ঘুরে আসুন পোড়ামাটির শহর বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুর : বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত , চোখ জুড়ানো টেরাকোটার মন্দিরের শহর এই বিষ্ণুপুর। অতীতে মল্লভুমের ( বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, কিছুটা মুর্শিদাবাদ আর বিহারের ছোটো নাগপুরের কিছু অংশ) মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল এই শহর। এই রাজাদের আমলেই গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুরের এই জগদ্বিখ্যাত মন্দির গুলি। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে এই সব মন্দির গুলি তৈরী হয়। বিষ্ণুর উপাসক মল্লরাজাদের পৃষ্ঠ পোষকতায় স্থাপত্যের উন্নতির সাথে সাথে সঙ্গীত চর্চা ( বিষ্ণুপুর ঘরানা) , বয়ন শিল্প ( যার পরবর্তী ফলস্বরূপ বাংলার বিখ্যাত বালুচরী, স্বর্ণচরী শাড়ি ), মৃৎশিল্প ইত্যাদির চরম উন্নতি হয়েছিল। এখানকার অসাধারণ নক্সা ও কারুকার্য করা দশ অবতার তাস আর পোড়ামাটির ঘোড়া, পোড়ামাটির বিভিন্ন সামগ্রী আর শাঁখাও বিখ্যাত। ১৯৯৮ সাল থেকে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরগুলি ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলি দুই ঘরানায় তৈরি। এর মধ্যে মদনগোপাল, নন্দলাল, রাধা গোবিন্দ, রাধা মাধব, লালজী মন্দিরগুলি ল্যাটেরাইট পাথরে গড়া আর মদনমোহন, মুরলী মোহন, জোড় বাংলা, শ্যামরাই ইটের তৈরি। বিষ্ণুপুরের প্রথম দর্শনীয় স্থান বিখ্যাত রাসমঞ্চ, যা ঝামাপাথরের তৈরি, যার উচ্চতা ৩৫ ফুট,চওড়ায় ৮০ ফুট, দেখতে পিরামিড আকৃতির। রাস মঞ্চের অনেকগুলি চওড়া খিলান যুক্ত বারান্দা অপূর্ব দেখতে লাগে। একটি বড়ো বেদীর উপর এই রাস মঞ্চ রয়েছে। এটি বাস স্ট্যান্ডের কাছে বিষ্ণুপুর কলেজে যাওয়ার পথে পড়বে। এটি কোনো মন্দির নয়, এতে কোনো বিগ্রহ নেই, সেকালে এখানে মহা সমারোহে রাস যাত্রা হতো। রাস উৎসবের সময় বিষ্ণুপুর শহরের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ এখানে আনা হত। ১৬০০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এখানে রাস উৎসব আয়োজিত হতো। এখান থেকেই ক্রমে রাসযাত্রা বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ে। মল্লরাজা বীর হাম্বীর আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মঞ্চটি নির্মাণ করেন। রাস মঞ্চের কাছেই দলমাদল কামান। ২৯৬ মণ ওজনের ১২ ফুট লম্বা এই মাকড়া পাথর গলানো লোহার তৈরি কামানটিতে এত বছরেও রোদ,জল বৃষ্টিতে মরচে পড়েনি। শোনা যায় যে, শত্রুদের হাত থেকে বিষ্ণুপুরকে রক্ষা করার জন্য মল্ল রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন নিজেই শত্রুদের উপর কামান দেগেছিলেন। এর পাশেই রয়েছে ছিন্নমস্তার মন্দির। আর তারপরই আছে যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন। এই সংগ্রশালাটিও যথেষ্ঠ আকর্ষণীয়। পাল, সেন, মল্ল, মুঘল যুগের নানান পুরাকীর্তি, পুঁথি, নক্সা,মূর্তির নিদর্শন দেখতে পাবেন। এরপর বিষ্ণুপুর কলেজ ছাড়িয়ে চলে আসুন লাল ইটের স্তূপ, এক সময়ের গুম ঘরে, যার বেশির ভাগ অংশ এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। একটু এগিয়ে এবার দেখবেন পাঁচ চূড়া বিশিষ্ঠ শ্যামরাই মন্দির। সমস্ত মন্দির জুড়ে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত আর তৎকালীন সমাজ জীবনের পোড়ামাটির অপরূপ ভাস্কর্য। ১৬৮৩ সালে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। শ্যাম রাইয়ের কাছেই রয়েছে রাধা শ্যাম মন্দির। এই মন্দিরে আজও পুজো হয়। মন্দিরে রয়েছে রাধে শ্যাম, গৌর নিতাই আর জগন্নাথের মূর্তি। মন্দিরের সামনে সুন্দর নহবৎখানা, এক সময় নিত্য নাচগানের আসর বসতো। মন্দিরের চতুষ্কোণ ছাদের চূড়া গম্বুজের মতো। মন্দিরের অন্দরমহলে আছে তুলসিমঞ্চ, নাট মঞ্চ আর রান্নাঘর। রাধা শ্যাম মন্দিরের পরেই রয়েছে মল্ল রাজ দেব সিংহের জোড় বাংলা মন্দির। মন্দিরটি পরস্পর সংযুক্ত দুটি দোচালা কুটিরের সমন্বয়ে গঠিত। সংযুক্ত অংশের মধ্যস্থলে একটি চারচালা শিখর রয়েছে। তাই একে জোড় বাংলা বলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী, সামাজিক জীবনযাত্রা ও শিকারের দৃশ্য অপূর্ব টেরাকোটার কারুকার্যে চিত্রিত। এই মন্দির কৃষ্ণরায় মন্দির বলেও পরিচিত। রাধা শ্যাম মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দির, ৯৯৭ সালে মল্লরাজা জগৎমল্ল -এর তৈরী মন্দির, মৃন্ময়ী মাতার মন্দির। এই মন্দিরে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই মন্দিরের পিছনে মল্লরাজাদের রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বর্তমান। এই মন্দিরের উত্তর -পূর্ব কোণে রয়েছে লাল জিউর মন্দির। এই মন্দির ছাড়িয়ে একটু গেলে পড়বে দূর্গের তোরণ দ্বারের মতো মাকড়া পাথরের বড়ো পাথর দরজা আর ছোটো পাথর দরজা। বড়ো দরজা ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে পড়বে মদনমোহন মন্দির। ১৬৯৪ সালে, মল্লরাজা দুর্জন সিংহ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটির ছাদ চৌকো ও বাঁকানো, কিনারা বাঁকযুক্ত ও মধ্যে গম্বুজাকৃতি শীর্ষ বর্তমান। মন্দিরের দেওয়ালে পোড়ামাটির কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপায়িত।এই মন্দিরেও পুজো হয় রাধা কৃষ্ণের। এরপর দেখে নেবেন , বিষ্ণুপুরের একমাত্র শিব মন্দির মল্লেশ্বর। এছাড়াও মন্দিরের শহরে আরও অনেক প্রাচীন মন্দির দেখতে পাবেন। মন্দির ছাড়াও মল্ল রাজাদের মহান কীর্তি এখানকার বড়ো বড়ো দিঘি, লাল বাঁধ, কৃষ্ণ বাঁধ, যমুনা বাঁধ, কালিন্দী বাঁধ, পোকা বাঁধ, শ্যাম বাঁধ দেখতে পাবেন। মন্দির দর্শন শেষ হলে, চলে আসুন বড়ো কালিতলায়, পাটরা পাড়ায়। এখানে তৈরী হিয় বিখ্যাত বালুচরী শাড়ি। তবে, মল্লভূম সিল্ক সেন্টার থেকে শাড়ি কেনাই ভালো। বিষ্ণুপুর গেলে অবশ্যই কিনতে ভুলবেন না এখানকার দশবতার তাস, এই তাসের খেলা মল্ল রাজারা খেলতেন এক সময়। কাপড় শুকিয়ে জোড়া দিয়ে গোলাকৃতি এই তাস গুলোয় আঁকা হয় বিষ্ণুর দশবতারের বর্ণময় অপরূপ চিত্র। 120 সেটের এই তাস সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। আর যদিও বাঁকুড়ার পাঁচ মুড়ায় তৈরী হয়, তবুও বিষ্ণুপুরের নিদর্শনের স্মৃতি বিখ্যাত টেরাকোটার ঘোড়াও কিনবেন মনে করে। এছাড়া , পুরাণের কাহিনীর সূক্ষ্ম কারুকার্য করা শাঁখ আর শাঁখা কিনতেও পারেন। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এখানে একটি মেলার আয়োজন করা হয়। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার মত এটিও খুব বিখ্যাত মেলা। তবে এই মেলা দেখতে হলে, আগে থেকে বিষ্ণুপুরের হোটেল বুকিং করে নেওয়া ভালো,না হলে থাকার জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল, হোটেল ওই সময় পাওয়া যায়না বললেই চলে। বিষ্ণুপুর থেকে কাছাকাছি ঘুরে নেওয়া যায় কংসাবতী নদীর উপর ড্যাম মুকুটমনিপুর, ঝিলিমিলি, মা সারদার জন্মস্থান জয়রামবাটি, শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুর। কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে খড়গপুর হয়ে বাঁকুড়ার পথে বিষ্ণুপুর। দূরত্ব ২০০ কিমি, সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। কলকাতা থেকে বাঁকুড়ার ট্রেনগুলি যায় বিষ্ণুপুর। আরামবাগ স্টেশনে নেমে কামারপুকুর, জয়রাম বাটি দর্শন করেও বাসে বা ট্রেকারে যাওয়া যায় বিষ্ণুপুর। কলকাতা থেকে সড়কপথে ধর্মতলা থেকে সরকারি, বেসরকারি বাস যায় বিষ্ণুপুর, সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। বিষ্ণুপুর পৌঁছে রিক্সা/অটো/টোটো ভাড়া করে দেখে নেওয়া যায় 3 থেকে 4 ঘণ্টায় বিষ্ণুপুরের দর্শনীয় স্থানগুলো। কোথায় থাকবেন : এখানে প্রচুর হোটেল আছে। WBTDC এর বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ 03244- 252013, বেসরকারি হোটেল উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- উদয়ন লজ : ০৩২৪৪-২৫২২৪৩ মোনালিসা লজ : ০৩২৪৪-২৫২৮৯৪, ৮১৪৫৬৮৪১৪১ হোটেল লক্ষ্মী পার্ক : ০৩২৪৪ ২৫৬৩৫৩ হোটেল অন্নপূর্ণা : ৭৪০৭৫০৪০০০, ৭৪০৭৫০৫০০০ তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা © কলমে : মিতা মন্ডল ছবি : Wikipedia, Google থেকে সংগৃহীত
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |