"টিলায় ভিলায় শিমুলতলায়"
।। আরোগ্য নিকেতন।। """""""""'"'""""" "এই ওঠ!-ওঠ!-ওঠ!-আর বলবেন না!! এই ভাবেই আমাকে রোজ ওকে ওঠাতে হয়"!!! ----না, না এটা আমার কথা নয়।আমি বলছি সেই মহাপুরুষ "বিরিঞ্চি বাবা"র কথা! এখনো মনে পরলো না!তাহলে একটু খোলসা করেই বলি। ১৯৬৫সালে সত্যজিৎ রায় যে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন"মহাপুরুষ"সেই বিরিঞ্চি বাবা। তিনি রোজ সূয্যি মামাকে এই ভাবেই ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুলতেন।সেই চলচ্চিত্রের সুটিং হয়েছিল এই শিমুলতলাতেই। আজ আমার কলমে বাঙ্গালীর সেই বিখ্যাত পশ্চিম শিমুলতলার কথাই বলতে এসেছি। ছবি তোলার নেশা সেই সময় আমার ছিল না বললেই চলে। তাই ছবি সেরকম দিতে পারলাম না।কয়েকটা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে দিলাম। কিন্তু ঘোরার নেশা ওই যে কথা আছেনা! ---- "উঠলো বাই তো কটক যাই"। এই বাক্যটিকে যৌবনে একেবারে আপ্তবাক্য মেনে চলতাম। ব্যাগ প্রায় গোছানোই থাকতো,শুধু মনের মত সঙ্গী পাওয়ার অপেক্ষা।পেলেই ওয়ান-টু-থ্রী। সেবার পাঁচজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম হোলিটা এবার কাটাবো শিমুলতলায়।ব্যাস!নির্দষ্ট দিনে ট্রেন ধরে ফেললাম।রেল কলোনীর ছেলে হওয়ার সুবাদে চালক থেকে গার্ড,টিকিট পরীক্ষক সবাই কাকু। ওনারাও আমাদের এই বাউন্ডুলেপনাকে একটু বেশিই প্রশ্রয়ও দিতেন। গার্ডভ্যানে চেপে প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতেই পৌঁছে গেলাম শিমুলতলা। সূর্য তখনও উঠেনি।আধো অন্ধকারে ডুবে ছোট্ট ষ্টেশনের বাঁ দিকে একটা জায়গায় কয়েকজন লোক আগুন তাপছে। আমাদের মধ্যে এক বন্ধু আগে এখানে এসেছিল,সেই নিয়ে চললো। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শুরু করেছে শিমুলতলা।একটা বড় মাঠের মত জায়গা,শেষ মাথায় দূরে একটা স্কুল বাড়ি। রেল গেটের কাছে চা এর দোকানে চা খেয়ে পাশের ডেকরেটারের দোকানে পৌঁছে বন্ধু খোঁজ চাইলো "বিরিঞ্চি"র। না,না,এই "বিরিঞ্চি" সেই "বিরিঞ্চি" নয়!! এ এক বাংলোর কেয়ারটেকার।যথাসময়ে তাকে পাওয়া গেল,ডেকোরেটরের দোকানে প্রয়োজনীয় লেপ কম্বল, হ্যাজাক,বাসন কোসন এর অর্ডার দিয়ে চললাম "বিরিঞ্চির" সাথে। শাল ,সেগুন,মহুয়া,পলাশ, শিমুল ঘেরা লাল মোড়ামের পথ ধরে নির্দিষ্ট ঠিকানায়। ওরে বাবা!এতো দেখছি পেল্লায় বাংলো। বড় গেট,উঁচু পাঁচিল ঘেরা,কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে। রয়েছে হরেক রকমের ফল ফুলের গাছ। আর একটা বড় পাড় বাঁধানো গভীর কুয়ো। এর জলেই খাওয়া রান্না মায় স্নান করা। আপাতত স্নান করেই রাতের ক্লান্তি মিটিয়ে নিলাম। সারা রাতই প্রায় ঘুম হয়নি,ডেকোরেটরের মাল পোঁছাতেই একটু গড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হোলো। বিরিঞ্চিও চলে গেলো টিফিন ও বাজার আনতে। রান্না বান্না সব ওই করবে।চারদিকে এই রকম আরও কয়েকটা পেল্লায় পেল্লায় বাংলো। কোনো কোনো টার ভেতরে মানুষের সারা পেলাম,একটাতে দেখলাম দুটো বাচ্চা ছেলে ব্যাটমিনটন খেলছে।ঘোরার লোক ঐআমাদেরই মত আর কি!! এই বাড়ি গুলো সব কলকাত্তাইয়া বাবুরা স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য এক সময় তৈরি করেছিলেন। উনিশ শতকে ১৮৫৪ সালে হাওড়া--রানীগঞ্জ ট্রেন চলাচল পরেই কলকাতার বাবুদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পশ্চিমে যাওয়ার তাগিদ থেকেই মধুপুর-গিরিডি-শিমুলতলায় যা একসময় সাঁওতাল পরগনাই ছিল,সেইসব জায়গায় এই বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। ইংরেজরা যদি দেরাদুন-মুসৌরি-ডালহৌসি যেতে পারে তাহলে সেই সময়ের বাঙালি বাবুরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য যেমন এখানকার জল ও জলহাওয়া উপযোগী,তেমনই ছিল "ড্যাম চিপ"এখানকার সব জিনিসপত্র। সেই ড্যাম চিপ কথা থেকেই হয়তো "ড্যাঞ্চি বাবু" কথাটার প্রবর্তন। এক সময় এই সব জায়গা কে বাঙ্গালীর "আরোগ্য নিকেতন"ও বলা হোতো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও দেখার মধ্যে এখানে আছে নলডাঙ্গার রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। পাথরের ওপর দিয়ে তির তির কোরে বয়ে চলা চলা সুন্দর সুন্দর পাহাড়ি ঝোড়া।খুব সুন্দর লাগবে যখন আপনি লাট্টু পাহাড়ের ১০০০ফুট উচ্চতায় ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখবেন। পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে! আমরা চাদর পেতে সামনের বারান্দায় গিয়ে বসলাম টিফিন সহযোগে,ওদিকে হ্যাজাক জ্বালিয়ে রাতের খাবার তৈরিতে ব্যাস্ত বিরিঞ্চি,ঘরে ঘরে মোমবাতি।দুরের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে হোলির গানের সুর আর বাজনার আওয়াজ।হোলি যে এসে গেছে দোরগোড়ায়। মনে পরে গেল এই শিমুলতলাতেই সুটিং হওয়া তরুন মজুমদারের সেই বিখ্যাত ছবি "দাদার কীর্তি"তে শক্তি ঠাকুরের গাওয়া সেই গান:- "এলো রে এলো রে এলো হোলি এলো রঙ্গে রঙ্গে মন প্রান রাঙ্গা রাঙ্গা হোলো রে" শুনেছিলাম শিমুলতলায় ভুত আছে। রাতে খেতে বসে বিরিঞ্চি কে জানতে চাইলে ও বললো :- "ইহা ভুত ক্যাহা রহেগা,আদমী রহেনে কে লিয়ে জায়গা কম পর রাহ্যা হয়,তব্ হ্যাঁ! জঙ্গল পার্টি জরুর হ্যায়,আপ লোগ ফিকর মত কিজিয়েগা ,হ্যাম হ্যায় না"।। পরের দিন ভোরবেলায় উঠে চলে এলাম ঐ পাহাড়ি ঝোড়াটার কাছে,পা ভিজিয়ে ওকে বন্ধু কোরে এগিয়ে গেলাম বিরিঞ্চিদের গ্রামে। সারাদিন বাংলোর বারান্দায় ও সামনের রাস্তায় হোলির আনন্দে মেতে মনটাকেও সেই রঙ্গে রঙ্গিন করে রাতে আবার ট্রেন ধরলাম। বিদায় শিমুলতলা।
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |