লকডাউনের দিনগুলোর একঘেয়েমি থেকে বাঁচার জন্য মাঝে মধ্যেই সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ছি গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কলকাতার আশেপাশে একশো থেকে দুশো কিলোমিটারের মধ্যে ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে। গত রবিবার( ২০/৯/২০২০) গিয়েছিলাম ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনীর জঙ্গলের মধ্যে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দিরে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের গিধনি স্টেশন থেকে চিল্কিগড়ের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার এবং ঝাড়গ্রাম শহর থেকে ঠিক ১৮ কিলোমিটার দূরে। আমি কলকাতা থেকে খড়গপুরের চৌরঙ্গী হয়ে নিমপুরা, লোধাশুলী হয়ে সোজা কনকদুর্গার মন্দিরে ঢুকেছিলাম। লোধাশুলী থেকে কনকদুর্গার মন্দিরের দূরত্ব ঠিক ছাব্বিশ কিলোমিটার। নিবেদিতা সেতুথেকে ১৮৩ কিলোমিটার। চিল্কিগড়ের মূল আকর্ষণ হল, কনকদুর্গার মন্দির। দেবী কনকদুর্গা বহুকাল ধরে জামবনি তথা ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের আরাধ্যা দেবী।
জামবনীর এই জঙ্গলে প্রায় ৪৩৩ প্রজাতির গাছগাছড়া আছে। মন্দিরে ঢোকার পথে এবং তার চারপাশে ফরেস্ট বিভাগ থেকে প্রতিটি গাছের সঙ্গে তার প্রজাতির নাম উল্লেখ করা রয়েছে দেখলাম। লক্ষ করলাম যে দেবদারু, অর্জুন, নিম, বাবলা, বাঁদরলাঠির মত গাছ যেমন রয়েছে, তেমন বিরাজ করছে লং, পিপুল, গুলঞ্চ, পুনর্নবা, অতসী, মৃতসঞ্জীবনী ইত্যাদি গাছও। এইসব গাছগাছড়ার যেমন ভেষজ গুণ আছে, তেমন রয়েছে গ্রামীণ অর্থনৈতিক গুরুত্ব। ঝুড়ি বোনা থেকে শুরু করে নিমকাঠিতে শালপাতার বাসনপত্র তৈরি, খাড়াং জাতীয় গাছ থেকে তৈরি ভাল ঝাঁটা ইত্যাদি। নানাবিধ ফুল ও ফলের গাছ আর সেই গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখিদের আওয়াজ মন্দিরে তৈরি করেছে এক অদ্ভূত আশ্রমিক পরিবেশ। গাড়ি পার্কিং করে দেখলাম টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি প্রবেশমূল্য পাচটাকা। এবং গাড়ির পার্কিং মূল্য পঞ্চাশ টাকা। তারজালে ঘেরা জঙ্গলের পথ ধরে হাটতে হাটতে এবং পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছে।
ডুলুং নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কনক দুর্গা মন্দির। দেবী এখানে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা। দেবী চণ্ডীর একটি লোকরূপ হল কনকদুর্গা। দেবীর চারটি হাত। ওপরের বামহাতে পানপাত্র, নীচের বামহাতে ঘোড়ার লাগাম। ওপরের ডানহাতে খড়্গ আর নীচের ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। ওখানে গিয়ে শুনলাম, চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ তৈরি করেন এই মন্দির ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে মূর্তি তৈরি করান তিনি। ১৯৬৮ সালে দেবীর আদি মূর্তিটি চুরি যায়। সেই মূর্তিতে সোনার ভাগ ছিল বেশি। পরে তৈরি হয় অষ্টধাতুর মূর্তি। সত্তরের দশকের গোড়ায় সেই মূর্তিও চুরি যায়। তবে সে বার দুষ্কৃতীরা ঘোড়াটি নেয়নি। তারপর অষ্টধাতুর ঘোড়ার উপর প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি গড়া হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সালে ঘোড়াসমেত মূর্তিটি ফের চুরি যায়। এর পর দীর্ঘ ১৯ বছর মূর্তি ছাড়াই দেবীর পুজো হয়েছে। ১৯৯৬ সালে অষ্টধাতুর নতুন মূর্তি তৈরি করা হয়। সেটিই আবার চুরি হয় ২০১১ সালে। এখন আবার অষ্টধাতুর তৈরি মূর্তিতে পূজা হচ্ছে। ওখানে শুনলাম এখন অষ্টধাতুর মূর্তিতে পিতলের ভাগই বেশি । স্থানীয় লোকের মুখে শুনলাম, আগে নাকি ওখানে নরবলি হত। দেবীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বলি আজও হয়। পাঁঠাবলি, দূর্গাপূজার অষ্টমীর রাতে। কিন্তু বলির পাঁঠা দেবীর ভোগে দেওয়া হয় না। তবে পেঁয়াজ ছাড়া আমিস ভোগ হয়। মাছ এবং হাঁসের ডিম দেওয়া হয় আমিস ভোগে।
মন্দির বলতে দেখলাম, পুরনো আমলের যে মন্দির রয়েছে, সেটি বর্তমানে ভগ্নাবশেষমাত্র। শুনলাম প্রাচীনকালে কোন এক সময় এই মন্দিরে একটি প্রবল বজ্রপাত হয় যার ফলে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে সমান দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। প্রাচীন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ায় একই চত্বরে তৎকালীন রাজা জগদীশচন্দ্র দেও ধবলদেবের উদ্যোগে পাশেই নতুন মন্দির নির্মিত হয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। নতুন মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলী বেশ আধুনিক। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। একরত্ন মন্দিরের চূড়া গির্জার মত সুচালো। রয়েছে গর্ভগৃহ ও চারিদিকে খোলা বারান্দা। সামনের দিকে খানিকটা অংশ সিঁড়ির পর একটি টিনের বড় চালা, যাকে জগমোহন বলা হয়। এই প্রশস্ত জায়গাটিতে আছে বিরাট হোমকুণ্ড আর উত্তরে বলিদানের স্থান। মোষ বলির জন্য পোঁতা রয়েছে দু’টি মোটা কাঠ আর হাঁড়িকাঠ রয়েছে বলি দেওয়ার জন্য। ওড়িশা থেকে স্থপতি আনিয়ে পুরনো এবং নতুন দুটো মন্দিরই নির্মিত হয়। কথিত আছে যে, রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজের আমলে পাথরে খোদাই করা মূর্তির অনুকরণেই কনকদুর্গার বর্তমান বিগ্রহের রূপ। রাজা, রাজপুরোহিত ও ধাতুশিল্পী যোগী কামিল্যা, তিনজনেই দেবীর একই রূপ দেখেছিলেন স্বপ্নে। স্বপ্নাদেশের বর্ণনা অনুযায়ী দেবীর মূর্তি নির্মিত হয়। অশ্ববাহিনী, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা মূর্তি তৈরি হয় রানি গোবিন্দমণির হাতের সোনার কঙ্কন দিয়ে। সোনার দুর্গা তাই কনকদুর্গা মন্দির।
বন দপ্তরের উদ্যোগে কনকদুর্গা মন্দির চত্বরে নানা ধরনের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ঢোকার মুখে পিচরাস্তার ওপর তৈরি হয়েছে বিশাল ‘অশ্বদুয়ার’। দেবীর বাহন অশ্ব। তাই প্রকাণ্ড কংক্রিটের প্রবেশপথের মাথায় দু’টি ঘোড়ার মূর্তির মাঝে রয়েছে দেবীমূর্তির কংক্রিটের রেপ্লিকা। মন্দিরে যাবার পথ আজ কংক্রিটের ঢালাই রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে বাতিস্তম্ভ। মন্দির চত্বর জুড়ে তৈরি হয়েছে নীল-সাদা রঙের ফোয়ারা, সবুজ ঘাসের লন, পর্যটকদের বসার আসন, শিশু উদ্যানে রয়েছে দোলনা, স্লিপারের ব্যবস্থা। পুজোর সামগ্রী ও খাবার দোকানের জন্য কংক্রিটের সাতটি দোকান ও একটি গুদামঘর রয়েছেছে। হ্যা, সমস্ত মন্দির চত্বরেই হনুমানের উপস্থিতি, কিন্তু ওরা নিজেদের মতোই ঘোরাফেরা করছে।
মন্দিরের পাশ দিয়ে মোরাম বেছানো রাস্তা দিয়ে খানিকটা গিয়েই ডুলুং নদীর সাক্ষাৎ পেলাম। নামটি জলতরঙ্গের মত, কিন্তু চরিত্র দেখলাম একদম পাহাড়ি। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে তিরতির করে আপনমনে বয়ে চলেছে। নদীর বেড থেকে দু’পাশের পাড় অনেকটা উঁচু। ছোট্ট পাহাড়ি ডুলুং নদীর পূর্বদিকে জঙ্গলের অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে মন্দিরটির অবস্থান। চিল্কিগড় গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে গভীর শাল জঙ্গল। ডুলুং নদীটির গতিপথ পূর্বদিকে বইতে বইতে চিল্কিগড় গ্রামের উত্তর সীমানায় একেবারে সোজা দক্ষিণদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রায় সমকোণের সৃষ্টি করেছে। এই বাঁকটির বাঁদিকে কনকদুর্গা মন্দিরের জঙ্গল। খুবই ভালো লেগেছিল। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক ছিলাম, কারন ফেরার তাড়া। রাতে কোথাও থাকার উপায় নেই কারন করোনায় সংক্রমনের আশঙ্কা। অতএব সঙ্গে বগলদাবা করে নিয়ে যাওয়া খাবারের সদ্ব্যবহার করে আবার গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে, বাড়ির যাবার রাস্তার দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিলাম । পারলে ঘুরে আসুন, বিশেষ করে যারা আমার মতই লম্বা ড্রাইভিং করতে ভালবাসেন। রাস্তা পুরোটাই খুব ভালো। ভালো লাগবে।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |