লাসায় চারদিন জামাল ভড় লাসাভ্রমনের শুরুতেই বিপত্তি । কোলকাতা থেকে ইস্টার্ন চায়নার বিমান প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ায় কুনমিঙে পঞ্চাশ মিনিট পরে বিমান পৌঁছানয় কুনমিঙ থেকে লাসার সংযোগকারী বিমান কুনমিঙ ছেড়ে চলে । কুনমিঙে আমাদের দো-ভাষী লিউ জিঙ ইস্টার্ন চায়নার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বিকেলের উড়ানে আমাদের বাইশজনের ব্যবস্থা করে দেয় । ফলে অহেতুক ছঘণ্টা কুনমিঙে অলসভাবে সময়কাটানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না । স্থানীয় সময় বিকেল সাড়েচারটায় কুনমিঙে বিমানে চড়ে আড়াই ঘণ্টার উড়ানে লাসায় যখন নামলাম তখন চীনের ঘড়িতে ছটা । রোদ-ঝলমলে লাসার আকাশ তখনও । বিমানেই ঘোষণা করে দিয়েছিল বাইরের তাপমাত্রা আঠার । লাসার দো-ভাষী তথা গাইড সোনম ও তেনজিং বিমানবন্দরের লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিল । তিন-তারকা যুক্ত হোটেল লাসা কিচেনের অদূরে গাড়ি থামিয়ে আমাদের যার-যার ঘরে তুলে দেওয়ার আগেই তেনজিং বলে দিয়েছিল রাতে তাপমাত্রা এক বা দুইয়ে নামবে । ওদেশে আবহাওয়া দপ্তরের আগামবার্তা যা বলে তাই যে হয় সেটা ওদেশে তেরদিন অবস্থানকালে মিলে যেতে দেখেছিলাম । লাসায় দেরিতে পৌঁছানোর ফলে আবহাওয়ার সাথে খাপখাওয়ার সময় আমাদের কমে গেল । পৃথিবীর অন্যতম উঁচু শহর লাসায় শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত কোন অসুবিধায় পড়ব না তো --এরকম একটা ভয় অনেকের মনে কাজ করছিল । আমাদের লাদাক ভ্রমনকালে আমার স্ত্রী এরকম একটা অসুবিধায় পড়েছিল । পৃথিবীর উচ্চতম সড়ক খার্দুঙলায় (১৮৩৬০ ফুট) আমার ভ্রমনসাথী শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত কষ্টে পড়লে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল । ওখানে ডায়ামক্স ট্যাবলেট দিয়েছিল । ফলে লাসায় যাওয়ার একদিন আগে থেকেই ঐ ট্যাবলেট খেতে শুরু করায় লাসায় নেমে কোন অসুবিধায় পড়েনি । আমাদের দলের উনাশি বছরের ভৌমিকবাবু প্রথমদিকে একটু অসুবিধায় পড়লেও ওষুধে পরে সামলে নিয়েছিলেন । তবে অশোকবাবুকে দেখলাম একটু কাহিল অবস্থায় । মুখে যদিও বলছিলেন ঠিক আছেন কিন্তু মন্থরগমন ও ঘনঘন বিশ্রামে সেটা বোঝা যাচ্ছিল । লাসা শব্দের অর্থ ভগবানের দেশ । অবশ্য তিব্বতীয় লিপিতে লাসাকে রা-সা বলা আছে । রা-সা মানে অজা-অবিদের স্থান । অর্থাৎ ভেড়াছাগলদের চারণভূমি । চতুর্দিকে পর্বতবেষ্টিত , মধ্যে সমতলভূমি --অজা-অবিদের উপযুক্ত চারণভূমি বটে । দেখলে মনে হবে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত । লাসানদীর দক্ষিণতীরে শহরটি ছড়িয়ে আছে । পৃথিবীর ছাদ নামে পরিচিত পামির গ্রন্থিমালায় অবস্থিত । তিনহাজার ছশ পঞ্চাশ মিটার বা বারহাজার ফুট উচ্চতার শহর লাসা পৃথিবীর ছাদে অবস্থিত । তিব্বতের সবচেয়ে জনবহুল শহর শিনিঙয়ের পর এই লাসাতেই জনসংখ্যা বেশি । লাসায় গাছপালা খুবই কম । বর্তমানে যেসব শ্যামলিমার দেখা মেলে তা বিগত ত্রিশচল্লিশ বছরে সৃজিত । পরিকল্পিত শহর । প্রশস্ত সড়ক । সড়কের পাশে পুষ্পতরুবৃক্ষ । মনে হবে পুষ্পমেলা বসেছে । নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী । লাসায় আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য ছিল পোটালা প্রাসাদ । সপ্তম শতকে নির্মিত এই প্রাসাদের নির্মানশৈলী এক বিস্ময় । একে তো লাসা উচ্চমালভূমিতে অবস্থিত তার উপর আবার এক উঁচু পাহাড়ের উপর দুর্গসম প্রাসাদটি অবস্থান । ফলে প্রাসাদের শীর্ষদেশ অবধি আরোহন এক দুরূহ কষ্টসাধ্য ব্যাপার । মনোবল ও হাঁটুর জোর দুটোরই দরকার । কথিত আছে তিব্বতীয় প্রাচীন রাজা সঙৎসেন গিয়ালপোর একাধিক স্ত্রীর মধ্যে দুজন ছিলেন নেপালী । সেই তাঙ বংশীয় দুই নেপালী স্ত্রীর জন্য রাজা এই প্রাসাদ নির্মান করেন । পরবর্তীকালে পঞ্চম দালাই লামার সময়ে এই দুর্গটি সংস্কৃত হয় । সংস্কারে সময় লেগেছিল তিন বছর । সপ্তম দালাই লামার আমল সতেরশ পঞ্চান্ন থেকে এখানেই ছিল শীতকালীন প্রাসাদ । চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিঙ গিয়াসতো তিব্বত ছেড়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন ১৯৫৯ সালে । চীন তিব্বত ১৯৫০ সালে টিবেট অটোনমাস রিজিয়ন গঠন করে কিন্তু ১৯৫৯এ তিব্বতীরা আন্দোলন শুরু করলে দালাই লামা ভারতে চলে আসেন । কী নেই এই পোটালা প্রাসাদে ? বৌদ্ধমন্দির , রাজপ্রাসাদ , বহুজনের আবাসস্থল ও প্রশাসনিক করণ --সব মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক কক্ষ । সপ্তদশ শতক থেকে প্রত্যেক দালাই লামার কাছে এটাই তিব্বতের জ্ঞহোয়াইট হাউসঞ্চ । এটাই রাজনৈতিক ভবন । এখানে রক্ষিত আছে তিব্বতীয় অসংখ্য দুষপ্রাপ্য অমূল্য সম্পদ ।আর আছে এখানে প্রয়াত দালাই লামাদের সমাধি । তিব্বতের দ্বার বহির্বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর পর্যটকরসিকরা যে-হারে এখানে ভ্রমন করেছেন চীনের অন্যত্রে তেমন একটা করেননি । এই প্রাসাদের চতুর্দিকের পরিধিতে ধার্মিক বৌদ্ধরা শুয়ে পড়ে গণ্ডি কাটে । প্রাসাদকক্ষের অভ্যন্তরে ছবিতোলায় নিষেধ থাকলেও বাইরে কোন মানা নেই । প্রাসাদের সর্বোচ্চ স্থানে উঠলে লাসা শহরের সম্পূর্ন দৃশ্য অবলোকন করা যায় । পোটালা প্যালেসের এক কিলোমিটার পশ্চিমে নরবুঙলা সামার প্যালেস আপাতত সংস্কারের জন্য বন্ধ আছে বলে আমাদের দেখা হয়নি । বর্তমানে এখানে একটা মিনি চিড়িয়াখানা আছে । এছাড়া লাসা মিউজিয়াম অন্যতম দর্শনীয় । এই মিউজিয়ামে ত্রিপিটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৌদ্ধলিপি , তিব্বতীয় তৈজসপত্র ও প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও বহু মূল্যবান জিনিস সংরক্ষিত আছে । পরের দিন আমরা গেলাম লাসার আর এক দর্শনীয় স্থান জোখাঙ মন্দির দেখতে । বিশাল চত্বর জুড়ে এই মন্দির । বৌদ্ধদের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান । বার্খোর স্কয়ারের মুখ করে এই মন্দিরটি অবস্থিত । এই পবিত্র মন্দিরটিও তেরশ বছরের পুরানো । চারতলাবিশিষ্ট এই মন্দিরটিতে শাক্যমনি বুদ্ধের মূর্তি আছে ও এটি উপাসিত হয় । বৌদ্ধরা এই মন্দিরের চারপাশে ঘড়ির কাঁটার মতো প্রদক্ষিণ করে । এই প্রদক্ষিণ করাকে জ্ঞকোরাঞ্চ বলা হয় । মন্দিরের বাইরে বার্খোর স্ট্রীটে বিশাল বাজার । সেই বাজারে পসরা সাজিয়ে বসে আছে তিব্বতীরা যাদের মধ্যে অধিকাংশ মহিলা । কী নেই সেই বাজারে ? তিব্বতীয় হস্তশিল্প থেকে সমগ্র চীন তথা বহির্বিশ্বের সব কিছুই পাওয়া যায় । তিব্বতীয় খাবার পরখ করার পক্ষে এটা খুবই উৎকৃষ্ট স্থান । সবসময় এই বাজার গমগম করছে লোকের ভিড়ে । লাসায় একদিন গাইডছাড়া যে প্রবল ভাষাসমস্যায় পড়েছিলাম সেটা না বলে পারছিনে । একদিন বৈকালিক প্রার্থনা সেরে লাসার প্রধান মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি একদল লোক চা খাচ্ছে । কিন্তু চায়ের দোকানটা যে কোঠায় তা ঠাহরে এলো না । তাই পরিষ্কার ধীর উচ্চারনে ইংরাজিতে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় চা পেতে পারি । বোঝা তো দূরের কথা আমি যেন ভিন গ্রহের ভিনভাষায় ওদের সাথে কথা বলছি এমন ভাবে তাকাতে লাগলো । চা-চিনি-চামচ চীনা শব্দ জানা ছিল বলে জ্ঞচাঞ্চ জ্ঞচায়েঞ্চ জ্ঞচিয়াঞ্চ সব বলেও যখন কোন কাজ হলো না তখন কল্পিত চায়ের কাপ হাতে ধরে ইশারায় চা-পান করার অভিনয় করতে লাগলাম । দেখলাম এতেই কাজ হলো । একজন ছুটে গিয়ে বড় এক গ্লাসে চা এনে হাতে ধরিয়ে দিল । মুখে দিলাম । দুধ-চিনি ছাড়া মাখন মিশ্রিত গ্রিনটি । সম্পূর্ন ভিন্নস্বাদের । দাম পরিশোধ করতে যেই একটা দশ ইউয়ানের নোট হাতে দিতে গেলাম অমনি দেখি আমার হাতটা ধরে আমার পকেটেই ঢুকিয়ে দিল । আমার লাসা ভ্রমনের অন্যতম কারন স্কাইট্রেন চড়া । বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশে স্কাইট্রেন থাকলেও লাসা থেকে শিয়ান পর্যন্ত এই ট্রেনে চড়ার আনন্দই আলাদা । আমাদের গন্তব্যও তাই । আগে থেকেই জানতাম তেত্রিশ ঘন্টা এই স্কাইট্রেনে চড়ে আমরা টেরাকোটার শহর শিয়ান যাব । লাসা ট্রেনস্টেশানে যথাসময়ের পূর্বেই পৌঁছলাম । তেনজিংনাম্নী মহিলা গাইড আগেই বলে দিয়েছিল এই ট্রেনে লটবহর থেকে যাত্রীদের সম্পূর্ন পরীক্ষা করে দেখা হয় কোন অনিষ্টকর বস্তু সঙ্গে আছে কি না । আমাদের বাইশজনের দলের লোকের যাতে দেরি না হয় সেজন্য গাইড সোনম আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল । ফলে কোন বেগ পেতে হয়নি । নির্ধারিত সময়েই ট্রেন ছাড়লো । তেত্রিশঘন্টা এই ট্রেনে থাকতে হবে আমাদের । একটা অদম্য আগ্রহ ছিল । ট্রেনে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় । প্রত্যেক কুপে ও করিডোরে অক্সিজেন নির্গমনের ব্যবস্থা আছে । কোন যাত্রী অক্সিজেনের ঘাটতি অনুভব করলে ওখানে দাঁড়ালে অতিরিক্ত অক্সিজেন পাবে । ঘুমকে বোতলবন্দি করে রেখে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম । একসময় এলো নাগচু স্টেশান । প্লাটফর্মেই লেখা আছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নাগচুর উচ্চতা । চৌদ্দহাজার ছশ উনচল্লিশ ফুট ।আগ্রহ ছিল কখন আসবে তাঙগুলা পাস । ষোলহাজার ছশ চল্লিশ ফুট উচ্চতায় এই পাসের উপর দিয়ে ট্রেন যাবে । একটু নেমেই ঐ নামে একটা স্টেশানও আছে । পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশান । আগে আমরা গর্ব করতাম ঘুম রেলস্টেশান নিয়ে । সেই গর্বও আমাদের চূর্ণ । এর পরের আকর্ষণ ছিল ফেঙহুয়োশান টানেল । ষোলহাজার তিরানব্বই ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই টানেলের দৈর্ঘ চারহাজার নশ পাঁচ মিটার । পৃথিবীর সর্বোচ্চে ও দীর্ঘতম টানেল । যে-সব স্টেশানে ট্রেন একটু বেশিক্ষণ থামে সেখানে নামছিলাম । ঝাঁচকচকে প্লাটফর্ম । শেষরাতের বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল । অধ্যাপক নন্দীবাবুর ডাকে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম । বাইরে তাকিয়ে দেখি রাক্ষসতাল হ্র্রদ । এই লেকের পাশ দিয়েই মানস সরোবর যাওয়ার পথ । রেললাইনের অদূরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই লেক । এমন নৈসর্গিক ও নয়নাভিরাম লেক আগে কখনো দেখিনি । চোখফেরানো দায় । পলক পড়তে চায়না । হিন্দুপুরানে কথিত মানস সরোবরের সাথে এই রাক্ষসতাল লেকের সংযোগ ঘটিয়েছে গঙ্গা ছু নামে একটি নদী । পুরাকালের ঋষিরা এই লেকে নির্মলজল সরবরাহের জন্য এই নদীর সৃষ্টি করেন । অবশ্য বৌদ্ধশাস্ত্রানুযায়ী ভিন্ন কিংবদন্তী । মানস সরোবর সূর্যের আকৃতিবিশিষ্ট আর রাক্ষসতাল অর্ধাচন্দ্রাকার আকৃতিবিশিষ্ট । যা হোক শেষ অবধি এই নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে করতে কখন যে টেরাকোটার শহর শিয়ান পৌঁছলাম তা খেয়ালই করিনি । Post By:- Jamal Bhar
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |