স্মৃতি_সততই_মধুর_হোক_না_যতই_ভয়ংকর# সালটা ১৯৯১, সদ্য কলেজের গন্ডি পেরোনো আট যুবক যার কনিষ্ঠতম সদস্য এই অধম হঠাৎ ঠিক করে বসলো কোথাও যেতে হবে আর সে পাহাড় ই হোক বা সমুদ্র । সুবাস ঘিসিং এর কল্যানে দার্জিলিং তখন অবরুদ্ধ , পুরীও বাবা মায়ের সাথে বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে দলের বেশির ভাগ সদস্যদের ই, তাই সেটাও বাদ অথচ এমন কোথাও যেতে হবে যাতে পকেটের চাপ ও খুব বেশি না হয়। তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করা হলো নৈনিতাল এবং আলমোড়া, রানীক্ষেত ও কৌশানি। যদিও সেই সময়ে সমগ্ৰ ট্যুর যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ হওয়ার জন্য প্রায় বাতিল হয়ে যাচ্ছিল আর কি , কিন্তু মুশকিল আসান করে দিল আমাদেরই এক সদস্যের বন্ধু। যে খুবই কম খরচে নৈনিতালে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। তাই দেরি না করে অমৃতসর মেলে টিকিট কেটে ফেললাম লখনৌ অবধি সেখান থেকে মিটার গেজ ট্রেনে কাঠগোদাম ।দিনটি ছিল দূর্গা পূজার দশমীর দিন। যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে আমরা যাত্রা শুরু করলাম জীবনে প্রথম বারের মত সম্পূর্ণ অভিভাবক মুক্ত হয়ে।আটবন্ধু একসাথে মুখোমুখি আটটা বার্থে। কিভাবে যে সময় কেটে গেল তা বলে বোঝানো যাবে না। পরেরদিন বৈকাল নাগাদ পৌঁছে গেলাম লখনৌ । ঐদিনই রাত্রি ১১ টা নাগাদ চেপে বসলাম কাঠগোদামগামি মিটারগেজ ট্রেন নৈনিতাল এক্সপ্রেসে। অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। মাঝরাতে কোন এক অনামি অজানা ষ্টেশনে প্রায় বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকল এবং যথারীতি বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরি করে গন্তব্যে পৌঁছাল। কাঠগোদাম ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার ছিল আমাদের এক বন্ধুর দাদা তাই আগে থেকেই জানানো ছিল । ষ্টেশনে ট্রেন পৌঁছানো মাত্রই মাইকে আমাদের নাম ঘোষণা করা হলো এবং সত্বর ষ্টেশন মাষ্টারের সাথে দেখা করার অনুরোধ জানান হলো। সত্যিই নিজেদের তখন কেউকেটা মনে হচ্ছিলো । তাই সোজা ষ্টেশন মাষ্টার এর ঘরে গিয়ে দাদার সঙ্গে দেখা করলাম এবং প্রাতরাশ করে তবে ছাড়া পেলাম। তবে দাদা অনেক বার আমাদের যেতে বারণ করেছিলেন নৈনিতাল এবং এও বলেছিলেন একদুদিন ওনার কাছে থেকে বাড়ি ফিরে যেতে এবং ফেরার টিকিট এর সম্পূর্ণ ব্যবস্থা উনি করে দেবেন। কিন্তু অতো দূর গিয়ে ফিরে আসার কোন ইচ্ছাই আমাদের তখন ছিল না। আবার নির্দিষ্ট কারনও বলেছেন না। তাই ওনাকে বিদায় জানিয়ে উঠে বসলাম নৈনিতালগামী বাসে। বিকেলের আগেই পৌঁছে গেলাম বহু কাঙ্ক্ষিত সেই নৈনিতালে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেলাম সেই সিমের আকৃতির নীলাভ সবুজ জলের সরোবরের যার সৌন্দর্যের আরো বিকাশ করেছিল তিনকোনা রঙিন পালতোলা ছোট্ট ছোট্ট নৌকা যারা ইয়েট নামে পরিচিত। লেকের ধারে রাস্তা তার ঠিক পাশেই আমাদের হোটেল যার নাম আজ আর মনে নেই তবে লেকভিউ সেই হোটেল সত্যিই সুন্দর ছিল। হোটেলে চেকইন করার পর একটু ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম ডাইনিং রুমে। সেখানে হঠাৎ চোখ আটকে গেল টিভির নিউজে সেখানে তখন একটাই খবর চলছে Earthquake in Uttarkashi Garhwal region... Epicenter near Nainital .. Richter scale 7 ....1000 deaths..। শিরদাড়া দিয়ে হিমশীতল শিহরণ খেলে গেল এবং মাঝরাতে ট্রেনের দাঁড়িয়ে থাকা বা ষ্টেশন মাষ্টার দাদার বারনের কারন জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। সেইসময় মোবাইল তো দূর অস্ত বাড়িতে বাড়িতে টেলিফোন ও ছিল না। ছুটলাম STD বুথের দিকে গিয়ে দেখলাম বিরাট লাইন, সবাই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও দাঁড়িয়ে পরলাম এবং পাড়ার দোকানে যার কাছে সেইসময় ফোন ছিল জানালাম আমাদের নিরাপদ থাকার বার্তা। ওনার কাছে জানতে পারলাম আমাদের প্রত্যেকেরই বাড়িতে রিতিমত শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং লোকাল থানায় যোগাযোগ করা হয়েছে। যাইহোক উনি আমাদের নিরাপদ থাকার বার্তা খুব ই তাড়াতাড়ি প্রত্যেকের বাড়িতে জানিয়ে আশ্বস্ত করেন, এরজন্য এতবছর পর ও আমরা কৃতজ্ঞ। পরদিন সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে প্রাতরাশ করে বেরোলাম লেক বা তাল ভ্রমণে, উঃ প্রদেশ ট্যুরিজম এর বাসে। তখন ই ধীরে ধীরে বুঝলাম যে প্রাকৃতিক ধংসলীলা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।গ্ৰামের পর গ্ৰাম সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যাইহোক আফটার শক তখন ও চলছে তাই বাস ড্রাইভার ও ধসপ্রবন এলাকা এড়িয়ে আমাদের যাত্রা কে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছিলেন। আশপাশের লেক গুলোর মধ্যে এক ভীমতাল লেক ছাড়া আর কোনোটাই দেখার মত নয় বিশেষ করে নৈনিতাল লেকের তুলনায়। বিকেলে ফিরে সন্ধ্যায় নৈনি লেকের চারিদিকে ঘুরে বেড়ানো ও প্যাডেল বোটে ভ্রমণের স্মৃতি আজও মনিকোঠায় উজ্জ্বল। পরেরদিন সকালে পায়ে হেঁটে উঠলাম নৈনাপিক্। উঠার সময় আরো দু'বার আফটার শক।ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড় তবুও চেষ্টা ছাড়িনি। সবশেষে সেই কাঙ্খিত ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে সমগ্ৰ নৈনিতাল শহরকে সীমের আকৃতির লেকের চারিদিকে অসাধারণ দৃশ্যপট সৃষ্টি করে। নতুন কেনা Olympus ও বন্ধুর Pentax SLR ক্যামেরা দিয়ে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। মনের সুখে বলতে পারছিনা কারন ৩৫ মিমি কোডাক, ফুজি বা কোনিকা প্রায় ১০০ টাকা আর মাত্র ৩৬ এক্সপোজার অথচ হোটেল ভাড়া ২০০ টাকা তাই ১০০ টাকার অনেক দাম আমাদের কাছে সেইসময়। উপরে তখন কিছু ই ছিল না কিন্তু উপরে উঠতে উঠতে কিছু যায়গা থেকে বরফাবৃত পর্বতমালার দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পরেরদিন আলমোড়া হয়ে চলে এলাম রানীক্ষেত। সাইট সিয়িং এ গল্ফ মাঠ , ঝুলাদেবি মন্দির ,আপেল বাগান ও আরো কিছু জায়গা দেখে সেদিনের মত হোটেলে রাত্রি যাপন। পরেরদিন ভোরে কৌশানির উদ্দেশ্যে যাত্রা। কৌশানি পৌঁছে সোজা গান্ধী আশ্রম। কিন্তু গিয়ে হতাশ হতে হলো , কারন আমরা অবিবাহিত আর সংখ্যায় এতজন। বহু পীড়াপীড়ি করে অবশেষে একটা বড় ঘরে একরাতের জন্য থাকতে দিতে রাজি হয়েছিলেন আশ্রমের প্রধান পুরোহিত। যাইহোক কোনোক্রমে মাথাগোঁজার ঠাঁই পেয়ে আমারা যারপরনাই খুশি। বাক্স প্যাটরা নামিয়ে ছুটে চলে গেলাম গান্ধী আশ্রমের বিশাল চত্বরে যেখান থেকে ৩০০ কিঃমিঃ হিমালয়ের রেঞ্জ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় প্রজ্জ্বলিত সমগ্ৰ পর্বতমালা। সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আজও মনিকোঠায় উজ্জ্বল। যাইহোক এরমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল যেটা এখানে না উল্লেখ করে পারছি না। ভাগ্যক্রমেই বলুন বা দূর্ভাগ্যক্রমে আশ্রমের প্রধান রাঁধুনি শারীরিক কারণে হঠাৎ অনুপস্থিত, অথচ সমগ্ৰ আশ্রমে ১৫০জনের বেশী ট্যুরিস্ট রয়েছেন, আশ্রম কতৃপক্ষের মাথায় হাত । তখন আমরা প্রধান পুরোহিত মহাশয়কে আশ্বস্ত করে সমগ্ৰ আশ্রমের রান্না ও খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলাম সেই দিনের জন্য এবং তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালনো করলাম। পুরোহিত মহাশয় আমাদের কাজে এতই খুশি হলেন যে তারপর আরো দুই দিন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আশ্রমের সবথেকে ভালো ঘরে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা ভীষণ খুশি হয়ে আরো দুই দিন গোয়ালদাম ,বৈজনাথ ঘুরে বেড়ালাম। এবার ধীরে ধীরে পকেটে টান ধরায় ফেরার কথা চিন্তা করতে হলো।তখন আমরা ফেরার টিকিট না করেই বেরোতাম আর ফেরার টিকিট সহজে করাও যেত না এখনকার মতো। চিন্তা করুন সেই সময়ের বাবা মায়েদের কথা যারা তাদের সন্তানদের ছেড়ে দিত ফেরার দিন তারিখ না জেনেই, আর আমরা আজকে আমাদের সন্তানদের হাওড়া থেকে বর্ধমান যেতেই দশবার ফোন করি। যাইহোক ফেরার সময় কৌশানি থেকে আলমোড়া মারুতি ভ্যানে এসে সেখান থেকে বাসে কাঠগোদাম আর তারপর মিটার গেজ ট্রেনে লখনৌ। একদিন লখনৌ ভ্রমন করে পরেরদিন মোগলসরাই এবং সেখান থেকে ডিলাক্স ধরে বাড়ীতে ফেরা। আমাদের ১৩ দিনের ভ্রমন শেষ হলো মাথাপিছু ১৩০০ খরচে।সমগ্ৰ ভ্রমণের বেশিরভাগ ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে, তারই মধ্যে কিছু ছবি দিলাম। Post By-Avijit Chowdhuri
0 Comments
Leave a Reply. |
Best Washing MachineCategories
All
Archives
November 2021
Best Autoclean Chimney |