়েছে l হাটের ব্যাপ্তি দিনকেদিন বেড়েই চলেছে l আর সবথেকে খারাপ লাগে যখন দেখি সোনাঝুরির ক্যানেলের ধারের লালমাটির পথটা কালো পিচে মুড়ে গেছে l এখন বোলপুরের রাঙামাটির পথ দেখতে গেলে যেতে হবে আমার কুঠি যাবার রাস্তা বল্লভপুর জঙ্গলের সেই পথটাই পরে আছে l আমার কুঠির মনির দোকানের মনমাতানো চা এর টানেই আমি বোলপুর গেলে অবশ্যই মনির দোকানে যাই l প্রদীপ বাউল মারা গেলেন l ও হাঁ আপনারা প্রদীপ বাউল কে কি করে চিনবেন,তবে যারা বারে বারে বোলপুরে যায় তারা নিশ্চই এই প্রদীপ বাউলের নামে না হলেও ওনার মুখের ছবি দেখলে চিনতে পারবেন, যিনি আমারকুঠিরের সামনে খিরিশ গাছের নিচে বসে সকlল থেকে সন্ধ্যা অবধি একনাগাড়ে গান গেয়ে সকলের মনে আনন্দ দিতেন l ভোর রাত্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিশব্ধে চলে গেল l সব থেকে দুঃখের বিষয় হলো যে এই বোলপুর শান্তিনিকেতনে এতো সনামধন্য মানুষজনের আসাযাওয়া ও বসবাস তবুও এখানে আজ অবদি কোনো বড়োসড়ো রোগের চিকিৎসা মেলেনা l বিশেষ করে হার্ট বা সেরিব্রাল নামক ভয়ঙ্কর অসুখের চিকিৎসা পাওয়া যায়না l এখানে যেভাবে হোটেল ব্যবসা ও ইমারত ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে , সেখানে একটা ভালো নার্সিং হোম বা হাসপাতাল হয়না কেন? বোলপুর শান্তিনিকেতনে এখন অনেক কিছুর রূপে রূপসী, যেমন আমাদের মন্দির, গুরুদেবের অস্তিত্ব যেখানে আজও প্রতি মুহূর্তে বিরাজ করেন l এই বিশ্বভারতী ছাড়াও হয়েছে বিশ্ববাংলা হাট , খোয়াইয়ের হাট , সায়ার বীথি,সৃজনী গ্রাম, কঙ্কালীতলা,আমার কুঠি, কোপাইয়ের পার , সোনাঝুরির পথ, প্রকৃতি ভবন ,বল্লভপুর জঙ্গলে eco park যেখানে সায়ার বীথির মতো জলকেলী করা যায়, আছে ডিয়ার পার্ক আর আছে সরলতায় ভরা আদিবাসী গ্রাম, প্রান্তিকের ধারের বাউল আখড়া l আবার যদি ভূতের বাড়ির ভুতুড়ে রূপ দেখতে চান তবে চলে আসুন রাইপুর গ্রামের পুরোনো জমিদারের বাড়ি l বহু বাংলা সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের শুটিং এখানে হয়েছে ও হয় l আমি তাই বলি "বারে বারে বোলপুর" l এবার শেষ করবো আমার লেখা, আমাদের ট্রেনের সময় ছিল সকাল ৬.২৬ এ তাই আগের দিন রাত্রে দীপ কে ফোন এ অনুরোধ করলাম সকাল পাঁচটায় আমাদের হোটেলে আসতে l ভাড়ার কথা চিন্তা করতে বারণ করলাম l ঠিক সকাল ৫টার সময় দীপ এসে হাজির আর ৫.৩০ এ স্টেশন l দীপ ও ওর বন্ধু আমাদের মালপত্র স্টেশন নামিয়ে দিলো , আমি ওকে ১৫০ টাকা করে আটো পিছু দিলাম কিন্তু ও ১২০ টাকা করে নিয়ে বাকিটা ফেরত দিয়ে চলে গেল l বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার 20 মিনিট দেরিতে স্টেশনে ঢুকলো. আমাদের কিন্তু এই ভর্তি ট্রেনেও কখনো মনে হলো না অন্যান্ন যাত্রীদের অপরিচিত l টুকটাক খাওয়া দাওয়া শুরু হলো সাথে গান সবাই যখন গান গাইছি তখন আমাদের পাশের আসনে বসা একটি ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে আমাদের অচেনা ভেবেও আমাদের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলো " কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া। চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি। ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের ... " দেখে খুব ভালো লাগলো. সরলতা এখনো মরে যায়নি l বোলপুরে বাপের বাড়ি, একটা মিষ্টি বাচ্চা কে নিয়ে কোলকাতায় ওর বরের কাছে যাচ্ছে. খুব মিষ্টি ওর কণ্ঠ ও সুরের দখল l ওর নামটা হচ্ছে পূর্বl মুখার্জী l এবার টিকিট চেকার এলেন, আমি আমার ব্যাগ থেকে টিকিট বার করতে গেছিলাম তখন বুঝলাম ব্যাগের মধ্যে একটা অচেনা খাম l চেকার যাবার পরে কৌতূহল বসতো ক্ষlম টা খুললাম , খুব অবাক হলাম , খামে ৫০০ টাকা আর একটা চিরকুট তাতে লেখা " কাকু মাফ করবেন টাকাটা নিতে পারলামনা কারণ কোনো অনুদান আমরা নিতে পারিনা , পদবীতে আটকে গেছে l কাকু আমাদের খিদে পায় আমরাও তো গরিব কিন্তু কেন বলুনতো সরকারি নিয়মে আমরা অনুদান পাবনা ? আমাদের সম্ভ্রান্তের তকমা লাগিয়ে বঞ্ছিত করা হচ্ছে নয় কি? পেটের জ্বালা তো সবাইকেই দিয়েছেন সৃষ্টি কর্ত্তা,তবে আমার খিদেটা কেন মূল্যহীন? যেদিন সরকারি ভাবে আমার দারিদ্রতা স্বীকৃতি পাবে সেদিন ই আমি অনুদান কে হয়তো দয়া মেনে নেবো না l স্বামীজী, মহাত্মাজী, গুরুদেব , কাজী সাহেব, রামমোহন রায় , বিদ্যাসাগর মহাশয় এনারা সমাজটাকে শ্রেণী বিভাজন মুক্ত করবার লড়াই করে ছিলেন,আর কারা যেন সেই সমাজকেই ধর্মে বিভাজন , জাতিতে বিভাজন ও পদবিটাতেও বিভাজন করলো l কাকু খিদে জিনিষটা তো সবার পেটে একই সুরে চিৎকার করছে , তবে আমাদের চিৎকার কেন গুরুত্বহীন বলতে পারেন."??? দ্বীপের কথা ভাবতে ভাবতে কখন হাওড়া পৌছালাম জানিনা l সবাইকে বিদায় জানিয়ে এই যাত্রাটা শেষ করলাম l যখন আমার গাড়ি এই শহরের ভিড়ে হারিয়ে গেল তখন আমি দীপের দেওয়া চিরকুটটা গাড়ির জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম ২ কোটি মানুষের এই শহরের শরীরে ll Post By:- Parthamoy Chatterjee
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |