শিমুলতলার গল্প শোনাতে বসলে রাজবাড়ী আর লাট্টু পাহাড়ের কথা বলতেই হয়। ঢেউ খেলানো উপত্যকায় ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা বন জঙ্গল। আর চারিদিকে যতদূর চোখ যায় সেই দিগন্ত রেখায় টিলা পাহাড়ের ধুমায়মান নীলচে উপস্থিতি। পাখির কলরবের সাথে তাল মিলিয়ে যখন পালকের মত মেঘ গুলো সরে গিয়ে সূর্যদেব কে একটু জায়গা করে দেবে, তখন সেই স্নিগ্ধ আলোয় লাট্টু পাহাড় শিমুলতলার ক্যানভাসে ফুটে উঠবে। সেখান থেকে ঈশান কোনের দিকে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন সেই অভিমানী রাজপ্রাসাদটিকে। ইতিহাস হয়তো আছে কিছু, তবে আমার মনে হয়েছিল যেনো কোনো এক রূপকথার দেশে এসে পড়েছি আর ওরা কোনো এক চুপকথার গল্প বলতে জড়ো হয়েছে।
আঁধার থাকতেই ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়েছি পায়ে হেঁটে। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মাটির রাস্তা। জল কাদা ভেদ করে এগিয়ে চলেছি। প্রায় জনশূন্য পথ। পালভিলার নেমপ্লেটে বাংলা হরফ দেখে মনটা ভরে গেলো। পাখিগুলো ডেকে চলেছে। বউ কথা কও, টিয়া, শালিক। দুপাশের ঝোপে হলুদ সবুজের ফিউশন। বুনো ফুলের গন্ধ। রাস্তাটা একটু বাঁক নিয়েছে। আর সামনেই দেখি পাহাড়ের কোলে সুজ্জিমামা উঁকি মারছে। ঠিক যেনো ছোটবেলায় আঁকা ছবি। অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলাম। লাট্টু পাহাড়ের কোলে সূর্যদয়! সূর্যোদয় দেখে গুটি গুটি এগিয়ে চললাম রাজবাড়ীর দিকে। সোজা পথে না গিয়ে কিছু পুরনো বাড়ি ঘুরে সবুজ মাঠের শিশির মাখতে মাখতে গিয়ে পড়লাম রাজবাড়ীর দিকে। স্থানীয় কিছু লোক শরীর চর্চা করছে। আর সামনে প্রকণ্ডকায় সেই রাজবাড়ী। অভিমান করে যেনো স্বেচ্ছায় বনবাস নিয়েছে। একসময় যার একদিকে থাকতো হাউস অব লর্ডস, আর অন্য দিকে হাউস অব কমনস্। আজ সে নিজেই যেনো কোণঠাসা। জানলা দরজা কিছু নেই। ফোকলা বুড়ো। কেউ এলো কি গেলো, কোনো তোয়াক্কা করেনা। অনেকটা সেই জলসাঘর সিনেমার বৃদ্ধ ছবি বিশ্বাসের মত ঠুনকো অহংবোধ। আমি বলবো ভিতরে না যেতে। কারণ সেদিনের সেই হাসিকান্না গুলো উপর থেকে ছাদ ভেঙে ইটের শক্ত কবরে হারিয়ে গেছে। আমি আর কবর খোঁড়ার চেষ্টা করিনি। প্রতিদিন একটা একটা করে পাকাচুলো ঝড়ে পড়ছে। যদিও নিজে ভিতরে গিয়ে এক দেওয়ালকে আলিঙ্গন করে জিজ্ঞেস করে এসেছি 'বুড়ো আর কতদিন?'
এবার ওকে বিদায় দিন। শুনেছি ঢাকার কোনো এক রাণীমা সাধের এই শিমুলতলায় এই প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন। তারপর তো ব্রিটিশদের সাথে চোখ রাঙানি, খাজনা না দিতে পেরে রাজত্ব গেলো পাটে। রইলো পড়ে বাড়িটুকু। তারপরে এই বুড়ো বাড়িটি ভারত পাকিস্থান দেখলো। পরে বাংলাদেশও তৈরি হলো। কিন্তু নতুন বা পুরাতন কেউ আমরা এইসব বাড়ীগুলো নিয়ে ভাবিনি। না আমি আর আপনাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত দেবো না। রাজবাড়িটির অনেক বয়স হলো। আমার আপনার সাধ্যের বাইরে ক্ষয়িষ্ণু এক মারণ ক্যান্সার। হয়তো মেরেকেটে আর পাঁচটি বছর। পারলে মাঝে গিয়ে একটা সেল্ফি তুলে আসুন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাড়িটিকে রেখে, সেটাই হয়ে থাকুক বাকি জীবনের পাথেয়।
লাট্টু পাহাড়ের নীচে এসে যখন দাঁড়ালাম, মনটা তখন হঠাৎ ভালো হয় গেল। শিমুলতলার প্রত্যেকের বয়স বেড়েছে, বাড়েনি শুধু লাট্টু পাহাড়ের। ছোট ছোট সিমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। একেবারে পাহাড়ের টঙে সেই মন্দিরটা আজও মায়াকারা। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ, তাই আকাশ মেঘলা। এই পাহাড়ের বিশেষত্ব হল, চোখের সামনে চারিদিকে দিগন্ত খোলা সমস্ত উপত্যকা উদ্ভাসিত। যেদিকে খুশি তাকিয়ে থাকুন। দূরে বন জঙ্গলের সারি, তারও দূরে টিলা টিলা শিমুলতলা। ফুরফুরে হওয়ার সাথে ফিরে আসতে বাধ্য সেই হারানো শৈশব। তবে একলা যাবেননা। গেলে পুরনো বন্ধুদের সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন। কোনো এক পাথরের উপর চেপে দূরের প্রেক্ষাপট দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়ে যাবে ছেলেবেলার কথা। একটা কথা বলে রাখি, হয়তো দেখবেন পাহাড়ের নীচে দিয়ে কেউ হয়তো পি এন পি সি করতে করতে এগিয়ে আসছে, আপনি স্পষ্ট শুনতে পাবেন। এতটাই শান্ত নিরিবিলি সে জায়গা। তবে খবরদার, আপনি যেনো ভুলেও কোনো মন্তব্য করে বসবেননা, কারণ নীচে থেকেও আপনার কথা পাহাড়ের গা বেয়ে ওদের কানেও পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। শিমুলতলা স্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার। আর হাওড়া থেকে শিমুলতলা ডাইরেক্ট ট্রেনও আছে। দুদিনের প্ল্যানে ঘুরে আসুন প্রকৃতি আর নস্টালজিয়া পরখ করতে। দূর্গেশ গড়ের গুপ্তধন-এর ক্লাইম্যাক্স আর সূর্য ডোবা সিনেমার সূর্যাস্ত দুটিই নাহয় শিমুলতলায় বসেই দেখে নেবেন।
1 Comment
Sujan Indu
11/6/2020 03:26:13 pm
Khub Sundor lalo apnar lekha ta ..
Reply
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |